সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৭

অদ্ভুত বন্ধন

-কই যাও?
.
আমি পিছনে তাকালাম। না সারা ছাড়া আর কেউ নাই। তাহলে সারা আমাকেই ডাকছে।যাক অবশেষে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে!
তবুও সিউর হওয়ার জন্য সারার দিকে তাকিয়ে আমাকে ডাকছে কিনা ইশারা করলাম। সারা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো।
সারার পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম। সারা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকাতে লাগলো। আমার কেমন কেমন লাগছে। যে কেউ আমাকে ফোকাসে রেখে আমাকে নিয়ে ভাবতে থাকলে আমার কেমন অস্বস্তি অস্বস্তি লাগে। আর এটাতো সারা। অস্বস্তি একটু বেশিই লাগছে। আমি অস্বস্তি দূর করার জন্য সারাকে বললাম,
- ও ভাবে চেয়ে আছো কেন?
- ভাবছি তুমি এতো বান্দর কিভাবে হতে পারো। আর কখনো এমন চিন্তা মনের মাঝে আনবে না, কখনোই না। আমার এসব ভালো লাগে না।
.
আমি মাথা নেড়ে সারার কথায় সায় দিলাম।
সকাল সকাল ক্লাসে এসে বসেছিলাম। হঠাৎ করে মনে পড়লো আজ ক্লাসে আসা একদম ঠিক হয়নি। রাত পর্যন্ত তো ঠিক করে রেখেছিলাম আজ আসবো না। তাহলে সকালে কেন মনে হলো না গতকালের ঘটনা, কেন চলে আসলাম?
তড়িঘড়ি করে উঠে ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কলেজ গেট পর্যন্ত আসছিলাম ভালোভাবেই, হঠাৎ করে পিছন থেকে,"কই যাও" বলে ডাকায় চেয়ে দেখি সারা।
আমি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে আসলাম। পিছনে তাকালাম না আর। নিশ্চয় সারা অবাক হয়েছে আমার এমন আচরণে।
.
ঘটনা-১:
....ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসে ঢুকে একটা মেয়েকে দেখলাম বসে বসে বই নাড়াচাড়া করছে, পড়ছে না। আমার মনে হলো এটাই সেই মেয়ে, অনিক যার কথা বলছিলো। আরো কয়েকটা মেয়ের দিকে তাকালাম, না কোনো মেয়েই পড়ায় নেই।অনিক বলছিলো মেয়েটা বই নাড়াচাড়া করছে, ঠোঁটের নিচে তিল আছে।সে ইন্টার ক্লাসের পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখেছে।
ক্লাসে কেউ মোবাইল টিপছে, কেউ বসে গল্প করছে। ইন্টার পড়া শেষে অনেকদিন পর হলো ইন্টার রুমে আসলাম। ইন্টারে পড়বার সময় যে জায়গাটায় আমি ঘন ঘন বসতাম সেইখানেই মেয়েটি বসে আছে, পা দুলিয়ে দুলিয়ে বসে বই নাড়াচাড়া করছে। আমি ঢুক গিলে রুমে ঢুকে আবার বের হয়ে গেলাম। কেমন নার্ভাসনেস কাজ করছে। বাইরে বের হয়ে গণিত ডিপার্টমেন্টের দিকে তাকিয়ে দেখলাম অনিক আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বের হয়ে আসতে যেন রাগে লাল হয়ে গেল, দূর থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। পাশের জনকে লক্ষ্য করে রাগমুখে কিছু বলছে। আমি নিশ্চিত এই কথাগুলো বলছে, "দেখ দেখ ছাগলটা এখনো যায়নি। একটু পরেই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কানের নিচে একটা দিতে ইচ্ছে করছে।"
আমি অনিকের রাগমাখা মুখ দেখে চোখবুজেই রুমে ঢুকে গেলাম। আমি জানি সারা কোথায় তবুও বড় ভাই হিসাবে হুট করে ছোট ক্লাসের স্টুডেন্ট, আরো স্পষ্ট করে বললে একটা মেয়েকে ফলো করা যায়না। ওরা অন্যকিছু ভাববে। অবশ্য আমি যে উদ্দ্যেশ্য নিয়ে এসেছি এমনিতেই ভাববে একটু পর। তবুও একটু মান নিয়ে সামনের ব্রেঞ্চের একজন মেয়েকে উদ্দ্যেশ্য করে বললাম..
- আচ্ছা তোমাদের মাঝে সারা কে? কে? কে?
সম্ভবত আমার মাঝে নার্ভাসবোধটা খুব বেশি হচ্ছে তাই দু তিনবার বলে ফেললাম "সারা কে?"
সারা তিন ব্রেঞ্চ পরে ছিলো। তাই স্বভাবতই আমার কথা শুনতে পেলো। প্রথম ব্রেঞ্চে থাকা মানবী ইশারা করে বুঝিয়ে দিলো, "ওই যে সারা বসে আছে!"
আমি এতক্ষণ আড়চোখে সারাকে দেখছিলাম, এবার ভালো করে দেখলাম। ওরে বাপরে, মেয়েতো নয় যেন আগুনেরি গোলা। কি মারাত্মক সুন্দর। আচ্ছা, অধিকাংশ সুন্দর মেয়েদের ঠোঁটের নিচে তিল থাকবে কেন? এই মেয়ের তো আছেই। আমি মেয়েদের মুখ দেখার পর চুল দেখি। সারার মুখমণ্ডল বেশ সুন্দর, চুলগুলোও। আরো সুন্দর লাগছে কারণ মাথার চুল উপর করে বেঁধে নিয়েছে। এটা সুন্দর পরিপাটি দেখার একটা কারণ নিশ্চয়। এতো সুন্দর মেয়ে আর কোথাকার কোন বলদ টাইপের অনিককেই সিলেক্ট করলো!
আমার তো ভাবতে অবাক লাগছে এতো সুন্দর একটা মেয়ে কেন এতো বাজে ছেলেকে বেছে নিলো। তাও আবার রাজনীতি করে এমন ছেলে। আচ্ছা,মেয়েটাকি জানে আমি এখন কি বলতে আসছি কিংবা কি ঘটবে এখন?
জানে সম্ভবত, তাইতো মুখের মাঝে কেমন উদাসীন উদাসীন ভাব।
আমি বললাম..
- অনিক ভাই বলেছেন তুমি ক্লাস শেষে উনার জন্য অপেক্ষা করতে।উনি তোমাকে ভালো করে দেখবেন।
ভালো করে দেখবেনের মানেটা মেয়েটা নিশ্চয় খুব ভালো করেই জানে, আশেপাশের সবাই না বুঝলেও। অবশ্য আমি নার্ভাসনেসের জন্য কথাগুলো খুব দ্রুত বলে ফেলেছি, স্পষ্ট বুঝা দুঃসাধ্য। সারা সেইজন্য প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি নিষ্পাপ তার চেয়ে থাকা, ইচ্ছা করছে মাথার চুলগুলো নেড়েচেড়ে দেই!
- সরি বুঝলাম না অনিককে আর আপনিই বা কে?
আজব তো! মেয়েটা কি ধূর্ত! ক্লাসে ফ্রেন্ডের সামনে ভালো মানুষ সেজে থাকবে আর বাইরে গিয়ে একটা গর্দভের সাথে ঘুরে বেড়াবে।
আমি নতুন করে কিছু না বলে আগের কথাটা আবার মুখস্থের মতো বলে দিলাম, আগের চেয়ে ধীরেধীরে।
সারা বসা থেকে উঠে বাইরে আসলো।আমিও পিছু পিছু গেলাম। আমার দিকে তাকালো। আমি চোখ সরিয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টের দিকে তাকালাম।দেখলাম অনিক বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে।
 - আপনি ওর চামচা?
সারা আমাকে বললো। আমি চামচা হতে যাব কেন! চামচা টামচা নই। অনিক ক্লাসের মাঝে সবচেয়ে খারাপ, সম্ভবত কলেজের মাঝেও। সে আমাকে এখানে আসার আগে নির্দেশ দিলো সারাকে কথাগুলো বলতে। অনিক ডিপার্টমেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর সাঙ্গপাঙ্গ একটার সাথে হেসে হেসে বলছিলো,, " মালটা কি জোশ মাইরি, ও'র রুমের পাশ দিয়ে আসতে আসতে দেখলাম বেশ আকর্ষণীয়ভাবে বসে আছে। তখন ইচ্ছে করছিলো না রে...!
আমি ডিপার্টমেন্টে ঢুকতে যাব তখন শুনছিলাম। আমি অনিকের দিকে একটু অন্যভাবে তাকালাম, কেন তাকালাম জানি না। হয়তো এরকম বিশ্রী কথা শুনে। তখনই সে বললো," ওই তোকে দিয়েই একটা কাজ করাই। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার রুমে গিয়ে দেখবি একটা মেয়ে বই পড়ছে,ঠোঁটের নিচে তিল আছে।বলবি ক্লাস শেষে আমার জন্য অপেক্ষা করতে। ভালো করে দেখবো।" আমার ওভাবে চেয়ে থাকায় সম্ভবত ক্ষেপছে।
অনিকের কথা না শুনার প্রশ্নই আসেনা।সিনিয়র সাথে সরকার দলের ক্ষমতায় ক্ষমতাধর।
- বলেন?
সারা আমাকে আবার প্রশ্ন করলো।
- আরে চামচা হতে যাব কেন? সিনিয়র ভাই তাই উনার আদেশটা পালন করলাম আর কি।
- অহ বাঁচলেন তাহলে। নয়তো ওর সাথে সাথে আপনাকেও...!
আমি বোকা হয়ে গেলাম। কি বললো মেয়েটা? আমাকে কি করতো চামচা হলে? চড় লাগাতো?
আর দ্বিতীয়ত, সারার তাহলে অনিকের সাথে সম্পর্ক টম্পর্ক নেই, এমনকি বাজে সম্পর্কও। অনিক থার্ড ক্লাস টাইপের ছেলে সুতরাং মেয়েদের বিরক্ত করাই ওর কাজ। সারাতো ওর আদর্শ টার্গেট হবার কথাই।
.............
.
..ছাদে বসে বসে সারার কথা ভাবছি। আমার কি উচিৎ কিছুদিনের জন্য নিজেকে লুকিয়ে ফেলা?
আজ কলেজে সারাকে কিছু না বলে এসেছি ঠিকই, কিন্তু এভাবে না বলে বলে কতক্ষণ থাকতে পারবো?
সারাকে নিজের অনিচ্ছাবশত খুব ভালোবেসে ফেলেছি। আমি সারার পাশ থেকে নিজেকে সরিয়ে কোনোভাবেই থাকতে পারবো না।কোনোভাবেই না!
তাহলে কি আমি সারার ক্ষতি করতে যাচ্ছি?
দুদিন আগে অনিক যা বললো তারপর কি আর সারার পিছে ঘুরঘুর করা যায়?
গতকাল আমি একটা টার্গেট করে বাসা থেকে বের হলাম। যে করেই হোক এই সম্পর্ক আর আগাতে দেওয়া যায়না। সারার সাথে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বললাম..
- আইসক্রিম টা ফেলে দাও তো।
- কেন? খাবো না?
- না অনেক খেয়েছ। বিরক্ত লাগে, কি এক সারাদিন মুখে ধরে থাকে।
- আচ্ছা তুমি শুধু শুধু অযথা মেজাজ দেখাচ্ছ কেন? কদিন ধরেই দেখছি তুমি চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছ। why? আমার সাথে বন্ধুত্ব ভাল লাগছে না?
- না লাগছে না।
- but why?
- উফ বিরক্ত! তোমার চালচলন কথা বার্তা কেমন বোরিং টাইপের। তাছাড়া আমি তোমার সিনিয়র ক্লাসের। ফ্রেন্ডশিপ হয় একই ক্লাসের মাঝে, ভিন্ন ক্লাসে নয়। তুমি একটা কারণ বলো তো সিনিয়র ক্লাসের একটা ছেলের সাথে বন্ধু হিসাবে থাকার?
- এসব চিন্তা নিয়ে আমার উপর বিরক্ত?
.
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিনা। বন্ধুত্ব কিভাবে নষ্ট করতে হয় সেটাও বুঝতে পারছিনা।
- আমি জানিনা। তবে আমার সাথে আর মিশামিশি করিও না কেমন? দেখো সারা,তুমি কোথায় আর আমি কোথায়। তোমার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস অনেক উঁচুমানের। আমার সাথে শুধু শুধু টাইম ওয়েষ্ট করছো। আর যেমন তোমার ভাই বিষয়টা ভালোভাবে নিবে না, তেমনি অনিকও!
- ওহ।এই কথা?
-হু।
আমি অস্বস্তি নিয়ে চলে আসি। সারাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কি যথেষ্ট হয়েছে?
.
.
ঘটনা-২:
..... - আপনার বস কোথায়?
কলেজ গেইটে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কলেজে যাব, সাথের একজন লাইব্রেরিতে বই কিনতেছিলো। দেখলাম সারা মেয়েটি ফ্রেন্ডের সাথে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বললো তো? আমার বস তো কেউ নেই।কার কথা বলছে! সারা মেয়েটা তো আরো সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। অনিক টপিকে সারাকে দেখার পর প্রায় ২০-২৫ দিন পর আবার দেখলাম।
- বুঝলেন না তো। অনিক গুন্ডাটার কথা বলছি।
.
এবার বুঝলাম সারা কি বলতে চাইছে। আমি বললাম..
- তুমি আসলে ভুল বুঝতেছো। অনিক আমার সিনিয়র তাই ওর...!
- সেকথা বলেন না কেন নেতা কেতা থাকায় ভয় পেয়ে জ্বী জ্বী করে আমার কাছে আসছিলেন। সেদিন আপনাকে কিন্তু..!
কথাটা বলে সারা এবং ওর ফ্রেন্ডরা হাসছে। কথা কিন্তু সত্য। অনিক লিগের নেতা, তাই নিজের পড়াশোনায় তার প্রভাব না পড়বার জন্য জ্বী জ্বী করে যেতে চাইবো, আর সেটা সেইদিনও করছিলাম।
- আপনার বস কোথায় জানেন? জেলে।
সারার সাথের এক ফ্রেন্ড বললো।
অনিক জেলে! সেটা কিভাবে সম্ভব! তার দল ক্ষমতায় যে! সারা কি নারী নির্যাতন কেইস টেইস করছে নাকি?
আমার মনে আরো প্রশ্ন জাগলো। তাহলে কি সারার সাথে অনিকের সম্পর্ক নাই? দারুণ খবর।কিন্তু আমার ভাল লাগছে কেন? বুঝতে পারছিনা!
সারা ও'র ফ্রেন্ডদের সাথে চলে যাচ্ছে কলেজে।আমি ওদের সামনে যেয়ে বললাম..
- ছোটবোন, জেলে কি তুমি পাঠিয়েছো? কাজটা তো দারুণ হলো।
সারা আমার কথা শুনে হাসলো। বললো..
- হুম। ভাইয়া তো পুলিশ তাই।
আমার মাথা একটা ৩৬০ ডিগ্রী কোণে ঘুরা দিলো। পুলিশের সিস্টার! ওরে বাপরে!
পুলিশের বোনরা দারুণ হয় দেখতে। এতোদিন যেখানে শুনতাম কথাটা হেসে উড়িয়ে দিতাম।এবার প্রমাণিত হলো কথা কিন্তু সত্যি। তবে আমি এতো ভয় পাচ্ছি কেন? আমারতো ভয় পাবার কিছু নেই।আমিতো আর পুলিশের সিস্টারের সাথে লাইন মারছি না।
সম্ভবত মেয়েটা সিঙ্গেল হবে।পুলিশের বোনরা দীর্ঘদিন সিঙ্গেল থাকে, শোনা কথা।
- আপনার বসের জন্য কষ্ট হচ্ছেনা?
- আরে পুলিশের সিস্টার, আমার বস টস কিছু নয় গুণ্ডাটা। বুঝছো? না বুঝলে মুড়ি খাও।
- কি বললেন?
এমা! কি বললাম এগুলা। পুলিশের সিস্টারকে মুড়ি খেতে বলছি?
- সরি,সরি। আসলে মুড়ি নয়।বলছি না বুঝলে বার্গার খাও।মুড়ি থেকে দামী।
- what the hell are u talking!
পুলিশের সিস্টারকে সাধারণ ভাষায় কি বলবো একটা জিনিস না বুঝলে সেটাই বুঝতেছিনা। আচ্ছা, আপনি সমাজের নামীদামী ব্যক্তি।আপনি আমার একটা কথা বুঝলেন না বারবার বলার পরেও।তখন আমার কি বলা উচিৎ? না বুঝলে মুড়ি,বার্গার খান।এটা কি খুব বেশি বলে ফেলেছি? এভাবে ইংলিশে গালি মারতে হয়?
আমি কিছু না বলে দ্রুত প্রস্থান করলাম।না জানি কি থেকে কি বলি আর অনিকের সাথে জেল খাটতে হয়! আমি পারবোনা একই সাথে একই জেলখানায় বসবাস করতে!
.......
.
.
দুদিন আগে অনিক এসে বললো..
- তোকে সারার সাথে ঘুরঘুর করতে দেখতেছি।কেন?
আমি এই কথা শুনে কি বলবো বুঝতে পারছিনা। আমি চুপ থাকলাম।
- কি রে আঙ্গুল বাঁকা করতে হবে নাকি?
- না মানে সারা আমার পূর্ব পরিচিত। এক স্কুলে পড়তাম তো তাই। বড় ভাই বলে ডাকে।হেহে।
.
কথাটা বলে হেসে দিলাম। মিথ্যাকথা বলেছি।সারাকে কিছুদিন ধরে চিনি, এর আগে জীবনেও দেখিনি। অনিক সম্ভবত আমার কথায় ভরসা পেল না। কেমন ঝিম ধরে রয়ে ভাবতেছে। বলল..
- সারার সাথে আর মেশামেশির দরকার নেই।ঠিক আছে? মনে থাকবে তো!
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম ও'র কথায়। আমার ও মনে হচ্ছে সারার সাথে আর মেশার দরকার নাই। আমার বাসায় যদি জানে আমি একটা মেয়ের জন্য একসাথে পুলিশ, নেতা কে নিয়ে লড়ছি।তাহলে কাজের কাজই হবে।এরচে' ভাল আমার সরে পরা। তাই গতকাল সারাকে ফ্রেন্ডশিপ বাদ দিয়ে দিতে বলেছি, আর আজ এড়িয়ে চলে এসেছি। তবে এসবে কাজের কাজ কিছুই হবেনা। একদম সিরিয়াস ভাবে কিছু করতে হবে। ছাদ থেকে উঠে ঘুমাতে চলে গেলাম।
.
.
ঘটনা-৩:
... চার পাঁচদিন পরের কথা। লাইব্রেরীতে একটা বই কিনতে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দেখি একশো বিশ টাকা আছে।লাগবে দুশো টাকা। আমার কাছে আর নেই। টাকার হিসাব ভুলে গিয়েছিলাম, মনে করেছিলাম দুশো টাকা আছে।বই কেনার পর হেঁটে হেঁটে মেসে চলে যাব।দাম করে এখন টাকা দিতে পারছিনা, লজ্জা লাগছে।
- লাগবে টাকা?
পিছনে চেয়ে দেখি সারা দুহাত পেটে ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁট বাঁকা করে রেখেছে। আমার মনে হয় মেয়েটি ঘণ্টায় ঘণ্টায় সুন্দর হয়। কয়েকদিন আগে কলেজ গেটে দেখে এর আগের থেকে সুন্দর লাগছিল,এখন আরো বেশি সুন্দর লাগছে।
বইটা খুব দরকার। তাই রাজি হয়ে গেলাম। বলল..
- আঁশি দিলে আমার সাথে যেতে হবে।
কি বুঝাতে চাইলো আমি বুঝতে পারিনি। বিক্রেতা টাকা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো, তাই আঁশি টাকা নিয়ে নিলাম।
- চলেন।
সারার কথা শুনে অবাক চোখে তাকালাম। আমি প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম।
- এই রোদের মাঝে হেঁটে যেতে পারবেনা না তো। অবাক হয়ে তাকাতে হবে না। আপনার মানিব্যাগ ফাঁকা।আমি দেখেছি।
.
আমার পিছন থেকে তাহলে দেখে ফেললো। বেশ লজ্জা লাগছে।সম্ভবত দিনটা ভাল যাবেনা। এখনই কেন সারাকে লাইব্রেরিতে আসতে হবে! পরে আসলে কি হত?
-আসলে অনিক ছেলেটা আমাকে বেশ কিছুদিন ধরে ডিস্টার্ব করছে। প্রথম প্রথম পাত্তা দেয়নি।
.
সারা আর আমি গাড়িতে অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর সারা হঠাৎ করতে বললো। কথাটা শুনে আমার সবটুকু শুনার আগ্রহ বাড়লো।এমনিতেই কিছুদিন ধরে আগ্রহ ছিল কাহিনীটা আসলে কোথায় জানার, কিন্তু এই মেয়েকে চারদিন আগে মুড়ি,বার্গার খাওয়ার কথা বলে প্রায় তর্ক বাধিয়ে ফেলেছি। তাই সাহস হয়নি।
- তারপর?
- তারপর দেখলাম ঘন ঘন আমাকে ডিস্টার্ব করছে। কলেজ থেকে বের হবার পর তো প্রায় সাথে সাথে পুলিশ ফাঁড়ি পর্যন্ত আসে।তারপর সরে পড়ে। তবুও কিছু হতোনা।কিন্তু তার কিছুদিনপর থেকে পাশেপাশে হেঁটে নানান কথা বলে,ভাইয়াকে গালি দেয়।তবুও ভাইয়াকে বলিনি কিছু। আপনি সেদিন ওইটার কথায় ক্লাসে আসায় রাতে ভাইয়াকে বলি।ভাইয়া ও'র নামে কয়েকটা কেস আছে বলে।তাই ও'কে ধরে নিয়ে যায়।আপনাকেও জেলে ঢুকাবো!
.
শেষটুকু বলে সারা হেসে দেয়। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনার পর সারার হাসায় আমিও হেসে ফেলি। এসব কথা শুধু নীরব দর্শকের মতো শুনে যেতে হয়। কোনো সাজেশন দেওয়া যায়না। আইন যেখানে আহত, উন্নতি সেখানে নিহত। জানি কিছুদিন পরই অনিক ছাড়া পেয়ে যাবে।
তারপর প্রায়ই সারার সাথে টুকটাক কথা হয়। আমাকে ভাল বন্ধু হিসাবে মেনে নিয়েছে। জুনিয়র ক্লাসের একটা মেয়ের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করার উদ্দেশ্য কি হতে পারে?
একদিন বললাম..
- সারা তুমি আমার জুনিয়র। আমার সাথে এভাবে কথা বলা, চলাফেরার কারণ কি হতে পারে?
- কেন ভাল লাগছে না বুঝি?
- না তা নয়।এভাবে হয় নাকি?
- বন্ধুত্ব, সম্পর্কে নেই ধরাবাঁধা।
বলে অদ্ভুতভাবে হাসলো। আমার বুকের মধ্যে দিয়ে মৃদু ঝড় বহে গেলো। আমি আর কথা বাড়ায়নি।
........
.
- তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
সারার কথা ভাবতে ভাবতে গতরাতে ঘুমিয়ে যাই।আর এক ঘুমেই সকাল। তবে ফোনের শব্দ না হলে ঘুমের স্থায়িত্ব আরো বাড়তো। সারার ফোনে ঘুম ভাঙ্গলো।আমি বললাম..
- আমার নাই।
- শুভ্র মজা করো না। গতকাল কলেজ থেকে ওইভাবে চলে আসা তোমার ঠিক হয়নি। আসো বলছি।
- না।
- তুই আসবি না?
এই প্রথম সারা তুই করে বলছে। আমি অনেকটা রাগ নিয়ে দেখা করার জন্য উঠে পড়লাম।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর সারা বললো..
- তুমি এমন করো কেন?
বলে মুখ কালো করে রইলো।
- আচ্ছা কোথায় লিখা আছে ফ্রেন্ডশিপ সারাজীবন ধরে রাখতে হয়? আমার প্রয়োজন শেষ তাই আর রাখবো না।
আমার কথাশুনে সারা চোখে চোখে চেয়ে রইলো।আমার কেমন যেন লাগলো। চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম।
- এটা মনের কথা নয় তোমার।আমি তোমাকে চিনি। এভাবে কথা বলতে পারো না।
.
সারার কথাবার্তা মোটেও সুবিধার লাগছে না। সারা আমার হাতে ধরে বলল..
- প্লীজ এমন করো না।আমার চোখের দিকে তাকাও।
আমি হাত ছাড়িয়ে নিলাম।
- এগুলা কোন ধরণের কথাবার্তা, সারা? তুমি কি বলতে চাইছো?
.
সারা এভাবে কখনোই কথা বলেনি। তবে কি সারা আমার প্রতি দুর্বল? আমি যা মনে মনে ভাবছিলাম তাই ঠিক। এটা ঠিক নয়। একদিকে অনিক,অন্যদিকে পুলিশ ব্রাদার।এদের সাথে লড়াই করার মতো অস্ত্র আমার নাই।আমি আগেই পরাজিত।
- আমি বলতে চাইছি তুমি আগের মতো হবা।ব্যাস!
- পাগলামি করো না তো। অনিক কয়েকদিন আগে ছাড়া পেয়েছ।দেখো নাই? তার উপর তোমার ভাইকে আমার মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না।
- অনিক কে ভয় পাও, ভাইয়াকে ভয় পাও তাইতো??
.
আমি উত্তর না দিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে রইলাম।সারা "ওকে ফাইন" বলে চলে যাচ্ছে। আমি আটকালাম না। আচ্ছা সারা যদি ভয় পাই সেটাই ভেবে নেয় তাহলে কি দূরে সরে যাবে? যদি তাই হয় তাহলে সেটাই ভাল!
.
এভাবে দুদিন কেটে গেল। বিকালে ক্লাস করে ফিরছি এমন সময় হঠাৎ করে আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসলো। আমি রিসিভ করতেই আমাকে বলল
- শুভ্র তো? সারাকে চিনেন?
আমার বুকের ভিতর হঠাৎ করে কেঁপে উঠলো।
- এই জায়গায় আসেন।
আমি তড়িঘড়ি করে চলে আসলাম।
- তুমি শুভ্র?
- জ্বী।
সাদা পাঞ্জাবি পরা যুবকটাই পুলিশ হবে, সম্ভবত। পাশে আরেকজন আছে, তিনিও পাঞ্জাবি পরেছেন। লাল পাঞ্জাবি! তিনি সম্ভবত সারার বাবা।
- দুদিন করে কিছু খাচ্ছেনা। সব কিছু ভাংচুর করছে,
সাদা পাঞ্জাবি পরা লোকটা বললেন।
বড়লোক ছেলে-মেয়েদের একটাই স্বভাব মন মতো কিছু না হলে জিনিসপত্র ভাঙ্গা,হাত কাটা। সারা বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় থেকে আমার দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখগুলো খুব লাল হয়ে আছে। খুব কেঁদেছে। আমি পিছনের দিকে তাকাতেই দুই ভদ্রলোক বাইরে চলে গেলেন।
- ওই পাগলির ঘরের পাগলি এভাবে ফ্রেন্ডশিপ শেষ করা?
- ঘর তুলবা না। খুশি হও নাই?
- একশোবার তুলবো।
- কোন অধিকারে?
আমি কিছু বলতে চেয়েও চুপ হয়ে রইলাম।কথা ঘুরিয়ে বললাম..
- খুব ব্যথা হচ্ছে? এভাবে হাত কাটার মানে হয়?
- হুম। খুব হাত ব্যথা।একটু পর আবার কাটবো।
- না কাটবে না।
- কেন?
- ব্যথা পাবে।
- আমার ব্যথা হলে তোমার তাতে কি?
আমি উঠে গিয়ে রুমের জানালায় এসে বাইরে থাকিয়ে আবার সারার পাশে যেয়ে বলি..
- আমি জানি বারবার তুমি আমাকে দিয়ে কি বলাতে চাচ্ছ। জেদ দিয়ে সব হয়না সারা।
- আচ্ছা।
- আচ্ছা কি! প্রমিজ করো আর এমন করবে না।
- প্রমিজ অল্প সময়ের জন্য করে কি হবে? একটু পর ভেঙ্গে ফেলবো যে!
- তাহলে আমাকে এখানে আনালে কেন?
- প্রমিজ ভাঙ্গার সাক্ষী হবে।তাই।
.
আমি সারার পাশে যেয়ে বসে ও'র কপালে,চুলে হাত বুলিয়ে বললাম..
- প্লীজ সারা। আবেগ কণ্ট্রোল কর।প্লীজ!
- এভাবে সারাজীবন হাত বুলিয়ে দিলে ভেবে দেখবো।
আমি জলদি হাত সরিয়ে নিলাম। আমার মনে হচ্ছে আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না।
- সারা বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে ফলের ছুরি নিয়ে বলল..
- ওকে ঠিক আছে।আমার কাটার সময় এসে গেছে।
আমি চোখ বুজে নিয়ে বললাম..
- আচ্ছা।আচ্ছা। ঠিক আছে। আমি সারাজীবন এভাবে হাত বুলিয়ে দিবো।
চোখ খুলে দেখলাম সারা একদম কাছে চলে এসেছে আর হাসছে। আমি বুঝে গেলাম সারা কি করতে চায়। আমি মাথা নেড়ে না করলাম। ইতস্ততভাবে বললাম..
- মানলাম তো।
সারা আমার কথা শুনছেই না।অন্যভাবে চেয়ে আছে। আমার হাত সরিয়ে নিয়ে বুকে মাথা গুঁজবার প্রচেষ্টা।
কি এক অদ্ভুতভাবে এই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলাম। প্রেম ভালবাসা আসলেই ভয়ঙ্কর রকমের অন্ধ।মানে না কোনো প্রতিবন্ধকতা। এই প্রেমের কাছে কোথায় গেল পুলিশ, কোথায় গেল নেতা আর কোথায় রইলো পারিবারিক অসামঞ্জস্যতা।
আমি ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলাম।কিন্তু পারলাম না। পারবোও না।
সারার সাথে অদ্ভুত বন্ধনে জড়িয়ে পড়লাম। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন