শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭

একটি রাগ, অতঃপর

অন্যমনস্ক হয়ে হাটছে রনি। মাঝেমাঝে দুই একবার টান দিচ্ছে সিগারেটে। আজ ভালোবাসা দিবস। ইশাকে কি উপহার দেয়া যায় ভাবতে লাগল রনি। ভাবতে ভাবতে একটা ফুলের দোকানে এসে হাজির হলো। একটা ফুলের তোড়া কিনল। তখনই ইশার ফোন এল। ফোন রিসিভ করতেই ইশার ধমক শোনা গেলো:- রনি, তুমি কোথায়? কতক্ষণ ধরে আমি অপেক্ষা করে বসে আছি?"
--আসছি বাবা, আসছি। আর ১০ মিনিট ওয়েট কর।" বলেই ফোন কেটে দিল রনি। তারপর জুয়েলার্সের দোকানে গিয়ে পছন্দ করে একটা স্বর্ণের আন্টি কিনল ইশার জন্য।
দশমিনিট পর ইশা আবার ফোন দিল। রনি ফোন কেটে দিয়ে একটা টমটমে উঠল। ইশা বারবার ফোন দিতে লাগল। শেষে আর থাকতে না পেরে ফোন রিসিভ করল রনি। ইশা রাগ দেখিয়ে বলল:
--রনি, তোমাকে আর আসতে হবেনা, চলে যাচ্ছি আমি।"
--প্লিজ, আর দশমিনিট অপেক্ষা কর শুধু। আমি গাড়িতে উঠছি, দশমিনিটেই পৌঁছে যাব।"
ফোন রেখে দিয়ে রনি টমটম চালকের উদ্দেশ্যে বলল: ভাই, তাড়াতাড়ি চালাননা একটু......"
ড্রাইভার কোন জবাব দিলনা। একই গতিতে চলতে লাগল টমটম।
পার্কে এসে পৌছতে রনির ১৫ মিনিট লাগল। ইশা উঠে চলে যাচ্ছিল। রনি তার হাত ধরে টান দিল। ইশা এসে পড়ল রনির বুকে। রনি কান ধরে বলল:
--সরি জানু, একটু দেরি হয়ে গেলো।"
ইশা নাক চেপে ধরে বলল: তুমি আজকেও স্মোক করেছ?"
--একটা টেনেছি শুধু। টেনশন বেড়ে গেছিল তাই।
--কিসের এত টেনশন তোমার?" বলতে বলতে ইশা ধাক্কা দিয়ে একটা বেঞ্চে বসাল। তারপর নিজেও তার পাশে বসল।
রনিকে চুপ দেখে আবারও গর্জে উঠল সে:
--বল, কেন সিগারেট খাইছ? তোমাকে না বলেছি, এসব অভ্যাস থাকলে আমি আর সম্পর্ক রাখতে পারবনা।"
--আসলে বাবার সাথে আজকেও অনেক কথা কাটাকাটি হয়ছে। চাকরি করিনা, বসে বসে খাই এসবের জন্য।"
ইশা কিছুটা শান্ত হলো। রনির মুখে হাত বুলিয়ে বলল: চিন্তা করোনা বাবু, একদিন নিশ্চয়ই তুমি বড় চাকরি পাবে...."
রনি মুখ নিচু করে রইল। ইশা তার মুখটা ধরে উপরে তুলল। তারপর একটা টিস্যু বের কর করে রনির ঠোঁটটা মুছে নিয়ে বলল: দেখতো সিগারেট খেয়ে খেয়ে আমার পছন্দের জিনিসটা কেমন কালো হয়ে যাচ্ছে........."
--সরি বেবি....." কোমলকণ্ঠে বলল রনি। ইশা তখন রনির ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল তাকে। তারপর নিজের ঠোঁটটা ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গেলো রনির ঠোঁটের দিকে। চোখ বুজে আলতো করে ছুয়ে দিল ঠোঁটে ঠোঁট। দুজনের শরীরে তখন পুলকিত শিহরণ বয়ে গেলো।
একটুপর রনি ইশার বামহাতটা টেনে নিয়ে আন্টিটা পরিয়ে দিল একটা আঙুলে। তারপর একপায়ে হাটুগেড়ে বসে ফুলের তোড়াটা সামনে ধরে বলল:
--ইশা, অনেক ভালোবাসি তোমাকে।"
রনির কান্ড দেখে চোখে জল এসে গেলো ইশার। ফুলের তোড়াটা নিয়ে বুকে টেনে নিল রনিকে। তারপর বলল: আমিও তোমায় অনেক ভালোবাসি রনি।"
ইশা রনির ডানহাতটা টেনে একটা ঘড়ি পরিয়ে দিয়ে বলল: এটা তোমার জন্য আমার উপহার। যখনই আমার কথা মনে পড়বে, এই ঘড়িটা দেখবে।"
--আচ্ছা।" বিনয়ীকণ্ঠে জবাব দিল রনি।
এরপর সারাদিন দু'জন ঘুরাঘুরি করল অনেক। রাতে রনি বাসায় ফিরল। তখন তার বাবা তাকে ডাক দিল। রনি বাবার সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে বলল:
--হ্যা বাবা, কিছু বলবে?"
--আমার জামার পকেট থেকে কত টাকা নিয়েছ আজ?" গর্জে উঠলেন রনির বাবা মাসুদ সাহেব।
--সামান্য নিয়েছি বাবা......" মুখ নিচু করেই বলল রনি।
রনির গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে মাসুদ সাহেব বললেন: হতচ্ছাড়া ছেলে, রোজ রোজ টাকা চুরি করতে তোর লজ্জা করেনা? নিজে তো চাকরি করিসনা।"
ভেতর থেকে তখন রনির মা আয়েশা বেগম এসে রনিকে টেনে নিয়ে গেলেন। পেছন থেকে মাসুদ সাহেব স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন: তোমার জন্যেই ছেলের আজ এই অবস্থা। প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছ।"
আয়েশা বেগম স্বামীর কথায় কান না দিয়ে ছেলেকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। ছেলেকে পাশে বসিয়ে খেতে দিলেন। তারপর ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন: রনি, তুই একটা চাকরি কি পাবিনা বাবা?"
রনি জবাব দিল: নতুন একটা চাকরিতে অ্যাপ্লাই করেছি মা। দেখি ওরা কি করে।"
--ঠিক আছে বাবা, দোয়া করি এই চাকরিটা যেন তোর হয়।"
খাওয়ার পর রনি নিজের রুমে এসে একটু শুইল। তখন ইশার ফোন এল। ফোন রিসিভ করতেই ইশার কান্না শুনা গেলো।
--কি হলো ইশা?" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল রনি।
কাঁদতে কাঁদতে ইশা জবাব দিল: রনি, আজকে আমার বাবা আমাদেরকে পার্কে দেখে ফেলেছে, আমাকে খুব মেরেছে এখন। বলছে বিয়ে দিয়ে দেবে। আমার জন্য নাকি পাত্র আসতে বলবে দু'দদিনের মধ্যে।"
এই মুহূর্তে রনির কি বলা উচিত বুঝতে পারলনা সে। ইশাকে সে অনেক ভালোবাসে। তাকে হারাতে পারবেনা।
--ইশা, তুমি চিন্তা করোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে।" বলার সময় গলাটা কেঁপে উঠল রনির।
--কি ঠিক হবে? দু'দিন পর আমাকে দেখতে অন্য পাত্র আসবে, আর তুমি বলছ......
--তো আমি কি করব এখন?"
--তুমি তোমার বাবা মাকে কাল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে বল আমার বাবার কাছে।
--ঠিক আছে বলব।"
--মনে থাকে যেন, কাল অবশ্যই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেন আসে.....
--আচ্ছা....."
ওপাশ থেকে ইশা ফোন রেখে দিল। রনি চিন্তা করতে লাগল এখন সে কি করবে। বাবা-মাকে কি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাঠাবে? এছাড়া তো আর কোন উপায় নেই।
পরদিন সকালে মাথা নিচু করে রনি গেলো তার বাবার সামনে। একটু ইতস্তত করে বলল:
--বাবা, একটা কথা বলার ছিল.....
--বল....." গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন মাসুদ সাহেব।
--বাবা, তোমাদেরকে আজ আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে এক জায়গায়....."
রনির কথা শুনেই মাসুদ সাহেবের রাগ উঠে গেল মাথায়। এমনিতেই তিনি অনেক রাগী। রনির গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললেন: লজ্জা করলনা এ কথা বলতে? নিজে কোন চাকরি করিসনা, বউকে খাওয়াবি কি? আর তোর মতো একটা বেকারকে বউ দিবে কে? শুধু শুধু প্রস্তাব নিয়ে গিয়ে আমি অপমানিত হতে পারবনা, যা এখান থেকে...."
--বাবা প্লিজ একটু দেখনা......
মাসুদ সাহেব তখন আবারও ছেলের গায়ে হাত তুললেন। আয়েশা বেগম এসে ছেলেকে আগলে নিয়ে স্বামীকে বললেন: যখন তখন ছেলের গায়ে হাত তোল কেন? দেখ, একদিন তোমার এই রাগের জন্যেই তোমাকে পস্তাতে হবে। চরম মূল্য দিতে হবে।"
 রনি নিরবে চলে এল ওখান থেকে। বুঝল বাবাকে বলে কোন লাভ নেই। রুমে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল সে। কি জবাব দেবে সে এখন ইশাকে।
সেদিন আর গেলনা রনির বাবা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। ওদিকে ইশা সারাদিন পথ চেয়ে ছিল কবে রনির বাবা মা আসবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। সেও নিরাশ হলো।
বিকেলে ইশাকে ফোন দিল রনি। ইশা রিসিভ করে বলল:- রনি, কই তোমার বাবা মা তো এখনও আসেনি?"
রনি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল:- ইশা, ওরা যাবেনা...."
রনির কথা শেষ না হতেই ইশা ফোন কেটে দিল। এরপর রনি অনেকবার ফোন দিল ইশার নাম্বারে। কিন্তু ইশার ফোন বন্ধ। সারারাত রনি কেঁদেই কাটিয়ে দিল।


আজ কয়েকদি ধরে ইশার সাথে রনির কথা হচ্ছেনা, দেখা হচ্ছেনা। ঐ দিনের পর থেকে ইশার ফোন এক মুহূর্তের জন্য খোলা ছিলনা। আজ হঠাৎ করে ওর নাম্বারে ফোন গেলো। তখন খুশিতে রনির ভেজা চোখদুটো জ্বলে উঠল। ইশা ফোন রিসভ করে বলল:
--রনি, কি বলবে বল?"
--ইশা, আমি তোমার সাথে একবার দেখা করতে চাই।"
--আমিও তোমার সাথে দেখা করতে চাই। পার্কে এসো ৩০ মিনটের মধ্যে।"
রনি ফোন রেখে দিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হলো। ইশার দেয়া কালো টি-শার্টটা পরে বের হলো সে। বিশ মিনিটেই পৌঁছে গেল পার্কে। একটু পর ইশা আসল। সে আজ নীল শাড়ি পরেছে। কপালে একটা লাল টিপ। মনে হলো কোন পরী নেমে এল আকাশ থেকে। ইশা এসে দূরত্ব বজায় রেখে বসল রনির পাশে। তারপর বলল: রনি, আজ তোমার সাথে শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছি.....
--মানে?" চমকে উঠল রনি।
--মানে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে....."
রনি দেখল ইশাকে ঐ দিন যে আন্টিটা পরে দিয়েছিল সে, সেই আন্টিটা নেই। সেই জায়গায় এখন অন্য একটা আন্টি।
--আন্টিটাও বদলে ফেলেছ?" করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রনি।
--হ্যা, এটা আমার এনগেজম্যান্ট রিং। পাত্রপক্ষ পরিয়ে দিয়ে গেছে। আর এই নাও, তোমার সেই আন্টি। এটার ভার আমি সহ্য করতে পারছিনা। এটা যতক্ষণ আমার কাছে থাকবে ততক্ষণ আমি তোমার কথা ভুলতে পারবনা। এটা ফেরত দিতেই এসেছি।" আন্টিটা রনিকে দিয়ে ইশা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে গেলো। রনি কয়েকবার ডাক দিল ইশার নাম ধরে। ইশা থামলনা। একটা রিকশায় উঠে চলে গেল। রনি ওখানেই হাটুগেড়ে বসে পড়ল। দু'চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল তার।


ইশার বিয়ের দিন রনি সকাল থেকে দরজা বন্ধ করে রুমে শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল। তখন মাসুদ সাহেব এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে রনিকে ডাকলেন কয়েকবার। চোখ মুছে দরজা খুলে দিল রনি জিজ্ঞেস করল:-
--কি হয়েছে?"
মাসুদ সাহেব একটা খাম রনির দিকে এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললেন:-
--এই নে, তোর চাকরি হয়ে গেছে, এটা তোর চাকরির এপয়েনম্যান্ট লেটার।"
রনি তার বাবার হাত থেকে খামটা নিয়ে চোখের সামনে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল। মাসুদ সাহেবের রাগ তখন অনেক বেড়ে গেলো। কয়েকটা লাথি, থাপ্পড় দিয়েও যখন রাগ কমলনা, তখন তিনি বললেন: দাড়া, তোকে আজ খুন করে ফেলব।" বলেই তিনি ছুটে গেলেন দা আনতে।"
একটু পর একটা দা নিয়ে এসে কোপ মারতে যাবেন রনিকে, ঠিক তখনই আয়েশা বেগম এসে ছেলেকে আগলে ধরে। কোপটা তার মাথায় লেগে যায়। জোরে আর্তনাদ করে আয়েশা বেগম মাটিতে ঢলে পড়লেন। "মা মা" বলে চিৎকার করে উঠল রনি। আশেপাশের বাসা থেকে লোক এসে মাসুদ সাহেবের হাত থেকে দা টা কেড়ে নিল। তারপর আয়েশা বেগমকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই মারা গেলেন তিনি।
এরপর পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় মাসুদ সাহেবকে। আয়েশা বেগমের পোস্ট মর্টেম হয়। পোস্ট মর্টেম শেষে লাশ নিয়ে আসা হয় বাসায়। লাশের গোসল করিয়ে জানাজা পড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। জানাজা শেষে রনি নিজের মাকে নিজ হাতে কবরে শুয়ে দিল। তারপর ধীরে ধীরে মাটি দিতে লাগল কবরে।
কবর দেয়া শেষে সবাই চলে গেল। রনি একা মায়ের কবরটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল জোরে জোরে। এই পৃথিবীতে একমাত্র তার মা ই তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত, সেই মাও আজ তাকে ছেড়ে চলে গেল। অনেক্ষণ কাঁদার পর রনি চোখ মুছে উঠল। রাস্তা ধরে হাটতে লাগল বাসার দিকে। তখন পাশ দিয়ে কয়েকটা বিয়ের গাড়ি চলে যেতে লাগল। এক মুহূর্তের জন্য রনি কনের মুখটা দেখতে পেল। তার চিরচেনা সেই মুখ। তার প্রিয়তমা ইশা বউ সেজে চলে যাচ্ছে তার পাশ দিয়ে। গাড়িগুলো যতক্ষণ দেখা যায় রনি তাকিয়ে থাকল সেদিকে। তারপর ডানহাতে নজর গেলো তার। ইশার দেয়া ঘড়িটা তখন তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রনি একটা জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল বাতাসে। সময়টা তার খারাপ যাচ্ছে। সব এলোমেলো হয়ে গেলো আজ। সবকিছু হারিয়ে সে আজ নিঃস্ব। এই ঘড়িটা যতক্ষণ হাতে থাকবে ভুলতে পারবেনা সে ইশাকে। ঘড়িটা হাত থেকে খুলে ছুড়ে ফেলে দিল রনি..... তারপর হাটতে লাগল অন্যমনস্ক হয়ে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন