মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৭

কালো মেয়ে

ছোট থেকেই আমি আলাদা, আলাদা বলছি এই কারণে আমি অন্য আট দশটি মেয়ের মতো নয়...পরিবার,সমা
জ সব খানেই আমি অবহেলার সিকার কেননা আমি কালো...আমি কালো এটাই আমার সবচেয়ে বড় দোষ...আমাকে যখন স্কুলে ভর্তি করানো হয় তখনি আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমি অন্য সবার মতো নয়...সবার যেখানে অনেক অনেক বন্ধু বান্ধবি থাকতো আমার সেখানে তেমন থাকতোনা বা নাই বললেই চলতো...থাকবে কি করে আমি যে কালো কালো মেয়ের কি বন্ধু, বান্ধবি থাকতে পারে...কালো মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভুল করেছি...
.
আমি বরাবরি ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম...ক্লাসে আমার বান্ধবিগুলো অনেক বিষয় না বুঝলে আমার কাছে আসতো...আমিও সময় নিয়ে সব বুঝিয়ে দিতাম...কিন্তু যখন ক্লাস শেষ হয়ে যেত তখন আমার বান্ধবিগুলো আমায় আর চিনতো না...রাস্ত দিয়ে হেটে গেলেও মুখ ফিরিয়ে নিত... আমি বুঝতে পারতাম তারা তাদের স্বার্থের জন্য আমার কাছে আসতো এবং তা পূরণ হয়ে চলে যেত...আমি মেনেই নিয়েছিলাম এগুলোই কেননা আমি কালো, তাই মেনে নেওয়া ছাড়া আমার পক্ষে কিছুই করার ছিলনা...এরপর থেকে আমি নিজের মতো থাকার চেষ্টা করতাম, কারো সাথে কথা বলবোনা বলেও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি...কি দরকার নিজেকে ছোট করা...
.
একটা মেয়ের সবচেয়ে সুরক্ষার স্হান তার পরিবার...সেই পরিবার থেকেও যদি অবহেলা করে তাহলে আর কি করার থাকতে পারে কেউ জানলে বলবেন...আমি কি আল্লাহ কে বলেছিলাম আমাকে কালো বানাতে...কি দোষ করেছিলাম কে জানে যে আল্লাহ আমায় এতো বড় শাস্থি দিলেন...তবে আমার ছোট ভাই এদিক থেকে আলাদা...ও কখনো আমায় অবহেলার চোঁখে দেখেনি আর কখনো দেখবেও না...আমার কষ্ট গুলো ও বুঝতো এবং আমার সঙ্গ দিতো সব সময়...
.
এক সময় কলেজে ভর্তি হলাম...সকালে কলেজে আসতাম, ক্লাস করে সোজা বাসায় চলে যেতাম...ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে যাওয়া, আড্ডা দেওয়া এগুলো করতাম না...একা হলেও নিজেকে নিজের মতো করে মানিয়ে নিয়েছিলাম...তাই বোধ হয় আর একা বোধ করতাম না নিজেকে...
.
কলেজে ভর্তি হওয়ার তিন মাসের মাথায় আমাকে একটা ছেলে প্রপোজ করে বসে...আমিও মুখের উপর না বলে চলে আসি...কোন উদ্দেশ্য প্রপোজ করেছে তা না বললেও চলে...আমি ভালো করেই জানি আমি প্রোপোজ পাওয়ার মতো কোন মেয়ে নয়...তবে ছেলেটাকে কিছুদিন আমার পাশে ঘুরাঘুরা করতে দেখেছিলাম তাই বলে প্রপোজ করে বসবে তা অবশ্য ভাবিনি...যাই হোক আমি কেন এগুলো ভাবছি, ঐ ছেলের কথা ভেবে আমার কাজ কি...
.
পরের দিন কলেজে যাওয়ার পর গেইটের সামনে আবার সেই ছেলের আগামন...আমার সামনে হাত মিনতি করতে লাগলো...সবার সামনে এগুলো করার মানে কি, প্রচন্ড রাগ উঠে গেল আমার, কালো হতে পারি তাই বলে ও আমাকে অপমান করার অধিকার পেল কোথায়,এক সময় ছেলেটাকে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করে ক্লাসে চলে গেলাম...
.
আজ প্রায় দু মাসের মতো হতে চললো ছেলেটা আমার পিঁছু নিয়েছে...পিঁছু নিয়েছে ঠিকি তবে একটা দূরত্ব বজায় রেখেছে কারণ প্রথম যেদিন আমায় প্রপোজ করে ছেলেটা তারপরেও কয়েক বার আমার কাছে আসার চেষ্টা করেছে তবে তেমন কোনো আশা নুরূপ ফল পায়নি সে বা আমি সুযোগ দিইনি...ও ছেলেটার নাম হচ্ছে আরিন...এভাবে চলতে চলতেই হঠাৎ একদিন আমার কাছে একটা চিঠি অসে আরিনের...প্রথমে কি করবো বুঝতে পারছিলাম না, পরে খাম থেকে চিঠিটা বের করে পড়তে আরম্ভ করলাম....
.
প্রিয় নিধি,
আষা করি ভালো আছো, আমি সবসময় দোয়া করি যেন তুমি ভালো থাকো...আমার তোমাকে ভালো লাগে আগেই বলেছি...তবে তুমি মেনে নাওনি, কেন মেনে নাওনি সেটাও এখন কিছুটা বুঝতে পারি...আমি তোমার সম্পর্কে অনেক জানার চেষ্টা করেছি তবে তেমন কিছু জানতে পারিনি বললেই চলে...তবে এটা জেনেছি তুমি কারো সাথে খুব একটা কথা বলনা...বিস্বাস করো আমি তোমায় মন থেকে চাই...
আমি তোমায় প্রথম যেদিন দেখি সেদিনি ভালো লাগে তবে বিস্বাস কর তুমি কালো বলে নয় আমার কাছে তোমাকে চরিত্রবান মনে হয়েছে...আমি জানি তুমি অন্য সব মেয়ের মতো নয়...অমি তোমার পিঁছু নিই এটা তোমার পছন্দ না...বিস্বাস কর আমি তোমার হাতটা ধরার সুযোগ চাই যদি তুমি সুযোগ দাও...আমি চাই কাল তুমি আমার সাথে দেখা কর...অবশ্যই আসবে প্লীজ, ৪টা বাজে কলেজের পাশের জায়গাটায় অপেক্ষা করবো তোমার জন্য...আবারো বলছি প্লীজ এসো...
.
অপেক্ষায় রইলাম....
.
আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না...আচ্ছা আমার কি করা উচিত, আমি সত্যিই জানিনা...
.
পরের দিন বিকেলে, আমি এখন আরিনের সামনে দাঁড়িয়ে...ছেলেট
া পাঁচ মিনিট ধরে অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে...ছেলেটার চোঁখ কেমন লাল হয়ে রয়েছে, দেখেই বুঝা যায় রাতে ঘুম ভাল হয়নি...আমার নিজের কাছে আরিনের এভাবে তাকিয়ে থাকায় কেমন লজ্জা লাগছিলো তাই মাথা নিঁচু করে ছিলাম...
-আমি জানতাম তুমি আসবে...
-আপনি পাগলামি কেন করছেন...আমি সত্যিই আপনেকে মেনে নিতে পারবোনা...
-কি করলে তুমি বিস্বাস করবে আমি তোমায় সত্যি মন থেকে ভালোবাসি...
.
কিছুক্ষণ নিরবতা...
.
-এটা কি জানো?
.
আমি আরিনের হাঁতে ব্লেড দেখে ভড়কে গেলাম...ছেলেটা কি করতে যাচ্ছে ভাবতেই ভয়ে গা টা গুলিয়ে যাচ্ছিলো...
.
-থামুন প্লীজ এমন করবেন না...
.
আমি আরিনের হাত থেকে ব্লেডটি নিয়ে ফেলে দিলাম...আমি ভাবতেই অবাক হচ্ছিলাম এই কারণে যে একটা ছেলে আমাকে পাওয়ার জন্য কি না করছে...আমি আরিনকে মনে নিতে বাধ্য হলাম...
...
আরিনের সাথে আমার সম্পর্কটা ভালো চলছিল...তবে এটা কলেজের অনেকেই সহ্য করতে পারতোনা...ও একটা কথা বলা হয়নি, আরিন মাসআল্লাহ অনেক সুন্দর সুদর্শন একটা ছেলে...যে কেউ তাকে পছন্দ করতে বাধ্য...আমি মাঝে মাঝেই শুনতাম আরিনের ফ্রেন্ডরা তাকে বলতো তোর মতো সুদর্শন একটা ছেলের সাথে কিনা সম্পর্ক একটা কালো মেয়ের...তার বন্ধুরা প্রায় এ নিয়ে তাকে বুঝাতো...কিন্তু আরিন কখনো এইসব বিষয় আমার সামনে ভুলেও উচ্চারণ করেনি...আমি সত্যি অবাক না হয়ে পারতাম না...তবে আমি চুপ করে থাকার মতো মেয়ে না, আমিও একদিন বলেই ফেললাম আমার মতো অসুন্দর কালো মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখোর কি দরকার তোমার...আমি জানি তোমাকে তোমার বন্ধুদের থেকে আমার কারণে অনেক কথা শুনতে হয়...কি দরকার কথা শুনার বল?আরিন আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমায় বুঝাতো, আমাদের সম্পর্কটা অনেকেই হিংসার চোঁখে দেখবে তাই বলে আমি তোমার ছেড়ে যাবো...আমি তোমায় ভালোবাসি, তুমি আমায়...অদের বলতে দাও, সময় হলে তুমি বলবে...
আমায় আরিন বলতো ওসব কথায় কান না দিতে...আমারা সামিজিক জীব, জন্ম যখন নিয়েছি তখনতো কাছু কথা শুনার জন্য প্রস্তুত থাকতেই হবে...আরিনের এই সব কথা শুননে চোঁখ দিয়ে দুফোঁটা সুখের অশ্রু গড়িয়ে পড়তো...নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হতো তখন...
.
আজ আমি অনেক সুখি, আমি আমার স্বপ্নের দিকে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছি...আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছি...মেডিকেলে যাতে চান্স পাই তার জন্য আরিন আমার পাশে থেকে সব সময় সাহায্য করেছে...আরিন আমায় সব সময় বুঝাতো এই বল যে আমাকে আরো অনেক বড় হতে হবে...যারা আমাকে নিয়ে কথা শুনাতো তাদের যোগ্য জবার দিতে হবে...
.
আরিন একদিন আমায় বলে বসলো আমার পরিবারে বিয়ের পস্তাব পাঠাবে...কথাটা শুনার পর অনেক লজ্জা পেয়েছিলাম...এর কিছুদিন পর সত্যি সত্যি আরিন তার বাবা মাকে নিয়ে আমাদের বাসায় উপস্হিত হলো...আমি যত না খুশি ছিলাম তার চেয়েও বেশি আমার বাবা মাকে মনে হলো...আসলো আমার বাবা, মা আমার বিয়ে নিয়ে অনেক টেনশনে ছিলেন...আর আমার কপালে আরিনের মতো একটা ছেলে জুটবে তা হয়তো ভাবেননি...আমি জানি আমার মা আমায় অনেক বকলেও সব সময় আমার ভলো চান...সেদিন রাতে যখন ঘুমাচ্ছিলাম হঠাৎ দেখলাম মা কে আমার পাশে বসে কান্না করতে...আমিও ঘুমের ভান করে ছিলাম যাতে মা না বুঝেন...
....
....
আজ আমাদের বিয়ের প্রায় তিন বছর হতে চললো, এখন অবধি কোন একটা দিন সুখ ছাড়া কিছুই চোঁখে দেখিনি...আমি যা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি তাই হতে লাগলো আমার সাথে...ও আমাদের একটা ফুটফুটে মেয়েও রয়েছে...নামটা অবশ্য আরিনের দেওয়া "হৃহা"...নামটা অনেক সুন্দর তাইনা...অনেক সুখেই আছি আমরা...আজ আমরা ঘুরতে বের হবো আমাদের মেয়েকে নিয়ে...হৃহা এখনো কথা বলতে পারেনা তবে অনেক কথাই বুঝতে পারে...তার মুখ দিয়ে একটা কথাই বেরহয় বাব্বা...আরিনকে অনেক ভালোবাসে মেয়েটা, তার ববা যে আসলেই ভালোবাসা পাওয়ার মতো মানুষ...
.
এখন আমি কালো বলে কেউ আমায় তা নিয়ে কিছু বলেনা, সম্মান দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে...আমার বান্ধবি যেগুলো আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলতো তাদের সাথে এখন আমার দেখা হলে তারা মাথা নিঁচু করে কথা বলে...আমি তখন চুপি চুপি হাসি...যে হাসির মাঝে লুকিয়ে রয়েছে কিছু কষ্ট, বুক চাপা অভিমান,হয়তো আর অনেক কিছু...আজ আমি আলাদা তবে কালো বলে নয় একজন মানুষ হিসেবে............

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন