বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭

আংটি বদল

নীলার যেদিন মেডিকেল অরিয়েন্টেশন তার সঙ্গে
রাসেলও এসেছিলো সেদিন।নীলার ডানপাশে তার
বাবা আব্বাস মিয়া।আর তার ডানে বসা রাসেল।আব্বাস
মিয়া গ্রামের গরীব কৃষক।নিজের জমিজমা কিছু নেই।
অন্যের জমিতে ভাগে চাষ করে কোনমতে সংসার
চালায়।তিন মেয়ের মধ্যে নীলা সবার বড়।ছেলে নেই।
রাসেলকে নিজের ছেলের মতোই ভাবে আব্বাস মিয়া।
কালেভদ্রে গরীবের ঘরে ভালো কিছু রান্না হলে
দাওয়াত করে খাওয়ায়,নতুন ধানের ক্ষীর করলে ডেকে
আনে।নীলার মা সুফিয়া মনে মনে ঠিকই করে নেয় এই
ছেলেটিকেই ভবিষ্যতের জামাই করবে।গ্রামের
বাজারে ছোট্ট এক ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে মাধ্যমিক
উচ্চমাধ্যমিক লেভেলের ছাত্র ছাত্রীদের প্রাইভেট
পড়ায় রাসেল।সে স্থানীয় একটি কলেজে বিএ পড়ে।
তবে সে বেশ মেধাবী ছেলে।স্কুল কলেজে বিজ্ঞান
বিভাগ থেকে ভালো রেজাল্ট করে।ইচ্ছে ছিলো শহরের
কোন ভার্সিটি মেডিকেলে পড়বে।হঠাৎ বিপদ নেমে
এলো ঘরে।বাবা অনেক আগেই গত হয়েছিলো।মাও
সেদিন এক বর্ষায় হাঁপানিতে মারা গেলো।একটা মাত্র
ছোট বোন।ক্লাশ নাইনে পড়ে।বোনটার জন্য তার সকল
সাধ স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে এলাকাতেই থাকতে হলো।
অনেকের মতো নীলাও তার কাছে প্রাইভেট পড়তো।
অনেক কঠিন বিষয়গুলো সহজে বুঝিয়ে দেয়ার দারুণ
ক্ষমতা রাসেলের।সবার চেয়ে একটু বেশিই কেয়ার নেয়া
হতো নীলার।রাসেল প্রায়ই বলতো,'তোমাকে আমি
মেডিকেলে চান্স পাইয়েই দেবো নীলা।'নীলা
বলতো,'ঠাট্টা করছেন রাসেল ভাই?গরীবের আবার
ডাক্তারী!
-নিজেকে এত ছোট ভাবো কেন নীলা?দেখো,তুমি
একদিন ডাক্তার হবে।
তাদের মধ্যে মন দেয়া নেয়া হবার পর থেকে রাসেল আর
একটি মাসের টাকা নীলার কাছ থেকে নেয় নি।বরং
নীলার কলম,খাতা,প্রয়োজনীয় কিছু বই নিজের পকেটের
টাকা খরচ করেই কিনে দিয়েছে রাসেল।নীলার কেমন
জানি তাতে লজ্জা লজ্জা লাগতো।পরীক্ষার সময়
নীলার যাতে বাড়তি কষ্ট না হয় সেজন্য সারা রাত
জেগে তার জন্য প্র্যাকটিকেল খাতা লিখে
দিয়েছে,ছবি এঁকে দিয়েছে।নীলা মনে মনে ভাবে,এমন
কপাল আছে কজন প্রেমিকার?
আব্বাস মিয়া গ্রামের গন্ডমূর্খ মানুষ।শহর কখনো দেখে
নি।এই প্রথম সুযোগ হয়েছিলো তার শহর দেখার।
রাসেলকে তাই সঙ্গে করে নিয়েছিলো পথ ঘাট চিনিয়ে
নিতে।
.
সেই নীলা এখন মেডিকেল জীবনের তিন বছর পার করে
দিয়েছে।গ্রামে আসলে তার সেকি কদর!পাড়া
প্রতিবেশীরা আসার খবর শোনা মাত্রই দেখা করতে
চলে আসে।কেউ হাতে গাছের কলাটা,আমটা,জামট
া,কারো ঘর থেকে বা গ্লাশভর্তি গাইয়ের গরম দুধ!
বাজারের চা স্টলে বসে মানুষ বলাবলি করে,আব্বাস
মিয়ার দিন ফিরতে আর বেশী দিন নাই।আব্বাস মিয়ার
সে কথা শুনতে কীযে ভালো লাগে।গর্বে বুকটা ভরে
উঠে তার।
মেডিকেলে যাবার পর থেকে নীলার সঙ্গে
যোগাযোগটা তেমন হচ্ছিলো না রাসেলের।ফোন করেও
তেমন সাড়া মেলে না নীলার।প্রতিদিন আইটেম,কার্ড
পরীক্ষায় ব্যস্ত থাকতে হয় তার।হাই হ্যালোর বেশি খুব
একটা তেমন কথা হয় না তাদের।মাঝে যে তিন চারবার
নীলা গ্রামে আসে,রাসেল তাকে দেখতে এলেও তার
মধ্যে সেরকম কোন উৎসাহ দেখতে পায় নি সে।যেন
তাকে এড়িয়ে চলছে কিছুটা।নীলার বাবা মায়েরাও
তাকে দেখেও যেন না দেখার ভান করে থাকে।আগের
মতো খাতির যত্ন এ ঘরে পায় না সে।যদিও প্রথম প্রথম
মেয়ের খরচ পাঠাতে রাসেলের কাছ থেকে টাকা ধারও
করেছে আব্বাস মিয়া।রাসেল তার শোধ পেতে কোনরকম
চাপও দেয় নি।নিজে কষ্ট করে থেকেছে,তবুও তার নীলা
ভালো থাকুক। এই ক বছরে নীলার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন
আসে।আগের চাইতে অনেক বেশি স্মার্ট হয়েছে।গেঁয়ো
কথা ছেড়ে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে সে।রকমারি
ডিজাইনের জামা পড়ে।গায়ে এ জীবনে কখনো
পারফিউম দেয় নি।এখন হাঁটলে তার গায়ের সুগন্ধি
বাতাসে ভাসে।
.
নীলার ফোন মাঝে মধ্যেই এখন অফ পায় রাসেল।মনের
মধ্যে প্রচন্ড একটা ব্যাথা অনুভব করে তখন।ডাক্তারি
সাদা এপ্রোন মনটাও বদলে দিলো নীলার?এখন কি আর
তাকে ভালোবাসে না সে?নাকি অন্যকিছু?কোন
একসিডেন্ট?
যেদিন ফোন খোলা পেলো,রাসেল অস্থির হয়ে জানতে
চায়,'ফোন বন্ধ ছিলো কেন?'
-পরীক্ষা ছিলো।
-আমাকে জানাতে পারতে না?
-মনে ছিলো না।
-আচ্ছা,নীলা তুমি কি আমাকে ভালবাসো না?
-কেন,আমি কি তোমাকে বলেছি?
-মনে হয়তো।কেমন যেন এখন এড়িয়ে চলো আমাকে।
-বুঝি না বাবা এত।তোমরা পুরুষ লোকের কী মন!
.
টানা একুশদিন ধরে নীলাকে আর ফোনে খুঁজে পায় না
রাসেল।কীযে দুঃস্বপ্নের মতো দিন রাতগুলো পার
করছে রাসেল।কোন খারাপ কিছু হয় নিতো আবার?শহরে
একা থাকে।তার উপর দেশের যা অবস্থা।ভয় লাগা
স্বাভাবিক।সেদিন আর সইতে না পেরে নীলার খুঁজে
তাদের বাড়ি গেলো রাসেল।সেখানে এসে জানতে
পারে,তার মা বলছে,-
নীলা নতুন ফোন কিনেছে।নাম্বারও পাল্টিয়েছে।তার
হবু স্বামী ওই মেডিকেলের লেকচারার, তাকে কিনে
দিয়েছে ফোনটা।আগামী সোমবার ওই শহরে তাদের
আংটি বদল!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন