সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৭

ট্রাফিক জ্যাম এবং ভালবাসা

সবাই সরে দাঁড়ান।
ট্রাফিক পুলিশের দিকে হতাশ হয়ে তাকালাম। সে সব গাড়ি সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করছেন। বাস থেমে আছে। একটুও নড়াচড়া করছে না। অবশ্য নড়াচড়া করার কথা না। ট্রাফিক পুলিশ রাস্তা আটকে দিয়েছে। কারন, একটু পরে এখান দিয়ে মেয়রের গাড়ি যাবে। তার জরুরি মিটিং আছে। আগেই ফোন করে সেটা জানিয়ে দিয়েছে। তাই ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পরেছে রাস্তা পরিষ্কার করা। আমার মত আরো অনেকে গাড়ি থেকে নেমে সার্কাস দেখছে যেন!
.
ফোনের রিংটোন বেজে উঠার সাথে ফোন কেঁপে উঠল। বরাবর আমি ফোন ভ্রাইবেট করে রাখি। সাথে রিংটোন। যাতে কল আসলে বুঝতে পারি। ফোন বের করে রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে আভা বলল
-কোথায় তুমি?
ওর কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। এমন হুংকার ছেড়ে কথা বললে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। মাঝেমাঝে মনেহয় আভার পুলিশের উচ্চপদস্থ কোন পদে চাকরি করা উচিত। যাতে তার রাগে আর হুংকারে সবাই ভয় পায়। 
আমি প্রায়ই তার ঝারি খেয়ে ভয় পেয়ে যাই।
আমি আস্তে করে বললাম
-এইত আসছি। পথে আছি।
-সেটা অনেক্ষণ ধরে বলছ। আর কতক্ষণ!
-বলো না। জ্যামে আটকা পরে আছি।
-এটা নতুন কি! আসতে কতক্ষণ লাগবে সেটা বল। এই দশ পনের মিনিট!
-এত সময়!
-কই এত সময়! অল্প সময়।
-তোমার দশ পনের মিনিট আমার জানা আছে। তাড়াতাড়ি এস। একা একা এখানে ভাল লাগছে না।
-তবে কাউকে পাশে নাও।
-কি বললে!
আভা আরেকবার আমাকে ধমক দিল। আমি যদিও কথাটা মজা করে বলেছি। তার পাশে অন্য কেউ আসলে আমার কাছে অসহ্যকর।
.
-আপনি এখানে কেন! সরে দাঁড়ান।
পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ট্রাফিক পুলিশ আমার কাছে চলে এসেছে। কথা বলতে বলতে রাস্তার মাঝে চলে এসেছি। অবশ্য জ্যাম থাকার কারনে কোন সমস্যা হয়নি। তড়িঘড়ি করে রাস্তার একপাশে চলে এলাম। ফোনটা এখনো কানের সাথে লাগিয়ে রেখেছি। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ আসছে না। আমিও কথা বলিনি। আমি কথা না বললে এতক্ষণে তো আভার ঝারি শুরু হয়ে যেত।
.
ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম ফোন অফ হয়ে গিয়েছে!
তারমানে চার্জ শেষ!
ফোন নিয়ে এই এক ঝামেলায় আছি। চার্জ থাকেনা। যখন তখন বন্ধ হয়ে যায়। নতুন ব্যাটারি লাগিয়েও কোন লাভ হয়নি। নতুন ফোন কিনতে হবে।
কিন্তু চাইলেই সেটা সম্ভব না। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হলে চাওয়া পাওয়া গুলো অপূর্ন থেকে যায়।
.
-ভাই কয়টে বাজে?
পাশে দাঁড়ানো একজনের কাছে সময় জিজ্ঞেস করলাম। লোকটা কিছুক্ষণ পরে বলল
-দশটা চব্বিশ।
কয়েকবার চেষ্টা করেও ফোন চালু করতে পারলাম না। আশা ছেড়ে দিয়ে মরা ফোনটা পকেটে ঢুকালাম। আভার সাথে দেখা করার কথা সাড়ে দশটায়। কিন্তু এখান থেকে যেতে লাগবে বিশ মিনিটের মত।
তবে হেটে গেলে ত্রিশ মিনিটেই হয়ে যাবে! ঢাকার যে জ্যাম!।
ত্রিশ মিনিট হেটে যাওয়ার পথ গাড়িতে গেলে তারচেয়ে বেশি সময় লাগে!
.
বাসের আশা বাদ দিয়ে হাটা শুরু করলাম। এই জ্যামে আটকে থাকলে আমার কপালে শনি রবি আরো অনেক কিছু আছে। যেটার দেখা পেতে চাই না। আপাতত আভার দেখা পেলেই চলবে।
সকাল থেকে অনেকবার সে আমাকে ফোন দিয়েছে। আটটার সময় আমার রওনা দেওয়ার কথা ছিল। কারন আমি আভার সাথে দেখা করতে গেলেই দেরি হয়ে যায়!
.
হাটতে হাটতে অনেক পথ চলে এসেছি। আরেকটু গেলেই পেয়ে যাব। রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাটছি। বৈশাখ মাসের কড়া রোদ আমার গায়ে আঁচড়ে পরছে। সে রোদে আমি ঝলসে যাচ্ছি।
এই বৈশাখ মাসের রোদে একটা সুবিধা আছে। মাঝে মাঝে ক্লাস ফাকি দেওয়া যায়!
.
একটা ফুলের দোকান দেখে দাঁড়ালাম। পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম চল্লিশ টাকা আছে। ত্রিশ টাকায় কয়েকটা গাদা ফুল কিনলাম। ফুলগুলো হাতে নিয়ে আবার হাটতে থাকলাম।
এতক্ষণ ধরে হাটলেও ক্লান্ত হইনি। হাটার অভ্যাস আছে।
.
পার্কে ঢুকে আশেপাশে তাকিয়ে হাটতে থাকলাম। আভাকে এখন ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করা লাগত, সে কোথায় অপেক্ষা করছে!
কিন্তু আমাকে সেটা করতে হয়না। তার বসার জন্য নির্দিষ্ট একটা জায়গা আছে। 
.
চুপি চুপি আভার পিছনে এসে দাঁড়ালাম। সে বারবার ফোন কানের কাছে নিচ্ছে। বুঝতে পারলাম কাউকে কল দিচ্ছে। পিছন থেকে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার কাছে ফোন দিচ্ছে! 
.
-এই!
ফোনের দিকে খেয়াল থাকায় সে বুঝতে পারেনি আমি তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার ডাক শুনে ঘুরে তাকাল। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
-এই তোমার সমস্যা কি! ফোন বন্ধ কেন?
আভা কথাগুলো উচ্চস্বরে বলছিল। এমন ভাবে কথা শুনে পার্কের অন্য সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে।
সে রাগে আর ক্ষোভে ফেটে পরছে। কখন যেন চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে যাবে।
আমি ওর হাতটা ধরে বললাম
-সরি ফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আভা কোন কথা না বলে সোজা আমাকে জড়িয়ে ধরল। এতক্ষণে চেপে থাকা কান্না বের হয়ে আছে। অনেকেই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আভার সেসবে খেয়াল নেই। কাঁদতে কাঁদতে বলল 
 -জানো এতক্ষণ কতটা টেনশনে ছিলাম!
আমি চুপ করে থাকলাম। মনের সব ক্ষোভ ঝরে পরুক।
.
আভার কান্না থামলে চোখ মুছে দিয়ে বললাম
-বস এবারে।
আভা আমার কাধে মাথা রেখে বসল। চুপচাপ থাকার পরে নীরবতা ভেঙে বলল
-ফোন বন্ধ ছিল কেন!
-চার্জ ছিল না।
-চার্জ থাকবে কিভাবে! রাত জেগে মেয়েদের সাথে চ্যাটিং করলে চার্জ থাকে!
-রাত জেগে চ্যাটিং করিনি। ফোনে সমস্যা হয়েছে।
-সবই বুঝি। বুঝি তো! সুযোগ পেলেই তুমি অন্য মেয়ের সাথে টাংকি মার!
আভার কথা শুনলে মুচকি হাসলাম। ওর এমন অভিযোগ মাঝেমাঝে হয়। বিশেষ করে ফোন ধরতে দেরি হলে অথবা ফোন বন্ধ পেলেই এমন করে!
তাকে কি করে বুঝাব!
মনের পুরোটা জায়গা জুড়ে শুধুই সে। এতটুকু জায়গা ফাকা নেই। সারাক্ষণ তাকে নিয়ে ভাবতেই সময় শেষ। অন্য কাউকে নিয়ে ভাবার সময় বা সুযোগ কোথায়!
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তার অভিযোগ শুনলাম। সংসদে বিল উপস্থাপন করার মত সে তার অভিযোগ উপস্থাপন করছিল। আমি তার উত্তরে কিছু বলছিলাম না। বললে বিরোধি দলের পাল্টা হাওয়ার মত আমার উপর আক্রমণ হতে পারত!
.
-এই ফোনটা নাও।
আভা তার ব্যাগ থেকে একটা নতুন মোবাইল বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলল
-নাও বলছি। নাহলে তোমার খবর আছে। আর এখন থেকে ফোন বন্ধ না পাই যেন। তবে তোমার বারোটা বাজাব।
বাধ্য হয়ে ফোনটা নিলাম। আমার এক হাত পিছনে লুকিয়ে রেখেছি। হাত পিছনে দেখে আভা বলল
-এই তোমার হাতে কি?
-কিছুনা।
-দেখি!
.
হাত সামনে এনে গাঁদাফুল হাতে দিলাম। প্রেমিক প্রেমিকাকে সাধারণত গোলাপ ফুল দেয়। কিন্তু আমি গাঁদাফুল দিচ্ছি! আভা ফুলগুলো দেখে বলল
-এগুলো!
-হ্যা। তোমায় খোঁপায় দিব।
-আমি খোঁপা করে দিচ্ছি।
আভা পিছন ঘুরে ওর চুল বেধে দিলাম। সবার অবাক হওয়ার কথা! পার্কে প্রেমিক প্রমিকা পাশাপাশি বসে বাদাম খায়। আমি সেখানে প্রেমিকার চুল বেধে দিচ্ছি!
খোঁপা করে চুল বেধে দিয়ে ওর খোঁপায় ফুল গুজে দিলাম। 
.
আভার দিকে তাকিয়ে আছি। এখন তাকে দেখে কে বলবে এই মেয়েটা খুব রাগি! রাগ হলে হুংকার দেয় সেটাও বলার উপায় নেই। তবুও তার রাগে আমার বিরক্ত নেই। তার রাগের মাঝে ভালবাসা দেখতে পাই!
.
-ভালবাসি।
আভা আস্তে করে কথাটা বলেই থেমে গেল। আমি শুনেও না শোনার ভান করে বললাম
-কি বললে!
-বললাম মাথা ফাটাব তোমার।
বলেই হাসতে শুরু করল।
হ্যা আভা আমার মাথা ফাটাবে! তাকে একটু কম ভালবাসলেই আমার খবর আছে। 
তাকে পুরোটা দিয়েই ভালবাসি। একটু কম ভালবাসলেই আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। অনেক ভালবাসি তাকে। 
নাই-বা বললাম সে কথা। সব কথা কি বলে দিতে হয়!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন