সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৭

এক ফোটা অশ্রূ

দিন দিন মনটা কেমন জানি বেদঘুটে হয়ে যাচ্ছে।
ভাল লাগেনা কিছুই,এমন একটা ভাব।মার্চ এপ্রিল মাসটা বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় বেস অপছন্দ আমার।
চারদিকে কেমন জানি খা খা আর শূন্য শুন্য একটা ভাব।বাইরে বের হতে একদম ইচ্ছা করেনা।
ধুলা বালির বিশাল সম্রাজ্য।
আমি এখন যে রুমটায়,সেটার চারদিকে ধুয়ায় আছন্ন।
দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিয়েছি।আমার হাতে এখোনো সুমাইয়ার দেয়া শেষ আর একমাত্র উপহার হাত ঘড়িটা পরিহিত।
ঘড়িটা নষ্ট, নষ্ট হয়ে গেছে মাস খানিক আগে।
আমার ডান হাতের আংগুলের দু ফাকে এখোনো একটা দামি ব্রান্ডের সিগারেট জ্বলন্ত।
ইদানিং সিগারেটটা একটু বেশিই পান করা হচ্ছে।
এতটা সিগারেটের প্রতি আসক্ত ছিলাম না কখোনো।
মাঝে মধ্যে খেতাম।
সেদিন পলিটেকনিক এর এক কোনায় নীরবে বসে,গভীর চিন্তা করছিলাম।আর একটা কবিতা লেখার বৃথা চেষ্টা করছিলাম।মানুষ সত্যিই বলে,প্রেম না করে কেউ কখোনো কবি হতে পারেনা।
আধা ঘন্টা যাবৎ চেষ্টা করছি,কিন্তু এক লাইন ও লিখতে পারিনি।
চুলে হাত দিয়ে যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন আমি,তখোনেই পিছন দিক থেকে কেউ একজন
বলে উঠলো"২৩০৪ নাম্বার রুমটা কোন ভবনে বলতে পারবেন"
আমি মাথা তুলে তার দিকে তাকালাম।
এতো এক অনিন্দ্য সুন্দরী।চোখের নিচে কাজল,পড়নে গোলাপি ড্রেস আর হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ।হিজাব পরিহিত কোন সুশ্রী রমনী আমার সামনে দাড়িয়ে।বিশ্বাষ করতে কেমন জানি কষ্ট হচ্ছে।
পলিটেকনিকে যারা পড়ে,শুধু তারাই জানে।এখানে মেয়েদের অভাব প্রচন্ড।যদিও প্রতি ডিপার্ট মেন্টে দু চারটা মেয়ে থাকে,তবে তারা সুশ্রী বা অনিন্দ্য কোন কাতারেই পড়েনা।
আমি চিন্তার জগৎ টাকে বিশাল বড় করলাম।
কোন কালেও যে আমি কোন কবিতা লিখিনাই,বা বলতে পারিনাই সেই আমার মুখ দিয়ে তখন কবিতার ফুল ঝুড়ি ঝড়তে লাগল"কে তুমি,হে অপরুপা।
মরুর বুকে এনে দিয়েছো এক ফোটা শিশির,
যার পদ ধুলিতে ধন্য হলো মোদের ক্যাম্পাস।
মেয়েটি তখন মুখ দিয়ে কিছু কু বাক্য ছুড়ে দিল।ভাবিনাই কখোনো এতো সুশ্রী রমনী,বিশ্রী কিছু বলবে।
তাহলে কি,কবিতাটি ভালো লাগেনি তার।
আমি ঝট করে বসে কবিতাটি খাতায় লিপি বদ্ধ করলাম।যদি পরে লাইন গুলো হাড়িয়ে ফেলি।
রাতে আর ঘুামাতে পারিনা আমি,
চোখে কাজল ঠোটে হাসি,কোন সুশ্রী রমনী আমার রাতের ঘুম হারাম করবে।ভাবিনি কখোনো।বেডে শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করছি,
"কিরে কোল বালিশটার উপড় আর কত অত্যাচার চালাবি তুই।এবার বেচারাকে তো রেহাই দে"।
পাশ থেকে রুম মেট আবির কথাটি বলল।
"কালকের জন্য টেনশন হচ্ছে,কি করবো বলতো"।
সময়টা মার্চ মাস।
২৬ শে মার্চ আমাদের পলিতে প্রতিবছর প্রতি যোগিতা হয়।
এবার বুকে সাহষ জমিয়ে কবিতা প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছি।
রাত পোহালেই প্রতি যোগিতা।
"কালকে গিয়ে নামটা ক্যান্সেল করে দিস,তুই যে কবিতা বলতে পারবিনা সে গ্যারান্টি আছে।
রুম মেট কিছুটা তামাশা করে কথাটি বলল।
ওর উত্তর আমি কাল দেবো।
মন্চে তখন সবাই উপস্হিত।
আমার সামনে বিচারক মন্ডলি আর তার পিছনে ইনষ্টিটিউটের সকল ছাত্র ছাত্রী।
আমার বুকে কে যেনো হাতুরি দিয়ে গন হারে পেটাচ্ছে,পা দুটো যেন থর থরে কাপছে।
আমার দারা হবেনা,বা আমি অসুস্হ কিছু একটা বলে কেটে পড়বো।তখোনেই মন্চের বাম দিকের এক কোনায় কাকে যেন দেখে, বুকের মাঝে কিছুটা সাহষ সন্চিত হলো।আরে এতো কালকের সেই সুশ্রী রমনী।
আমি ডাইরির পাতা খুলে আবৃতি করছি আর তার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছি।
সে খুব মনোযোগ সহকারে আবৃত্তি শুনছে।
"চিন্তার সাগরে বিভোর আমি,
হটাতেই তোমার আগমন।
এ যেন ভুমিকম্প,বা কোন জলোচ্ছাস।
এতো রুপবতি কেউ হয়,জানতাম না এমন।
হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ,পড়নে গোলাপি ড্রেস।
উফ তাতেই তোমাকে লাগছে বেশ।
প্রথম দেখাতেই হয়েছি একশেষ।
কবিতাটি যে জঘন্ন হয়েছি বুঝতে পেরেছি সবার হাসা হাসিতে।
তবে তার মুখে হাসি ছিলনা,সে কি জানি ভাবছিল।
আমি মন্চ থেকে নেমে মাঠের এক কোনায় গিয়ে বসলাম।
মনটা কেমন জানি খুব খারাপ এতো গুলো মানুষের সামনে কখোনো অপমান হইনি আমি।
রুমমেট আবির এসে পাসে বসল।
"কলেজের সবচেয়ে দুষ্ট আর ফাজিল ছেলেটার মন খারাপ ভাবতেই কেমন জানি লাগছে"।
আমি মাথা তুলে তার দিকে তাকালাম।
"খারাপ লাগতোনা জানিস,কিন্তু মেয়েটা না জানি কি মনে করলো"
--কে,কোন মেয়েটারে?
---আজ না পরে বলবো সব।
পরের দিন ক্যাম্পাসে গিয়ে একটা জাম গাছের নিচে বসে আছি।ক্লাস ভাল লাগছেনা।ধুর এসব এপ্লাইড ম্যাথ করতে ভাল লাগেনা সোজা ম্যাথ পারিনা,আর সেখানে এপ্লাইড।
সব স্যারদের সাথে মজা করতে পারলেও এই আজাদ স্যারের সাথে মজা করতে পারিনা।কেমন জানি গম্ভীর,আর রুক্ষ মেজাজের।
তার সাথে জাদরেল গোফ।ধুর বেটা হওয়ার পর থেকেই হয়তো এমন। কখোনো হাসতে দেখিনি।
সেদিন একটা ম্যাথ করে সবাইকে বলল"বুঝেছো তো সবাই"
আমিও সবার সাথে মাথা নাড়িয়ে বললাম হে বুঝছি।কিন্তু আসলে আমি কিছুই বুঝিনাই।
স্যার মাঝখানের একটা লাইন দেখিয়ে,আমার দিকে আংগুল তুলে বললেন"এই তুমি বলোতো এই লাইনটা কিভাবে আসলো"
আমি কাচুমাচু করে দাড়িয়ে বললাম"যে ভাবে আসে সে ভাবেই তো আসলো স্যার।
ক্লাসের সবার মুখে তখন একগাল হাসি।স্যার একধমকে সবাইকে চুপ করলেন।আর আমাকে যে কি অপমানটাই না করলেন,
সেই দিন থেকে স্যারের ক্লাসে কম উপস্হিত থাকি।
আজকেও এই সময়টায় ছিল।
তাই আগে ভাগেই কেটে পড়েছি।
ব্যাগ থেকে হেডফোন বের করে একটা গান প্লে করে চোখ বুঝে গানটায় হাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি।এমন সময় কারো হাতে টোকায় ধ্যানটা ভেংগে গেল।চোখ খুলেই আমার অবাক হওয়ার পালা।এতো কাপুনি ছাড়াই জ্বর।
আমার সামনে সেই অনিন্দ্য সুন্দরি,আজকে সাদা ড্রেসে যেন সাদা পরির মতো লাগছে তাকে।আমি মুখ হা করে তার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছি।
"মুখটা বন্ধ করেন,মাছি ঢুকে যাবে তো।
এই এতটুকুন কথায় কি যে লজ্জা পেয়েছি।বলে কয়ে বোঝানো যাবেনা।
মেয়েটা হাত বাড়িয়ে দেয়"হাই আমি সুমাইয়া,প্রথম পর্ব ইলেকট্রিক্যাল।
এতটা ফার্ষ্ট হবে বুঝতে পারিনি যেন জ্বর ছাড়াই কাপুনি।
আমি তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলি"আমি তুহিন,৫ম পর্ব ইলেকট্রিক্যাল"
---আমরা তাহলে একই ডিপার্ট মেন্টে,যাক ভালই হলো।অসময়ে অনেক হেল্প পাওয়া যাবে।
---তাতো বটে,তাতো বটে।
বুকটা ফুলিয়ে শার্টের হাতা মুড়িয়ে একটু দাদা দাদা ভাব নিয়ে আবার বললাম"এই যে ক্যাম্পাসটা দেখছোনা,মনে করো এটা আমার,তাতে তুমি ইচ্ছে মত চলতে পারো।কেউ যদি কিছু বলে তাহলে আমার নাম বলবা,বুঝছো চা নাস্তাও পেতে পারো।
সুমাইয়া মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল"সে তো আপনাকে দেখেই বোঝা যায়,আর আপনার কবি প্রতিভার কিন্তু তারিফ করতে হয়।খুব সুন্দর তো আবৃত্তি করতে পারেন আপনি।দোয়া করি ভবিষ্যৎে বিশাল বড় কবি হবেন।
আমার বুঝতে বাকি রইলোনা,কথার মোড় কোন দিকে।
আমি খুক খুক করে কাশি দিয়ে বললাম"তা তুমি যথার্থ বলেছো।আসলে আমার মাঝে এরকম আরো অনেক গুন আছে,বিকাশ করার মতো জায়গা পাইনা বুঝছো।
পাশে যে কখোন আজাদ স্যার এসে দাড়িয়েছেন বুঝতেই পারিনি।
"ক্লাস ফাকি দেয়া,এটাও তো তোমার বড় একটা গুনের অংশ তাইনা,ফাজিল ছেলে কোথাকার।
যাক পেষ্টিজ বলতে কিছুই রইলনা আর।
সুমাইয়া স্যারকে সালাম জানিয়ে চলে গেল।
আমিও সুমাইয়ার পথ অবলম্বন করলাম।মানে স্যারকে সালাম দিয়ে দৌড় দিলাম।
এর পর কেটে যায় বেশ কটা দিন।সুমাইয়ার সাথে আর দেখা হয়না।
দিন দশেক পরেই হুট করে সুমাইয়া আমার সামনে হাজির।আমি তখোন ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিলাম।
"আরে তুমি,এতদিন পর বস চা খাই"
সুমাইয়া একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমার সামনে বসে পড়ে।
"তো কোন সমস্যা হইছে কিনা তোমার"
জানতে চাইলাম সুমাইয়ার কাছ থেকে।
সুমাইয়া মুখ দিয়ে কিছুই বললনা শুধু আংগুল তুলে একটা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল"ওই ছেলেটা আজ কয়েক দিন থেকে জালাচ্ছে আমায়"
ছেলেটির নাম রাজু।ওর বাবা এই পলির ভিসি।
খুব ভাল করেই চিনি তাকে।সুন্দরী মেয়েদের দেখলেই ওর জীব থেকে লালা ঝরে।
আমার মাথা গরম হয়ে যায়,নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনা।দৌড়ে গিয়ে ওর শার্টের কলার ধরি।
"তুই কি বলেছিস ওকে,আর কেনইবা ডিস্টার্ব করছিস।
রাজু ও আমার শার্টের কলার চেপে ধরে।
"তোর এতো ফাটছে কেন হে,কি লাগে তোর"
আমার মাথায় তখোন খুন চেপে যায়,আমি ওকে লাথি মারার জন্য পা বাড়াই।এমন সময় আমার ফ্রেন্ডরা ওর কাছ থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নেয়।
ক্যাম্পাসে তখন হুলস্থুল অবস্হা।প্রিন্সিপাল স্যার ও ইতিমধ্যে চলে এসেছেন।দু গ্রুপের মাঝে তখন রক্তের নেশা।
প্রিন্সিপাল স্যার বিচার করলেন,সব শুনে রাজুকে বললেন সুমাইয়ার কাছে ক্ষমা চাইতে।
২।
আমি জানি সুমাইয়ার জীবন এখন বিপর্যয়ের মাঝে।ও যখন সুমাইয়ার কাছে ক্ষমা চাইলো ওর চাহনি দেখেই বুঝেছি,সুমাইয়াকে সে দেখে নিবে।
আমি নিজেকে নিয়ে টেনশন করিনা,ওর সাথে সব সময় ঝগড়া লেগেই থাকে আমার।
আমি তখোন আমার ডিপার্ট মেন্টের ছাত্রলীগের সভাপতি।
আর রাজু ওর ডিপার্ট মেন্টের সভাপতি।
সুমাইয়ার সাথে বেস ভাল সম্পর্কই গড়ে উঠতে লাগলো আমার।রাজুর থেকে নিরাপদ আর সেভ রাখার জন্যই হয়তো ওর কাছে থাকা আমার।সবসময় সুমাইয়ার উপড় নজর রাখার দ্বায়িত্ব ছিলো আমার।
সময়টা তখন বর্ষাকাল,বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছে।
ক্লাস শেষ করে মাত্র বের হয়েছি।ব্যাস্ত রাস্তাটা,আজ ভীষন ফাঁকা।মাঝে মধ্যে দু একটা বাস আর সিএনজি চলাচল করছে।আমি ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে সিএনজির অপেক্ষা করছি।
আমার সামনে রাস্তার ওপাশে দেখলাম রাজু আর তার কিছু চ্যালা দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে।আমি সেদিকে আর না তাকিয়ে সি এনজির অপেক্ষায় না থেকে ছাতাটা বের করে হাটতে লাগলাম।
মিনিট দশেক হাটার পর,লক্ষ্য করলাম সুমাইয়াকে।বৃষ্টিতে একদম কাক ভেজা হয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে আছে।
আমি একটু দ্রুত হেটে ওর কাছে গেলাম।
"আরে এই বৃষ্টিতে এভাবে ভিজছো কেন,তোমার ছাতা কই"
সুমাইয়া কান্না করতে করতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল"ক্যাম্পাস থেকে বের হয়েছি আধা ঘন্টা আগে,রাস্তায় দাড়িয়ে তখোন আমি সিএনজির অপেক্ষা করছিলাম।
এমন সময় রাজু আর ওর দলের কিছু ছেলে আমাকে অনেক নোংরা কথা বলে আর অসভ্য আচরন করে,জন্মের পর থেকে কেউ আমাকে খারাপ গালি দেইনি।আমি আর এখানে থাকবোনা,কালেই ভর্তি ক্যান্সেল করবো,তুমি ভাল থেকো।
সুমাইয়া চোখ মুছতে মুছতে আমার সামনে থেকে চলে যায়।ওর কথাগুলো তখন আমার হৃদয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে,ক্ষতের জ্বালাটা বাড়তে থাকে।ছোট কাল থেকেই বাবা বলে আসছেন আমার মাথা নাকি অল্পতেই গরম হয়ে যায়।
আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি,দৌড়ে যাই রাজুর কাছে।ওর সাথে আমিনুর ছিলো,আমি আমার হাতে থাকা কাঠের ফালিটা দিয়ে রাজুর কাধে বেস জোড়ে আঘাত করি।
"কি যেন বলেছিলি সুমাইয়াকে,ও বেশ্যা ওর সাথে আমার শারিরিক সম্পর্ক আছে"
কথাটি বলে আরো একটা চোট দেই ওর কাধে,ও তখন ধুম করে মাটিতে পড়ে যায়।ওর সাথে থাকা আমিনুর তখন দৌড়ে পালিয়ে যায় ওখান থেকে।
"নেক্সট টাইম যদি ওর কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করিস,বলে দিলাম পার পাবিনা"
রাজু তখন মাটি থেকে কাপতে কাপতে উঠে দাড়িয়ে আংগুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়,তোর খবর আছে।
আমি তখন চেচিয়ে বলি"যা করার করে নিস,তবে সুমাইয়াকে যদি কিছু উল্টা পাল্টা বলিস মেরে ফেলবো তোকে।
৩।
রাতে সুমাইয়াকে ফোন দেই,সুমাইয়া হামি তুলতে তুলতে বলল"কিছু বলবা তুমি"
আমি আস্তে করে বলি"না থাক, কাল বলবো নাহয় তুমি বরং ঘুমাও"।
সুমাইয়া ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দেয়।
সুমাইয়াকে কখোনো বলা হয়ে ওঠেনি,খুব ভালবাসি,পাগলের মতো ভালো বাসি তোমাকে সুমাইয়া।প্রতিদিন যে ছেলেটা তোমাকে নীল চিরকুট দিতো সে ছেলেটা আর কেউ নয় সেটা আমি।
চিরকুট পেয়ে সুমাইয়া প্রতিদিন আমার কাছে এসে বিচার দিতো"তুমি তো এই কলেজের ডন,তা এই ছেলেটাকে ধরে এনে দিতে পারছোনা কেন"
আমি তখন মনে মনে বলি নিজেই নিজে ধরবো কিভাবে সুমাইয়া,কখোনো কি বুঝতে পারোনা,কিংবা হাতের লেখা মিলিয়ে দেখতে পারোনা সেই ছেলেটাই যে আমি।জানতাম মেয়েরা নাকি অনেক কিছুই বুঝতে পারে,তুমি কি কিছুই বুঝতে পারোনা।
আমি তখন একগাল হাসি হেসে সুমাইয়াকে বলি"বাদ দাও তো কেনা কে,এসব নিয়ে চিন্তা করো কেন।
সুমাইয়া তখন চিন্তিত মুখে বলতে থাকে,বাদ দেয়ার মতো না, ছেলেটা এই পলিতেই পড়ে আমাকে ফলো করে।
"তাই,তুমি বুঝলে কি করে"
সুমাইয়া তখন দাত দিয়ে নখ খোটাতে খোটাতে বলে"কলেজে কি ড্রেস পড়ে আসি সেটা পর্যন্ত লেখা থাকে।
আমি তখন আবার এক গাল হেসে বলব"তোমাকে যে গোলাপি ড্রেসে অপরুপ লাগে সেটা লেখা থাকেনা।
সুমাইয়া তখন ফক করে হেসে দেয়,ধুর বাদ দাও তো,কেনা কে।
সকালের দিকে সুমাইয়া আমাকে ফোন দেয়,তখন আমি ঘুমের রাজ্যের বাসিন্দা।
ঘুমকে বিদায় জানিয়ে সুমাইয়ার ফোন রিসিভ করি।
ও খুব গম্ভীর কন্ঠে আমাকে প্রশ্ন করে"একটু তাড়াতাড়ি ক্যাম্পাসে আসতে পারবা।
আমি ঠিক আছে বলে রেখে দিলাম।
তাড়া তাড়ি রেডি হয়ে ক্যাম্পাসে চলে যাই,সুমাইয়া তখন শাহিন চত্বরের বিশাল বড় বটগাছ টার নিচে আমনা হয়ে বসে আছে।
আমি কাছে যেতেই বলল"আব্বু দুপুরের দিকে এসে আমাকে নিয়ে যাবে,আর কখোনো তোমার সাথে হয়তো আমার দেখা হবেনা"।
আমি জানতাম সুমাইয়া এখানে আর পড়বেনা,তাই আশ্চর্য হইনা।
আমি তখন ধির কন্ঠে সুমাইয়াকে বলি"এখানে ভাল লাগছেনা,চল ক্যান্টিনে বসি"।
সমুাইয়া চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল"তোমার মতো বন্ধুকে হয়তো জীবনে পাবোনা তুহিন,মিস করবো তোমাকে খুব।
আমি তখন বিষন্ন মনে সুমাইয়াকে প্রশ্ন করি"তুমি কিন্তু অন্য পলিটেকনিকে বদলি হতে পারো,এভাবে ভর্তি ক্যান্সেল করাটা কিন্তু বোকামি।
সুমাইয়া তখন চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল"আমার বাসা থেকে বেশিদুরে গিয়ে পড়তে ইচ্ছে করেনা,আর আব্বু ও রাজি নন অনেক আদরের মেয়ে তো।
আমার তখন প্রচন্ড পরিমানে ঘুম পাচ্ছে,আমি হামি দিতে দিতে বললাম"তোমার চিঠির মালিকের কি হবে তাহলে"
সুমাইয়া হাসতে হাসতে বলল"বেচারা হয়তো খুব কষ্ট পাবে তাইনা,আহারে বেচারার জন্য কষ্ট হচ্ছে।
হটাৎ করে সুমাইয়ার ফোনে একটা ফোন আসল,সুমাইয়া আমাকে পাচ মিনিট বলে চলে গেল।
পাচ মিনিটেই ভাবতে লাগলাম,সুমাইয়াকে কি বলে দেবো,চিঠির মালিক আমি।বলটা কি ঠিক হবে,যদি আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়।থাক কিছু কথা না বলাই ভাল,
সুমাইয়া হুট করে এসে আমাকে বলল"ভাল থেকো,পারলে রাজনীতিটা ছেড়ে দিও।
আমি তখন কল্পনা করতে পারিনাই,সুমাইয়া এতো তাড়া তাড়ি চলে যাবে।আমি হুট করেই সুমাইয়াকে বলি"তোমার চিঠির মালিককে খুজে পেয়েছি,কি শাস্তি দিবে বলো।
সুমাইয়া তখন ওর হাতে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগের চেইন খুলতে খুলতে বলল"ভাল কথা মনে করে দিয়েছো।
ও ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করে দিয়ে বলল"এই চিঠিটা তাকে দিও,খবর দার তুমি পড়বেনা কিন্তু।
আর হে তোমাকে একটা জীনিষ দেয়ার ছিলো,ও ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা হাত ঘড়ি বের করে আমাকে দিয়ে বলে"এটা তোমার জন্য,অসময়ে আমাকে মনে পড়ার জন্য এটাই যথেষ্ট।
আমি ওর হাত থেকে চিঠিটা আর হাত ঘড়িটা নেই।
ঘড়িটা লংগিনেস এর,খুব সুন্দর হাতে মানিয়েছে আমার।আমি ধন্যবাদ জানিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলি,"তোমাকে তো কিছুই পারলাম না দিতে এ জন্য লজ্জিত আমি। সর্বদা নিজের খেয়াল রাখবে,আর আমাকে বেশি বেশি করে মনে রাখবে কেমন।
সুমাইয়া হাসতে হাসতে বলল"পাগল আমার জন্য কবিতা লিখেছেলি,এটা কম কিসের।ভাবতে ভাল লাগে কেউ আমার জন্য কবিতা লিখেছিলো।
নিজের খেয়াল রেখো,আসি,,,,,,
একপা দুপা করে সুমাইয়া আমার থেকে,আমার সাজানো পৃথিবীটাকে অন্ধকারে বিলীন করে দিয়ে চলে যাচ্ছে।
আমি ধুপ করে মাটিতে বসে পড়ি,আমার চোখে তখন রাজ্যের ক্লান্তি।চোখ দিয়ে নীরবে অশ্রূ ঝড়া ছাড়া কিছুই করার ছিলনা তখন,আমার পৃথিবিটা তখন ঘোর অন্ধকার।
মাঠের এক কোনে গিয়ে বসি,যেখনটায় প্রথম সুমাইয়াকে দেখেছিলাম এক অপরুপ সাজে।
ওর দেয়া চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করি"তোমার অবাক হওয়ার পালা তুহিন,জানি প্রতিদিন কে আমাকে চিঠি পাঠাতো।সব জেনেও কিছু বলিনি তোমাকে,কারন আমাদের বন্ধুত্বটা যেন নষ্ট না হয়।আমার জীবনটা আমার মতো করে সাজানো নয় তুহিন।আমি চাইলেই কাউকে পছন্দ করতে পারিনা,চাইলেই তোমাকে ভালবাসতে পারবোনা।আমার ও ইচ্ছে হতো তোমাকে নিয়ে আমার পৃথিবিটা সাজাতে,সাত রং এ রাংগাতে।তোমার হাতে হাত রেখে সূর্যের শেষ আলোটা দেখতে,কিংবা ভোরের কুয়াশা ভেজা ভোরে হাটতে।
ক্লাস টেনে থাকতেই আমার সব ইচ্ছে গুলোকে মাটিতে চেপে দেয়া হয়।আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে আমার চাচাতো ভাইয়ের সাথে,উনি ডাক্তার।কলেজের সব খবর শুনেই উনি আমাকে ভর্তি ক্যান্সেল করতে বাধ্য করেন।আমার খুব ইচ্ছে ছিল তুহিন,আমি পড়াশুনা করবো।
কিভাবে ইলেক্ট্রন আমাদের পৃথিবীটাকে সচল রাখছে তা জানবো,কিন্তু কিছু ইচ্ছা কখোনো পূরন হয়না।আমার বিশ্বাষ ছিলো তোমার উপড়,তুমি থাকতে কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবেনা।তবে সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়লে নিজেকে অপরাধি মনে হয় খুব,আমার জন্য তুমি নিজের জীবন বাজি রেখে রাজুকে মেরেছো।আমি থাকলে না জানি আরো কত বিপদ তোমার জীবনে আসবে।
আমি চাইনা আমার জন্য তোমার জীবনটা বিষাদ গ্রস্হ হয়ে পড়ুক,আমি চাই তুমি সুখি হও।
আমার ইচ্ছে হতো,,,,,,,,,,,
থাকনা বাদ দেই নিজের ইচ্ছের কথা,সেটা আর নেই মরে গেছে বছর খানিক আগে।তুমি খুব বোকা তুহিন,যে ছেলেটা প্রতিদিন আমাকে চিঠি দিতো তার প্রিয় রং ও ছিল গোলাপী।আমাকে নাকি গোলাপি ড্রেসে সুন্দর লাগে।সেই একই কথা সেদিন আমাকে ও বলছিলে তুমি।আমার সন্দেহ ছিল চিঠির ছেলেটা তুমি,তোমার হাতের লেখা মিলিয়ে দেখেছিলাম অনেক আগেই।
বাদ দাও এসব,নিজের খেয়াল রাখবে।আর পারলে এসব রাজনীতি ছেড়ে দিও,তোমার জীবনটা শেষ করে দিবে।রাজুর থেকে সাবধানে থাকবে,,,,,,,,,,,,,,
নিশ্বাষটা কেমন জানি ভারি হয়ে আসছে আমার,আকাসের অবস্হা ভালো নয়।মেঘের গর্জন তীব্রতর হয়ে আসছে,
চারদিকে তখন ঝুম বৃষ্টি,আমি মাঠের সেই জায়গাটাতেই বসে আছি।আমার হাতে থাকা চিঠিটা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেছে।আমি হটাৎ পিছন থেকে রাজুর কন্ঠ শুনতে পাই।
"আজ পালাবি কই শালা কুত্তার,,
আমি রাজুকে হাত জোড় করে বলি"প্লিজ আমাকে আজ যেতে দে,তোর যা হিসেব আছে পরে মিটিয়ে নিস।
এই মুহুর্তে আমার সুমাইয়ার কাছে যাওয়াটা ইম্পর্টেন্ট,ওর হাত ধরে বলতে চাই"চলোনা তোমার পৃথিবিটা সাজিয়ে দেই সূর্যের শেষ আলোটা দিয়ে,কিংবা ভোরের কুয়াশা হয়ে।অনেক দুরে কোথাও হাড়িয়ে যাই যেখানে শুধু তুমি আর আমি সাজাবো কোন নতুন জীবন।আমার হাতে এখোনো সময় আছে।
আমি হুট করে রাজুর পা ধরে বলি"প্লিজ আজ আমাকে যেতে দে রাজু,আমার হাতে সময় কম।
আমার কথা শুনে রাজু হাসতে থাকে,ওর সাথে থাকা চেলা গুলাও হাসতে থাকে।
রাজু হাসতে হাসতে বলে"সত্যি বলেছিস তোর হাতে সময় কম।
আমি উঠে দাড়াতেই পিছন থেকে আমার মাথায় আঘাত করা হয়।এর পর আর কিছুই মনে নেই আমার।
পরে যখন জ্ঞান ফেরে,নিজেক তখন হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করি।তিন দিন পরে আমার জ্ঞান ফেরে,আমার পাশে তখন লেলিন দাড়িয়ে।
আমি ওকে প্রশ্ন করি সুমাইয়া কি চলে গেছে,ও কি আমার অবস্হার কথা জানে,আমাকে দেখতে কি হাসপাতালে এসেছিলো কিনা।
লেলিন শুধু মাথা ঝোকায় বলেনা কিছুই।আমি চিৎকার করে বলি লেলিন কিছু তো বল।
লেলিন আমার হাতে একটা বিয়ের কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলে।
ও আসছিলো কাল,তোর কথা জানতে চেয়েছিলো।আমি বলেছি তুই গ্রামে চলে গেছিস,আর ফোনটা রেখে হারায় ফেলেছিস।ও আর কিছু না বলে কার্ডটা ধরায় দিয় চলে গেছে।
আমি তড়ি ঘড়ি করে কার্ডটা খুলে পড়ি"ওর বিয়ে,পড়শু দিন"
খুব সুন্দর করে কার্ডটা ছাপানো হয়েছে,কার্ডের বাম পাশে সুন্দর করে লেখা কনের নাম-মোছাঃসুমাইয়া পারভীন।
আমি তখন এক সাগড় কষ্ট নিয়ে কল্পনা করি।লাল বেনারসিতে সুমাইয়াকে কেমন লাগবে।আচ্চা বেনারসি কি গোলাপি হয়না,সব বিয়েতে কনে কে কি লাল বেনারসিতে সাজাবে এমন কোন কথা নেই।
সুমাইয়া পড়বে গোলাপি বেনারসি,,,,, স্বামিকে নিয়ে সাজাবে নতুন পৃথিবী।
আমি ওর রেখে যাওয়া শেষ সূর্যের আলো টুকু নিয়েই বেচে থাকবো নাহয় আজীবন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন