পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত হতে থাকে, নীড় হারা পাখি গুলো আকাশে-বাতাসে উড়ে উড়ে নীড়ে যেতে থাকে। ব্যস্ত শহরের মানুষ গুলো জীবিকা শেষ করে কেউ নিজের গাড়ি চড়ে, আবার কেউ অন্যের গাড়ি চড়ে বাসায় ফিরতে থাকে।
কিন্তু একটা ছেলের কোন তাড়া নেই, কোন চিন্তা নেই, কোন ভাবনাও নেই, সে তার মত করেই চলছে। শুধু তার একটাই চিন্তা, একটাই ভাবনা, কিভাবে একটা বোতল তার ব্যাগে ভরতে পারবে। সে একা নয়, তার মত এরকম আরও অনেক ছেলে-মেয়ে এভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কারণ বোতল গুলো তাদের মালিকের কাছে জমা দিলে কিছু টাকা পাবে সেই টাকা দিয়ে তাদের ক্ষুুধার্ত পেট গুলো একটু হলেও ঠান্ডা করতে পারবে।
•
ধীরে ধীরে সন্ধা হয়ে যায়। পাখিরা গাছে বসে কিচিরমিচির করতে থাকে। কিছু মানুষ বাসায় চলে যেতে থাকে। আর কিছু মানুষ বিভিন্ন কাজে আটকে থাকে। বিভিন্ন মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি শুনা যেতে থাকে।
এখন শীতকাল, তাই আস্তে আস্তে কুয়াশাও পড়তে থাকে।কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ ছাড়া প্রায় প্রত্যেকের গায়েই দামী বা কম দামী শীতের পোশাক পড়া থাকে।
.
ঐ ছেলেটা বোতল খুঁজা শেষ করে মালিকের দোকানে যেতে থাকে। হঠাৎ ডাসটবিনের পাশ থেকে কান্নার আওয়াজ শুনে তার হাঁটার গতি থামিয়ে দেয়।
সে কাছে যেতেই দেখে একটা বাচ্চা মেয়ে কান্না করতেছে। মেয়েটার কান্না দেখে তাদের সবার চোখে পানি এসে পরে।কারণ তারাও যে একই পথের পথিক ছিল।
তারপর ঐ ছেলে ও আর একটা মেয়ে বাচ্চটাকে নিয়ে বস্তিতে ফিরতে থাকে, আর অন্যরা বোতল গুলো জমা দিতে মালিকের কাছে যেতে থাকে।
•
গল্পের ছেলেটার নাম আকাশ। তার বয়স মাত্র দশ বছর। এখন তার স্কুলে পড়ার কথা কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সে রাস্তার ছেলে পরিচিতি লাভ করে। তার সাথে যে ছেলে-মেয়ে গুলো আছে তারাও তার মতই; কারো বয়স ছয়, কারো সাত,কারো আট, আবার কারো নয়।
কারো নাম রহমত, কারো নাম বেলী, কারো নাম আরিফ, কারো নাম আলী। আকাশকে পেয়েছিল এক মহিলা। ঐ মহিলাকেই সে মা বলে ডাকতো এবং মা বলেই চিনতো। কিন্তু একদিন তার এই মা তাকে বলে
.
- বাজান! বাজান! একটা কথা কইতাম, কিন্তু কথাটা যে তরে কিভাবে কই!
তখন সে বলে
- কও মা কি কইবা
- কথাটা শুনে তুই মন খারাপ করতে পারবি না, কথা দে
- আচ্ছা মন খারাপ করতাম না।
- আমি তোকে একদিন রাস্তা থেকে পাইছিলাম।
এই কথাটা বলার সময় উনার গলাটা কিরকম যেন ধরে আসে ও চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরে।
কথাটা শুনে সে শুধু তার মায়ের দিকে মলিন মুখে তাকিয়েই ছিল, ভাল বা মন্দ কিছু বলতে পারেনি।
.
ঐ-দিন সে একা একা চিৎকার করে বাবা-মা বলে ডেকে ডেকে কেঁদেছিল। তার এই কান্না কাউকে দেখতে দেয়নি। কিন্তু তার এই মায়ের কাছে লুকাতে পারেনি। তার কান্না দেখে, দূর থেকে তার মাও সাথে সাথে কেঁদেছে। তখন দূর থেকেই বলতে থাকে
- বাজান! ও বাজান! আর কাঁদিস না, তোর কান্না না আমি সহ্য করতে পারছি না, বাজান না ভালা আর কাঁদিস না।
কিন্তু এই কথা তো আকাশের কানে যায় না, তাই তার কান্নাও থামে না।
.
ঐ-দিন এর পর থেকে সে কি-রকম যেন হয়ে যায়। কারো সাথে ঠিকমত কথা বলতে পারতো না, কারো সাথে ঠিকমত চলতে পারতো না। কেমন যেন পাল্টে যায়, কিভাবে যে পাল্টে যায়, সে নিজেও জানে না, নিজেও বোঝে না।
•
মাঝে মাঝে আকাশ একা একাই চিন্তা করতো তার বাবা-মা দেখতে কি রকম ছিল। আবার কখনো তার বাবা-মাকে নিয়ে কল্পনার জগতে হারিয়ে যেত।
সে কল্পনাই দেখতো তার বাবা-মা তাকে নিয়ে গল্প করতেছে, সে গল্প শুনে শুনে ঘুমানোর চেষ্টা করতেছে। আবার দেখতো, তাকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে, ঘুরা-ফেরা করছে, এটা সেটা কিনে দিচ্ছে এবং এটা সেটা খাইয়েও দিচ্ছে। আবার বাসায় ফিরার পথে তার সাথে মজা করছে।
যখন কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসতো। তখন সে অনুভব করত তার চোখ বেয়ে পানি পরছে। তারপর রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে চিৎকার করে বাবা-মা বলে ডাকতো আর চোখের পানি ফেলতো।
.
সে কেঁদে কেঁদে বলতো
- মা! ও মা! বাবা! ও বাবা! তোমরা কই বল? ও মা ও বাবা! তোমাদেরকে না দেখতে খুব ইচ্ছা করতাছে। একবার দেখা দিবে এই ছেলেটাকে! দেও না একটা বার দেখা একটা বার দেখা দিলে কি এমন দোষ হবে? কি এমন ক্ষতি হবে? ও মা! ও বাবা! বল না?
.
আচ্ছা বাবা! আচ্ছা মা! একটা কথা আমারে কইবা আমার কোন দোষের জন্য আমারে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেয়েছিলে! আমার কোন অপরাধের জন্য এভাবে বড় হতে হচ্ছে? এই কথাটা একবার বল বা(কেঁপে কেঁপে কেঁদে ওঠে আর এভাবে বলতে থাকে)
.
কিন্তু তার বাবা-মা কি করে শুনবে! কি করে বলবে! কি করে দেখা করবে! তাদের তো এই সময় নেয়। এসব নোংরা কাজ করার পরেও তাদের মনে কোন অপরাধ বোধ কাজ করছে না। মরলে কতটুকু শাস্তি পাবে এটাও তারা ভাবছে না, চিন্তা করছে না। কারণ তারা তো আছে রং তামাশায় মেতে।
.
তার এই মা দূর থেকে সব দেখতো আর নীরবে চোখের জল ফেলতো। কিছু বলতে পারতো না, কিছু করতে পারতো না, আবার মুখ বুজে নীরবে সহ্যও করতে পারতো না। এভাবে প্রায় দিনেই আকাশ কাঁদতো আর উনি দূর থেকে চোখের জল ফেলতো।
•
আকাশ ও বেলী বাচ্চাটাকে নিয়ে এসে তার মাকে ডাকতে থাকে।
- মা! মা! ও মা! তাড়াতাড়ি আইসা দেইখা যাও।
তার মা ভিতর থেকে বলে
- কিরে বাজান কি হইছে?
- আইসা দেইখা যাও কারে আনছি।
তার কোলে বাচ্চা দেখে তার মা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। উনি দেখেন যে তার কোলে বাচ্চাটা শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, ভাই বোনের অনেক দিন দেখা হয়নি। তাই আজ ভাইকে পেয়ে চুপ হয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে সব কিছু খুলে বলে।
তারপর উনি বাচ্চাটার সেবা যত্ম করতে থাকেন। কি সুন্দর মুখ, কি সুন্দর চোখ, কি সুন্দর চেহারা দেখলেই যেন তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। দেখলেই যেন আদর করতে ইচ্ছা করে।
.
কিন্তু এই রকম একটা বাচ্চাকে কিভাবে ডাসটবিনে ফেলে দিতে পারে আকাশের মা ভেবে পায় না। এই বাচ্চাটার কোন দোষের জন্য কোন অপরাধের জন্য তাকে এভাবে ফেলে দিতে হয়েছে! তিনি এটাও ভেবে পান না। তিনি তো তার কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছেন না। তাহলে কেন তাকে ফেলে দিয়ে গেল? তিনি যা মনে করেন সব দোষ তার বাবা-মার ছিল।
তারা নোংরামী ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে।একটু সুখের জন্য অসামাজিক কাজ করে। তারপর পাপের ফলকে ডাসটবিনে ফেলে, মেরে ফেলে বা অন্যকিছু করে। আর যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে তখন তারা আত্মহত্যা করে বা জীবন্ত লাশ হিসেবে বেঁচে থাকে। কিন্তু এসবের মানে কি? কেন এসব করতে হয়? তিনি ভেবে পান না।
•
গভীর রাতে বাচ্চাটা কান্না আরম্ভ করে। কিন্তু তখন এই কান্না কেউ থামাতে পারে না। তখন আকাশ কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে
- বোন! এই বোন! কান্দিছ না রে কান্দিছ না। আমাদের যে কাঁন্দন সাজে না, কেন তুই বুঝিস না! এই বোন কান্না করিস না, তোর কান্না না যে আমি সহ্য করতে পারছি না।
- কিন্তু সে কান্না করেই যাচ্ছে তার কোন কথা শুনছে না। কি করে শুনবে? কি করে বুঝবে? তার যে শুনার ও বোঝার সে বয়স হয়নি।
তখন আকাশ তার মাকে বলতে থাকে
- মা! ও মা! বোনকে বল না কাঁন্দা বন্ধ করতে, বোন কি বোঝে না! তার কান্না আমি সহ্য করতে পারছি না।
তখন তার মা বলতে থাকে
- বাজান! ও বাজান! কত করেই তো কইতাছি; কিন্তু সে তো কোন কথায় শুনে না, বোঝে না। কি করেই শুনবে বা কি করেই বুঝবে সে ক্ষমতা তো তার হয়নি।
.
সকালে আকাশের ঘুম ভাংলে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখে, তার এই বোন তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে মুখটা ছুঁয়ে দিতেই একটা হাসি দেয়। এই হাসিটা দেখে তার মনটা আনন্দে ভরে যায়।তারপর এই বোনের সাথে খেলায় মেতে উঠে।তার বোনও তার সাথে খেলতে শুরু করে।
.
আকাশ তার এই বোনের নাম দেয় মায়া। কারণ তার চেহারাটার মাঝে যে অনেক মায়া ছিল।মায়া বলে ডাক দিতেই তাকিয়ে একটা হাসি দিত। তখন তার যে কতটুকু ভাল লাগতো বলে বোঝাতে পারবে না।এখন এই বোনকে নিয়ে তার একটা নতুন পৃথিবী তৈরি হয়ে যায়।
.
দেখতে দেখতে দিন গুলি কেটে যেতে থাকে। মায়া বড় হতে থাকে। কখনো ভায়ের সাথে, কখনো মায়ের সাথে, আবার কখনো অন্যদের সাথে দুষ্টামি করতো , খেলা করতো। তারাও তার সাথে সাথে দুষ্টামি করতো, খেলা করতো, আনন্দে মেতে থাকতো। কিন্তু কোন কোন সময়ে সে যখন কান্না আরম্ভ করতো তখন তার এই কান্না কেউ থামাতে পারতো না। তখন তার দেখাদেখি সবাই কাঁদতো।
•
তখন তার ভাই বলতো, বোন! এই বোন! কান্না করিস না। কেন কান্না করিস? তুই বুঝিস না তুই কাঁন্না করলেও তোর বাবা-মা শুনবে না, তোকে দেখতে আসবে না। যদি তোকে দেখতই তোর জন্য মায়া হতোই তাহলে কি তোকে ফেলে দিয়ে যেত?
মা! এই মা! বোনকে বল না কান্না না করতে, সে কেন বোঝে না তার কান্না সাজে না। ও মা! তাকে বল না! এভাবে আকাশ বলে আর কাঁদে।তার সাথে তার মা ও অন্যেরাও কাঁদে।
.
এভাবেই সুখে-দুঃখে, হাসি-আনন্দে মায়ের আদর ভালোবাসা শাষণ পেয়ে তারা বড় হতে থাকে।কিন্তু প্রকৃত বাবা-মায়ের আদর ভালোবাসা শাষণ পায় না।কোনদিন পাবে কিনা সেটাও তারা জানে না।
কিন্তু একটা ছেলের কোন তাড়া নেই, কোন চিন্তা নেই, কোন ভাবনাও নেই, সে তার মত করেই চলছে। শুধু তার একটাই চিন্তা, একটাই ভাবনা, কিভাবে একটা বোতল তার ব্যাগে ভরতে পারবে। সে একা নয়, তার মত এরকম আরও অনেক ছেলে-মেয়ে এভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কারণ বোতল গুলো তাদের মালিকের কাছে জমা দিলে কিছু টাকা পাবে সেই টাকা দিয়ে তাদের ক্ষুুধার্ত পেট গুলো একটু হলেও ঠান্ডা করতে পারবে।
•
ধীরে ধীরে সন্ধা হয়ে যায়। পাখিরা গাছে বসে কিচিরমিচির করতে থাকে। কিছু মানুষ বাসায় চলে যেতে থাকে। আর কিছু মানুষ বিভিন্ন কাজে আটকে থাকে। বিভিন্ন মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি শুনা যেতে থাকে।
এখন শীতকাল, তাই আস্তে আস্তে কুয়াশাও পড়তে থাকে।কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ ছাড়া প্রায় প্রত্যেকের গায়েই দামী বা কম দামী শীতের পোশাক পড়া থাকে।
.
ঐ ছেলেটা বোতল খুঁজা শেষ করে মালিকের দোকানে যেতে থাকে। হঠাৎ ডাসটবিনের পাশ থেকে কান্নার আওয়াজ শুনে তার হাঁটার গতি থামিয়ে দেয়।
সে কাছে যেতেই দেখে একটা বাচ্চা মেয়ে কান্না করতেছে। মেয়েটার কান্না দেখে তাদের সবার চোখে পানি এসে পরে।কারণ তারাও যে একই পথের পথিক ছিল।
তারপর ঐ ছেলে ও আর একটা মেয়ে বাচ্চটাকে নিয়ে বস্তিতে ফিরতে থাকে, আর অন্যরা বোতল গুলো জমা দিতে মালিকের কাছে যেতে থাকে।
•
গল্পের ছেলেটার নাম আকাশ। তার বয়স মাত্র দশ বছর। এখন তার স্কুলে পড়ার কথা কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সে রাস্তার ছেলে পরিচিতি লাভ করে। তার সাথে যে ছেলে-মেয়ে গুলো আছে তারাও তার মতই; কারো বয়স ছয়, কারো সাত,কারো আট, আবার কারো নয়।
কারো নাম রহমত, কারো নাম বেলী, কারো নাম আরিফ, কারো নাম আলী। আকাশকে পেয়েছিল এক মহিলা। ঐ মহিলাকেই সে মা বলে ডাকতো এবং মা বলেই চিনতো। কিন্তু একদিন তার এই মা তাকে বলে
.
- বাজান! বাজান! একটা কথা কইতাম, কিন্তু কথাটা যে তরে কিভাবে কই!
তখন সে বলে
- কও মা কি কইবা
- কথাটা শুনে তুই মন খারাপ করতে পারবি না, কথা দে
- আচ্ছা মন খারাপ করতাম না।
- আমি তোকে একদিন রাস্তা থেকে পাইছিলাম।
এই কথাটা বলার সময় উনার গলাটা কিরকম যেন ধরে আসে ও চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরে।
কথাটা শুনে সে শুধু তার মায়ের দিকে মলিন মুখে তাকিয়েই ছিল, ভাল বা মন্দ কিছু বলতে পারেনি।
.
ঐ-দিন সে একা একা চিৎকার করে বাবা-মা বলে ডেকে ডেকে কেঁদেছিল। তার এই কান্না কাউকে দেখতে দেয়নি। কিন্তু তার এই মায়ের কাছে লুকাতে পারেনি। তার কান্না দেখে, দূর থেকে তার মাও সাথে সাথে কেঁদেছে। তখন দূর থেকেই বলতে থাকে
- বাজান! ও বাজান! আর কাঁদিস না, তোর কান্না না আমি সহ্য করতে পারছি না, বাজান না ভালা আর কাঁদিস না।
কিন্তু এই কথা তো আকাশের কানে যায় না, তাই তার কান্নাও থামে না।
.
ঐ-দিন এর পর থেকে সে কি-রকম যেন হয়ে যায়। কারো সাথে ঠিকমত কথা বলতে পারতো না, কারো সাথে ঠিকমত চলতে পারতো না। কেমন যেন পাল্টে যায়, কিভাবে যে পাল্টে যায়, সে নিজেও জানে না, নিজেও বোঝে না।
•
মাঝে মাঝে আকাশ একা একাই চিন্তা করতো তার বাবা-মা দেখতে কি রকম ছিল। আবার কখনো তার বাবা-মাকে নিয়ে কল্পনার জগতে হারিয়ে যেত।
সে কল্পনাই দেখতো তার বাবা-মা তাকে নিয়ে গল্প করতেছে, সে গল্প শুনে শুনে ঘুমানোর চেষ্টা করতেছে। আবার দেখতো, তাকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে, ঘুরা-ফেরা করছে, এটা সেটা কিনে দিচ্ছে এবং এটা সেটা খাইয়েও দিচ্ছে। আবার বাসায় ফিরার পথে তার সাথে মজা করছে।
যখন কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসতো। তখন সে অনুভব করত তার চোখ বেয়ে পানি পরছে। তারপর রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে চিৎকার করে বাবা-মা বলে ডাকতো আর চোখের পানি ফেলতো।
.
সে কেঁদে কেঁদে বলতো
- মা! ও মা! বাবা! ও বাবা! তোমরা কই বল? ও মা ও বাবা! তোমাদেরকে না দেখতে খুব ইচ্ছা করতাছে। একবার দেখা দিবে এই ছেলেটাকে! দেও না একটা বার দেখা একটা বার দেখা দিলে কি এমন দোষ হবে? কি এমন ক্ষতি হবে? ও মা! ও বাবা! বল না?
.
আচ্ছা বাবা! আচ্ছা মা! একটা কথা আমারে কইবা আমার কোন দোষের জন্য আমারে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেয়েছিলে! আমার কোন অপরাধের জন্য এভাবে বড় হতে হচ্ছে? এই কথাটা একবার বল বা(কেঁপে কেঁপে কেঁদে ওঠে আর এভাবে বলতে থাকে)
.
কিন্তু তার বাবা-মা কি করে শুনবে! কি করে বলবে! কি করে দেখা করবে! তাদের তো এই সময় নেয়। এসব নোংরা কাজ করার পরেও তাদের মনে কোন অপরাধ বোধ কাজ করছে না। মরলে কতটুকু শাস্তি পাবে এটাও তারা ভাবছে না, চিন্তা করছে না। কারণ তারা তো আছে রং তামাশায় মেতে।
.
তার এই মা দূর থেকে সব দেখতো আর নীরবে চোখের জল ফেলতো। কিছু বলতে পারতো না, কিছু করতে পারতো না, আবার মুখ বুজে নীরবে সহ্যও করতে পারতো না। এভাবে প্রায় দিনেই আকাশ কাঁদতো আর উনি দূর থেকে চোখের জল ফেলতো।
•
আকাশ ও বেলী বাচ্চাটাকে নিয়ে এসে তার মাকে ডাকতে থাকে।
- মা! মা! ও মা! তাড়াতাড়ি আইসা দেইখা যাও।
তার মা ভিতর থেকে বলে
- কিরে বাজান কি হইছে?
- আইসা দেইখা যাও কারে আনছি।
তার কোলে বাচ্চা দেখে তার মা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। উনি দেখেন যে তার কোলে বাচ্চাটা শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, ভাই বোনের অনেক দিন দেখা হয়নি। তাই আজ ভাইকে পেয়ে চুপ হয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে সব কিছু খুলে বলে।
তারপর উনি বাচ্চাটার সেবা যত্ম করতে থাকেন। কি সুন্দর মুখ, কি সুন্দর চোখ, কি সুন্দর চেহারা দেখলেই যেন তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। দেখলেই যেন আদর করতে ইচ্ছা করে।
.
কিন্তু এই রকম একটা বাচ্চাকে কিভাবে ডাসটবিনে ফেলে দিতে পারে আকাশের মা ভেবে পায় না। এই বাচ্চাটার কোন দোষের জন্য কোন অপরাধের জন্য তাকে এভাবে ফেলে দিতে হয়েছে! তিনি এটাও ভেবে পান না। তিনি তো তার কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছেন না। তাহলে কেন তাকে ফেলে দিয়ে গেল? তিনি যা মনে করেন সব দোষ তার বাবা-মার ছিল।
তারা নোংরামী ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে।একটু সুখের জন্য অসামাজিক কাজ করে। তারপর পাপের ফলকে ডাসটবিনে ফেলে, মেরে ফেলে বা অন্যকিছু করে। আর যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে তখন তারা আত্মহত্যা করে বা জীবন্ত লাশ হিসেবে বেঁচে থাকে। কিন্তু এসবের মানে কি? কেন এসব করতে হয়? তিনি ভেবে পান না।
•
গভীর রাতে বাচ্চাটা কান্না আরম্ভ করে। কিন্তু তখন এই কান্না কেউ থামাতে পারে না। তখন আকাশ কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে
- বোন! এই বোন! কান্দিছ না রে কান্দিছ না। আমাদের যে কাঁন্দন সাজে না, কেন তুই বুঝিস না! এই বোন কান্না করিস না, তোর কান্না না যে আমি সহ্য করতে পারছি না।
- কিন্তু সে কান্না করেই যাচ্ছে তার কোন কথা শুনছে না। কি করে শুনবে? কি করে বুঝবে? তার যে শুনার ও বোঝার সে বয়স হয়নি।
তখন আকাশ তার মাকে বলতে থাকে
- মা! ও মা! বোনকে বল না কাঁন্দা বন্ধ করতে, বোন কি বোঝে না! তার কান্না আমি সহ্য করতে পারছি না।
তখন তার মা বলতে থাকে
- বাজান! ও বাজান! কত করেই তো কইতাছি; কিন্তু সে তো কোন কথায় শুনে না, বোঝে না। কি করেই শুনবে বা কি করেই বুঝবে সে ক্ষমতা তো তার হয়নি।
.
সকালে আকাশের ঘুম ভাংলে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখে, তার এই বোন তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে মুখটা ছুঁয়ে দিতেই একটা হাসি দেয়। এই হাসিটা দেখে তার মনটা আনন্দে ভরে যায়।তারপর এই বোনের সাথে খেলায় মেতে উঠে।তার বোনও তার সাথে খেলতে শুরু করে।
.
আকাশ তার এই বোনের নাম দেয় মায়া। কারণ তার চেহারাটার মাঝে যে অনেক মায়া ছিল।মায়া বলে ডাক দিতেই তাকিয়ে একটা হাসি দিত। তখন তার যে কতটুকু ভাল লাগতো বলে বোঝাতে পারবে না।এখন এই বোনকে নিয়ে তার একটা নতুন পৃথিবী তৈরি হয়ে যায়।
.
দেখতে দেখতে দিন গুলি কেটে যেতে থাকে। মায়া বড় হতে থাকে। কখনো ভায়ের সাথে, কখনো মায়ের সাথে, আবার কখনো অন্যদের সাথে দুষ্টামি করতো , খেলা করতো। তারাও তার সাথে সাথে দুষ্টামি করতো, খেলা করতো, আনন্দে মেতে থাকতো। কিন্তু কোন কোন সময়ে সে যখন কান্না আরম্ভ করতো তখন তার এই কান্না কেউ থামাতে পারতো না। তখন তার দেখাদেখি সবাই কাঁদতো।
•
তখন তার ভাই বলতো, বোন! এই বোন! কান্না করিস না। কেন কান্না করিস? তুই বুঝিস না তুই কাঁন্না করলেও তোর বাবা-মা শুনবে না, তোকে দেখতে আসবে না। যদি তোকে দেখতই তোর জন্য মায়া হতোই তাহলে কি তোকে ফেলে দিয়ে যেত?
মা! এই মা! বোনকে বল না কান্না না করতে, সে কেন বোঝে না তার কান্না সাজে না। ও মা! তাকে বল না! এভাবে আকাশ বলে আর কাঁদে।তার সাথে তার মা ও অন্যেরাও কাঁদে।
.
এভাবেই সুখে-দুঃখে, হাসি-আনন্দে মায়ের আদর ভালোবাসা শাষণ পেয়ে তারা বড় হতে থাকে।কিন্তু প্রকৃত বাবা-মায়ের আদর ভালোবাসা শাষণ পায় না।কোনদিন পাবে কিনা সেটাও তারা জানে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন