১। সিগারেট টা ধরিয়ে বেশ আয়েশ করে বসল নীল । দশ
মিনিটের বিরতিতে আছে এখন সে । তাছাড়া দুর্বা
ও আশে পাশে নেই । দুর্বার যন্ত্রনায় তার সিগারেট
টাও খাওয়া হয় না ঠিকমত । আগে বারান্দায় বসে
রকিং চেয়ারে গা মেলে দিয়ে গান শুনতে শুনতে
সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ত ! দুর্বা এসে তার পুরা
জীবন টাই এলোমেলো করে দিয়েছে । মেয়ে তো না
যেন ঝড় একটা । এক মাস হয়েছে দুর্বার সাথে নীল
এর বিয়ে হয়েছে । দেড় মাসের পরিচয় । প্রথম
দেখাতেই প্রেম । দ্বিতীয় দেখাতেই সরাসরি
বিয়ের প্রস্তাব । এবং তৃতীয় দেখার দিন বিয়ে ।
কোন জাঁকজমক ছাড়াই দু তিনটা বন্ধুবান্ধব নিয়ে
কাজি ডাকিয়ে বিয়ে । নীলের মা মারা গেছেন
জন্মের সময় । বাবা ও কিছুদিন আগে । একটা বোন
আছে , স্বামী নিয়ে বিদেশে । আর খুব কাছের তেমন
কোন আত্মীয় নেই তার । দুর্বার অবস্থা তো আরও
খারাপ । এতিমখানায় বড় হয়েছে । নিজের যোগ্যতায়
পড়াশোনা করেছে এতদূর । এত মিষ্টি একটা মেয়ে ।
দুর্বা যেন তার একাকী জীবনে এসেছে আশির্বাদ
হয়ে । একটা মানুষ এতটা কিভাবে ভালবাসতে পারে
নীল বুঝেনা । দুর্বার সম্পুর্ণ জগত জুড়েই নীল ।
মাস্টার্স পাশ করা একটা মেয়ে । অথচ কোন চাকরি
করতে চায়না । সারাদিন ঘরে বসে থাকে , খুটুর খুটুর
করে এইটা ওইটা করবে । নীলের পছন্দের খাবার
বানাবে … ঘর সাজাবে । কই একটু বাইরে ঘুরবে ,
বন্ধুদের সাথে দেখা করবে … না , তার কোন বালাই
নেই , সারাদিন নীল কে নিয়েই পড়ে থাকবে । ঘণ্টার
পর ঘণ্টা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে তার দিকে ।
কোনই ক্লান্তি নেই তার । নাহ , এরকম ভালবাসা
পাবার জন্য এক দুইটা জীবন খুব সহজেই বিসর্জন
দেয়া যায় । নীলের জীবনের রাইট টার্ন ছিল দুর্বা ।
মধ্য বয়সে এসে দুর্বাকে পাওয়া ! নিঃসঙ্গ
ভালবাসাহীন জীবনটা দুর্বা ভরিয়ে দিয়ে গেছে ।
এখন নীল ভীষণ ব্যস্ত । গত দেড় মাসে ঠিক মত
চেম্বারে আসা হয়নি । কোন পেসেন্ট ও এটেণ্ড করা
হয়নি । ঘর থেকে বের হলে দুই তিন ঘণ্টা পার হয় না ,
দুর্বা ফোন করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় । একলা
তার ভাল লাগে না । কাজকর্ম তার শিকেয় তুলে
বসে থাকতে হয় দুর্বার সাথে । গত এক সপ্তাহ ধরে সে
নিয়মিত চেম্বারে আসছে । এই মুহূর্তে অনেক রাশ ।
মোবাইলের রিংটোনের শব্দে নীলের ধ্যানভঙ্গ হল ।
কাজের সময় ফোন সাধারণত তার এই হাসপাতালের
এসিস্টেন্ট এর কাছেই থাকে । আজকে সে নিয়ে
যায়নি । এমন ভুল সাধারণত সে করে না । পেসেন্ট
দেখার সময় কেউ ফোন করলে সে খুব বিরক্ত হয় ।
ফোন টা হাতে নিয়ে দেখে নীল বিশেষ মানবীর
ফোন । দুর্বা … তার মন টা ভাল হয়ে গেল হুট করেই ।
‘কি কর , সোনা …’
‘ক্রিকেট খেলছিলাম … তোমার ফোন পেয়ে চলে
এলাম …
উফফ , সবসময় ঠাট্টা । আজ কখন আসবে ?
উমম , ৯টার মাঝে । প্রমিস ।
আজ একটু আগে আসলে কেমন হয় ?
খুব খারাপ হয় ।
কেন ?
পেশেণ্ট রা আমাকে ধরে পিটাবে ।
কেন ? ডাক্তার কে নিজেদের কোন লাইফ নেই
নাকি ?
আরে তা না । এপয়েণ্টমেণ্ট নেয়া না ?
তো কি ? জরুরি কিছু হতে পারেনা ? তুমি অসুস্থ হতে
পারনা ? আমি অসুস্থ হতে পারিনা ?
কি ব্যপার তুমি অসুস্থ নাকি ?
নাহ । তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিব , তাড়াতাড়ি
আসো প্লিজ ।
কি করি বলতো ? রাগ করে না । ভাল না বউ আমার । ৯
টার মাঝে ঠিক আসব ।
লাগবে না যাও । কাজ ই কর । তোমার বাসায় ই
আসার দরকার নেই ।
ফোনটা কেটে গেলো । এক চিলতে হাসল নীল ।
দুর্বার এই রাগ ভাঙ্গানোর উপায় তেমন কঠিন কিছু
না । কয়টা বেলি ফুলের মালা কিংবা বকুল ফুলের
মালা হলেই হবে । আবার কাজে মন লাগাল নীল ।
২।
কলিংবেলে হাত ছোঁয়াবার সাথে সাথেই দরজা
খুলে গেল । দুর্বা সম্ভবত লুকিং গ্লাস দিয়ে
তাকিয়ে ছিল । নীল ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার
সাথে সাথেই জড়িয়ে ধরল তাকে । হাতের ব্যগ টা
মাটিতে ফেলে দিল নীল । দুহাতে সেও শক্ত করে
জড়িয়ে ধরল দুর্বা কে । ভালবাসার এই অনুভূতির জন্য
এমন হাজার টা জীবন পেতে ইচ্ছা করে নীলের ।
কয়েক মিনিট পেরিয়ে যায় , তবু দুজন এমনিই দাঁড়িয়ে
থাকে ।
আমার সারপ্রাইজ টা কি ??
বলব না । আমার গিফট কই ?
এনেছি তো সোনা ।
কই ? দাও নাই তো ?
আস তোমাকে পরায় দেই আমি ।
কয়েকটা বকুল ফুলের মালা পেঁচিয়ে দিল নীল দুর্বার
খোপায় । আদুরে বিড়ালের মত নীলের বুকের কাছে
ঘেঁষে মুখ লুকালো দূর্বা ।
কেউ আসছে ..
.
কে ?? কেন ?
আরে বুদ্ধু কেউ আসতে চাইছে আমাদের মাঝে …
বলেই লজ্জা পেয়ে গেল দুর্বা । এবং তখন ই পুরা
ব্যপার টা বুঝতে পারল নীল । সাথে সাথে আরো
শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে দুর্বা কে । এক মুহুর্তে
পৃথিবীটা কেমন সুন্দর হয়ে যায় !
আবছা আলোয় দুর্বা কে দেখে সে ।
ফিসফিস করে বলে সে , আসুক না… আসতে দাও
তাকে ……
৩।
অনেক কষ্টে চোখ খুলল নীল । মাথাটা কেমন ফাঁকা
ফাঁকা লাগছে । কালকের কথা কিছু মনে পড়ছে না
তার । দুর্বার সাথে কথা বলছিল … এর মাঝে ঘুমিয়ে
গেল কখন সে ? মাথা নাড়াতে পারছে না । একদম
ভারি লাগছে নিজেকে । চোখে প্রথমে খুব ঝাপসা
দেখছিল নীল । তারপর স্পষ্ট দেখল তার শোবার
ঘরের সোফায় শুয়ে আছে সে । প্রায় শেষ রাত তখন ।
এবং তার ই বিছানায় এক জোড়া নারী – পুরুষের
অবয়ব । জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে । আবার চোখ বন্ধ
করে খুলল সে । তাকিয়ে হঠাৎ করে মনে হল তার
এইটা কোন দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু হতেই পারেনা ।
তার শোবার ঘরে , তারই বিছানায় তার ই স্ত্রীর
সাথে অন্য কোন পুরুষ ? এইটা কিভাবে সম্ভব ?
কিছু বলতে যায় নীল । পারেনা । চিৎকার করার
চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা । গলা দিয়ে একটা শব্দ
বের হয়না তার । উঠে বসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সে
। দুর্বার সঙ্গীর ততক্ষনে ঘুম ভাঙ্গে । মৃদু হাসি
দুচোখে তার । লোকটাকে তার খুব চেনা চেনা লাগে
। কোথায় যেন দেখেছে সে ।
আমি খুব ই দুঃখিত ডাক্তার সাহেব । আপনাকে
সামান্য ক্লোরোফর্ম ছোঁয়ানো হয়েছিল । কিন্তু
আপনি এতই নাজুক যে রাত কাটিয়ে দিলেন । আর
আমরাও অপেক্ষা করতে করতে একটু আরকি ……
অনেক দিন পর দুর্বা কে পেলাম তো ! নাহলে আপনার
শোবার ঘর ব্যবহার করতাম না আর যাই হোক !
ওকি , উঠতে চাচ্ছেন নাকি ? তা বোধ হয় আর হচ্ছে
না । আপনার এখন সম্পূর্ণ সেন্স আছে যদিও , নড়াচড়া
বা কথা বলার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই ভাই ।
আমার কিছু কথা শুনুন । আপনাকে না বললেও চলত ।
তবু বলি । আমি আবার গোপনে কোন কাজ করি না ।
করাটা পছন্দও করিনা । যাই হোক , দুর্বাকে খুব
ভালবাসেন নাকি আপনি ? তাই তো মনে হয় । বেশি
আবেগে মানুষ অন্ধ হয়ে যায় । ঠিক ভুলের হিসাব টাও
মনে হয় বুঝেনা , তাই না ? দুর্বা যা বলল আপনাকে
তাই ধ্রুব সত্য ? একটা খোঁজ ও নিলেন না ? ভাগ্য
আমাদের ভালই ছিল … নাহলে আপনি কেন দুর্বার
প্রেমে এমন পাগলের মত পড়বেন ? আবার বলেন
দুর্বাকে খুঁজে পাওয়া আপনার জীবনের রাইট
টার্ন ??? আপনার রং টার্ন কিংবা দুর্ভাগ্য !!
হাহাহাহা …
নীল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে । যেনো কোন গল্প
শুনছে … প্রচণ্ড হাসির শব্দে দুর্বার ঘুম ভেঙ্গে গেছে
। সে আলতো হাসি মুখে উঠে বসলো । তার ভাঁজ
ভাঙা চুলে এখনও কিছু বকুল ফুল ছিটিয়ে পড়ে আছে ।
আপনি ভয় পাবেন না । আপনাকে খুব বেশি একটা
কষ্ট পেতে হবে না । আমার অবশ্য ইচ্ছা ছিল । কিন্তু
দুর্বার অনুরোধ আবার আমি ফেলতে পারিনা । কি
করব বলেন ??
লোকটা নীলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে । ঠিক
তখনি নীল চিনতে পারে লোক টাকে । তার ছবি বেশ
কয়েকদিন আগে পেপারে দেখেছিল । অনীশ
আরাফাত । একজন সিরিয়াল কিলার । গত ১৫ মাসে
সে ৫ টার মত খুন করেছে … প্রত্যেক টা খুন ই বীভৎস
উপায়ে করে সে …… প্রথম মাসে সে শিকার খুঁজে
বের করে … তারপরের মাসে সে শিকার কে টোপ
ফেলে জালে এনে ভরে … তৃতীয় মাসে সে শিকার
কে বিভিন্ন উপায়ে খুন করে এবং পরের মাসে নতুন
শিকারকে খুঁজে …
৫টা খুন ই হয়েছে বীভৎস তম উপায়ে … পুরো লাশ টাও
খুঁজে পায়নি পুলিশ । লাশের শরীরের কিছু অঙ্গ শুধু
উদ্ধার করতে পেরেছিল । ৫টা কেসে এক ই কাহিনী ।
লাশের শুধু মাথা টা পড়ে থাকে । চোখ দুটা উপড়ে
নেয়া … জিহবা কাটা … কোথাও দু একটা আঙ্গুল …
আর চাপ রক্ত সারা ঘর জুড়ে … ব্যস , এতটুকই । লাশ টা
কি করে , কোথায় ফেলে , কাটাকাটি কেন করে
তার বিন্দুমাত্র ধারণাও করতে পারে নাই পুলিশ ।
নীলের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যায় ।
ঢোক গিলে সে । অবাক হয়ে তাকায় দুর্বার দিকে ।
দুর্বা সেই আগের মতই আদুরে চোখে তাকিয়ে আছে ।
চোখে চঞ্চল হাসি ।
আই এম স্যরি ডক্টর নীল । তবে আপনাকে এতটুক
সম্মান করছি আমরা , আপনার মৃত্যু টা হবে ব্যথা হীন
। ৫০০ মিলি. ক্লোরোফর্ম ঢালা একটা রুমাল শুধু
আপনার মুখের উপর রাখব … বাকি কিছু হবে আপনার
মরে যাওয়ার পর । বেশি সময় লাগবে না । আপনাকে
আরও একটু সম্মান করছি , আপনার মাথাটা অবিকৃত
রেখে দেব একদম । ধারালো ছুরিটা একদম ই ছোয়াব
না । প্রমিস । যদিও চোখ টা আমার বেশ পছন্দ !
আপনি বেগুন ভাজি যতটা পছন্দ করেন চোখ আমার
তার থেকেও বেশি প্রিয় । তবু আপনার ক্ষেত্রে ছাড়
দিলাম । আফটার অল , আমাদের হবু সন্তানের
জন্মদাতা তো আপনিই ।
নীলের গা গুলিয়ে উঠল । লাশ গুলো খুঁজে পাওয়া
যায় না তার কারণ … তার কারণ অনীশ আরাফাত
এইগুলা ..????? পিশাচ !!!! তার চোখ মুখ কুঁচকে উঠল …
আবেদনময়ীর ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে দুর্বা । হাতে
একটা সাদা রুমাল ? এই কি সেই ক্লোরোফর্ম দেয়া
রুমাল ? কিছু ভাবার আগেই নীলের ঠোঁটে গভীর
ভাবে চুমু খায় সে … বাধা দেবার শক্তিটাও নেই
নীলের … বাধা দিতে ইচ্ছাও করছে না আর । সব
কেমন লাগছে … এলোমেলো … দুর্বা কে রং টার্ন
ভাবতে ইচ্ছা করেনা তার … চোখ বন্ধ করে সে …
তারপর শূন্যতা … প্রবল শূন্যতা ।
৪।
কাজ শেষ ?
হুমম ।
সব প্যাক করে নিয়েছ তো ?
হুমম ।
তাহলে চলো । দেরী করছ কেন ?
ঘরটা গুছিয়ে দিয়ে যাই ?
কী পাগলের মত বলছ দুর্বা ? হাতে সময় কম । সকাল
হবার আগেই বেরোতে হবে ।
চলো …
এঈ দুর্বা , ঠিক আছ তো ?
হূম আছি । চলো বের হই ।
আমি ভাবছিলাম তুমি আমার সত্যি নীলের প্রেমে
পড়ে গিয়েছিলে নাকি !
আরেহ না … কি যে বল না তুমি !
ভোরের অন্ধকারে দুজন মানব-মানবী (! ) বের হয়ে
আসে হাত ধরে … পেছনে পড়ে থাকে নির্জন একটা
ঘর … আর সারা ঘরে চাপ চাপ রক্ত …
মিনিটের বিরতিতে আছে এখন সে । তাছাড়া দুর্বা
ও আশে পাশে নেই । দুর্বার যন্ত্রনায় তার সিগারেট
টাও খাওয়া হয় না ঠিকমত । আগে বারান্দায় বসে
রকিং চেয়ারে গা মেলে দিয়ে গান শুনতে শুনতে
সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ত ! দুর্বা এসে তার পুরা
জীবন টাই এলোমেলো করে দিয়েছে । মেয়ে তো না
যেন ঝড় একটা । এক মাস হয়েছে দুর্বার সাথে নীল
এর বিয়ে হয়েছে । দেড় মাসের পরিচয় । প্রথম
দেখাতেই প্রেম । দ্বিতীয় দেখাতেই সরাসরি
বিয়ের প্রস্তাব । এবং তৃতীয় দেখার দিন বিয়ে ।
কোন জাঁকজমক ছাড়াই দু তিনটা বন্ধুবান্ধব নিয়ে
কাজি ডাকিয়ে বিয়ে । নীলের মা মারা গেছেন
জন্মের সময় । বাবা ও কিছুদিন আগে । একটা বোন
আছে , স্বামী নিয়ে বিদেশে । আর খুব কাছের তেমন
কোন আত্মীয় নেই তার । দুর্বার অবস্থা তো আরও
খারাপ । এতিমখানায় বড় হয়েছে । নিজের যোগ্যতায়
পড়াশোনা করেছে এতদূর । এত মিষ্টি একটা মেয়ে ।
দুর্বা যেন তার একাকী জীবনে এসেছে আশির্বাদ
হয়ে । একটা মানুষ এতটা কিভাবে ভালবাসতে পারে
নীল বুঝেনা । দুর্বার সম্পুর্ণ জগত জুড়েই নীল ।
মাস্টার্স পাশ করা একটা মেয়ে । অথচ কোন চাকরি
করতে চায়না । সারাদিন ঘরে বসে থাকে , খুটুর খুটুর
করে এইটা ওইটা করবে । নীলের পছন্দের খাবার
বানাবে … ঘর সাজাবে । কই একটু বাইরে ঘুরবে ,
বন্ধুদের সাথে দেখা করবে … না , তার কোন বালাই
নেই , সারাদিন নীল কে নিয়েই পড়ে থাকবে । ঘণ্টার
পর ঘণ্টা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে তার দিকে ।
কোনই ক্লান্তি নেই তার । নাহ , এরকম ভালবাসা
পাবার জন্য এক দুইটা জীবন খুব সহজেই বিসর্জন
দেয়া যায় । নীলের জীবনের রাইট টার্ন ছিল দুর্বা ।
মধ্য বয়সে এসে দুর্বাকে পাওয়া ! নিঃসঙ্গ
ভালবাসাহীন জীবনটা দুর্বা ভরিয়ে দিয়ে গেছে ।
এখন নীল ভীষণ ব্যস্ত । গত দেড় মাসে ঠিক মত
চেম্বারে আসা হয়নি । কোন পেসেন্ট ও এটেণ্ড করা
হয়নি । ঘর থেকে বের হলে দুই তিন ঘণ্টা পার হয় না ,
দুর্বা ফোন করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় । একলা
তার ভাল লাগে না । কাজকর্ম তার শিকেয় তুলে
বসে থাকতে হয় দুর্বার সাথে । গত এক সপ্তাহ ধরে সে
নিয়মিত চেম্বারে আসছে । এই মুহূর্তে অনেক রাশ ।
মোবাইলের রিংটোনের শব্দে নীলের ধ্যানভঙ্গ হল ।
কাজের সময় ফোন সাধারণত তার এই হাসপাতালের
এসিস্টেন্ট এর কাছেই থাকে । আজকে সে নিয়ে
যায়নি । এমন ভুল সাধারণত সে করে না । পেসেন্ট
দেখার সময় কেউ ফোন করলে সে খুব বিরক্ত হয় ।
ফোন টা হাতে নিয়ে দেখে নীল বিশেষ মানবীর
ফোন । দুর্বা … তার মন টা ভাল হয়ে গেল হুট করেই ।
‘কি কর , সোনা …’
‘ক্রিকেট খেলছিলাম … তোমার ফোন পেয়ে চলে
এলাম …
উফফ , সবসময় ঠাট্টা । আজ কখন আসবে ?
উমম , ৯টার মাঝে । প্রমিস ।
আজ একটু আগে আসলে কেমন হয় ?
খুব খারাপ হয় ।
কেন ?
পেশেণ্ট রা আমাকে ধরে পিটাবে ।
কেন ? ডাক্তার কে নিজেদের কোন লাইফ নেই
নাকি ?
আরে তা না । এপয়েণ্টমেণ্ট নেয়া না ?
তো কি ? জরুরি কিছু হতে পারেনা ? তুমি অসুস্থ হতে
পারনা ? আমি অসুস্থ হতে পারিনা ?
কি ব্যপার তুমি অসুস্থ নাকি ?
নাহ । তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিব , তাড়াতাড়ি
আসো প্লিজ ।
কি করি বলতো ? রাগ করে না । ভাল না বউ আমার । ৯
টার মাঝে ঠিক আসব ।
লাগবে না যাও । কাজ ই কর । তোমার বাসায় ই
আসার দরকার নেই ।
ফোনটা কেটে গেলো । এক চিলতে হাসল নীল ।
দুর্বার এই রাগ ভাঙ্গানোর উপায় তেমন কঠিন কিছু
না । কয়টা বেলি ফুলের মালা কিংবা বকুল ফুলের
মালা হলেই হবে । আবার কাজে মন লাগাল নীল ।
২।
কলিংবেলে হাত ছোঁয়াবার সাথে সাথেই দরজা
খুলে গেল । দুর্বা সম্ভবত লুকিং গ্লাস দিয়ে
তাকিয়ে ছিল । নীল ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার
সাথে সাথেই জড়িয়ে ধরল তাকে । হাতের ব্যগ টা
মাটিতে ফেলে দিল নীল । দুহাতে সেও শক্ত করে
জড়িয়ে ধরল দুর্বা কে । ভালবাসার এই অনুভূতির জন্য
এমন হাজার টা জীবন পেতে ইচ্ছা করে নীলের ।
কয়েক মিনিট পেরিয়ে যায় , তবু দুজন এমনিই দাঁড়িয়ে
থাকে ।
আমার সারপ্রাইজ টা কি ??
বলব না । আমার গিফট কই ?
এনেছি তো সোনা ।
কই ? দাও নাই তো ?
আস তোমাকে পরায় দেই আমি ।
কয়েকটা বকুল ফুলের মালা পেঁচিয়ে দিল নীল দুর্বার
খোপায় । আদুরে বিড়ালের মত নীলের বুকের কাছে
ঘেঁষে মুখ লুকালো দূর্বা ।
কেউ আসছে ..
.
কে ?? কেন ?
আরে বুদ্ধু কেউ আসতে চাইছে আমাদের মাঝে …
বলেই লজ্জা পেয়ে গেল দুর্বা । এবং তখন ই পুরা
ব্যপার টা বুঝতে পারল নীল । সাথে সাথে আরো
শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে দুর্বা কে । এক মুহুর্তে
পৃথিবীটা কেমন সুন্দর হয়ে যায় !
আবছা আলোয় দুর্বা কে দেখে সে ।
ফিসফিস করে বলে সে , আসুক না… আসতে দাও
তাকে ……
৩।
অনেক কষ্টে চোখ খুলল নীল । মাথাটা কেমন ফাঁকা
ফাঁকা লাগছে । কালকের কথা কিছু মনে পড়ছে না
তার । দুর্বার সাথে কথা বলছিল … এর মাঝে ঘুমিয়ে
গেল কখন সে ? মাথা নাড়াতে পারছে না । একদম
ভারি লাগছে নিজেকে । চোখে প্রথমে খুব ঝাপসা
দেখছিল নীল । তারপর স্পষ্ট দেখল তার শোবার
ঘরের সোফায় শুয়ে আছে সে । প্রায় শেষ রাত তখন ।
এবং তার ই বিছানায় এক জোড়া নারী – পুরুষের
অবয়ব । জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে । আবার চোখ বন্ধ
করে খুলল সে । তাকিয়ে হঠাৎ করে মনে হল তার
এইটা কোন দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু হতেই পারেনা ।
তার শোবার ঘরে , তারই বিছানায় তার ই স্ত্রীর
সাথে অন্য কোন পুরুষ ? এইটা কিভাবে সম্ভব ?
কিছু বলতে যায় নীল । পারেনা । চিৎকার করার
চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা । গলা দিয়ে একটা শব্দ
বের হয়না তার । উঠে বসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সে
। দুর্বার সঙ্গীর ততক্ষনে ঘুম ভাঙ্গে । মৃদু হাসি
দুচোখে তার । লোকটাকে তার খুব চেনা চেনা লাগে
। কোথায় যেন দেখেছে সে ।
আমি খুব ই দুঃখিত ডাক্তার সাহেব । আপনাকে
সামান্য ক্লোরোফর্ম ছোঁয়ানো হয়েছিল । কিন্তু
আপনি এতই নাজুক যে রাত কাটিয়ে দিলেন । আর
আমরাও অপেক্ষা করতে করতে একটু আরকি ……
অনেক দিন পর দুর্বা কে পেলাম তো ! নাহলে আপনার
শোবার ঘর ব্যবহার করতাম না আর যাই হোক !
ওকি , উঠতে চাচ্ছেন নাকি ? তা বোধ হয় আর হচ্ছে
না । আপনার এখন সম্পূর্ণ সেন্স আছে যদিও , নড়াচড়া
বা কথা বলার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই ভাই ।
আমার কিছু কথা শুনুন । আপনাকে না বললেও চলত ।
তবু বলি । আমি আবার গোপনে কোন কাজ করি না ।
করাটা পছন্দও করিনা । যাই হোক , দুর্বাকে খুব
ভালবাসেন নাকি আপনি ? তাই তো মনে হয় । বেশি
আবেগে মানুষ অন্ধ হয়ে যায় । ঠিক ভুলের হিসাব টাও
মনে হয় বুঝেনা , তাই না ? দুর্বা যা বলল আপনাকে
তাই ধ্রুব সত্য ? একটা খোঁজ ও নিলেন না ? ভাগ্য
আমাদের ভালই ছিল … নাহলে আপনি কেন দুর্বার
প্রেমে এমন পাগলের মত পড়বেন ? আবার বলেন
দুর্বাকে খুঁজে পাওয়া আপনার জীবনের রাইট
টার্ন ??? আপনার রং টার্ন কিংবা দুর্ভাগ্য !!
হাহাহাহা …
নীল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে । যেনো কোন গল্প
শুনছে … প্রচণ্ড হাসির শব্দে দুর্বার ঘুম ভেঙ্গে গেছে
। সে আলতো হাসি মুখে উঠে বসলো । তার ভাঁজ
ভাঙা চুলে এখনও কিছু বকুল ফুল ছিটিয়ে পড়ে আছে ।
আপনি ভয় পাবেন না । আপনাকে খুব বেশি একটা
কষ্ট পেতে হবে না । আমার অবশ্য ইচ্ছা ছিল । কিন্তু
দুর্বার অনুরোধ আবার আমি ফেলতে পারিনা । কি
করব বলেন ??
লোকটা নীলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে । ঠিক
তখনি নীল চিনতে পারে লোক টাকে । তার ছবি বেশ
কয়েকদিন আগে পেপারে দেখেছিল । অনীশ
আরাফাত । একজন সিরিয়াল কিলার । গত ১৫ মাসে
সে ৫ টার মত খুন করেছে … প্রত্যেক টা খুন ই বীভৎস
উপায়ে করে সে …… প্রথম মাসে সে শিকার খুঁজে
বের করে … তারপরের মাসে সে শিকার কে টোপ
ফেলে জালে এনে ভরে … তৃতীয় মাসে সে শিকার
কে বিভিন্ন উপায়ে খুন করে এবং পরের মাসে নতুন
শিকারকে খুঁজে …
৫টা খুন ই হয়েছে বীভৎস তম উপায়ে … পুরো লাশ টাও
খুঁজে পায়নি পুলিশ । লাশের শরীরের কিছু অঙ্গ শুধু
উদ্ধার করতে পেরেছিল । ৫টা কেসে এক ই কাহিনী ।
লাশের শুধু মাথা টা পড়ে থাকে । চোখ দুটা উপড়ে
নেয়া … জিহবা কাটা … কোথাও দু একটা আঙ্গুল …
আর চাপ রক্ত সারা ঘর জুড়ে … ব্যস , এতটুকই । লাশ টা
কি করে , কোথায় ফেলে , কাটাকাটি কেন করে
তার বিন্দুমাত্র ধারণাও করতে পারে নাই পুলিশ ।
নীলের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যায় ।
ঢোক গিলে সে । অবাক হয়ে তাকায় দুর্বার দিকে ।
দুর্বা সেই আগের মতই আদুরে চোখে তাকিয়ে আছে ।
চোখে চঞ্চল হাসি ।
আই এম স্যরি ডক্টর নীল । তবে আপনাকে এতটুক
সম্মান করছি আমরা , আপনার মৃত্যু টা হবে ব্যথা হীন
। ৫০০ মিলি. ক্লোরোফর্ম ঢালা একটা রুমাল শুধু
আপনার মুখের উপর রাখব … বাকি কিছু হবে আপনার
মরে যাওয়ার পর । বেশি সময় লাগবে না । আপনাকে
আরও একটু সম্মান করছি , আপনার মাথাটা অবিকৃত
রেখে দেব একদম । ধারালো ছুরিটা একদম ই ছোয়াব
না । প্রমিস । যদিও চোখ টা আমার বেশ পছন্দ !
আপনি বেগুন ভাজি যতটা পছন্দ করেন চোখ আমার
তার থেকেও বেশি প্রিয় । তবু আপনার ক্ষেত্রে ছাড়
দিলাম । আফটার অল , আমাদের হবু সন্তানের
জন্মদাতা তো আপনিই ।
নীলের গা গুলিয়ে উঠল । লাশ গুলো খুঁজে পাওয়া
যায় না তার কারণ … তার কারণ অনীশ আরাফাত
এইগুলা ..????? পিশাচ !!!! তার চোখ মুখ কুঁচকে উঠল …
আবেদনময়ীর ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে দুর্বা । হাতে
একটা সাদা রুমাল ? এই কি সেই ক্লোরোফর্ম দেয়া
রুমাল ? কিছু ভাবার আগেই নীলের ঠোঁটে গভীর
ভাবে চুমু খায় সে … বাধা দেবার শক্তিটাও নেই
নীলের … বাধা দিতে ইচ্ছাও করছে না আর । সব
কেমন লাগছে … এলোমেলো … দুর্বা কে রং টার্ন
ভাবতে ইচ্ছা করেনা তার … চোখ বন্ধ করে সে …
তারপর শূন্যতা … প্রবল শূন্যতা ।
৪।
কাজ শেষ ?
হুমম ।
সব প্যাক করে নিয়েছ তো ?
হুমম ।
তাহলে চলো । দেরী করছ কেন ?
ঘরটা গুছিয়ে দিয়ে যাই ?
কী পাগলের মত বলছ দুর্বা ? হাতে সময় কম । সকাল
হবার আগেই বেরোতে হবে ।
চলো …
এঈ দুর্বা , ঠিক আছ তো ?
হূম আছি । চলো বের হই ।
আমি ভাবছিলাম তুমি আমার সত্যি নীলের প্রেমে
পড়ে গিয়েছিলে নাকি !
আরেহ না … কি যে বল না তুমি !
ভোরের অন্ধকারে দুজন মানব-মানবী (! ) বের হয়ে
আসে হাত ধরে … পেছনে পড়ে থাকে নির্জন একটা
ঘর … আর সারা ঘরে চাপ চাপ রক্ত …
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন