বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৭

চশমাপরা ভূত

পেছন থেকে জেসমিনকে ডাকছে মেঘ। কিন্তু জেসমিন মেঘের ডাকে সাড়াই দিচ্ছে না। কারন মেঘ আজ লেইট করেছে। দশ মিনিট জেসমিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে মেঘের জন্য। যতবার মেঘ পেছন থেকে জেসমিনকে ডাকছে তত জেসমিনের রাগ হচ্ছে। প্রতিদিনই লেইট করে ছেলেটা। ডাকে সাড়া না পেয়ে দৌড়ে এসে জেসমিনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে মেঘ। জেসমিনের মুুখের দিকে তাকাতেই যেনো মেঘের বুক কাপতে থাকে। মেঘ বুঝতে পারে যে জেসমিন অনেক রেগে আছে।
---> জেসমিন শোন...(মেঘ)
--> তুই আমার নাম ধরে ডাকবি না...(জেসমিন)
---> না মানে আজ না আসার সময় আমি চশমাটা ভুলে বাসায় রেখে আসছিলাম...মনে করেছিলাম ব্যাগেই রেখেছি কিন্তু পরে দেখি ব্যাগে নেই। চশমাটা আনতেই তো দেড়ি হয়ে গেলো।
জেসমিন মেঘের আর কোন কথা না শুনে হাটতে থাকে। মেঘও জেসমিনের পিছু পিছু যেতে থাকে। মেঘকে পিছু পিছু আসতে দেখে জেসমিন সোজা গিয়ে মেঘের কলার টেনে ধরে....
---> আমার পিছনে যদি আর একবার তোকে দেখি একদম ঘুতো মেরে চোখ কানা করে দিবো।
--> আমার তো চোখে চশমা পরা ঘুতো মারবি কিভাবে?
এই কথা শুনে জেসমিনের আরো রাগ হয়। মেঘের সাথে আর কথা না বলে একটা রিক্সা ডেকে কলেজে চলে যায়। আর মেঘ দাঁড়িয়ে জেসমিনের চলে যাওয়া দেখতে থাকে।
.
জেসমিন আর মেঘ ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে একসাথে পড়ে। অবশ্য শুধুই কলেজ লাইফ না সেই প্রাইমারি থেকেই একসাথে পথ চলা তাদের। আর সেখান থেকেই বন্ধুত্ত্ব। জেসমিন ছিলো খুব রাগি...চঞ্চল....আর একটু পাগলাটে টাইপের কিন্তু দেখতে ছিলো রূপকথার পরীর মত। তার রাগের জন্য আর পাগলামির জন্য কলেজের সবাই তাকে অনেক ভয় পায়। কতজন যে তাকে ফুল দিতে গিয়ে থাপ্পর খেয়েছে তার হিসাব নেই। আর অন্য দিকে মেঘ যেনো ঠিক তার বিপরীত। একটা সাদা সিধে বোকা ছেলে। চোখে বড় একটা চশমা পড়ে থাকে সব সময়। এই চশমা ছাড়া যে মেঘ কিছুই দেখতে পায় না। আর তাই জেসমিন মেঘকে চশমাপরা ভূত বলে ডাকতো। নামটা অবশ্য মেঘের কাছে অনেক বেশি ভাললাগতো। মেঘ এমনি বোকা হলেও দেখতে ছিলো অনেক কিউট। আর জেসমিন সব সময় মেঘের উপর রাগ করতো। কিন্তু এই রাগ করার মাঝেও ছিলো একটা কারন। আর সেটা হলো জেসমিন মেঘকে ভালবাসতো....সেই হাইস্কুল থেকেই। কিন্তু মেঘ গাধা একটা। সবাই জানে জেসমিনের ভালবাসার কথা শুধু এই গাধাটাই জানে না। তাই জেসমিনের রাগটা আরো বেশি। প্রতিদিন মেঘ জেসমিনকে নিয়ে একসাথে কলেজে আসবে আবার একসাথে যাবে। এটা যেনো প্রতিদিনের কাজ মেঘের জন্য। কিন্তু আজ মেঘ লেইট করে ফেলেছে তাই জেসমিনের অনেক রাগ হয়েছে মেঘের উপর।
.
কলেজে এসেই ধুপ করে ব্যাগটা রেখেই বসে পড়ে জেসমিন। এসেই মেঘের কথা ভাবে। ছেলেটা এত বোকা কেনো? একটু তো হাতটা ধরে বাধাও দিতে পারতো...তা না....দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো! উফফ এই ছেলেটাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ভাবতেই তখন মেঘের ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো আর জেসমিন মুচকি একটা হাসি দিলো। এতটা রাগ করাও ঠিক হয় নি। মায়া হতে লাগলো মনে মনে। ঠিক তখনি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতেই দেখে মেঘ রিতুর সাথে একসাথে লাইব্রেরিতে যাচ্ছে। রিতু মেঘের বান্ধবী যাকে জেসমিন একদম দেখতে পারে না। আর মেয়েটাও...এই মেঘের পেছনেই ঘুর ঘুর করে। জেসমিনের আবার রাগ হতে থাকে মেঘের উপর। তখন আর মেঘকে কিছু বলে না জেসমিন। কলেজ ছুটির পরে মেঘকে ডাকে জেসমিন....
---> ওই তখন তুই রিতুর সাথে কি করছিলি হুমম?(জেসমিন)
--> তুই এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো?(ভয়েমেঘ)
---> তোকে গিলে খাবো। আগে বল রিতুর সাথে তোর কি হ্যা?
--> রিতু তো ফ্রেন্ড...তুই জানিস তো।
---> ফ্রেন্ড তো লাইব্রেরীতে কি? 
--> না মানে ও বললো ওর একটা বই লাগবে কিন্তু খুজে পাচ্ছে না। তাই আমাকে বললো আমি খুজে দিলাম....
---> আর কেউ ছিলো না বই খুজে দিতে? তোকেই খুজে দিতে হবে? আমাকে নিয়ে তো কখনো যাস নি লাইব্রেবীতে....
--> তোকে নিয়ে যাবো কেনো? তুই তো কখনো যাইতেও চাস নি। 
---> আমি চাই নি বলেই নিয়ে যাবি না? আর শোন আর একবার যদি ওই রিতুর সাথে দেখি তাহলে কিন্তু তোকে....
বাকিটা শেষ না করেই চলে যেতে থাকে জেসমিন। আর মেঘ শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। 
.
রাতে জেসমিন বার বার ফোনের দিকে তাকায়। একবার ফোন দিবে মেঘকে? অনেক বোকেছে আজ। মেঘের ভয়ে রাঙ্গা বোকা মুখটাই যেনো জেসমিনের অনেক ভাল লাগে আর তাই তো সেই মুখটা দেখার জন্যই বার বার বোকে। ফোনটা হাতে নেয় জেসমিন। ভাবতে থাকে যদি মেঘই আগে কল দিতো...মিষ্টি করে বলতো কেমন আছিস তুই.... খুব মনে পড়ছিলো তোর কথা.... তখনি জেসমিনের ফোনটা বেজে ওঠে...! স্কিনের দিকে তাকাতেই জেসমিনের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কারন মেঘ ফোন দিয়েছে। অনেক আগ্রহে ফোন ধরে জেসমিন....
---> মেঘ....(জেসমিন)
--> হ্যা আমি...শোন....
---> হুমম বল না কি বলবি.....!
--> আজ না ক্লাসে আমি স্যারের অংক তুলতে পারি নি...তুই তো তুলছিস কাল আমাকে একটু খাতাটা দিস তো।
কথাটা শোনার পরেই জেসমিনের গা যেনো জ্বলে যাচ্ছিলো। 
---> তোকে কিচ্ছু দিবো না....তুই আর আমাকে কল দিবি না....
এই কথা বলেই ফোন কেটে দেয় জেসমিন। খুব রাগ হয় মেঘের উপর। যদি কাছে পেতো তবে ঠিক কিছু একটা করে ফেলতো। রাতে ফোন দিছে খাতা নেয়ার জন্য। মেঘ কি সত্যিই কিছু বোঝে না...জেসমিন সে তো বোঝানোর মত সব কিছুই করেছে তবুও কিছু বোঝে না। ভাবতে ভাবতেই প্রতিদিনের মত মেঘের দেয়া গিফট গুলোর দিকে তাকায় যেগুলো মেঘ জেসমিনকে তার বার্থডে তে দিয়েছিলো। সব ছেলেরা মেয়েদের বার্থডে তে রোমান্টিক কিছু গিফট দেয়...একসাথে নিয়ে ঘোরে...পাশা পাশি হাতটা ধরেহাটে....! কিন্তু এই গাধা চশমাপরা ভূত প্রতি বার্থডেতেই শুধু একটা করে ডায়েরি গিফট দেয়! যদিও জেসমিনের খুব রাগ হয় কিন্তু সেগুলিই অনেক যত্নে রেখে দেয় আর প্রতিদিনিই দেখে। কবে যে বুঝবে ছেলেটা...এসব ভেবেই রাত গুলি কেটে যায় জেসমিনের।
.
পরের দিন জেসমিন মেঘের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু কলেজের সময় হয়ে গেছে তবুও মেঘের আসার নাম নেই। জেসমিন মনে মনে ভাবে যখন মেঘ আসবে তখন অনেক বোকা দিবে। কিন্তু কলেজের সময় পেরিয়ে যায় তবুও মেঘ আসে না। মেঘ না আসায় অনেক খারাপ লাগে। একা একাই কলেজে চলে যায় জেসমিন। কলেজে এসে দেখে কলেজেও আজ মেঘ আসে নি। তবে কি কালকের জন্য মেঘ রাগ করেছে...? না মেঘ তো কখনো তার উপর রাগ করে নি আর রাগ করে থাকতেও পারে না। কিন্তু আজ এমন করলো কেনো...এই সব কিছুই ক্লাসে বসে ভাবতে থাকে। কলেজ শেষ হয়ে যায়। রাতে জেসমিন মেঘকে ফোন দেয় কিন্তু ফোনও বন্ধ দেখায়। জেসমিনের অনেক চিন্তা হয়। পরের দিনও ঠিক একই ভাবে জেসমিন অপেক্ষা করে কিন্তু মেঘ আসে না। কলেজেও যায় না। এবার আর জেসমিন নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। যে মেঘকে প্রতিদিন বোকা না দিলে ভালো লাগে না...একটু কথা না বললে ভালো লাগে না...একটা বার না দেখলেই ভালো লাগে না...সেই মেঘের সাথে দুই দিনে একবারো কথা হয় নি...একবারো বোকা দিতে পারে নি...একটি বারো দেখতেও পারে নি। জেসমিন কলেজ শেষ করেই বিকেলবেলায় মেঘদের বাসায় যায়। বাসায় গিয়েও দেখে কোথাও মেঘ নেই। জেসমিন মেঘের রুমে যায়। গিয়েই দেখে টেবিলে একটা ডায়েরি রাখা.... যার উপরে লেখা ছিলো জেসমিন। লেখাটা দেখেই জেসমিন ডায়েরিটা হাতে নেয়....আর নিয়েই পড়তে থাকে;
>>> জেসমিন...জানি না তোকে ভালবাসি কিনা। শুধু জানি তোকে একদিন না দেখলে...একদিন তোর বোকা না খেলে আমার ভালই লাগে না। জানি না কেনো সব সময় শুধু তোর কথাই মনে পড়ে। তুই জানিস যখন তোর সাথে পাশাপাশি হেটে কলেজ যাই রোজ বাসা থেকে ভেবে যাই যে আজ তোর হাতটা ধরবোই...তুই আড় চোখে তাকাবি কিন্তু আমি ভয় পাবো না ধরেই থাকবো তুই একটু পরেই মুচকি হাসবি আর আমি আরো শক্ত করে তোর হাতটা ধরবো। তুই সব সময় বলতিস না আমি এত ক্লাসের পিছনে কেনো বসি...? কারন তোকে দুচোখ ভরে দেখবো তাই। প্রতিটি ক্লাসেই তোর বাতাসে ওড়া এলোমেলো চুলে আমি হারিয়ে যাই তোর ভালবাসায়। আর তাই তো ক্লাসের অংক গুলি তুলতেই পারি না। আচ্ছা তুই হয়তো ভাবিস আমি তোকে এত ডায়েরি গিফট দেই কেনো। কারন তোকে যে কথাটা ভয়ে বলতে পারি না সেই কথা গুলি মনের রঙে লিখে দেই। জানি তুই দেখতে পাস না। মনের রঙের তো আর রং হয় না। প্রতিদিন রাতে তোকে ফোন দেই....কিছু বলবো বলবো করে আর বলতেই পারি না। তুই যখন আমাকে চশমাপরা ভূত বলিস তখন যেনো নিজের মাঝেই খুজে পাই তোকে...জানি কখনো বলতে পারবো না তোকে তাও বলি... এই চশমা ছাড়া যেমন আমার পৃথিবী অন্ধকার তেমনি তুই ছাড়াও আমার পৃথিবী অন্ধকার। 
ডায়েরিটা পড়েই দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে জেসমিনের। এই কান্না পাওয়ার কান্না। 
.
ডায়েরিটা হাতে নিয়েই জেসমিন মেঘের মায়ের কাছে যায় আর মেঘের কথা জিজ্ঞাস করে। মেঘ সেই তাদের বাসার পাশের নদীর কিনারায় বসে আছে। জেসমিন সেখানে যায়। গিয়েই দেখতে পায় মেঘ বসে আছে...
---> ওই চশমাপরা ভূত....(জেসমিন)
মেঘ পিছু ফিরে জেসমিনকে দেখে অবাক হয়ে যায়....
--> জেসমিন তুই...(মেঘ)
---> কলেজ যাস নি কেনো দুই দিন? 
--> না মানে.....এমনিই....
কথা বলার সময়ই জেসমিনের হাতে সেই ডায়েরিটা দেখতে পায়...
--> তোর হাতে এই ডায়েরি....কোথায় পেলি...
---> তোর ঘরে...পেয়েছি।
--> কি...তুই খুলিস নাই তো ডায়েরিটা...
---> হুমম খুলেছি....পড়েছি....সব কিছু জেনে গেছি....
--> না মানে......কি জানছিস...
---> কি জানছি? তুই তলে তলে আমার সাথে লাইন মারিস? আমার হাত ধরতে চাস....ক্লাসে শুধু আমাকে দেখিস....সব সময় আমাকে নিয়ে ভাবিস?
--> না মানে....এগুলা তো আমি এমনিই লিখছি....
---> এমনি লিখছিস? 
মাথা নিচু করে থাকে মেঘ।
---> হাত ধরতে চাইছিস কখনো ধরিস নি কেনো... ফোন দিতি কিন্তু কিছু বলতে পারিস নি কেনো...? খুব তো লিখছিস তোর চশমার মত আমি... যাকে ছাড়া তোর পৃথিবী অন্ধকার তবে দুই দিন কলেজ যাসনি কেনো? 
--> কলেজ যাই নি...দেখছিলাম তোকে ছাড়া থাকতে পারি কি না....এখন বুঝছি পারবো না থাকতে!
---> তার মানে লেখা গুলি সব সত্য? 
এবার আর মিথ্যা বলতে পারে না মেঘ। মাথা নেড়ে নিরবে সম্মতি জানিয়ে দেয়।
---> সব সত্যি কিন্তু মুখে বলিস নি কেনো? জানিস তোকে কতটা ভালবাসি আমি? আমি ভাবতাম কখন তুই আমাকে বলবি...কিন্তু তুই বলিসই না....প্রতি রাতেই ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতাম কখন তুই ফোন দিবি....যখন একসাথে হাটতাম তখন হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে থাকতাম তুই ধরবি তাই....কিন্তু তুই তো বোকার মত চুপ করে থাকতি।
--> ভয় হতো যদি সবার মতো আমাকেও চড় মারিস!
---> মার খাওয়ার খুব ভয় না? এখন তোকে দেখ আমি মারতে মারতে....
--> একদম মারবি না...না হলে রিতুর কাছে চলে যাবো কিন্তু....
---> কি বললি?
এই কথা বলেই জেসমিন মেঘকে মারতে থাকে। আর মেঘ তার এই স্পর্শে ভালবাসার পরশ খুজে পায়। হয়তো এভাবেই একসময় মেঘ জেসমিনকে বুকে টেনে নিবে আর জেসমিন চুপটি করে লুকিয়ে পড়বে মেঘের বুকে আর বলবে এই চশমাপরা ভূতটা অনেক বড় হয়ে গেছে।।।
:

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন