রবিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৭

সুইসাইড নোট

ডিপ্রেশন অনেক ছোট একটি শব্দ। কিন্তু এর অর্থ যে কতটা ভয়াভয় সেটা মেঘ আজ বুঝতে পারছে।কোন কিছুই যেনো ভালো লাগছে না তার। একরাশ ব্যার্থতার বোঝা যেনো ধুকে ধুকে খাচ্ছে মেঘের ভেতরটাকে। নিজেকে আর নিজের জীবনকে অনেক তুচ্ছ মনে হচ্ছে তার কাছে। এই সব কিছুর কারন একটাই...মেঘ মেডিকেলে চান্স পায় নি।
.
মেঘ পরিবারের একমাত্র ছেলে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হলেও তার বাবা কখনোই সেই মধ্যবিত্ত হওয়ার কষ্টটা বুঝতে দেন নি। মেঘের প্রতিটি চাওয়া, পাওয়া আর আবদার গুলি কষ্ট হলেও পূরণ করেছে। অনেক কষ্ট করেই বড় করে তুলেছে মেঘকে। আর বিনিময়ে তো তারা কিছু চাইতেই পারে। ঠিক এমনটাই চেয়েছিলো যে তাদের ছেলে অনেক বড় ডাক্তার হবে। কিন্তু মেঘ আজ তাদের কোন চাওয়াই রাখতে পারে নি।
.
যখন মেঘের রেজাল্ট দেয় তখন সে রেজাল্ট শোনার পর তার বাবার আশা ভরা মুখের হাসী এক নিমিষেই বিষন্বতায় রূপ নেয়। মায়ের চোখের পানিটাও স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছিলো মেঘ। সারাদিন কেউ কিছু খায় নি। মেঘ তার ঘরের দরজা বন্ধ করে এসব কিছু ভাবছিলো। নিজের কাছেই নিজেকে অনেক বড় আপরাধী মনে হচ্ছে। আজ রাত নিঃস্তব্ধ কিন্তু কাল সূর্য ওঠার সাথে সাথেই চার পাশের সবাই বিভিন্ন ধরনের কথা বলবে আর মেঘের জন্যই তার বাবা মাকে ছোট হতে হবে সবার কাছে কারন মেঘ যে তাদের একমাত্র গর্ব ছিলো আর মেঘ সেই গর্বের মর্যাদাটা রাখতে পারে নি।
.
অনেক ভেবে ফেলেছে আর ভাবতে পারছে না। এখন শুধুই একটাই পথ মেঘের চোখের সামনে ভাসছে আর সেটা হলো সুইসাইড। অনেক রাত। নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে পাশের মায়ের রুমে যায়। মা ঘুমচ্ছে। সারা দিনের বোবা কান্নায় চোখ দুটি ফুলে গেছে। শেষ একটি বারের জন্য মাকে দেখে মেঘ আবার রুমে ফিরে আসে। একটা সুইসাইড নোট লেখা প্রয়োজন। আর তাই মেঘ লিখতে থাকে...
>>> যখন আমার এই লেখা গুলি তোমরা পড়বে তখন আমি তোমাদের থেকে অনেক দূরে চলে গেছি যাকে আর চাইলেও তোমরা ফিরিয়ে আনতে পারবে না। জানো আমি কখনোই চাই নি তোমাদের মাথা নিচু হোক আমার জন্য। সত্যি বলছি আমি চেষ্টারও কোন কম করি নি। কিন্তু দেখো হেরে গেছি জীবনের কাছে। এখন এই পরাজিত জীবনের আর কোন দাম নেই। তাই তো তোমাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। সবাই কি কাদছো তোমরা? প্লিজ কেউ কেদো না। তোমাদের চোখের পানির মূল্য অনেক বেশি। আম্মুকে সবাই একটু দেখে রেখো। আম্মুর কষ্টের মূল্যটুকুও দিতে পারি নি। তোমরা সবাই ভালো থেকো আর পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। ইতি~মেঘ।
.
নোটটা টেবিলে রেখে মেঘ নিঃশব্দে বাসা থেকে বেড়িয়ে যায়। রাস্তার পাশ দিয়ে একা একা হাটছে আর ভাবছে কাজটা কিভাবে করবে। ঠিক তখনি। মেঘের নজর রাস্তার পাশের লোক গুলির দিকে যায়। জীবনের এক করুন দৃষ্টি দেখতে পায় সে। কি কষ্ট ভরা করুন অবস্থা তাদের কিন্তু তারা তো কখনো তাদের জীবন যুদ্ধে হেরে যায় নি। ঠিক জীবনের সাথে লড়াই করে টিকে থাকে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর বুকে। আর মেঘ তো মাত্র একবার হেরে গেছে কিন্তু জীবন যে সবাইকেই দ্বিতীয় সুযোগ দেয়। মেঘ এবার ভাবে সুইসাইড নয় তাকেও বেচে থাকতে হবে যুদ্ধ করে। জীবনের সেই দ্বিতীয় সুযোগকেই কাজে লাগাতে হবে আর তাই মেঘ ঠিক করে সে মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পরেই বাসায় যাবে। সেদিন থেকেই শুরু হয় মেঘের এক নতুন যুদ্ধ...জয়ী হওয়ার যুদ্ধ।
.
সেদিনের পর একবছর কেটে গেছে। মেঘ সেকেন্ড টাইম মেডিকেলে পরিক্ষা দেয় আর আজ তার রেজাল্ট। অনেক অপেক্ষার পর অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট যা শোনার পরে নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না মেঘ। এবারের মেডিকেল এর ভর্তি পরিক্ষায় মেঘ দ্বিতীয় হয়। হ্যা...আজ মেঘ জয়ী...আজ সে হারে নি। মেঘ ভাবে এবার সে বাসায় যাবে আর সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে। রেজাল্ট শোনার পরে সবাই অনেক খুশি হবে। সবার সেদিনের সব কষ্ট গুলি আজ মেঘ মুছে দিবে।
.
দীর্ঘ এক বছর পর... মেঘ অনেক উৎচ্ছাসিত। কত দিন পর আবার বাবা মাকে দেখতে পারবে তারা আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরবে...যখন তারা কাদবে মেঘ তাদের সব চোখের পানি মুছে দেবে। এসব ভাবতে ভাবতে যে মেঘ কখন বাসায় চলে এসেছে বুঝতেই পারে নি। হাসিমাখা মুখ নিয়ে আস্তে করে বাসায় ঢোকে আর ঢুকেই অবাক হয়ে যায়। কারন বাসার সব কিছুই কেমন জানি নিস্প্রান হয়ে গেছে। বাসার ভেতরে যেতেই সবাই মেঘকে দেখেই ছুটে আসে। মেঘ তার বাবার সামনে যায় আর দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। সবাই আছে কিন্তু কেনো জানি মাকে দেখতে পাচ্ছে না। মেঘ তার রেজাল্ট এর কথা বাবাকে বলে আর মায়ের কথা জিজ্ঞাস করে। মায়ের কথা শুনেই মেঘের বাবার চোখে পানি চলে আসে। মেঘকে নিয়ে তার বাবা বাসার পেছনে যায়। গিয়েই যা দেখতে পায় তাতে মেঘ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না...মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। কারন মেঘের সামনে তার মায়ের কবর। মেঘের আর বুঝতে বাকি রইলো না সেদিন কি ঘটেছিলো। 
সেদিন মেঘের সুইসাইড নোটটা তার মা পড়ার পরই হার্ট এটাক করেন। সবাই মিলে তাকে হাস্পাতালে নিয়ে গেলেও ততক্ষনে অনেক দেড়ি হয়ে যায়। মেঘের আগেই সবাইকে ছেড়ে পাড়ি জমান এক অজানা রহস্যের দুনিয়ায় যেখান থেকে কেউ কখনো ফিরে আসে না।
.
মেঘের মুখে আর কোন শব্দ নেই শুধুই চোখ দিয়ে ফোটায় ফোটায় পানি গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। কি হবে আজ এই রেজাল্ট দিয়ে...আজ যাকে খুশি করার জন্য এই রেজাল্ট সেই তো আর নেই। মেঘ তখন বুঝতে পারে সেদিন যদি সে এমন কিছু না করতো তবে হয়তো তার মা আজ এই রেজাল্টটা শুনতে পারতো...হয়তো অনেক খুশি হতো...হয়তবা আদর করে মেঘের কপালে চুমুও দিতেন।
মেঘ আজ সব বুঝতে পেরেছে যে সে কত বড় ভুল সেদিন করেছে...কিন্তু এতক্ষনে যে অনেকটাই দেড়ি হয়ে গেছে...।
.
আসলে জীবনটা এতটা নিষ্ঠুর না। ব্যার্থতা আর সাফল্যতা নিয়েই তো জীবন। আমাদের কাজ শুধু ধৈর্য ধরে সেই ব্যার্থতার মাঝে সাফল্যটাকে খুজে নেয়া। জীবন সবাইকেই দ্বিতীয় সুযোগ দেয়...শুধু সেটাকে কাজে লাগাতে হয়। আসলে জীবন আবেগ দিয়ে নয় নিষ্ঠুর বাস্তবতা দিয়ে চলে...।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন