তীব্র রোদে অসহায়ভাবে একা একা হেটে চলেছে মেঘ। বাহিরের পরিবেশর কোন কিছুতেই যেনো কোন মনোযোগ নেই তার। শুধুই মনে মনে ভেবে যাচ্ছে...। মনে হয় এবার আর তার ফাইনাল এক্সামটা আর দেওয়া হবে না।
বাবা মার এক মাত্র ছেলে ছিলো মেঘ। এই পৃথিবী যেনো মেঘের চির শত্রু! সেই ছোট বেলাতেই মেঘের বাবা মা এক্সিডেন্টে মারা যায়। আপন বলতেও কেউ ছিলো না। আর তাই সেই ছোট বেলা থেকেই খুব কষ্ট করে এতটা পথ আসতে হয়েছে। আজ মেঘ ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ে। এতটা পথ আসতে যে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে সেটা একমাত্র মেঘই জানে। এই পড়াশুনোর পেছনে তার বাবার রেখে যাওয়া যতটুকু সম্বল ছিলো তার প্রায় সবই শেষ হয়ে গেছে। এমন কি বাবা মার শেষ সৃতি তাদের বাসাটাও বিক্রি করতে হয়েছে। কিন্তু কিছুই যে করার ছিলো না। তবুও কষ্ট করে লেখা পড়াটা চালিয়ে যায়। একসময় ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়ে যায় সে। তার এই কষ্টের ফল সে পেতে যাচ্ছিলো কারন আড়াই মাস পরে তার ফাইনাল পরিক্ষা...মেঘের প্রিপারেশন খুবিই ভালো...তারপরেও যেনো একরাশ চিন্তা এসে গ্রাস করে মেঘকে। কারন ফাইনাল পরিক্ষার জন্য প্রায় ৫ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। কিন্তু এত গুলি টাকা কিভাবে জোগাড় করা সম্ভব। এগুলই ভাবতে ভাবতে একা একা হাটছিলো। এমনিতেই খুব কষ্ট করে এক দুটি টিউশনি করে বেশ ভালই চলে যায় কিন্তু একেবারে এত গুলি টাকা...এই কথাটা ভাবতেই মেঘের মনটা খারাপ হয়ে যায়। মেঘ ভাবে শেষ পর্যন্ত হয়তো আর তার স্বপ্ন...তার বাবা মার রেখে যাওয়া স্বপ্ন গুলি আর পূরন হবে না। এখন যেনো মেঘের বাবা মার কথা মনে পড়ে যায়। নিরবেই কেদে দেয় সে...কিন্তু এই কান্না ছিলো জলহীন। যা বাহিরে থেকে বোঝা যায় না। এভাবেই ভাবতে ভাবতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে মেঘ। আর ভাবতে পারছে না সে। তখনি পাশেই একটা হোটেল দেখতে পায়। আস্তে আস্তে মেঘ হোটলের ভেতরে যায় কিন্তু গিয়েই দেখতে পায় হোটেলের কোন সিটিই ফাকা নেই। ক্লান্ত শরীর নিয়েই দাঁড়িয়ে একটু জায়গার জন্য হোটেলের চারপাশ খুজতে থাকে। তখনি একটা সিট ফাকা দেখতে পায়। কিছু মাত্র না ভেবে মেঘ গিয়ে বসে সিটে। বসতেই ক্লান্ত চোখ দুটি বন্ধ করে বসে থাকে। চোখ খুলতেই দেখে তার সামনে একটা ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স খুব হলেও সাত বছর হবে। মেঘ তার দিকে তাকাতেই মেঘের উপরে যেনো কথার স্রোত নেমে আসে.....
~~~ এই তুমি আমার সিটে বসছো কেনো? তুমি জাননা এটা আমার সিট?(মেয়েটি)
এত ছোট্ট একটা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হলেও অনেক ভাল লাগে মেঘের।
~~ আচ্ছা এটা বুঝি আপনার সিট?(মেঘ)
~~~ হ্যা তো আমার সিট। তুমিই তো বসে পড়লা আমি কোথায় বসবো? মাটিতে?
~~ না না আপনি মাটিতে কেনো বসবেন আমিই মাটিতে বসি আর আপনিই সিটে বসেন।
~~~ কিন্তু তুমি আমার সিটে না বলে বসলা কেনো?
~~ ও হ্যা...আমার তো অনেক বড় ভুল হয়েছে!
~~~ হ্যা হয়েছে তো। এখন কান ধরো!
~~ আমি কান ধরবো? শুধু সরি বললে হবে না?
~~~ না হবে না। শুধু কান ধরলেই হবে না...উঠ বোস ও করতে হবে।
~~ দেখো আমি না ছোট্ট ছেলে...এমন শাস্তি দিলে তো মরেই যাবো।
~~~ উমমম...আচ্ছা আচ্ছা আর ধরতে হবে না। যাও তোমাকে মাফ করেই দিলাম।
মেয়েটি সিটে বসে পড়ে আর তখনি পাশের সিটও খালি হয়ে যায় সেখানে মেঘ বসে।
~~~ আচ্ছা কি নাম আপনার?(মেঘ)
~~ আমার নাম শুনে তুমি কি করবা হু? আমি ছেলেদের আমার নাম বলি না।
~~~ ওমা কেনো? নাম বলতে আপনার ভাল লাগে না?
~~ তুমি আমাকে আপনি করে কেন বলছো? আমি না অনেক ছোট।
~~~ ভয়ে বলছি তো। যদি আবার কান ধরতে বলো!
মেয়েটির সাথে কথা বলতে বলতেই মেয়েটির বাবা মা এসে পড়ে। এসেই মেয়েটিকে বোকা দিতে থাকে। কিন্তু মেঘ বাধা দেয়। মেঘ শুধু একদৃষ্টিতে সেই মেয়েটির মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
~~~ কি হয়েছে বাবা এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেনো? (মেয়েটির মা)
~~ না মানে আন্টি...আপনাকে না একদম আমার মায়ের মত দেখতে। কেমন জানি আপনাকে দেখার পরেই মনে হলো আমার মাকে দেখলাম।(মেঘ)
~~~ কেনো তোমার মা নেই?
~~ না আন্টি কেউ নেই........(কান্না সুর)
~~~ তাতে কি হয়েছে আমি তো তোমার মায়ের মতই তাই না? আমাকে মা বলেই ডাকতে পারো। আচ্ছা তুমি কি করো?
~~ আন্টি আমি ঢাকা মেডিকেলে পড়ি লাস্ট সেমিস্টার।
~~~ খুব ভালো তো। আচ্ছা আমাকে যখন তোমার মায়ের মত ভেবেইছো তখন রোজ আমার বাসায় আসবে।
~~ কিন্তু এভাবে কিভাবে রোজ যাবো....
~~~ আচ্ছা তুমি না হয় আমার এই ছোট্ট মেয়েটিকে প্রাইভেট পড়িয়ো।
~~ আচ্ছা পড়াবো কিন্তু একটা শর্ত আছে..!
~~~ কি শর্ত?
~~ আমি কিন্তু কোন টাকা নিবো না...। আপনার মেয়ে কে অনেক ভালো লেগেছে। ওকে দেখার জন্য হলেও একবার করে যাবো।
~~~ আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।
এই কথা গুলি শুনেই মেয়েটি বলে....
~~ তুমি তো এখন থেকে আমার স্যার হয়ে গেলা!
~~~ হ্যা...এবার দুষ্টামি করলে অনেক বোকা দিবো।
~~ তুমি বোকা দিতে পারবাই না। আমাকে না তোমার অনেক ভালো লাগছে।
~~~ তাই তো। আচ্ছা এবার তো স্যারকে তোমার নামটা বলো।
~~ আমার নাম জান্নাত! আমি ক্লাস টু তে পড়ি। আমাকে পড়াতে পারবা তো?
~~~ সেটাই তো মনে হয় পারবো না।
~~ না পড়লে আমি তোমাকে অনেক বকা দিবো হু। আর আমি কিন্তু তোমাকে স্যার বলবো না। ভাইয়া বলবো। আমার ভাইয়া নেই তো।
~~~ কে বলেছে নেই? এইতো আমি আছি না।
এই কথা বলেই মেঘ হেসে দেয়। কিছু সময়ের পরিচয় কিন্তু এই কিছু সময়ই যেনো মেঘ তাদের মাঝে নিজের পরিবারকে খুজে পেয়েছে। একটা নতুন বাচার যেনো আশা খুজে পেয়েছে। ফাইনাল পরিক্ষা...টাকার কথা সব কিছুই যেনো ভুলে গেছে মেঘ। ভোলবারই তো কথা...এমন সুন্দর একটা ছোট্ট মেয়ের হাসি যেনো সব কিছুই ভুলিয়ে দিতে পারে। জান্নাতের হাসিটা যেনো মেঘের বুকে গেথে গেছে। একনিমিশেই যেনো তাদের সবাইকে আপন ভাবতে লাগলো মেঘ।
®®®
মেঘ জান্নাতদের বাসায় রোজ যেতে থাকে। আস্তে আস্তে জান্নাতকে যেনো নিজের বোনের চেয়েও বেশি ভালবাসতে থাকে মেঘ। জান্নাতের মুখের হাসির জন্য সব কিছুই করতে পারতো মেঘ। আর জান্নাতের দুষ্টামি, আবদার সব জেদ গুলি যেনো মেঘের জীবনেরই একটা অংশ হয়ে যায়। জান্নাতের চকলেট খুব পছন্দ ছিলো মেঘ প্রতিদিন জান্নাতকে চকলেট দিতো... জান্নাত আবার একটা চকলেট নিতো না...তাই মেঘ জান্নাতের জন্য পকেট ভর্তি করে চকলেট নিয়ে যেতো। ভাইয়া আমি এটা খাবো না....ভাইয়া আজ তুমি আমাকে খাইয়ে দিবা....ভাইয়া আজ আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবা....ভাইয়া আজ তোমার পিঠে উঠবো....এমন হাজারো আবদার আর জেদে যেনো নতুন এক পৃথিবী গড়ে তোলে মেঘ। আর সেই জেদ সেই আবদার গুলি পুরন করার মাঝেও যেনো ছিলো এক অদ্ভুত ভালোলাগা। এভাইবেই আস্তে আস্তে যেনো মেঘ তাদের পরিবারের একজন হয়ে ওঠে। জান্নাতও মেঘকে নিজের ভাইয়ের মতই ভালবাসতো। যদি কেউ জিজ্ঞাস করতো জান্নাত বলে দিতো তারা দুই ভাই বোন।
জান্নাতকে নিয়ে সাজানো পৃথিবীতে মেঘ যে হারিয়ে ছিলো...আর তাই দেখতে দেখতে কখন যে দুই মাস চলে যায় মেঘ বুঝতেই পারে না। এদিকে তার পরিক্ষার আর মাত্র দুই সপ্তাহ মত আছে। তিন দিনের মধ্যেই সেই পাচ লাক্ষ টাকা জমা দিতে হবে। মেঘের মনে আবার সেই চিন্তা গ্রাস করে ফেলে।
এভাবেই সেদিন চিন্তায় মন খারাপ করে জান্নাতদের বাসায় যায় মেঘ। মেঘের যে মন খারাপ সেটা জান্নাত খুব ভাল করেই বুঝে যায় আর তার মাকে গিয়ে বলে দেয়। জান্নাতের মা মেঘের কাছে আসে আর মেঘের কাছে সব কথা শোনে যে তার ফাইনাল সেমিস্টার পরিক্ষা যেখানে তার পাচ লক্ষ টাকা লাগবে তাও আবার ৩ দিনের মধ্যে। সব কথা শোনার পরে জান্নাতের মা আর কিছুই বলে না। সেদিন মেঘ আর বেশিক্ষন জান্নাতদের বাসায় থাকে না। উঠে চলে যায়। রাতে বাসায় জান্নাতের বাবা আসেন আর এসেই জান্নাতের মা তার সাথে মেঘের সমস্যাটা নিয়ে কথা বলেন....
~~~ জানো মেঘের আর দুই সপ্তাহ পরে ফাইনাল সেমিস্টার পরিক্ষা। (জান্নাতের মা)
~~ হুমম শুনেছি। মেঘ তো অনেক ভালো স্টুডেন্ড দেখবা ও ঠিক অনেক ভাল কিছু করবে।(জান্নাতের বাবা)
~~~ পরিক্ষা দিতে পারলে তো করবে!
~~ কেনো পরিক্ষা দিতে পারবে না কেনো?
~~~ পরিক্ষা দিতে যে পাচ লক্ষ টাকা লাগবে। আর ওর যে আপন বলতে কেউ নেই। এত গুলি টাকা মনে হয় না ও দিতে পারবে।
~~ তাই বলে ছেলেটা শেষ পর্যন্ত পরিক্ষা দিতে পারবে না।
~~~ আমি বলছিলাম আমরা জান্নাতের জন্য যে ব্যাংকে সাত লক্ষ টাকা রেখেছিলাম ওইখান থেকে ওকে যদি দিতাম....
~~ কিন্তু সেই টাকা তো জান্নাতের জন্য অন্য কাজে রেখেছি....
~~~ হ্যা ওই টাকা তো এখনো অনেক পরে লাগবে। তত দিনে মেঘ ডাক্তার হলে তখন আর জান্নাতের টাকার অভাব হবে না। আর মেঘ যে জান্নাতকে কতটা ভালবাসে সেটা তো জানোই।
~~ আচ্ছা আমি কালকে চেক লিখে দিবো তুমি ওকে সেটা দিয়ো।
কথাটা শোনার পরে জান্নাতের মায়ের মুখে যেনো মিষ্টি হাসি ফুটে ওঠে।
পরের দিন জান্নাতের মা মেঘকে ফোন করে বাসায় ডাকে আর মেঘকে সেই টাকার চেকটা দেয়। প্রথমে মেঘ তাদের কাছে এই টাকাটা নিতে চায় না কিন্তু জান্নাতের মা মেঘকে বুঝিয়ে বলে। মেঘ নিতে রাজি হয় কিন্তু শর্ত একটাই ডাক্তার হলে সব টাকা আবার ফেরত দিবে। টাকাটা নিয়েই মেঘের যেনো আর কান্না থামে না। বাবা মার কথা মনে পড়ে যায়। টাকাটা নিয়ে মেঘ কলেজে জমা দিয়ে দেয়। আর পরিক্ষার জন্য খুব ভালো প্রস্তুতি নেয়।
®®®
মেঘের পরিক্ষা চলে আসে। খুব ভাল পরিক্ষা দেয় মেঘ। পরিক্ষার রেজাল্টও বেড়ায়। মেঘ কলেজের টপার হয়। আর সেই সাথে স্কলারশিপ পায় অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার। মেঘের এই রেজাল্টে সবাই খুব খুশি হয়। আর সব চেয়ে বেশি খুশি হয় জান্নাত। মেঘ মিষ্টি নিয়ে জান্নাতদের বাসায় যায়। মেঘকে দেখেই জান্নাত দৌড়ে গিয়ে মেঘের কোলে উঠে....
~~~ ভাইয়া তুমি নাকি অনেক দূরে চলে যাবা আমাকে ছেড়ে?(জান্নাত)
~~ কে বলেছে এই কথা? আমি কি কখনো আমার এই বোনটিকে ছাড়া দূরে যেতে পারি বলো....(মেঘ)
~~~ তুমি মিথ্যা বলছো। আম্মু আমাকে সব বলেছে তো। আমিও তোমার সাথে যাবো ভাইয়া...
~~ তোমাকে তো সাথে নিয়ে যেতে দেবে না যে। উমম আচ্ছা এটা বলো আমার জান্নাত সোনার কি কি লাগবে। আমি সব কিছুই আমার জান্নাত সোনার জন্য নিয়ে আসবো।
~~~ সত্যি তো? আচ্ছা আমার জন্য তুমি এত্ত গুলা চকলেট আনবা...একটা ট্রেডিবেয়ার আনবা.... আর....
~~ আর কি বলো....
~~~ আর খুব তাড়াতাড়ি আসবা কিন্তু না হলে কিন্তু আবার কান ধরাবো।
এই কথা শুনেই মেঘ হেসে দেয়। আর সাথে সাথে সবাই হাসে।
কিছু দিনের ভেতর মেঘের অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সব ব্যাবস্থা হয়ে যায়। দুই বছরের জন্য মেঘ চলে যাবে সবাইকে ছেড়ে জান্নাতকে ছেড়ে। জান্নাতকে রেখে যেতে মেঘেত খুবিই কষ্ট হয় তারপরেও যেতে তো হবেই।
®®®
সবার কাছে বিদায় নিয়ে মেঘ চলে যায়। সেখানে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনিই জান্নাতের সাথে তার পরিবারের সবার সাথেই কথা হয়। কিন্তু সেখানে পড়াশুনার চাপে আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমে যায়। তবুও মেঘ সব সময়ই জান্নাতের কথা ভাবে।
আস্তে আস্তে দুই বছর কেটে যায়। মেঘের অস্ট্রেলিয়াতে পড়াশুনাও শেষ হয়ে যায়। এখন মেঘ অনেক বড় হার্ড স্পেশালিষ্ট ডাক্তার।
মেঘ দেশে ফিরবে। আর ফিরেই ঢাকা মেডিকেলে হার্ড স্পেশালিষ্ট ডাক্তার হিসেবে জোয়েন করবে। কিন্তু এই খুশির খবর আর মেঘ যে দেশে ফিরবে এই কথা গুলি মেঘ জান্নাতদের জানায় নি। কারন মেঘ ভেবেছিলো সে এসে সবাইকে চমকে দিবে। জান্নাত যেই জিনিস গুলি নিতে বলেছিলো সব নিয়েছে...একটু মাত্র ভুলে যায় নি। মেঘ দেশে ফিরে আসে আর এসেই প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে জয়েন করে এপার্টমেন্ট লেটার নিয়ে সাথে সাথেই জান্নাতদের বাসায় চলে যায়। যেতে যেতে ভাবতে থাকে জান্নাত হয়তো অনেক বড় হয়ে গেছে। চিনতেই পারবে না এই মেঘ ভাইয়াকে। ভাবতে ভাবতেই বাসার সামনে চলে আসে। কলিং বেল টিপে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই অবাক হয়ে যায়। কারন বাসার ভেতর থেকে অন্য একজন লোক বেড় হয়ে আসে। প্রথমে ভাবে হয়তো অনেক দিন পড়ে রাস্তা ভুল করেছে কিছু পরে দেখে সব ঠিকিই আছে। সেই লোকটির কাছে জান্নাতদের কথা জানতে চায় মেঘ, কিন্তু যা শোনে তা কখনো কল্পনাও করতে পারে নি। জান্নাতরা নাকি বাসা বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু কোথায় গেছে সেটা জানে না। মেঘ ভাবতে থাকে জান্নাতরা বাসা বিক্রি করবে কেনো.... আর তাকেই বা বলে নি কেনো.... সব কিছু ভাবতে ভাবতে মেঘের ফোনে কল আসে। একটা খুব আর্জেন্ট হার্ডের অপারেশন আছে আজ রাতে। একটি দশ বছরের বাচ্চা মেয়ের। যার একপাশের হার্ডে ফুটো আছে। বাচবে কি না সন্দেহ আছে তাদের। তাও মেঘ বললো একবার সে ট্রায় করতে চায়। ফোনটা রেখে মন খারাপ করে চলে আসতে থাকে। আর ভাবে হয়তো তারা নতুন বড় বাসায় উঠেছে....মেঘ ঠিক খুজে নিবে তাদের এই ভেবেই চলে আসে। জীবনের প্রথম অপারেশন হতে যাচ্ছে মেঘের। তাই একটু ভাল ভাবেই প্রিপারেশন নেয় মেঘ। প্রিপারেশন নিয়ে মেঘ হাস্পাতালে যায়। অপারেশন শুরু হওয়ার সময় এসে গেছে। মেঘ রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি ওটি তে যায়। গিয়ে যা দেখে তা দেখে যেনো মেঘের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
কারন মেঘের সামনে থাকা লাইফ সাপোর্টে শুয়ে থাকা মেয়েটা আর কেউ নয় তার জান্নাত। সেই জান্নাত যে কিনা মেঘের সব...মেঘের পৃথিবী...যাকে মেঘ নিজের থেকেও বেশি ভালবাসে সেই জান্নাত! মেঘ হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে জান্নাতের দিকে। এটা তো সেই আগের চেহেরা নয় যেটা মেঘ দুই বছর আগে দেখেছে। মেঘ সাথে সাথে ওটি থেকে বাহিরে এসে দেখে জান্নাতের বাবা মা কাদছে। মেঘকে দেখে জান্নাতের মা জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকে। আর সব কিছুই খুলে বলে যে জান্নাতের সেই ছোট্ট বেলাতেই ওর হার্ডে ফুটো দেখা দেয়। তখন অপারেশন করতে ডাক্তাররা সময় দিয়েছিলো যে বয়স হলেই অপারেশন করবে আর তাই আস্তে আস্তে টাকা জমাতে থাকে তারা। কিন্তু মাঝেই মেঘের জন্য টাকা লাগে আর তার কিছু দিন পরেই জান্নাতের অবস্থার খারাপ হয়। আর তাই আজ অপারেশন করতে হচ্ছে। অনেক টাকা কম ছিলো তাই নিজেদের বাসাটাও বিক্রি করে দিতে হয়।
সব কিছু শুনেই নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো মেঘের। নিরবেই চোখের পানি গড়িয়ে মাটিতে পড়তে থাকে মেঘের। অপারেশনের সময় হয়ে গেছে। আর কোন কথা না বলেই ওটিতে ধুকে পড়ে মেঘ। মেঘের হাত যেনো কাপছিলো। ওটির লাল বাতি জ্বলে ওঠে। মেঘ যত বার দেখছে জান্নাতকে ততবারই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। এই অপারেশন কোন অপারেশন নয়...একটা যুদ্ধ। একটা ভাই তার বোনকে বাচানোর যুদ্ধ। মেঘ নিজের হাতে সব কিছু করে। নিজ হাতে কাটছে তার আদরের বোনটিকে....যেনো প্রতিটি ব্যাথাই অনুভোব করতে পারছে। জান্নাতকে বাচানোর সব চেষ্টাই করতে থাকে মেঘ। চার ঘন্টার অপারেশন চলে কিন্তু শত চেষ্টার পরেও শেষ পর্যন্ত সেই যুদ্ধে মেঘ পরাজিত! হেরে গেছে মেঘ। ওটিতেই মাটিতে বসে পড়ে মেঘ। হাতে এখনো জান্নাতের রক্ত লেগে আছে। অঝোড় ধারায় কাদতে থাকে মেঘ। তখনি জ্ঞান ফিরে পায় জান্নাত। সেটা দেখেই জান্নাতের কাছে ছুটে যায় মেঘ। জান্নাত চোখ খুলে তাকাতেই দেখে তার মেঘ ভাইয়া তাকে জড়িয়ে ধরে কাদছে কারন মেঘ জানে এই জ্ঞান ফেরা ক্ষনিকের জন্য। হয়তো শেষ বারের জন্য ভাইয়া ডাক শোনার জন্য...শেষ হাসিটা দেখার জন্য।
~~~ ভাইয়া তুমি.....(জান্নাত কম্পিত কণ্ঠে)
~~ জান্নাত.......(কান্নামাখা কন্ঠে)
~~~ তোমার সাথে কথা নাই যাও.....আমার কথা তোমার মনে আছে..... কত দেরি করে আসলা।
~~ হুমম অনেক দেরি করে এসেছি......
~~~ এখন কান ধরো.....বলছিলাম না দেরি করলে কান ধরাবো....
আরো বেশি কাদতে থাকে মেঘ.....
~~ তোমার জন্য দেখো কত্ত গুলা চকলেট এনেছি.....দেখো.....
মেঘ চকলেট আনতে ভুলে নি। মেঘের হাতে চকলেট দেখে জান্নাত মিষ্টি একটা হাসি দেয়....এই হাসি যেনো এক মায়াবী হাসি....যে হাসিতে জাদু আছে....! জান্নাতের হাসি দেখেই মেঘের মুখেও একটু হাসি ফুটে ওঠে। জান্নাতের হাসিটা যেনো মন জুড়িয়ে দিয়েছে মেঘের। কিন্তু জান্নাত আর কথা বলতে পারছে না... আস্তে আস্তে জান্নাতের মুখ মলিন হয়ে আসছে....জান্নাতের মুখের হাসিটা এক নিমিষেই থেমে গেলো কেনো জানি। মেঘ পাশের লাইফ সাপোর্টের দিক তাকাতেই দেখে আকা বাকা লাইন গুলি সব লাল বাতি জ্বেলে সোজা হয়ে গেছে....! মেঘ জান্নাতের পাশে বসে পড়ে আর জান্নাতকে ডাকতে থাকে...মেঘ জানে জান্নাত আর শুনতে পারবে না তার কথা তবুও ডেকে চলেছে। মেঘ আস্তে করে জান্নাতকে বুকে টেনে নেয়......মেঘের নিরব অশ্রু ভিজিয়ে দিতে থাকে জান্নাতকে। আর জান্নাত সে তো ভাইকে ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়লো....সব কিছু ছেড়ে একাই ঘুমিয়ে পড়লো...শুধু সৃতি করে রেখে গেলো তার মায়াবী সেই শেষ হাসী...!!!
বাবা মার এক মাত্র ছেলে ছিলো মেঘ। এই পৃথিবী যেনো মেঘের চির শত্রু! সেই ছোট বেলাতেই মেঘের বাবা মা এক্সিডেন্টে মারা যায়। আপন বলতেও কেউ ছিলো না। আর তাই সেই ছোট বেলা থেকেই খুব কষ্ট করে এতটা পথ আসতে হয়েছে। আজ মেঘ ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ে। এতটা পথ আসতে যে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে সেটা একমাত্র মেঘই জানে। এই পড়াশুনোর পেছনে তার বাবার রেখে যাওয়া যতটুকু সম্বল ছিলো তার প্রায় সবই শেষ হয়ে গেছে। এমন কি বাবা মার শেষ সৃতি তাদের বাসাটাও বিক্রি করতে হয়েছে। কিন্তু কিছুই যে করার ছিলো না। তবুও কষ্ট করে লেখা পড়াটা চালিয়ে যায়। একসময় ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়ে যায় সে। তার এই কষ্টের ফল সে পেতে যাচ্ছিলো কারন আড়াই মাস পরে তার ফাইনাল পরিক্ষা...মেঘের প্রিপারেশন খুবিই ভালো...তারপরেও যেনো একরাশ চিন্তা এসে গ্রাস করে মেঘকে। কারন ফাইনাল পরিক্ষার জন্য প্রায় ৫ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। কিন্তু এত গুলি টাকা কিভাবে জোগাড় করা সম্ভব। এগুলই ভাবতে ভাবতে একা একা হাটছিলো। এমনিতেই খুব কষ্ট করে এক দুটি টিউশনি করে বেশ ভালই চলে যায় কিন্তু একেবারে এত গুলি টাকা...এই কথাটা ভাবতেই মেঘের মনটা খারাপ হয়ে যায়। মেঘ ভাবে শেষ পর্যন্ত হয়তো আর তার স্বপ্ন...তার বাবা মার রেখে যাওয়া স্বপ্ন গুলি আর পূরন হবে না। এখন যেনো মেঘের বাবা মার কথা মনে পড়ে যায়। নিরবেই কেদে দেয় সে...কিন্তু এই কান্না ছিলো জলহীন। যা বাহিরে থেকে বোঝা যায় না। এভাবেই ভাবতে ভাবতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে মেঘ। আর ভাবতে পারছে না সে। তখনি পাশেই একটা হোটেল দেখতে পায়। আস্তে আস্তে মেঘ হোটলের ভেতরে যায় কিন্তু গিয়েই দেখতে পায় হোটেলের কোন সিটিই ফাকা নেই। ক্লান্ত শরীর নিয়েই দাঁড়িয়ে একটু জায়গার জন্য হোটেলের চারপাশ খুজতে থাকে। তখনি একটা সিট ফাকা দেখতে পায়। কিছু মাত্র না ভেবে মেঘ গিয়ে বসে সিটে। বসতেই ক্লান্ত চোখ দুটি বন্ধ করে বসে থাকে। চোখ খুলতেই দেখে তার সামনে একটা ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স খুব হলেও সাত বছর হবে। মেঘ তার দিকে তাকাতেই মেঘের উপরে যেনো কথার স্রোত নেমে আসে.....
~~~ এই তুমি আমার সিটে বসছো কেনো? তুমি জাননা এটা আমার সিট?(মেয়েটি)
এত ছোট্ট একটা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হলেও অনেক ভাল লাগে মেঘের।
~~ আচ্ছা এটা বুঝি আপনার সিট?(মেঘ)
~~~ হ্যা তো আমার সিট। তুমিই তো বসে পড়লা আমি কোথায় বসবো? মাটিতে?
~~ না না আপনি মাটিতে কেনো বসবেন আমিই মাটিতে বসি আর আপনিই সিটে বসেন।
~~~ কিন্তু তুমি আমার সিটে না বলে বসলা কেনো?
~~ ও হ্যা...আমার তো অনেক বড় ভুল হয়েছে!
~~~ হ্যা হয়েছে তো। এখন কান ধরো!
~~ আমি কান ধরবো? শুধু সরি বললে হবে না?
~~~ না হবে না। শুধু কান ধরলেই হবে না...উঠ বোস ও করতে হবে।
~~ দেখো আমি না ছোট্ট ছেলে...এমন শাস্তি দিলে তো মরেই যাবো।
~~~ উমমম...আচ্ছা আচ্ছা আর ধরতে হবে না। যাও তোমাকে মাফ করেই দিলাম।
মেয়েটি সিটে বসে পড়ে আর তখনি পাশের সিটও খালি হয়ে যায় সেখানে মেঘ বসে।
~~~ আচ্ছা কি নাম আপনার?(মেঘ)
~~ আমার নাম শুনে তুমি কি করবা হু? আমি ছেলেদের আমার নাম বলি না।
~~~ ওমা কেনো? নাম বলতে আপনার ভাল লাগে না?
~~ তুমি আমাকে আপনি করে কেন বলছো? আমি না অনেক ছোট।
~~~ ভয়ে বলছি তো। যদি আবার কান ধরতে বলো!
মেয়েটির সাথে কথা বলতে বলতেই মেয়েটির বাবা মা এসে পড়ে। এসেই মেয়েটিকে বোকা দিতে থাকে। কিন্তু মেঘ বাধা দেয়। মেঘ শুধু একদৃষ্টিতে সেই মেয়েটির মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
~~~ কি হয়েছে বাবা এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেনো? (মেয়েটির মা)
~~ না মানে আন্টি...আপনাকে না একদম আমার মায়ের মত দেখতে। কেমন জানি আপনাকে দেখার পরেই মনে হলো আমার মাকে দেখলাম।(মেঘ)
~~~ কেনো তোমার মা নেই?
~~ না আন্টি কেউ নেই........(কান্না সুর)
~~~ তাতে কি হয়েছে আমি তো তোমার মায়ের মতই তাই না? আমাকে মা বলেই ডাকতে পারো। আচ্ছা তুমি কি করো?
~~ আন্টি আমি ঢাকা মেডিকেলে পড়ি লাস্ট সেমিস্টার।
~~~ খুব ভালো তো। আচ্ছা আমাকে যখন তোমার মায়ের মত ভেবেইছো তখন রোজ আমার বাসায় আসবে।
~~ কিন্তু এভাবে কিভাবে রোজ যাবো....
~~~ আচ্ছা তুমি না হয় আমার এই ছোট্ট মেয়েটিকে প্রাইভেট পড়িয়ো।
~~ আচ্ছা পড়াবো কিন্তু একটা শর্ত আছে..!
~~~ কি শর্ত?
~~ আমি কিন্তু কোন টাকা নিবো না...। আপনার মেয়ে কে অনেক ভালো লেগেছে। ওকে দেখার জন্য হলেও একবার করে যাবো।
~~~ আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।
এই কথা গুলি শুনেই মেয়েটি বলে....
~~ তুমি তো এখন থেকে আমার স্যার হয়ে গেলা!
~~~ হ্যা...এবার দুষ্টামি করলে অনেক বোকা দিবো।
~~ তুমি বোকা দিতে পারবাই না। আমাকে না তোমার অনেক ভালো লাগছে।
~~~ তাই তো। আচ্ছা এবার তো স্যারকে তোমার নামটা বলো।
~~ আমার নাম জান্নাত! আমি ক্লাস টু তে পড়ি। আমাকে পড়াতে পারবা তো?
~~~ সেটাই তো মনে হয় পারবো না।
~~ না পড়লে আমি তোমাকে অনেক বকা দিবো হু। আর আমি কিন্তু তোমাকে স্যার বলবো না। ভাইয়া বলবো। আমার ভাইয়া নেই তো।
~~~ কে বলেছে নেই? এইতো আমি আছি না।
এই কথা বলেই মেঘ হেসে দেয়। কিছু সময়ের পরিচয় কিন্তু এই কিছু সময়ই যেনো মেঘ তাদের মাঝে নিজের পরিবারকে খুজে পেয়েছে। একটা নতুন বাচার যেনো আশা খুজে পেয়েছে। ফাইনাল পরিক্ষা...টাকার কথা সব কিছুই যেনো ভুলে গেছে মেঘ। ভোলবারই তো কথা...এমন সুন্দর একটা ছোট্ট মেয়ের হাসি যেনো সব কিছুই ভুলিয়ে দিতে পারে। জান্নাতের হাসিটা যেনো মেঘের বুকে গেথে গেছে। একনিমিশেই যেনো তাদের সবাইকে আপন ভাবতে লাগলো মেঘ।
®®®
মেঘ জান্নাতদের বাসায় রোজ যেতে থাকে। আস্তে আস্তে জান্নাতকে যেনো নিজের বোনের চেয়েও বেশি ভালবাসতে থাকে মেঘ। জান্নাতের মুখের হাসির জন্য সব কিছুই করতে পারতো মেঘ। আর জান্নাতের দুষ্টামি, আবদার সব জেদ গুলি যেনো মেঘের জীবনেরই একটা অংশ হয়ে যায়। জান্নাতের চকলেট খুব পছন্দ ছিলো মেঘ প্রতিদিন জান্নাতকে চকলেট দিতো... জান্নাত আবার একটা চকলেট নিতো না...তাই মেঘ জান্নাতের জন্য পকেট ভর্তি করে চকলেট নিয়ে যেতো। ভাইয়া আমি এটা খাবো না....ভাইয়া আজ তুমি আমাকে খাইয়ে দিবা....ভাইয়া আজ আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবা....ভাইয়া আজ তোমার পিঠে উঠবো....এমন হাজারো আবদার আর জেদে যেনো নতুন এক পৃথিবী গড়ে তোলে মেঘ। আর সেই জেদ সেই আবদার গুলি পুরন করার মাঝেও যেনো ছিলো এক অদ্ভুত ভালোলাগা। এভাইবেই আস্তে আস্তে যেনো মেঘ তাদের পরিবারের একজন হয়ে ওঠে। জান্নাতও মেঘকে নিজের ভাইয়ের মতই ভালবাসতো। যদি কেউ জিজ্ঞাস করতো জান্নাত বলে দিতো তারা দুই ভাই বোন।
জান্নাতকে নিয়ে সাজানো পৃথিবীতে মেঘ যে হারিয়ে ছিলো...আর তাই দেখতে দেখতে কখন যে দুই মাস চলে যায় মেঘ বুঝতেই পারে না। এদিকে তার পরিক্ষার আর মাত্র দুই সপ্তাহ মত আছে। তিন দিনের মধ্যেই সেই পাচ লাক্ষ টাকা জমা দিতে হবে। মেঘের মনে আবার সেই চিন্তা গ্রাস করে ফেলে।
এভাবেই সেদিন চিন্তায় মন খারাপ করে জান্নাতদের বাসায় যায় মেঘ। মেঘের যে মন খারাপ সেটা জান্নাত খুব ভাল করেই বুঝে যায় আর তার মাকে গিয়ে বলে দেয়। জান্নাতের মা মেঘের কাছে আসে আর মেঘের কাছে সব কথা শোনে যে তার ফাইনাল সেমিস্টার পরিক্ষা যেখানে তার পাচ লক্ষ টাকা লাগবে তাও আবার ৩ দিনের মধ্যে। সব কথা শোনার পরে জান্নাতের মা আর কিছুই বলে না। সেদিন মেঘ আর বেশিক্ষন জান্নাতদের বাসায় থাকে না। উঠে চলে যায়। রাতে বাসায় জান্নাতের বাবা আসেন আর এসেই জান্নাতের মা তার সাথে মেঘের সমস্যাটা নিয়ে কথা বলেন....
~~~ জানো মেঘের আর দুই সপ্তাহ পরে ফাইনাল সেমিস্টার পরিক্ষা। (জান্নাতের মা)
~~ হুমম শুনেছি। মেঘ তো অনেক ভালো স্টুডেন্ড দেখবা ও ঠিক অনেক ভাল কিছু করবে।(জান্নাতের বাবা)
~~~ পরিক্ষা দিতে পারলে তো করবে!
~~ কেনো পরিক্ষা দিতে পারবে না কেনো?
~~~ পরিক্ষা দিতে যে পাচ লক্ষ টাকা লাগবে। আর ওর যে আপন বলতে কেউ নেই। এত গুলি টাকা মনে হয় না ও দিতে পারবে।
~~ তাই বলে ছেলেটা শেষ পর্যন্ত পরিক্ষা দিতে পারবে না।
~~~ আমি বলছিলাম আমরা জান্নাতের জন্য যে ব্যাংকে সাত লক্ষ টাকা রেখেছিলাম ওইখান থেকে ওকে যদি দিতাম....
~~ কিন্তু সেই টাকা তো জান্নাতের জন্য অন্য কাজে রেখেছি....
~~~ হ্যা ওই টাকা তো এখনো অনেক পরে লাগবে। তত দিনে মেঘ ডাক্তার হলে তখন আর জান্নাতের টাকার অভাব হবে না। আর মেঘ যে জান্নাতকে কতটা ভালবাসে সেটা তো জানোই।
~~ আচ্ছা আমি কালকে চেক লিখে দিবো তুমি ওকে সেটা দিয়ো।
কথাটা শোনার পরে জান্নাতের মায়ের মুখে যেনো মিষ্টি হাসি ফুটে ওঠে।
পরের দিন জান্নাতের মা মেঘকে ফোন করে বাসায় ডাকে আর মেঘকে সেই টাকার চেকটা দেয়। প্রথমে মেঘ তাদের কাছে এই টাকাটা নিতে চায় না কিন্তু জান্নাতের মা মেঘকে বুঝিয়ে বলে। মেঘ নিতে রাজি হয় কিন্তু শর্ত একটাই ডাক্তার হলে সব টাকা আবার ফেরত দিবে। টাকাটা নিয়েই মেঘের যেনো আর কান্না থামে না। বাবা মার কথা মনে পড়ে যায়। টাকাটা নিয়ে মেঘ কলেজে জমা দিয়ে দেয়। আর পরিক্ষার জন্য খুব ভালো প্রস্তুতি নেয়।
®®®
মেঘের পরিক্ষা চলে আসে। খুব ভাল পরিক্ষা দেয় মেঘ। পরিক্ষার রেজাল্টও বেড়ায়। মেঘ কলেজের টপার হয়। আর সেই সাথে স্কলারশিপ পায় অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার। মেঘের এই রেজাল্টে সবাই খুব খুশি হয়। আর সব চেয়ে বেশি খুশি হয় জান্নাত। মেঘ মিষ্টি নিয়ে জান্নাতদের বাসায় যায়। মেঘকে দেখেই জান্নাত দৌড়ে গিয়ে মেঘের কোলে উঠে....
~~~ ভাইয়া তুমি নাকি অনেক দূরে চলে যাবা আমাকে ছেড়ে?(জান্নাত)
~~ কে বলেছে এই কথা? আমি কি কখনো আমার এই বোনটিকে ছাড়া দূরে যেতে পারি বলো....(মেঘ)
~~~ তুমি মিথ্যা বলছো। আম্মু আমাকে সব বলেছে তো। আমিও তোমার সাথে যাবো ভাইয়া...
~~ তোমাকে তো সাথে নিয়ে যেতে দেবে না যে। উমম আচ্ছা এটা বলো আমার জান্নাত সোনার কি কি লাগবে। আমি সব কিছুই আমার জান্নাত সোনার জন্য নিয়ে আসবো।
~~~ সত্যি তো? আচ্ছা আমার জন্য তুমি এত্ত গুলা চকলেট আনবা...একটা ট্রেডিবেয়ার আনবা.... আর....
~~ আর কি বলো....
~~~ আর খুব তাড়াতাড়ি আসবা কিন্তু না হলে কিন্তু আবার কান ধরাবো।
এই কথা শুনেই মেঘ হেসে দেয়। আর সাথে সাথে সবাই হাসে।
কিছু দিনের ভেতর মেঘের অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সব ব্যাবস্থা হয়ে যায়। দুই বছরের জন্য মেঘ চলে যাবে সবাইকে ছেড়ে জান্নাতকে ছেড়ে। জান্নাতকে রেখে যেতে মেঘেত খুবিই কষ্ট হয় তারপরেও যেতে তো হবেই।
®®®
সবার কাছে বিদায় নিয়ে মেঘ চলে যায়। সেখানে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনিই জান্নাতের সাথে তার পরিবারের সবার সাথেই কথা হয়। কিন্তু সেখানে পড়াশুনার চাপে আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমে যায়। তবুও মেঘ সব সময়ই জান্নাতের কথা ভাবে।
আস্তে আস্তে দুই বছর কেটে যায়। মেঘের অস্ট্রেলিয়াতে পড়াশুনাও শেষ হয়ে যায়। এখন মেঘ অনেক বড় হার্ড স্পেশালিষ্ট ডাক্তার।
মেঘ দেশে ফিরবে। আর ফিরেই ঢাকা মেডিকেলে হার্ড স্পেশালিষ্ট ডাক্তার হিসেবে জোয়েন করবে। কিন্তু এই খুশির খবর আর মেঘ যে দেশে ফিরবে এই কথা গুলি মেঘ জান্নাতদের জানায় নি। কারন মেঘ ভেবেছিলো সে এসে সবাইকে চমকে দিবে। জান্নাত যেই জিনিস গুলি নিতে বলেছিলো সব নিয়েছে...একটু মাত্র ভুলে যায় নি। মেঘ দেশে ফিরে আসে আর এসেই প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে জয়েন করে এপার্টমেন্ট লেটার নিয়ে সাথে সাথেই জান্নাতদের বাসায় চলে যায়। যেতে যেতে ভাবতে থাকে জান্নাত হয়তো অনেক বড় হয়ে গেছে। চিনতেই পারবে না এই মেঘ ভাইয়াকে। ভাবতে ভাবতেই বাসার সামনে চলে আসে। কলিং বেল টিপে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই অবাক হয়ে যায়। কারন বাসার ভেতর থেকে অন্য একজন লোক বেড় হয়ে আসে। প্রথমে ভাবে হয়তো অনেক দিন পড়ে রাস্তা ভুল করেছে কিছু পরে দেখে সব ঠিকিই আছে। সেই লোকটির কাছে জান্নাতদের কথা জানতে চায় মেঘ, কিন্তু যা শোনে তা কখনো কল্পনাও করতে পারে নি। জান্নাতরা নাকি বাসা বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু কোথায় গেছে সেটা জানে না। মেঘ ভাবতে থাকে জান্নাতরা বাসা বিক্রি করবে কেনো.... আর তাকেই বা বলে নি কেনো.... সব কিছু ভাবতে ভাবতে মেঘের ফোনে কল আসে। একটা খুব আর্জেন্ট হার্ডের অপারেশন আছে আজ রাতে। একটি দশ বছরের বাচ্চা মেয়ের। যার একপাশের হার্ডে ফুটো আছে। বাচবে কি না সন্দেহ আছে তাদের। তাও মেঘ বললো একবার সে ট্রায় করতে চায়। ফোনটা রেখে মন খারাপ করে চলে আসতে থাকে। আর ভাবে হয়তো তারা নতুন বড় বাসায় উঠেছে....মেঘ ঠিক খুজে নিবে তাদের এই ভেবেই চলে আসে। জীবনের প্রথম অপারেশন হতে যাচ্ছে মেঘের। তাই একটু ভাল ভাবেই প্রিপারেশন নেয় মেঘ। প্রিপারেশন নিয়ে মেঘ হাস্পাতালে যায়। অপারেশন শুরু হওয়ার সময় এসে গেছে। মেঘ রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি ওটি তে যায়। গিয়ে যা দেখে তা দেখে যেনো মেঘের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
কারন মেঘের সামনে থাকা লাইফ সাপোর্টে শুয়ে থাকা মেয়েটা আর কেউ নয় তার জান্নাত। সেই জান্নাত যে কিনা মেঘের সব...মেঘের পৃথিবী...যাকে মেঘ নিজের থেকেও বেশি ভালবাসে সেই জান্নাত! মেঘ হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে জান্নাতের দিকে। এটা তো সেই আগের চেহেরা নয় যেটা মেঘ দুই বছর আগে দেখেছে। মেঘ সাথে সাথে ওটি থেকে বাহিরে এসে দেখে জান্নাতের বাবা মা কাদছে। মেঘকে দেখে জান্নাতের মা জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকে। আর সব কিছুই খুলে বলে যে জান্নাতের সেই ছোট্ট বেলাতেই ওর হার্ডে ফুটো দেখা দেয়। তখন অপারেশন করতে ডাক্তাররা সময় দিয়েছিলো যে বয়স হলেই অপারেশন করবে আর তাই আস্তে আস্তে টাকা জমাতে থাকে তারা। কিন্তু মাঝেই মেঘের জন্য টাকা লাগে আর তার কিছু দিন পরেই জান্নাতের অবস্থার খারাপ হয়। আর তাই আজ অপারেশন করতে হচ্ছে। অনেক টাকা কম ছিলো তাই নিজেদের বাসাটাও বিক্রি করে দিতে হয়।
সব কিছু শুনেই নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো মেঘের। নিরবেই চোখের পানি গড়িয়ে মাটিতে পড়তে থাকে মেঘের। অপারেশনের সময় হয়ে গেছে। আর কোন কথা না বলেই ওটিতে ধুকে পড়ে মেঘ। মেঘের হাত যেনো কাপছিলো। ওটির লাল বাতি জ্বলে ওঠে। মেঘ যত বার দেখছে জান্নাতকে ততবারই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। এই অপারেশন কোন অপারেশন নয়...একটা যুদ্ধ। একটা ভাই তার বোনকে বাচানোর যুদ্ধ। মেঘ নিজের হাতে সব কিছু করে। নিজ হাতে কাটছে তার আদরের বোনটিকে....যেনো প্রতিটি ব্যাথাই অনুভোব করতে পারছে। জান্নাতকে বাচানোর সব চেষ্টাই করতে থাকে মেঘ। চার ঘন্টার অপারেশন চলে কিন্তু শত চেষ্টার পরেও শেষ পর্যন্ত সেই যুদ্ধে মেঘ পরাজিত! হেরে গেছে মেঘ। ওটিতেই মাটিতে বসে পড়ে মেঘ। হাতে এখনো জান্নাতের রক্ত লেগে আছে। অঝোড় ধারায় কাদতে থাকে মেঘ। তখনি জ্ঞান ফিরে পায় জান্নাত। সেটা দেখেই জান্নাতের কাছে ছুটে যায় মেঘ। জান্নাত চোখ খুলে তাকাতেই দেখে তার মেঘ ভাইয়া তাকে জড়িয়ে ধরে কাদছে কারন মেঘ জানে এই জ্ঞান ফেরা ক্ষনিকের জন্য। হয়তো শেষ বারের জন্য ভাইয়া ডাক শোনার জন্য...শেষ হাসিটা দেখার জন্য।
~~~ ভাইয়া তুমি.....(জান্নাত কম্পিত কণ্ঠে)
~~ জান্নাত.......(কান্নামাখা কন্ঠে)
~~~ তোমার সাথে কথা নাই যাও.....আমার কথা তোমার মনে আছে..... কত দেরি করে আসলা।
~~ হুমম অনেক দেরি করে এসেছি......
~~~ এখন কান ধরো.....বলছিলাম না দেরি করলে কান ধরাবো....
আরো বেশি কাদতে থাকে মেঘ.....
~~ তোমার জন্য দেখো কত্ত গুলা চকলেট এনেছি.....দেখো.....
মেঘ চকলেট আনতে ভুলে নি। মেঘের হাতে চকলেট দেখে জান্নাত মিষ্টি একটা হাসি দেয়....এই হাসি যেনো এক মায়াবী হাসি....যে হাসিতে জাদু আছে....! জান্নাতের হাসি দেখেই মেঘের মুখেও একটু হাসি ফুটে ওঠে। জান্নাতের হাসিটা যেনো মন জুড়িয়ে দিয়েছে মেঘের। কিন্তু জান্নাত আর কথা বলতে পারছে না... আস্তে আস্তে জান্নাতের মুখ মলিন হয়ে আসছে....জান্নাতের মুখের হাসিটা এক নিমিষেই থেমে গেলো কেনো জানি। মেঘ পাশের লাইফ সাপোর্টের দিক তাকাতেই দেখে আকা বাকা লাইন গুলি সব লাল বাতি জ্বেলে সোজা হয়ে গেছে....! মেঘ জান্নাতের পাশে বসে পড়ে আর জান্নাতকে ডাকতে থাকে...মেঘ জানে জান্নাত আর শুনতে পারবে না তার কথা তবুও ডেকে চলেছে। মেঘ আস্তে করে জান্নাতকে বুকে টেনে নেয়......মেঘের নিরব অশ্রু ভিজিয়ে দিতে থাকে জান্নাতকে। আর জান্নাত সে তো ভাইকে ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়লো....সব কিছু ছেড়ে একাই ঘুমিয়ে পড়লো...শুধু সৃতি করে রেখে গেলো তার মায়াবী সেই শেষ হাসী...!!!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন