সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৭

মেঘের ছায়া

শার , আপনে মইচ দিয়া ঝোল খাইবেন , নাকি মইচ ছাড়া ঝোল খাইবেন ?' প্রমিত খাতা থেকে মাথাটা তুলে আকবরের দিকে তাকালো । সে মনোযোগ দিয়ে একটা কবিতা লিখছিল ; সামনে তার কবিতার বই বেরোবে , সেই বইয়ের প্রধান কবিতা । মাত্র এক লাইন লেখা হয়েছে । এবং আকবরের দিকে তাকানোর সাথে সাথে সে কবিতার পরের লাইনটা ভুলে গেছে । সে বুঝতে পারছে , এখন তার মাথা গরম হচ্ছে , আকবরকে এখন বিদায় না করলে পরে ছোকরাটার খবর আছে ।
-' মরিচ দিস আকবর ।'
-' কাঁচা মইচ , না পাকনা মইচ ?'
যতক্ষণ পর্যন্ত জবাব পাবে না , আকবর ঠায় দাড়িয়ে থাকবে । একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল প্রমিত । ওকে বিদায় করতে হবে ।
-' শোন , কাঁচা মরিচ বেশি করে দিয়ে কেচকি মাছের ভুনা করবি । আর এখন আমার সামনে থেকে যা ত । কবিতা লিখছি ।'
আকবর চলে গেছে , সাথে কবিতাও নিয়ে গেছে ; প্রমিত কিছুতেই কবিতার পরের লাইনটা মনে করতে পারল না । হতাশ হয়েই কলমটা ছুড়ে ফেলল সে দেয়ালে । আকবরকে বারবার বলে দেয়া হয়েছে , সে না ডাকলে যেন ও না
আসে । দরজার বাইরেও লেখা আছে ,-' না ডাকলে আমাকে বিরক্ত করবি না ।'
কিন্তু বিরক্ত করার কাজটা সে নিপুণ ভাবেই করে যায় । ও বুঝতে পারল , মার সাথে দেখা করতে হবে । এই সময়ে মাকেই ওর সব চে প্রয়োজন হয় ।
,
ময়মনসিংহের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রমিতের বাসা । বাসাটা দু বিঘে জমির উপর করা । ওর বাবার খুব প্রিয় ছিল বাড়িটা । কয়েক বছর আগে তার বাবা মারা যায় । গত বছর তার মা মারা গেছে । সুস্থ অবস্থায়ই মারা যান তিনি , কোন রোগে ভুগতে হয়নি । বাবার কবরটা একটু ভিতরের দিকে , মায়ের কবরটাই আগে চোখে পড়ে । প্রমিত যখন খুব সমস্যায় পড়ে , মায়ের কবরের কাছে গিয়ে বসে থাকে । ওর মনে দৃঢ় বিশ্বাস , ওর মা ওকে দূর থেকে সব সমস্যার সমাধান দিয়ে যায় । আব্বার কবরও যিয়ারত হয় , কিন্তু মা-ই ওর বেশি আপন ।
সন্ধ্যার সময় আকবর বাসার প্রতিটা রুম খুঁজল, প্রমিতকে খুঁজে পেল না। ও জানে তাকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে।
মায়ের কবরের পাশে বসে বিড়বিড় করে কথা বলছিল প্রমিত । কিন্তু খুবই আস্তে , বুঝা যায় না । চোখে জল জমে আছে , কখন ঝরবে বলা যায় না ।
-' শার , কি অইছে ? চলেন বাইত যাই । নানীর কবরের পাশে বইয়া কানতে নেই । এতে মরা মাইনসের আত্মা কষ্ট হয় ।'
প্রমিত আকবরের দিকে তাকালো ; ওর চোখ ভেজা । সন্ধ্যের সময় আকাশে অনেকগুলো পাখি ঊরে যাচ্ছে , ঝাপসা চোখে সে তাকিয়ে বুঝতে চাইল কি পাখি যাচ্ছে ।
-' আকবর '
-' জে শার ।'
-' কি পাখি যাচ্ছে রে ?'
-' এই গুলারে কয় ক্যাঁচক্যাঁচ পাখি ।'
-' চল , যাই ।'
,

,
প্রমিত বিছানায় শুয়ে আছে , কিন্তু ঘুম আসছে না । অস্বস্তি হচ্ছে , বারবার এপাশ ওপাশ করছে কিছুক্ষণ ধরে । জিহ্বার একবারে গোঁড়ার দিকে কেচকি মাছের কাটা বিধে আছে । এক ঘণ্টা ধরে এটার সাথে যুদ্ধ করেও খুলতে পারেনি ।
একটু ঘুম আসতেই সে অবাক হয়ে খেয়াল করল , ওর মা পাশে এসে বসেছে ।
-' কি রে ! ঘুমাস না কেন ?'
-' গলায় কাটা বিঁধেছে মা ।'
-' সেটা ত দেখতেই পাচ্ছি । কিন্তু তুই তো অন্য কারণে ঘুমাচ্ছিস না । কি এক কবিতা নিয়ে পড়ে আছিস ।'
-' মা , কবিতার বই কদিনের ভিতরই বের হবে , তাড়াতাড়ি লেখা জমা দিতে হবে না ?'
-' তা , কি নিয়ে কবিতা ?'
-' একটা মেয়ে নিয়ে লিখতে হবে মা । তুমি ত জানই আমি প্রেম ছাড়া কবিতা লিখতে পারি না ।'
-' মেয়ে নিয়ে শুধু কবিতা লিখলে হবে ? বিয়ে করতে হবে না ? সারা দেশের মানুষ তোর কবিতা পড়ে প্রেম করতে চায় , আর তুই একা এই বনে জঙ্গলে গাছের গুড়ির মত পড়ে আছিস। আমি হঠাৎ করে মরে গেলাম , নয়ত কি আর তোকে এভাবে একা থাকতে দিতাম ?'
প্রমিত দেখে , মা কাঁদছে । ওর জন্য মা পাত্রী দেখা শুরু করেছিল , কিন্তু তার আগেই মা মারা যায় ।
-' আহহা মা , কাঁদ কেন । মেয়ে মানুষের ঝামেলা আমার ভাল লাগে না । কত বার বলব আমি বিয়ে করব না ।'
কথা শুনে মা মুখ টিপে হেসে দিল
-' বাব্বাহ ! বাপ আমার বিয়ে করবে না ! দেখব , মেঘকে পেলে পরে আবার আমাকেই না ভুলে যাস !'
-' মেঘ কে মা !?'
-' বউয়ের নাম । এখন মুখ বন্ধ কর । খালি বকবক । মুখটা আবার খোল ত । দেখি কাটাটা বের করি । '
প্রমিত মুখ খুলল । কিন্তু কেন যেন মায়ের হাত লোমশ লাগছে । এমন মনে হচ্ছে কেন !
ওর ঘুম ভেঙে গেল । ঘুম থেকে উঠে দেখল আকবরের বিড়ালটা ওর মুখে থাবা বুলোচ্ছে । প্রচণ্ড রাগে কি করবে বুঝতে না পেরে বিড়ালকে ধরে জানালা দিয়ে এক ঢিলে মাটিতে ফেলে দিল ।উঠে মুখ ধুতে গিয়ে সে অনুভব করল , কাটা নেই । স্বস্তির সাথে অস্বস্তিও হচ্ছে, কাটা কিভাবে গেল ওর ?
বিছানায় এসে শুতেই আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল প্রমিত । এবার দেখতে পেল , সে একটা বিলের পারে বসে, তার সাথে একটা মেয়ে বসে ।
মেয়েটার চুল অনেক সুন্দর , আর সোজা । চুলের কারণে তার মুখ দেখা যাচ্ছেনা ।
-' এই যে , তোমার নাম কি ?'
-' আমার নাম ? আমার নাম ত মেঘ ।'
-' মেঘ কি কারো নাম হতে পারে ? এই মেয়ে !'
মেয়েটার হাত ধরে ওর দিকে ঘুরাতেই ও হতভম্ব হয়ে গেল । সে কি স্বপ্ন দেখছে? বাস্তবে সে কোনদিন এত সুন্দর মেয়ে দেখেনি । ওকে আরও অবাক করতেই এবার মেয়েটা জোরে হেসে উঠল । বিলের পানি ওর দিকে ছিটিয়ে দিল দুষ্টুমির
ছলে ।
ঘুম ভেঙে প্রমিত দেখল , বৃষ্টি হচ্ছে ; বৃষ্টির ছাটে ওর মুখ ভিজে যাচ্ছে । জলদি জানালার পাট্টা ২টো লাগিয়ে এসে খাটে বসল । ওর মাথা এখন কাজ করছে না । পরপর ২টো স্বপ্ন দেখে ভিতরের তারের প্যাচ খেয়েছে , এখন
সমাধান একটাই ,ব্রেনকে অফ করে অন করা । সিদ্ধান্ত নিল, কাল সকালে স্বপ্নগুলো নিয়ে চিন্তা করা যাবে । এখন একটু ঘুমানো যাক ।
,

,
প্রমিত এখন খুশি খুশি মুডে আছে । মেইন কবিতাটা লেখা হয়ে গেছে । সাথে আরেকটা সমস্যা হয়েছে , কাল রাতে স্বপ্নে দেখা মেয়েটার চেহারা সে ভুলতে পারছে না । আচ্ছা , মেয়েটার ছবি যদি এঁকে প্রচ্ছদে দেয় , তাহলে কেমন হয়। খাতা আর পেন্সিল নিয়ে বসল , এমন সময় আকবর এসে দরজায় টোকা দিল ।প্রমিত ঘুরে তাকাল , গতবার ত ছেলেটা কবিতাটাই ভুলিয়ে দিয়েছিল , এবার কি মেয়েটার চেহারা ভুলিয়ে দিবে ?
-' শার , শিক্ষামন্ত্রীর চিঠি আইচে ।'
ছেলেটার বয়স ১৬ । ঢাকা থেকে যখন প্রমিত ওকে নিয়ে আসে , তখন ওর বয়স ছিল ১৪ । ও মায়ের সাথে বস্তিতে থাকত । একদিন ওর মায়ের লাশ দেখা গেল বাসার সামনের আম গাছের সাথে ঝুলছে । কারণটা
কেউই জানতে পারল না । আর বাবার কথা ত কেউই জানে না । আকবর ক্লাস ৬ এ পড়ত । সেদিনের পর আর স্কুলে পাঠানো যায়নি ওকে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী সবাইকেই চিনে । বাসায় পত্রিকা এলে খুঁটে খুঁটে পড়ে ।
-' দিয়ে যা ।'
সকাল ১০টায় চিঠি । তাও আবার শিক্ষামন্ত্রী মুনির সাহেবের । মনোযোগ দিয়েই চিঠিটা পড়ল সে । এমনিতেই কুশলাদি জানার চিঠি । আর সামনের বইয়ের জন্য তাগাদা । ভার্সিটিতে পড়ার সময় ওনাকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তার । সে ছিল স্যারের প্রিয় ছাত্র । ভার্সিটি জীবন নেই, কিন্তু স্যারের সাথে সম্পর্ক এখনও অটুট ।
স্যারের চিঠির জবাবটা লিখে আবার মেয়েটার ছবি আঁকতে বসল প্রমিত । ভাগ্য ভাল , এবার আর চেহারা ভুলে যায়নি । ছবিটা এঁকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে ; সে যে এত ভাল ছবি আকতে পারে, সে নিজেই জানে না! এত সুন্দর মেয়ে সে বাস্তবে কোনও দিনই দেখেনি । কিন্তু তার কল্পনায় সে এই মেয়েকে খুঁজে পেয়েছে । কখনও কখনও কল্পনার শক্তি বাস্তবতাকে হার মানায় ; তখন আর বাস্তবতা নিয়ে কেউ ভাবে না , কল্পনার ভেতরে ঢুঁকে যায়
মনের অজান্তেই । হয়তো মেয়েটা সাধারণ ই, কিন্তু প্রমিতের কাছে তাকে অপ্সরীর মত লাগছে!
,
বই মেলায় প্রমিত বসে আছে , সাথে শিক্ষামন্ত্রী । ওর বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে উনি এসেছেন ।ওর বইয়ের নাম ' মেঘের ছায়া '। প্রচ্ছদটা তারই আঁকা । প্রমিতকে বেশ খুশি লাগছে , কিন্তু মন্ত্রীর মুখে রাজ্যের সব অন্ধকার জড়ো
হয়েছে । বই উন্মোচনের পর থেকেই উনাকে চিন্তিত লাগছে । প্রমিত জিজ্ঞেস করবে করবে করেও করছে না । স্যারই আগে কথা বলুক , স্যারকে সে সুযোগ দিচ্ছে । সব সময় আগে কথা বলতে নেই ।
-' প্রমিত , কি খবর । কেমন আছ ? কতদিন পর দেখা হল! "
বিনিময়ে প্রমিত একটা মুচকি হাসি দিল । ও জানে , এবার স্যার আসল কথা তুলবে । ঝড়ের আগে যেমন পূর্বাভাস আসে , তেমনি স্যার হাসি দিয়ে কথা শুরু করলেন । নয়ত এমনিতে স্যার তেমন হাসেন না ।
-' প্রমিত , তুমি কি কখনও আমার বাসায় গিয়েছিলে ?'
ও একটু অবাকই হল । স্যার এ প্রশ্ন করার মানে কি !? ও ত কখনও স্যারের বাসায় যায়নি ।
-' না ত স্যার !'
মন্ত্রী মুনির সাহেব কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না । ছেলেটাকে কিছু বলে লাভ নেই । কিন্তু , এই রহস্যের সমাধান কি ? ও ত কোনও দিনই তাঁর বাসায় যায়নি । তাছাড়া তার অতীতও গোপনীয়তার আবরণে আচ্ছন্ন ।
-' আচ্ছা ,আজ উঠি প্রমিত । প্রধানমন্ত্রীর সাথে জরুরী মিটিং আছে ।'
স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম করল সে , স্যার ওকে বুকে জড়িয়ে নিলেন । তার সাথে কত কথা বলার ছিল । কিন্তু কবিতার বইটা দেখে আর কথা বলার ইচ্ছে নেই । প্রমিত অনুষ্ঠানস্থলের দিকে এগিয়ে গেল । তার কিছু ভক্ত সেখানে অপেক্ষা
করছে । আজ তাদের ঈদের দিন ; তাদের প্রিয় কবিতা লেখককে আজ তারা কাছে পেয়েছে । প্রমিত জনগণের ভিড়ে একজনকে খুঁজছে , কিন্তু এত মানুষের ভিড়ে তার দৃষ্টি হারিয়ে যায় গভীর হতাশায় । স্বপ্ন দেখে মানুষ , স্বপ্ন বাস্তবের প্রত্যাশায় দিন কেটে যায় ।
,

,
ইদানীং মেয়েটাকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখছে প্রমিত । স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত হলে সমস্যা ছিল না । মেয়েটা দিনের বেলাও তার পিছু ছাড়ছে না । সেদিন আকবর ও রুমে এসে দেখে , বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে , আর প্রমিত জানালা খুলে বসে বৃষ্টিতে
ভিজছে । কাছে যেতেই আকবরের মনে হল , প্রমিত কারো সাথে বিড়বিড় করে কথা বলছে ।
-' শার , আপনে কার লগে কতা কন ?' প্রমিত চমকে তাকাল । দেখে আকবর অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ।
লজ্জায় আর রাগে সে কুঁচকে গেল ; এক ধমকে ওকে রুম থেকে বের করে দিল । তারপর জানালার সামনে আবার বসে বসে বৃষ্টিতে ভেজা শুরু করল । ওর বাড়িটা একটা বিশাল মাঠের মাঝে । মাঠটা একটা গ্রামের সমান ।
তার মাঝে ১০ রুমের বিশাল বড় বাড়ি । চারপাশে হাজারো গাছের সমাহার । বৃষ্টি এলে বাতাসের তাণ্ডবে সব এলোমেলো হয়ে যায় । গোটা বাড়িতে দুজন মানুষ , কে কি ঠিক করবে বুঝতে পারে না । কিন্তু দিন দিন প্রমিত বদলে যাচ্ছে । আকবর কিছুই বুঝে না , শুধু ওর ধমক খায় ।
বৃষ্টিতে ভিজে প্রমিতের জ্বর এসেছে । রাতে আকবর জোর করে খাইয়ে কাথা দিয়ে ঢেকে তার রুমে চলে গেল । ঘুমের ঘোরে সে স্বপ্ন দেখছে , মেঘ মেয়েটা তার পাশে এসে বসেছে ।
-' দুপুরে না করলাম আমার সাথে ভিজতে হবে না । এখন দেখলে ত ?'
-' তাহলে তুমি ভিজলে কেন মেঘ ?'
-' আমি ভিজলে তোমার কি ? আমি তোমার কে ?'
-' তুমি আমার কে ? সুন্দর প্রশ্ন । এর উত্তর দিতে হলে আমাকে অনেক
ভাবতে হবে , আগে জ্বর সারুক , তারপর তোমার প্রশ্নের জবাব দিব । এখন
আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও ত ।'
আকবর দাড়িয়ে ওর কথা শুনছিল । ওর খুব খারাপ লাগল । ওর 'শার' ওকে অনেক বকাঝকা করে এতে ওর মন খারাপ হয় না ; স্যারের কিছু হলেই ওর মন খারাপ হয়ে যায় । সে প্রমিতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল ।
প্রমিত ঘুমের ঘোরে নাম জপে যায় , ' মেঘ , মেঘ , মেঘ ...
,
আজ আকবরের মনটা অনেক খারাপ । সে এখন রান্নাঘরে বসে কাঁদছে । তার মন খারাপ হয়েছে প্রমিতের কারণে । প্রমিত আজ তার গালে হাত তুলেছে । এর আগে কোনদিন এমন হয়নি । আকবর তাই তার কান্না আর আটকাতে
পারেনি ।
প্রমিত এখন সারাদিন একা রুমে বসে থাকে আর কার সাথে যেন কথা বলে । আকবরকে ও মানা করে দিয়েছে , অনুমতি ছাড়া ওর রুমে ঢুকতে । মানা আগেও করেছে , তবে এবার মানার সাথে থাপ্পড়ও ফ্রি বলে দিয়েছে । দুপুরে
খাবারের জন্য প্রমিতকে ডাকতে গিয়ে দেখে , সে একটা ছবির সাথে কথা বলছে। আকবর মেয়েটাকে চিনে না , তবে ওর নাম জানে , প্রমিত মাঝে মাঝেই মেয়েটাকে মেঘ বলে ।
-' মেঘ আফার লগে কতা কননি ।'
বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই থাপ্পড় খেয়ে ও বজ্রাহতের মত দাড়িয়ে রইল ।তারপর আরেকটা জোর ধমক খেয়ে রুম থেকে পালালো ।
,
প্রমিত ওর টেবিলে বসে আছে । হাতে একটা কাগজ , সেটাই টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ছে । ও এখন আর আগের সেই প্রমিত নেই । এখন ওর মাথা থেকে আর কবিতা বেরোয় না । সেখানে একটা মেয়ে বাসা বেধেছে । মেয়েটার পরিচয় কি সে জানে না , কিন্তু মেয়েটার পরিচয় জানা ওর জন্য খুবই দরকারি হয়ে পড়েছে । মেয়েটা এখন তার সাথে দিনরাত কথা বলে , হাসে, কাঁদে । সে মেয়েটাকে অনেক বার জিজ্ঞেস করেছে , ওর বাসা কোথায় । কিন্তু জবাবে সেই বিখ্যাত রহস্যময় হাসি ছাড়া আর কিছু পায়নি । সে জানে , সে ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে । এখানে একা থাকার সিদ্ধান্তটা তার অনেক বড় ভুল । অসামাজিক হয়ে বেশিদিন টিকা যায় না ; সমাজের উপাদানগুলোর অভাবে একসময় শ্বাস বন্ধ হয়ে ব্যক্তিটা চলে যায় দুনিয়া থেকে।
,

,
ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে প্রমিত রেডি হয়ে বসে আছে । ওর ভ্রূ কুঁচকে আছে , দেখেই বুঝা যাচ্ছে বিরক্ত । বিরক্ত হবার মত বেশি লোক নেই বাসায় । আকবর রেডি হতে দেরি করছে । আজ তারা দুজন ঢাকা চলে যাবে । মিরপুরের দিকে একটা কলেজে প্রমিত টিচারের চাকরি জোগাড় করেছে । সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কোনদিন কবিতা লিখবে না; ছবিও আঁকবে না। মেঘের সবগুলো ছবি সে পুড়িয়ে ফেলেছে, শুধু ১ম দিন আঁকা ছবিটা রেখে দিয়েছে স্মৃতি হিসেবে।
এটা সেটা ভাবছে , এইসময় আকবর এসে রুমে ঢুকল । প্রমিত ভাবল , সে মনে হয় রেডি হয়ে এসেছে; কিন্তু ওর পড়নে একটা গামছা । রেগে কষে একটা ধমক দিবে , তখন দেখল ওর হাতে একটা চিঠি ।
শিক্ষামন্ত্রী পাঠিয়েছেন। প্রমিত চিঠিটি খুলল, -' emergancy come to PG hospital. your teacher , Munir. "
প্রমিত আকবরের দিকে তাকাল , সে গামছা পড়ে দাড়িয়ে ।
-' জলদি কাপড় পড় । কাপড় গোছাতে হবে না । আজ আর ঢাকায় ট্র্যান্সফার হওয়া যাবে না । মন্ত্রীর জরুরী তলব এসেছে । '
প্রাইম মিনিস্টারের তলবকে এড়িয়ে যাওয়া যায় , মন্ত্রীর তলবকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না । সেটা ওহীর মতই জেঁকে বসে মনের ভিতর ।
,
হসপিটালের করিডোরে মুনির সাহেব বসে । ওনার আশেপাশে সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা সার্কেল তৈরি করে রেখেছে । মুনির সাহেব প্রমিতকে দেখে সামনে এগিয়ে এলেন । আকবর ওর পিছনে দাড়িয়ে । স্যার দুজনের দিকে
কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ; তারপর প্রমিতের হাত ধরে কিনারে টেনে নিলেন । মনে হচ্ছে কিছু বলবেন , কিন্তু এবারো মুখ খুলে বলতে পারছেন না ।
-' স্যার কি হয়েছে । কেউ কি এক্সিডেন্ট করেছে ?'
-' শোনো , আমার মেয়ে কাল ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছে । আজ সকালে গাড়ি নিয়ে বেরোতেই এক্সিডেন্ট করল ।'
-' স্যার , আপনার মেয়ের নাম কি ?'
মুনির সাহেবের মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে , তিনি নাম বলতে ইচ্ছুক নয় ।
-' ওর নাম মেঘ ; তাসফিয়া জান্নাত মেঘ ।'
প্রমিত একটু ধাক্কার মত খেল । বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের দিনের কথা তার মনে পড়ল । রহস্য নিয়ে বেঁচে থাকা খুবই কষ্টের । প্রমিত একটু খুশিই হল ; অনেক দিনের পুরনো রহস্যের কিনারা করতে পারল ।
-' তুমি এখন ভিতরে যাবে , মেঘের সাথে কথা বলবে ।'
প্রমিতের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হল জিজ্ঞেস করে, সে কি কথা বলবে । কিন্তু্‌, ওর ভিতরে কেউ একজন যেন ওকে বলছে , ওর কথা বলতে হবে । মেয়েটার হয়ত ওকে খুব জরুরী !
,
ও ভিতরে প্রবেশ করে দেখল , মেঘ ওর দিকে পাশ ফিরে অপর পাশে শুয়ে আছে । মেয়েটার হাত মারাত্মক ভাবে জখম হয়েছে । ভিতরে অল্প বয়সী এক নার্স । ওকে চোখের ইশারায় সামনে যাওয়ার ইশারা দিয়ে নার্স বাইরে বেড়িয়ে
গেল । মেয়েটার সামনে এসে দাঁড়াল সে । দেখল , পাতলা সাদা চাদর দিয়ে ওর মুখ ঢাকা । প্রমিতের ইতস্তত অনুভূত হচ্ছে , মুখ থেকে চাদরটা সরাবে কিনা । অবশেষে দ্বিধ্বা ঝেরে মুখ থেকে চাদর সরাল । সাথে সাথে প্রচণ্ড ভয়ে ও ছিটকে পিছনে পড়ে গেল । টেবিলের ওষুধের বোতলমাটিতে পড়ে ভেঙে গেল নিমিষেই । মেয়েটা চোখ খুলে তাকাল । মুখে আঘাতের চিহ্ন । ওকে দেখে মুখে এক গভীর তৃপ্তির আভা ছড়িয়ে পড়ল তার ; যেন অনেক আকাঙ্ক্ষার কারো দেখা পেল আজ ।
-' ভয় পাবেন না ।' ক্ষীণ স্বরে বলল মেঘ ।
-' আ-আ-আপনি কে ?'
-' আমি মেঘ , আপনার কল্পনার রাজকুমারী মেঘ ।' বলেই হেসে উঠল।
প্রমিত অবাক হয়ে গেল , মনে হচ্ছে যেন কাচের ঝিরঝির টাইপের শব্দ । ঠিক ওর স্বপ্নের সেই মেয়েটির মত । সেই মেয়েটি কেন ভাবছে ; ও ত সেই মেয়েই!
ধীরে ধীরে উঠে মেয়েটির পাশে গিয়ে বসল প্রমিত । ওর মনে হচ্ছে , ওর এখন নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই । মেয়েটির চোখের ইশারায় ওর হৃদয় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে । হাতটা মেঘের কপালে রাখল সে । মেঘ চোখ বনধ করে ফেলল । ওর মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠল ; প্রমিতও ওর সাথে হাসছে । চোখ খুলে মেঘ বলতে শুরু করে
-' জানেন ,আমার যখন ৫ বছর বয়স , সেই সময় আমার মা মারা যায় । বাবা আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান । চিন্তাটা আমার মানসিক প্রয়োজনের কথা ভেবে না ; আমার মা-ই আমাকে দেখে-শুনে রাখত । বাবা আমার কোন খোঁজ নিত না । অবশেষে আমার জন্য একটা যুগান্তকারী বুদ্ধি বের করল , আমাকে ক্যালিফোর্নিয়ায় আমার খালার কাছে পাঠিয়ে দিল ।সেই অব্দি আজ পর্যন্ত মাত্র দুবার আমার সাথে দেখা করতে যায় । একবার যায় আমি যখন ১০ বছর বয়সী ছিলাম তখন , আর গতবছর একবার দেখে আসে আমাকে ।
বাবা কখনওই আপনার লেখা বইটা আমাকে পড়তে দিত না । আর আমিও জানতাম ই না; বইটা চাচাতো বোন দিয়া আমাকে পাঠায় , বাবা জানতে পারেনি যে বইটা আমি পড়েছি ; জানতে পারলে দিয়াকে জেলে পাঠাত । দিয়াকে ওর প্রতিদান আমি আগেই দিয়েদিয়েছি , এবার আপনার পালা ।'
আপনার বইটি ১ম যেদিন হাতে পাই , আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না , নিজের মনকেও না ।
এতটা কিভাবে সম্ভব ? অবিকল আমার ছবি , আমার নামে কবিতা , আমার প্রিয় সব কথা । '
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেঘ। অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আবারো বলা শুরু করলো,
- 'বাবাকে না জানিয়েই কাল দেশে এসেছি । বাবা বেশ অবাক হয় , কিন্তু কিছু বলেনি । অনেকদিন পর মেয়েকে দেখতে পেয়ে হয়ত অনেক খুশিই হয়েছে । তারপর আজ কাউকে না জানিয়ে আপনার সাথে দেখা করতে বেরিয়েছিলাম । জানতে চাইবেন না ঠিকানা কোত্থেকে পেয়েছি । এরপর ত ,,, দেখছেনই । এক দিক দিয়ে ভালই হল ; বাবাকে আমি মন থেকে ঘৃণা করতাম । কিন্তু এক্সিডেন্টের পর বাবা আমার হাত ধরে বাচ্চাদের মত কেঁদেছে । শুনেছি ,
বাবা নিজেই নাকি আপনাকে আনার ব্যবস্থা নিয়েছে । সিদ্ধান্ত নিয়েছি , বাবাকে আমি ক্ষমা করে দিব ।
,

,
এক নাগারে অনেক কথা বলে ফেলল মেঘ । প্রমিত মাথা নিচু করে কথা শুনে যাচ্ছে ; কিছুই বলছে না। ওর মন আদ্র হয়ে গেছে , প্রাণপণ চেষ্টা করছে না কাঁদতে । কোনদিনও কারো সামনে কাদেনি সে ।
-' আমি কোনদিনও জানতে চাইব না আমি আপনার বইয়ে কি করে এলাম, জানতে চাইব না , আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন কিনা ।
আমি শুধু চাইব , যেদিন বৃষ্টি হবে , দুজন এক সাথে বৃষ্টিতে ভিজব । বৃষ্টিতে ভিজে আপনার ঠাণ্ডা লাগলে আমি আপনাকে বকে দিব। দুজন মিলে গভীর রাতে বনে চলে যাব জ্যোৎস্না রাতে ; আপনি কবিতা লিখবেন, আমি গভীর আগ্রহে শুনবো ...'
,
,
মুনির সাহেব জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন । মেঘ আর প্রমিত হাসছে না কাঁদছে বুঝা যাচ্ছে না । ওদের দেখে মনে হচ্ছে হাসছে , কিন্তু দুজনেরই চোখ ভেজা । মুনির সাহেবের পড়নে লাল রঙের শার্ট ; চোখের পানিতে কখন যে নিজের শার্টই ভিজে গেছে বলতেও পারবেন না । আর ওর পাশেই দাঁড়ানো আকবর । ওর চোখও ভেজা ।
একটা ছোট্ট বাচ্চা ওনার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল । ওনাকে দেখে বাবাকে বলল ,
-' বাবা বাবা দেখ , এত বড় লোকটা বাবুদের মত কাঁদছে ।'
মুনির সাহেব বাবুটার দিকে তাকালেন । ওনার মনে হল , একদম মেঘের ছোট বেলার মত বাবুটা । বাবুটার বাবা হকচকিয়ে গেল । মন্ত্রীকে উনার চেনা আছে । অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে এসেছিলেন , এখন মেয়েটা আবার মন্ত্রীকে নিয়ে মজা শুরু করেছে ।
মুনির সাহেব বাবুটাকে কোলে নিলেন ,ওনার মুখ হাসি হাসি । বাবুটা সুন্দর করে ওর চোখ মুছে দিল ।
-' আর কখনও কেঁদো না , কেমন ? আব্বু আম্মু যখন কাঁদে , তখনও আমি এভাবে ওদের কান্না এভাবে মুছে দেই ।'
মুনির সাহেব চমৎকৃত হলেন ; ওর বাবার দিকে তাকালেন , সে মুখে লজ্জা মেশানো হাসি ।
-' তোমার নাম কি বাবু ?'
-' আমার নাম মেঘ । আমার আম্মু অসুস্থ , তাকে দেখতে এসেছি ।'
-' তাই ? জান , আমার আম্মুর নামও ত মেঘ ! আমার আম্মুও না অনেক অসুস্থ , চল , আগে তোমার আম্মুকে দেখব , পরে আমার আম্মুকে দেখব । তোমার নাম কি ?'
-' আকবর '
-' তুমিও আমাদের সঙ্গে চল '
আকবর এতক্ষণ মুনির সাহেবের সাথে দাড়িয়ে ছিল , সেটা উনার চোখেই পড়েনি ।
ওরা এগিয়ে চলল , ভদ্রলোক পিছনে পিছনে আসছেন , ওনার চোখও ভিজে গেছে , কিন্তু উনি মুছছেন না । তার সাদা শার্টটাও পানিতে ভিজে যাচ্ছে । ভিজুক, একদিন কাঁদলে কিচ্ছু হয় না।
,
-' মেঘ '
-' হুম ?'
-' তোমাকে নিয়ে নতুন একটা বই লিখব ভাবছি ।'
মেঘ শোয়া অবস্থায়ই লাফ দিয়ে উঠার মত অবস্থা । প্রমিত ওর কপালে হাত দিয়ে রেখেছিল , নয়ত উঠেই পড়ত ।
-' তাইইইইইইইইই ! কি বই লিখবেন ?'
-' মেঘ-বৃষ্টির কাব্য ।'
প্রমিতের কথা শুনে মেঘ হেসে উঠল ; প্রমিত আবারো হতভম্ব হয়ে পড়ল । এত সুন্দর করে মানুষ কি করে হাসে ?
মেঘ হেসেই চলেছে । মেঘের ডান হাতে একটা বই , বইয়ের নাম ' মেঘের ছায়া '
হেমন্তকাল , এসময়ে সাধারণত বৃষ্টি হয় না । কিন্তু আজ হঠাৎ করে বৃষ্টি নেমেছে । প্রমিত জানালাটা খুলে দিল। বাইরে আমগাছ টা প্রচন্ড বাতাসে দুলছে। চারিদিকে তুমুল বাতাসের তাণ্ডব , সে বাতাসের শব্দ ভেদ করে মেঘের হাসির শব্দ হাসছে । এই মেয়েটা এত হাসতে পারে ! প্রমিতের মনে হচ্ছে , এই মেয়েটা সারাজীবনই ওকে অবাক করে যাবে। ভালোবাসার ছায়ায় ওকে ঢেকে রাখবে আজীবন ....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন