নীতু আমার দিকে তাকিয়ে কেমন অস্পষ্ট স্বরে
বলল,,---""ও কি আসবেনা??"
.
আমি একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বেশ আরাম করে
আধশোয়া হয়ে ছিলাম। সোজা হয়ে বসতে
বসতে বললাম,,
--মনে হয়না। ব্যাটা পালিয়েছে বোধহয় "
আমার কথা শুনে নীতুর চোখমুখ আরো ফ্যাকাসে
হয়ে গেল। মেয়েটা এখন ঘামতে শুরু করেছে।
শাড়ীর আচল দিয়ে বারবার কপালটা মুছে যাচ্ছে আর
ঝাপসা চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে। একটা
ছেলের অপেক্ষায়। যার জন্যে ও বাড়ি থেকে
পালিয়ে এসেছিল। ছেলেটা আমার বন্ধু। নাম আকাশ।
ছেলেটার সাথে আমার বন্ধুত্ব বেশিদিনের নয়।
অল্পকয়দিনে ওকে যতটুকু চিনেছি, ওর মত ভাল
ছেলে পৃথিবীতে খুব কম দেখা যায়। সকালবেলা
আকাশ আমাকে ফোন দিয়ে অনেক খুশি খুশি গলায়
বলল, আজ ও বিয়ে করছে। পালিয়ে কাজি অফিসে
বিয়ে। যেন পালিয়ে বিয়ে করা অনেক মজার একটা
ব্যাপার। আমাকে বলল,--"" বুঝলি শরীফ তোকে
যেভাবেই হোক থাকতে হবে। আর আমার
যেতে একটু দেরি হতে পারে। তুই যদি আমার
আগে পৌছাস তাহলে দেখবি নীল শাড়ী পড়া একটা
মেয়ে বসে বসে নখ কামড়াচ্ছে। নিঃসন্দেহে
ওটাই নীতু। আমি ওকে তোর কথা বলে
রেখেছি।""--
.
নীতুকে খুজে পেতে আমার খুব একটা সমস্যা
হলনা। কিন্তু মেয়েটাকে দেখা মাত্রই আমি ধাক্কামত
খেলাম। ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই ও এসে
আমাকে বলল,
-- আপনিই শরীফ তাইনা?"-- আমি বললাম,
--হ্যা।
-- আকাশ কোথায়? ও আসেনি?
-- ওর একটু দেরি হবে বলেছে। চলে আসবে।
নীতু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এরপর আকাশের
ফোনে অনেকবার ট্রাই করলাম। কিন্তু ফোনই
তুলল না। আকাশের মত একটা ছেলে এরকম কান্ড
করবে আমি ভাবতেই পারছিলাম না। আমি নীতুর দিকে
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। ওখানে আসার পর
থেকে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। ও বোধহয়
ব্যাপারটা বোঝতে পারেনি। ওর জন্যে আমার
মনের ভেতর সূক্ষ ব্যাথাও অনুভব করছি। মুখটা কেমন
মলিন হয়ে গিয়েছে।
.
অনেক্ষন বসে থাকার পর নীতু চোখ মুছে উঠে
দাড়ালো। এলোমেলো ভঙ্গীতে হেটে
যাচ্ছে। কেমন দিশাহারা দিশাহারা টাইপ। ব্যাপারটা সুবিধার
মনে হল না আমার। আমি ওর পিছন পিছন গেলাম। দিশাহারা
কন্যা তখন দিশা হারিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
যেকোন সময় অঘটন ঘটে যেতে পারে। অঘটন
ঘটার আগেই আমি খপ করে ওর হাত ধরে ফেললাম।
তারপর একটা কফিশপে নিয়ে গিয়ে বসলাম।
.
নীতুর কান্না থামানোর জন্যে আমি কিছু একটা বলতে
যাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছু বলার আগেই ও কাদতে কাদতে
বলে উঠলো,,,
--এই মুখ নিয়ে আমি কিভাবে বাড়ি যাবো!"
আমি বললাম,,
--তুমি এই মুখ নিয়েই বাড়ি যাবে। তোমার মুখের
তেমন কিছুই হয়নি। আয়নায় দেখে নিতে পারো।
--অসম্ভব।
--কেনো অসম্ভব?
-- বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি আমি। আজকে
আমাকে দেখতে আসার কথা। আমি জানি আমাকে
দেখলেই ওদের পছন্দ হয়ে যাবে। এর আগে
তিনবার দেখা হয়েছে। অনেক কস্টে বিয়েগুলো
আটকিয়ে ছিলাম। আসার আগে বাড়িতে চিঠি লিখে
এসেছি।
-- কি লিখেছ?
--ছোট্ট চিঠি। লিখেছি--"" আমি আমার পছন্দের
ছেলেকে বিয়ে করছি। খুব বেশি মান সম্মান নিয়ে
টানাটানি পড়লে মীতুকে দেখিয়ে দিও। কারন আমার
পক্ষে অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব নয়""--। মীতু
আমার ছোট বোন।
-- কিন্তু পাত্রপক্ষের কাছে তো তোমার ছবি
দেওয়া হয়েছে। উনারাতো তোমাকে দেখতে
আসবেন, তাইনা?
--তাও অবশ্য ঠিক।'"
কি মনে হতেই নীতু অবাক হয়ে আমাকে
জিজ্ঞেস করলো,,
--আপনি এত শিওর হয়ে কিভাবে বললেন যে
পাত্রপক্ষকে আমার ছবি দেওয়া হয়েছে?
আমি পকেট থেকে কুঁচকানো একটা ছবি বের
করে ওর সামনে রেখে বললাম,
--সরি, ভাজ না করলে ওটা পকেটেই ঢুকছিলো না।
.
নীতু এখন দিশাহারা কন্যা থেকে বিস্ময় কন্যাতে
পরিণত হয়েছে। আমি ওর বিস্ময় কাটানোর জন্যে
বললাম,,
--কাল রাতে মা আমাকে ছবিটা নিয়ে এসে
বললেন,--"" এই মেয়েকে আমার অনেক পছন্দ
হয়েছে। তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে
তাহলে কাল একে দেখতে যেতে চাই।""-- আমার
মায়ের ধারনা আমি খুব লাজুক টাইপের ছেলে। তাই উনি
বুদ্ধি করে বললেন,--"" তোমাকে মুখে কিছু
বলতে হবেনা। পছন্দ হলে ছবিটা নিজের কাছে
রেখে দাও। আর না হলে আমাকে দিয়ে দাও।"--আমি
কি করলাম বলতো?
নীতু যন্ত্রের মতো বলল,
-- ছবিটা ভাজ করে নিজের পকেটে রেখে
দিলেন।
--বাহ! তোমার তো বেশ বুদ্ধি!
--রসিকতা করার চেষ্টা?
আমি হাসতে হাসতে বললাম,--"হ্যা"--
.
নীতুর আমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিছুক্ষন
তাকিয়ে থাকার পর টলমল ভঙ্গীতে উঠে
দাড়াল। এই পড়ে যাবে, এই পড়ে যাবে এমন
অবস্থা। আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। ও ছবিটা
হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো দেখে আমি
বললাম,
--ছবি নিয়ে কোথায় যাও?
--কোথায় যাবো জানিনা। কিন্তু এতকিছুর পর তো আর
আমাকে পছন্দ হওয়ার কোন কারন দেখছিনা।
আমি ওর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে পকেটে
ঢুকাতে ঢুকাতে বললাম,--"সবকিছুতেই যে কারন
থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই।"--
নীতু মনে হয় হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু একটা বলতে
চাচ্ছিল। "দয়া দেখাচ্ছেন?" এমন কিছুই হবে। কিন্তু
বলতে পারলোনা। তার আগেই ও মুখ থোবড়ে
আমার কাধের ওপর পড়ে গেল! খুব সম্ভব জ্ঞান
হারিয়ে ফেলল। ঐ মূহুর্তে আমার শুধু একটা কথাই
মনে হল। আকাশটা এত ভাল কেন!!
.
""তারপর""
পিচ্চির কথায় আমার হুশ আসলো। এতক্ষণ
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলাম।আপার এক বন্ধুর
বিয়েতে এসেছি। মারাত্মক বোরিং লাগছিল। বাইরে
বেরিয়ে হাটছিলাম। হঠাৎ একটা পিচ্চি পিছন থেকে
ডেকে বলল,,--"এইযে আংকেল, এই ছবিটা আপনার
পকেট থেকে পড়লো মনে হয়।""-- আমি
তাকিয়ে দেখি, ওমা!! এটাতো আমার বউয়ের ভাজ করা
ছবিটা! কোনফাকে পকেট থেকে পড়ে
গেছে। আমি যেই ওটা হাতে নিতে যাবো ওমনি
পিচ্চি বলে উঠলো,,
--এই বিয়ে বাড়িতে আমার খুব বোরিং লাগছে
বোঝলেন। গল্প করার মত বা খেলার মত কাউকে
পাচ্ছিনা। এখন আপনি আমাকে কোন একটা গল্প
শোনাবেন, যতক্ষণ না বিয়েটা শেষ হয়। তাহলেই
ছবিটা পাবেন। ছবিটা আপনার খুব প্রিয় সেটা আমি
বোঝতে পেরেছি। তাই ছোটখাটো একটা
ব্লাকমেইলের চেষ্টা বলতে পারেন।"
পিচ্চির কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠলো। এই
টাইপের বাচ্চাদের সাথে কথায় পারা যায়না। আমি তাই
চুপচাপ গল্প বলতে শুরু করলাম,
--এক যে ছিল রাজা, তার ছিল তিন রানী।
রাজা একদিন.......
--উফফ! আমি দেখতে পিচ্চি হলাম বলে এইসব হাবিজাবি
শুনবো নাকি? ইন্টারেস্টিং কিছুবলুন।""
আমি পিচ্চি ছেলেটার দিকে এতক্ষনে ভালমত
তাকালাম। কত বয়স হতে পারে? নয় বা দশ? এর জন্যে
কি ইন্টারেস্টিং গল্প বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তখন
সে নিজেই চিন্তা করে বলল,,
--এই ছবির আন্টির পিছনে কোন কাহিনী আছে
তাইনা?"
--হুম
--ওকে তাহলে উনার গল্পই বলুন।
.
""কি হলো? তারপরের কাহিনী কি?"---
পিচ্চিটা আবার প্রশ্ন করলো। কি আজিব! এই ছেলেটা
বেছে বেছে আমাকেই ধরলো কেনো
বোঝলাম না। আমি বললাম,
--তারপর আর কি? বিয়ে হয়ে গেল। কাহিনী
শেষ। এখন ছবি দাও। পিচ্ছিটা পা নাচাতে নাচাতে বলল,
--উহু, কাহিনীতো শেষ হয়নি। পুরোটা বলুন।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু
করলাম।
..
""বিয়ের পর নীতু প্রায়ই স্বপ্নে আকাশকে
দেখত। কখনো কখনো মাঝরাতে ঘুম ভাঙতো ওর
কান্নার শব্দে। আমার হাতটা নিজের গালে রেখে
তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদতো। আমি ধড়ফড় করে
উঠে যখন জিজ্ঞেস করতাম, কি হয়েছে? তখন ও
বলতো,,
--""আমি ওকে কেন স্বপ্নে দেখি বলতো? আমি
তো শুধু তোমাকেই দেখতে চাই। আমি চাই আমার
কল্পনায়, আমার স্বপ্নে শুধু তুমি থাকো। কিন্তু ও
মাঝখান থেকে চলে আসে কেনো??"--- বলেই
আবার কান্না। আমারও মনে মনে রাগ লাগতো। ওই
ব্যাটা আমার বউয়ের স্বপ্নে আসবে কেন?? যাই
হোক, আমি সেটা ওকে বোঝতে দিতাম না।
মেয়েটা ছিল প্রচণ্ড অভিমানী। একটা ব্যাগে
সবসময় ওর কাপড় গোছানো থাকতো।সামান্য
রেগে কিছু বললেই ব্যাগটা নিয়ে
বাপের বাড়ি দৌড়। কিন্ত আমার প্রতি
ভালবাসার কোন কমতি ছিলনা। একদিন কি
একটা ব্যাপারে ওর সাথে রেগে কথা
বলেছিলাম। ব্যাস, হাউমাউ করে কাঁদতে
কাঁদতে উনি রওয়ানা হয়ে গেলেন বাপের
বাড়ি। রাগ করে তিনদিন আমার ফোনটাও
তোলেনি। শেষে চিন্তা করলাম নিজেই গিয়ে
ওকে নিয়ে আসব। যাওয়ার আগে একটা গিফট শপে
ঢুকলাম নীতুর জন্যে কিছু কেনার উদ্দেশ্যে।
ঢুকেই আবার বের হয়ে আসলাম। বাইরে নীতুর
মতো কাউকে দেখলাম মনে হল। হ্যা ওটাই নীতুই
ছিল। একটা ছেলের পাশে
দাঁড়িয়ে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে!! আমি
ছেলেটার অর্ধেক চেহারা দেখতে পাচ্ছিলাম,
দেখে মনে হল ওটা আকাশ। কিন্তু ওকে কেমন
অন্যরকম লাগছিলো দেখতে। আমি
স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজের চোখকে যেন
বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নীতুর চোখে
চোখ পড়তেই আমি সেখান থেকে চলে
আসলাম। রাগে কি যে করব বোঝতে পারছিলাম না।
.
একটু পর নীতু বাসায় চলে এল। ওকে দেখে
আমার রাগ তিনগুন বেড়ে গেল। আমাকে
জড়িয়ে ধরে তোতলাতে তোতলাতে বলল,,,
-- আ আ আকাশ,,,
-- হ্যা তো ওর কাছেই থেকে গেলেই পারতে।
আমার কাছে এসেছ কেন?.
আমার কথা শুনে নীতু চমকে উঠলো আমাকে
ছেড়ে দিয়ে বলল,,
--কি বলছো তুমি এসব?
-- কেন? স্বপ্নে দেখা হয় ওটা বলতে পারলে।
আর বাইরে যে গিয়ে দেখা করো সেটা বলতে
পারলেনা?.. এই মূহুর্তে তুমি আমার ঘর থেকে
বেরিয়ে যাবে। তোমার সাথে আমার আর কোন
সম্পর্ক নেই।""
নীতু আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা
করলো। কিন্তু আমি গাধা কিছু শোনলেতো!
বাধ্য হয়ে সে তার সবকিছু নিয়ে বেরিয়ে
গেল। মেয়েটাও কম জেদি ছিল না। নিজের
একটা কিছুও রেখে যায়নি। ওর ভাজ করা
ছবিটা সবসময় আমার পকেটে থাকতো বলেই ওটা
আমার কাছে থেকে গেছে।যাওয়ার আগে
কোনফাকে একটা চিঠিও লিখে ফেলেছিল। খুব
বেশি গল্প-উপন্যাস পড়তো কি-না, ওখান থেকেই
এসব চিঠি লেখালেখি শিখেছে। চিঠিটা আমি পাই রাতে,
বালিশের নিচে।
.
"শরীফ"
জানি চিঠিটা পড়ার পর তোমার মাথার সবকটা চুল ছিড়ে
ফেলতে ইচ্ছে করবে কিন্তু
কি আর করা? যা করার করে ফেলেছ। এখন চুল
ছিড়েও কোন লাভ নেই। যাইহোক, মূল কথায় আসি।
আজকে আমি সব অভিমান ভুলে তোমার কাছে
ছুটে আসছিলাম। কেনো আসছিলাম এখন আর বলব
না। বলার ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনটাই
নেই। পথে যার সাথে আমাকে দেখে তুমি
এভাবে রিএক্ট করলে, সেটা করাই স্বাভাবিক
ছিল। কিন্তু তুমি পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা
করার সুযোগ আমাকে দিলেনা। যার সাথে
আমাকে আজ দেখেছ সে ছিল আকাশের ভাই।
অবিকল ওর মতোই দেখতে। সেদিন আকাশ
আমাকে ঠকায়নি। কাজি অফিসে যাওয়ার আগে সে
গিয়েছিল ওর গ্রামের বাড়ি, মায়ের কাছে দোয়া
নিতে। কিন্তু আসার সময় রোড এক্সিডেন্টে ওর
মৃত্যু হয়। আকাশের ভালবাসা যেমন মিথ্যে ছিলনা,
তেমনি তোমার প্রতি আমার ভালবাসাও মিথ্যে ছিলনা।
তুমি এমন একটা মানুষ যাকে ভাল না বেসে থাকাই যায়না।
তুমি ভাল করেই জানো যে তোমার অবহেলা বা রাগ
করে কথা বলা আমি সহ্য করতে পারিনা। তারপরও
আজকে আমার সাথে যে ব্যাবহারটা করলে তা আমি
কোনদিনও ভুলতে পারবোনা। তুমি আমার কাছে
শেষ
একটা চাওয়া চেয়েছ, আমি যেন আমার এই মুখ
তোমাকে কোনদিনো না দেখাই। তুমি কিছু চাইবে
আর আমি সেটা পূরন করবোনা, তাই কখনো হয়? ভাল
থেকো। আমি গেলাম।
"নীতু"
.
চিঠিটা পড়ার পর আমি পর পর তিনগ্লাস পানি খেলাম। মাথার
চুলগুলো ঠিকই ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল।
কিন্তু এত সময় তখন আমার হাতে নেই। এক দৌড়ে
শ্বশুরবাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। কিন্তু এবার সে
ওখানেও গেলনা। বোঝলাম আমার সাথে আর
যোগাযোগ রাখতে চাচ্ছেনা। ওর সব বান্ধবিদের
বাড়িতে খোজ নিলাম। এমন কোন জায়গা বাদ রাখিনি
যেখানে ওকে খুজিনি। কিন্তু কোথাও পেলাম না।
একেবারে হারিয়ে গেল। সেদিনের পর থেকে
আমি রোজ ওদের বাড়ির সামনে রোজ দাঁড়িয়ে
থাকতাম।
মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে একদিন না
একদিন ও ফিরবেই। সেদিন ওকে আর কোথাও
যেতে দিবনা। আর কোনদিন কোন অভিযোগ
করার সুযোগ দিবনা। কিন্তু ও আর ফেরেনি। হয়তো
আঘাতটা একটু বেশি দিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমিও
অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করতে সমস্যা কি?
.
আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
--এখন ছবিটা দাও।
ও বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল,
--আমি চাইলে ছবি কেন, পুরো মানুষটাই
আপনার সামনে এনে দিতে পারি।
--মানে??তুমি এনাকে চেন?
--ইয়েস। উনি আমাদের পাশের ফ্লাটেই
থাকেন। বাসার কাছেই একটা স্কুলে ইংলিশ
পড়ান। আমিও ওই স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ি।"
ছেলের কথা শুনে আমি হা করে ওর দিকে
তাকিয়ে রইলাম। এত সহজে নীতুকে ফিরে পাব এটা
বিশ্বাসই হচ্ছেনা। তবে এতক্ষনে নীতুর ব্যাপারে
ওর এত আগ্রহের কারনটা বোঝতে পারলাম। খুশিতে
কি বলবো বোঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি
বললাম,,
--এই ছেলে তোমার নাম কি?
--শাওন।
--শোন শাওন, তোমার কথা সত্যি হয়, তবে তুমি যা
চাইবে আমি তাই দেব।
--যা চাইবো তাই দেবেন?
--অবশ্যই।
--উমমম,,,কিন্তু এখনতো আমার কিছু চাওয়ার নেই। যদি
কখনো কিছু দরকার পড়ে তাহলে সেটা ঠিক
চেয়ে নেব। এখন আপনাকে নীতু ম্যামের
কাছে নিয়ে যাই, চলুন।
.
প্রচন্ড বিরক্তকর একটা চেহারা নিয়ে নীতু
দরজা খোলল। মুখ দেখে বোঝা গেল ঘুমাচ্ছিল।
পুরো পাচ বছর, তিন মাস, দশ দিন পর দেখছি ওকে।
এতটুকুও পাল্টায়নি। একদম আগের মতোই আছে।
এইযে ভর সন্ধ্যাবেলায় ঘুমাচ্ছে, এই অভ্যাসটাও
এখনো আছে দেখছি। নীতু আধখোলা
চোখে একবার আমার দিকে তাকালো। ওর
পেছনে ছোট্ট একটা মেয়ে কৌতুহলি দৃষ্টিতে
আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে একদম
ছোট্ট একটা পরীর মতো দেখাচ্ছে। মেয়েটা
নীতুকে জিজ্ঞেস করল,
--ইনি কে আম্মু?
নীতু হাই তুলতে তুলতে তুলতে বলল,
--উনি তোমার বাবা হন আম্মু। স্বপ্নে আমাদের সাথে
দেখা করতে এসেছেন। বাবাকে সালাম দাও।"
মেয়েটা আমাকে সালাম দিলো। আমার মনে
হল এত সুন্দর করে সালাম এর আগে কেউ কখনো
দেয়নি। হাটু গেড়ে ওর সামনে কখন যে বসে
পড়েছি তা নিজেও জানিনা। পরীটা আমার চোখ মুছে
দিয়ে বলল,
--তুমি কাঁদছ কেন বাবা?
আমি কিছু না বলে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে
আরো বেশি কেঁদে ফেললাম। মেয়েকে
পেয়ে নীতুর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। নীতু এখন
ঘুমঘুম চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি
হাসছে। ম্যাডামের ধারনা তিনি এখনো স্বপ্ন
দেখছেন। আমি শাওনের দিকে তাকিয়ে
বললাম,--"থ্যাংকস"--ছেলেটা একবার হাসলো। তারপর
আমার মেয়ের সামনের চুল ধরে টান দিল। আর
আমার মেয়েটাও ভ্যা করে কেদে ফেলল।
.
২০ বছর পর,,,,,,
.
আমার একমাত্র কন্যা স্নিগ্ধা আমার দিকে
কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে একমনে নখ
কামড়াচ্ছে। আমি ওকে দেখেও না দেখার
ভান করে পত্রিকা পড়ছি। এতে মেয়েটার রাগ
আরো বাড়ছে সেটা বোঝতে পারছি। হঠাৎ ওর
বিকট একটা চিৎকার,
--বাবা!!
ওর এই হঠাৎ আক্রমনে ঘাবড়ে গিয়ে আমার হাত
থেকে পত্রিকাটা পড়ে গেল, পত্রিকা হাতে নিয়ে
আমি যথেষ্ট শান্তকন্ঠে বললাম,
--হ্যা মা বল?
--তুমি ভাবলে কি করে যে ঐ ফাজিলটাকে
আমি বিয়ে করব?
--শাওন মোটেও ফাজিল নারে মা। ও অনেক
বড় একজন ডাক্তার। এই দেশে ওর মত ডাক্তার কয়জন
আছে?
--ডাক্তার না ছাই! সেই ছোটবেলা থেকে
আমাকে জ্বালিয়ে আসছে। বাকি জীবনটা
যাতে আমাকে জ্বালাতে পারে সেই প্লানিং করছে
তাইনা? কিন্তু আমিতো সেটা হতে দিচ্ছিনা। যাচ্ছি আমি
তোমার ডাক্তারের কাছে। খুব বিয়ের শখ হয়েছে
না? শখ মেটাচ্ছি।"
এমন সময় ছুটতে ছুটতে শাওনের প্রবেশ। এসেই
আমাকে জড়িয়ে ধরল। ছেলেটা দেখছি আসলেই
মহাফাজিল। নিজের হবু-শ্বশুরকে কেউ এভাবে
জড়িয়ে ধরে! শাওন বলল,,--"থ্যাংকস আংকেল, আপনি
আপনার কথা রেখেছেন। আমি যা চেয়েছি সেটাই
দিয়েছেন। এই জীবনে আমার চাওয়ার আর কিছুই
নেই। আপনার মতো শ্বশুর যেন ঘরে ঘরে
জন্মায়।"--
বলেই যেভাবে ছুটতে ছুটতে এসছিল,
সেভাবেই চলে গেল। যাওয়ার আগে
অভ্যাসমতো আমার মেয়েটার সামনের চুলধরে টান
দিয়ে গেল। কিন্তু স্নিগ্ধার এখন সেদিকে খেয়াল
নেই। আমার বোকাসোকা রাগি মেয়েটা আজ সারাদিন
বসে বসে একটা কথাই ভাববে যে, শাওন কি এমন
আহামরি জিনিষ চেয়েছিল, যেটা ওর বাবা দিয়ে
দেওয়াতে এত খুশি হয়ে গেল.....?
বলল,,---""ও কি আসবেনা??"
.
আমি একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বেশ আরাম করে
আধশোয়া হয়ে ছিলাম। সোজা হয়ে বসতে
বসতে বললাম,,
--মনে হয়না। ব্যাটা পালিয়েছে বোধহয় "
আমার কথা শুনে নীতুর চোখমুখ আরো ফ্যাকাসে
হয়ে গেল। মেয়েটা এখন ঘামতে শুরু করেছে।
শাড়ীর আচল দিয়ে বারবার কপালটা মুছে যাচ্ছে আর
ঝাপসা চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে। একটা
ছেলের অপেক্ষায়। যার জন্যে ও বাড়ি থেকে
পালিয়ে এসেছিল। ছেলেটা আমার বন্ধু। নাম আকাশ।
ছেলেটার সাথে আমার বন্ধুত্ব বেশিদিনের নয়।
অল্পকয়দিনে ওকে যতটুকু চিনেছি, ওর মত ভাল
ছেলে পৃথিবীতে খুব কম দেখা যায়। সকালবেলা
আকাশ আমাকে ফোন দিয়ে অনেক খুশি খুশি গলায়
বলল, আজ ও বিয়ে করছে। পালিয়ে কাজি অফিসে
বিয়ে। যেন পালিয়ে বিয়ে করা অনেক মজার একটা
ব্যাপার। আমাকে বলল,--"" বুঝলি শরীফ তোকে
যেভাবেই হোক থাকতে হবে। আর আমার
যেতে একটু দেরি হতে পারে। তুই যদি আমার
আগে পৌছাস তাহলে দেখবি নীল শাড়ী পড়া একটা
মেয়ে বসে বসে নখ কামড়াচ্ছে। নিঃসন্দেহে
ওটাই নীতু। আমি ওকে তোর কথা বলে
রেখেছি।""--
.
নীতুকে খুজে পেতে আমার খুব একটা সমস্যা
হলনা। কিন্তু মেয়েটাকে দেখা মাত্রই আমি ধাক্কামত
খেলাম। ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই ও এসে
আমাকে বলল,
-- আপনিই শরীফ তাইনা?"-- আমি বললাম,
--হ্যা।
-- আকাশ কোথায়? ও আসেনি?
-- ওর একটু দেরি হবে বলেছে। চলে আসবে।
নীতু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এরপর আকাশের
ফোনে অনেকবার ট্রাই করলাম। কিন্তু ফোনই
তুলল না। আকাশের মত একটা ছেলে এরকম কান্ড
করবে আমি ভাবতেই পারছিলাম না। আমি নীতুর দিকে
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। ওখানে আসার পর
থেকে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। ও বোধহয়
ব্যাপারটা বোঝতে পারেনি। ওর জন্যে আমার
মনের ভেতর সূক্ষ ব্যাথাও অনুভব করছি। মুখটা কেমন
মলিন হয়ে গিয়েছে।
.
অনেক্ষন বসে থাকার পর নীতু চোখ মুছে উঠে
দাড়ালো। এলোমেলো ভঙ্গীতে হেটে
যাচ্ছে। কেমন দিশাহারা দিশাহারা টাইপ। ব্যাপারটা সুবিধার
মনে হল না আমার। আমি ওর পিছন পিছন গেলাম। দিশাহারা
কন্যা তখন দিশা হারিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
যেকোন সময় অঘটন ঘটে যেতে পারে। অঘটন
ঘটার আগেই আমি খপ করে ওর হাত ধরে ফেললাম।
তারপর একটা কফিশপে নিয়ে গিয়ে বসলাম।
.
নীতুর কান্না থামানোর জন্যে আমি কিছু একটা বলতে
যাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছু বলার আগেই ও কাদতে কাদতে
বলে উঠলো,,,
--এই মুখ নিয়ে আমি কিভাবে বাড়ি যাবো!"
আমি বললাম,,
--তুমি এই মুখ নিয়েই বাড়ি যাবে। তোমার মুখের
তেমন কিছুই হয়নি। আয়নায় দেখে নিতে পারো।
--অসম্ভব।
--কেনো অসম্ভব?
-- বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি আমি। আজকে
আমাকে দেখতে আসার কথা। আমি জানি আমাকে
দেখলেই ওদের পছন্দ হয়ে যাবে। এর আগে
তিনবার দেখা হয়েছে। অনেক কস্টে বিয়েগুলো
আটকিয়ে ছিলাম। আসার আগে বাড়িতে চিঠি লিখে
এসেছি।
-- কি লিখেছ?
--ছোট্ট চিঠি। লিখেছি--"" আমি আমার পছন্দের
ছেলেকে বিয়ে করছি। খুব বেশি মান সম্মান নিয়ে
টানাটানি পড়লে মীতুকে দেখিয়ে দিও। কারন আমার
পক্ষে অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব নয়""--। মীতু
আমার ছোট বোন।
-- কিন্তু পাত্রপক্ষের কাছে তো তোমার ছবি
দেওয়া হয়েছে। উনারাতো তোমাকে দেখতে
আসবেন, তাইনা?
--তাও অবশ্য ঠিক।'"
কি মনে হতেই নীতু অবাক হয়ে আমাকে
জিজ্ঞেস করলো,,
--আপনি এত শিওর হয়ে কিভাবে বললেন যে
পাত্রপক্ষকে আমার ছবি দেওয়া হয়েছে?
আমি পকেট থেকে কুঁচকানো একটা ছবি বের
করে ওর সামনে রেখে বললাম,
--সরি, ভাজ না করলে ওটা পকেটেই ঢুকছিলো না।
.
নীতু এখন দিশাহারা কন্যা থেকে বিস্ময় কন্যাতে
পরিণত হয়েছে। আমি ওর বিস্ময় কাটানোর জন্যে
বললাম,,
--কাল রাতে মা আমাকে ছবিটা নিয়ে এসে
বললেন,--"" এই মেয়েকে আমার অনেক পছন্দ
হয়েছে। তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে
তাহলে কাল একে দেখতে যেতে চাই।""-- আমার
মায়ের ধারনা আমি খুব লাজুক টাইপের ছেলে। তাই উনি
বুদ্ধি করে বললেন,--"" তোমাকে মুখে কিছু
বলতে হবেনা। পছন্দ হলে ছবিটা নিজের কাছে
রেখে দাও। আর না হলে আমাকে দিয়ে দাও।"--আমি
কি করলাম বলতো?
নীতু যন্ত্রের মতো বলল,
-- ছবিটা ভাজ করে নিজের পকেটে রেখে
দিলেন।
--বাহ! তোমার তো বেশ বুদ্ধি!
--রসিকতা করার চেষ্টা?
আমি হাসতে হাসতে বললাম,--"হ্যা"--
.
নীতুর আমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিছুক্ষন
তাকিয়ে থাকার পর টলমল ভঙ্গীতে উঠে
দাড়াল। এই পড়ে যাবে, এই পড়ে যাবে এমন
অবস্থা। আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। ও ছবিটা
হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো দেখে আমি
বললাম,
--ছবি নিয়ে কোথায় যাও?
--কোথায় যাবো জানিনা। কিন্তু এতকিছুর পর তো আর
আমাকে পছন্দ হওয়ার কোন কারন দেখছিনা।
আমি ওর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে পকেটে
ঢুকাতে ঢুকাতে বললাম,--"সবকিছুতেই যে কারন
থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই।"--
নীতু মনে হয় হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু একটা বলতে
চাচ্ছিল। "দয়া দেখাচ্ছেন?" এমন কিছুই হবে। কিন্তু
বলতে পারলোনা। তার আগেই ও মুখ থোবড়ে
আমার কাধের ওপর পড়ে গেল! খুব সম্ভব জ্ঞান
হারিয়ে ফেলল। ঐ মূহুর্তে আমার শুধু একটা কথাই
মনে হল। আকাশটা এত ভাল কেন!!
.
""তারপর""
পিচ্চির কথায় আমার হুশ আসলো। এতক্ষণ
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলাম।আপার এক বন্ধুর
বিয়েতে এসেছি। মারাত্মক বোরিং লাগছিল। বাইরে
বেরিয়ে হাটছিলাম। হঠাৎ একটা পিচ্চি পিছন থেকে
ডেকে বলল,,--"এইযে আংকেল, এই ছবিটা আপনার
পকেট থেকে পড়লো মনে হয়।""-- আমি
তাকিয়ে দেখি, ওমা!! এটাতো আমার বউয়ের ভাজ করা
ছবিটা! কোনফাকে পকেট থেকে পড়ে
গেছে। আমি যেই ওটা হাতে নিতে যাবো ওমনি
পিচ্চি বলে উঠলো,,
--এই বিয়ে বাড়িতে আমার খুব বোরিং লাগছে
বোঝলেন। গল্প করার মত বা খেলার মত কাউকে
পাচ্ছিনা। এখন আপনি আমাকে কোন একটা গল্প
শোনাবেন, যতক্ষণ না বিয়েটা শেষ হয়। তাহলেই
ছবিটা পাবেন। ছবিটা আপনার খুব প্রিয় সেটা আমি
বোঝতে পেরেছি। তাই ছোটখাটো একটা
ব্লাকমেইলের চেষ্টা বলতে পারেন।"
পিচ্চির কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠলো। এই
টাইপের বাচ্চাদের সাথে কথায় পারা যায়না। আমি তাই
চুপচাপ গল্প বলতে শুরু করলাম,
--এক যে ছিল রাজা, তার ছিল তিন রানী।
রাজা একদিন.......
--উফফ! আমি দেখতে পিচ্চি হলাম বলে এইসব হাবিজাবি
শুনবো নাকি? ইন্টারেস্টিং কিছুবলুন।""
আমি পিচ্চি ছেলেটার দিকে এতক্ষনে ভালমত
তাকালাম। কত বয়স হতে পারে? নয় বা দশ? এর জন্যে
কি ইন্টারেস্টিং গল্প বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তখন
সে নিজেই চিন্তা করে বলল,,
--এই ছবির আন্টির পিছনে কোন কাহিনী আছে
তাইনা?"
--হুম
--ওকে তাহলে উনার গল্পই বলুন।
.
""কি হলো? তারপরের কাহিনী কি?"---
পিচ্চিটা আবার প্রশ্ন করলো। কি আজিব! এই ছেলেটা
বেছে বেছে আমাকেই ধরলো কেনো
বোঝলাম না। আমি বললাম,
--তারপর আর কি? বিয়ে হয়ে গেল। কাহিনী
শেষ। এখন ছবি দাও। পিচ্ছিটা পা নাচাতে নাচাতে বলল,
--উহু, কাহিনীতো শেষ হয়নি। পুরোটা বলুন।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু
করলাম।
..
""বিয়ের পর নীতু প্রায়ই স্বপ্নে আকাশকে
দেখত। কখনো কখনো মাঝরাতে ঘুম ভাঙতো ওর
কান্নার শব্দে। আমার হাতটা নিজের গালে রেখে
তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদতো। আমি ধড়ফড় করে
উঠে যখন জিজ্ঞেস করতাম, কি হয়েছে? তখন ও
বলতো,,
--""আমি ওকে কেন স্বপ্নে দেখি বলতো? আমি
তো শুধু তোমাকেই দেখতে চাই। আমি চাই আমার
কল্পনায়, আমার স্বপ্নে শুধু তুমি থাকো। কিন্তু ও
মাঝখান থেকে চলে আসে কেনো??"--- বলেই
আবার কান্না। আমারও মনে মনে রাগ লাগতো। ওই
ব্যাটা আমার বউয়ের স্বপ্নে আসবে কেন?? যাই
হোক, আমি সেটা ওকে বোঝতে দিতাম না।
মেয়েটা ছিল প্রচণ্ড অভিমানী। একটা ব্যাগে
সবসময় ওর কাপড় গোছানো থাকতো।সামান্য
রেগে কিছু বললেই ব্যাগটা নিয়ে
বাপের বাড়ি দৌড়। কিন্ত আমার প্রতি
ভালবাসার কোন কমতি ছিলনা। একদিন কি
একটা ব্যাপারে ওর সাথে রেগে কথা
বলেছিলাম। ব্যাস, হাউমাউ করে কাঁদতে
কাঁদতে উনি রওয়ানা হয়ে গেলেন বাপের
বাড়ি। রাগ করে তিনদিন আমার ফোনটাও
তোলেনি। শেষে চিন্তা করলাম নিজেই গিয়ে
ওকে নিয়ে আসব। যাওয়ার আগে একটা গিফট শপে
ঢুকলাম নীতুর জন্যে কিছু কেনার উদ্দেশ্যে।
ঢুকেই আবার বের হয়ে আসলাম। বাইরে নীতুর
মতো কাউকে দেখলাম মনে হল। হ্যা ওটাই নীতুই
ছিল। একটা ছেলের পাশে
দাঁড়িয়ে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে!! আমি
ছেলেটার অর্ধেক চেহারা দেখতে পাচ্ছিলাম,
দেখে মনে হল ওটা আকাশ। কিন্তু ওকে কেমন
অন্যরকম লাগছিলো দেখতে। আমি
স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজের চোখকে যেন
বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নীতুর চোখে
চোখ পড়তেই আমি সেখান থেকে চলে
আসলাম। রাগে কি যে করব বোঝতে পারছিলাম না।
.
একটু পর নীতু বাসায় চলে এল। ওকে দেখে
আমার রাগ তিনগুন বেড়ে গেল। আমাকে
জড়িয়ে ধরে তোতলাতে তোতলাতে বলল,,,
-- আ আ আকাশ,,,
-- হ্যা তো ওর কাছেই থেকে গেলেই পারতে।
আমার কাছে এসেছ কেন?.
আমার কথা শুনে নীতু চমকে উঠলো আমাকে
ছেড়ে দিয়ে বলল,,
--কি বলছো তুমি এসব?
-- কেন? স্বপ্নে দেখা হয় ওটা বলতে পারলে।
আর বাইরে যে গিয়ে দেখা করো সেটা বলতে
পারলেনা?.. এই মূহুর্তে তুমি আমার ঘর থেকে
বেরিয়ে যাবে। তোমার সাথে আমার আর কোন
সম্পর্ক নেই।""
নীতু আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা
করলো। কিন্তু আমি গাধা কিছু শোনলেতো!
বাধ্য হয়ে সে তার সবকিছু নিয়ে বেরিয়ে
গেল। মেয়েটাও কম জেদি ছিল না। নিজের
একটা কিছুও রেখে যায়নি। ওর ভাজ করা
ছবিটা সবসময় আমার পকেটে থাকতো বলেই ওটা
আমার কাছে থেকে গেছে।যাওয়ার আগে
কোনফাকে একটা চিঠিও লিখে ফেলেছিল। খুব
বেশি গল্প-উপন্যাস পড়তো কি-না, ওখান থেকেই
এসব চিঠি লেখালেখি শিখেছে। চিঠিটা আমি পাই রাতে,
বালিশের নিচে।
.
"শরীফ"
জানি চিঠিটা পড়ার পর তোমার মাথার সবকটা চুল ছিড়ে
ফেলতে ইচ্ছে করবে কিন্তু
কি আর করা? যা করার করে ফেলেছ। এখন চুল
ছিড়েও কোন লাভ নেই। যাইহোক, মূল কথায় আসি।
আজকে আমি সব অভিমান ভুলে তোমার কাছে
ছুটে আসছিলাম। কেনো আসছিলাম এখন আর বলব
না। বলার ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনটাই
নেই। পথে যার সাথে আমাকে দেখে তুমি
এভাবে রিএক্ট করলে, সেটা করাই স্বাভাবিক
ছিল। কিন্তু তুমি পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা
করার সুযোগ আমাকে দিলেনা। যার সাথে
আমাকে আজ দেখেছ সে ছিল আকাশের ভাই।
অবিকল ওর মতোই দেখতে। সেদিন আকাশ
আমাকে ঠকায়নি। কাজি অফিসে যাওয়ার আগে সে
গিয়েছিল ওর গ্রামের বাড়ি, মায়ের কাছে দোয়া
নিতে। কিন্তু আসার সময় রোড এক্সিডেন্টে ওর
মৃত্যু হয়। আকাশের ভালবাসা যেমন মিথ্যে ছিলনা,
তেমনি তোমার প্রতি আমার ভালবাসাও মিথ্যে ছিলনা।
তুমি এমন একটা মানুষ যাকে ভাল না বেসে থাকাই যায়না।
তুমি ভাল করেই জানো যে তোমার অবহেলা বা রাগ
করে কথা বলা আমি সহ্য করতে পারিনা। তারপরও
আজকে আমার সাথে যে ব্যাবহারটা করলে তা আমি
কোনদিনও ভুলতে পারবোনা। তুমি আমার কাছে
শেষ
একটা চাওয়া চেয়েছ, আমি যেন আমার এই মুখ
তোমাকে কোনদিনো না দেখাই। তুমি কিছু চাইবে
আর আমি সেটা পূরন করবোনা, তাই কখনো হয়? ভাল
থেকো। আমি গেলাম।
"নীতু"
.
চিঠিটা পড়ার পর আমি পর পর তিনগ্লাস পানি খেলাম। মাথার
চুলগুলো ঠিকই ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল।
কিন্তু এত সময় তখন আমার হাতে নেই। এক দৌড়ে
শ্বশুরবাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। কিন্তু এবার সে
ওখানেও গেলনা। বোঝলাম আমার সাথে আর
যোগাযোগ রাখতে চাচ্ছেনা। ওর সব বান্ধবিদের
বাড়িতে খোজ নিলাম। এমন কোন জায়গা বাদ রাখিনি
যেখানে ওকে খুজিনি। কিন্তু কোথাও পেলাম না।
একেবারে হারিয়ে গেল। সেদিনের পর থেকে
আমি রোজ ওদের বাড়ির সামনে রোজ দাঁড়িয়ে
থাকতাম।
মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে একদিন না
একদিন ও ফিরবেই। সেদিন ওকে আর কোথাও
যেতে দিবনা। আর কোনদিন কোন অভিযোগ
করার সুযোগ দিবনা। কিন্তু ও আর ফেরেনি। হয়তো
আঘাতটা একটু বেশি দিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমিও
অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করতে সমস্যা কি?
.
আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
--এখন ছবিটা দাও।
ও বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল,
--আমি চাইলে ছবি কেন, পুরো মানুষটাই
আপনার সামনে এনে দিতে পারি।
--মানে??তুমি এনাকে চেন?
--ইয়েস। উনি আমাদের পাশের ফ্লাটেই
থাকেন। বাসার কাছেই একটা স্কুলে ইংলিশ
পড়ান। আমিও ওই স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ি।"
ছেলের কথা শুনে আমি হা করে ওর দিকে
তাকিয়ে রইলাম। এত সহজে নীতুকে ফিরে পাব এটা
বিশ্বাসই হচ্ছেনা। তবে এতক্ষনে নীতুর ব্যাপারে
ওর এত আগ্রহের কারনটা বোঝতে পারলাম। খুশিতে
কি বলবো বোঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি
বললাম,,
--এই ছেলে তোমার নাম কি?
--শাওন।
--শোন শাওন, তোমার কথা সত্যি হয়, তবে তুমি যা
চাইবে আমি তাই দেব।
--যা চাইবো তাই দেবেন?
--অবশ্যই।
--উমমম,,,কিন্তু এখনতো আমার কিছু চাওয়ার নেই। যদি
কখনো কিছু দরকার পড়ে তাহলে সেটা ঠিক
চেয়ে নেব। এখন আপনাকে নীতু ম্যামের
কাছে নিয়ে যাই, চলুন।
.
প্রচন্ড বিরক্তকর একটা চেহারা নিয়ে নীতু
দরজা খোলল। মুখ দেখে বোঝা গেল ঘুমাচ্ছিল।
পুরো পাচ বছর, তিন মাস, দশ দিন পর দেখছি ওকে।
এতটুকুও পাল্টায়নি। একদম আগের মতোই আছে।
এইযে ভর সন্ধ্যাবেলায় ঘুমাচ্ছে, এই অভ্যাসটাও
এখনো আছে দেখছি। নীতু আধখোলা
চোখে একবার আমার দিকে তাকালো। ওর
পেছনে ছোট্ট একটা মেয়ে কৌতুহলি দৃষ্টিতে
আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে একদম
ছোট্ট একটা পরীর মতো দেখাচ্ছে। মেয়েটা
নীতুকে জিজ্ঞেস করল,
--ইনি কে আম্মু?
নীতু হাই তুলতে তুলতে তুলতে বলল,
--উনি তোমার বাবা হন আম্মু। স্বপ্নে আমাদের সাথে
দেখা করতে এসেছেন। বাবাকে সালাম দাও।"
মেয়েটা আমাকে সালাম দিলো। আমার মনে
হল এত সুন্দর করে সালাম এর আগে কেউ কখনো
দেয়নি। হাটু গেড়ে ওর সামনে কখন যে বসে
পড়েছি তা নিজেও জানিনা। পরীটা আমার চোখ মুছে
দিয়ে বলল,
--তুমি কাঁদছ কেন বাবা?
আমি কিছু না বলে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে
আরো বেশি কেঁদে ফেললাম। মেয়েকে
পেয়ে নীতুর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। নীতু এখন
ঘুমঘুম চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি
হাসছে। ম্যাডামের ধারনা তিনি এখনো স্বপ্ন
দেখছেন। আমি শাওনের দিকে তাকিয়ে
বললাম,--"থ্যাংকস"--ছেলেটা একবার হাসলো। তারপর
আমার মেয়ের সামনের চুল ধরে টান দিল। আর
আমার মেয়েটাও ভ্যা করে কেদে ফেলল।
.
২০ বছর পর,,,,,,
.
আমার একমাত্র কন্যা স্নিগ্ধা আমার দিকে
কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে একমনে নখ
কামড়াচ্ছে। আমি ওকে দেখেও না দেখার
ভান করে পত্রিকা পড়ছি। এতে মেয়েটার রাগ
আরো বাড়ছে সেটা বোঝতে পারছি। হঠাৎ ওর
বিকট একটা চিৎকার,
--বাবা!!
ওর এই হঠাৎ আক্রমনে ঘাবড়ে গিয়ে আমার হাত
থেকে পত্রিকাটা পড়ে গেল, পত্রিকা হাতে নিয়ে
আমি যথেষ্ট শান্তকন্ঠে বললাম,
--হ্যা মা বল?
--তুমি ভাবলে কি করে যে ঐ ফাজিলটাকে
আমি বিয়ে করব?
--শাওন মোটেও ফাজিল নারে মা। ও অনেক
বড় একজন ডাক্তার। এই দেশে ওর মত ডাক্তার কয়জন
আছে?
--ডাক্তার না ছাই! সেই ছোটবেলা থেকে
আমাকে জ্বালিয়ে আসছে। বাকি জীবনটা
যাতে আমাকে জ্বালাতে পারে সেই প্লানিং করছে
তাইনা? কিন্তু আমিতো সেটা হতে দিচ্ছিনা। যাচ্ছি আমি
তোমার ডাক্তারের কাছে। খুব বিয়ের শখ হয়েছে
না? শখ মেটাচ্ছি।"
এমন সময় ছুটতে ছুটতে শাওনের প্রবেশ। এসেই
আমাকে জড়িয়ে ধরল। ছেলেটা দেখছি আসলেই
মহাফাজিল। নিজের হবু-শ্বশুরকে কেউ এভাবে
জড়িয়ে ধরে! শাওন বলল,,--"থ্যাংকস আংকেল, আপনি
আপনার কথা রেখেছেন। আমি যা চেয়েছি সেটাই
দিয়েছেন। এই জীবনে আমার চাওয়ার আর কিছুই
নেই। আপনার মতো শ্বশুর যেন ঘরে ঘরে
জন্মায়।"--
বলেই যেভাবে ছুটতে ছুটতে এসছিল,
সেভাবেই চলে গেল। যাওয়ার আগে
অভ্যাসমতো আমার মেয়েটার সামনের চুলধরে টান
দিয়ে গেল। কিন্তু স্নিগ্ধার এখন সেদিকে খেয়াল
নেই। আমার বোকাসোকা রাগি মেয়েটা আজ সারাদিন
বসে বসে একটা কথাই ভাববে যে, শাওন কি এমন
আহামরি জিনিষ চেয়েছিল, যেটা ওর বাবা দিয়ে
দেওয়াতে এত খুশি হয়ে গেল.....?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন