শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৭

বন্ধু, তোমাকে বিদায়...

কাল হাবিব খুশির দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী। সেই সন্ধ্যে থেকে হাবিবকে কল করে যাচ্ছে খুশি। কল বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে, অথচ রিসিভ হচ্ছে না। খুশি তবুও অক্লান্ত ভাবে কল করে যাচ্ছে, রাত ১১টায় কল রিসিভ করল হাবিব। তারপর কড়া গলায় বলল, কি হয়েছে? এত কল দিচ্ছো কেন? ব্যস্ত আছি। হয়তো ফোন রেখে দেবে, এই আশঙ্কায় খুশি তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? শাম্মির কাছে না??
হাবিব সেই মূহুর্তে কোন কথা বলল না, কিছুক্ষণ পর বড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এসব আজেবাজে কথা কে তোমার কানে লাগায় বলতো? আরে দোকানে আছি, অন্য কোথাও না, বিশ্বাস কর!!
খুশি কথা না বাড়িয়ে খুব শান্ত গলায় বলল, কখন আসবে? হাবিব যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, যাক খুশির কণ্ঠে আজ ঝগড়ার আঁচ নেই! সে নির্ভার কণ্ঠে বলল, এই তো দোকানে ভীর কমলেই। তুমি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ো, ওহ, খুশবু ঘুমিয়েছে??
হু, আচ্ছা ফোন রাখি। বলে কলটা কেটে দিলো খুশি। তারপর কিছুক্ষণ ফোনহাতে ঝিমধরে বসে রইল সে। তার আর হাবিবের জন্য আনা ভাত তরকারি টেবিলে ঢাকা আছে প্রতিদিনের মত, হাবিব একটু রাত করে ফেরে তাই খুশি ওদের খাবারটা নিজের রুমে এনে রাখে যেন অত রাতে শাশুড়িকে না উঠতে হয়। সত্যি বড় খিধে পেয়েছিল তার কিছুক্ষণ আগেও, তাই অনবরত কল করে যাচ্ছিল হাবিবকে। কেন যেন এখন আর তার খিধের অনুভূতি নেই আর। খুশি বিছানা ছেড়ে উঠে ডেসিং টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, একবার ঘুরে ফিরে দেখল নিজেকে... এখনো কি সে দুবছর আগের মত-ই চরম আকর্ষণীয়া আছে? নাকি স্বামী, সন্তান, সংসারের চাপে অনেকটাই আনস্মার্ট গেঁয়ো বধু হয়ে গেছে? হয়তো সেটাই, নচেৎ হাবিব কেন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? হাবিব কেন সুখ খোঁজে অন্যান্য রক্ষিতার কাছে?
অজান্তে খুশির বুক চিড়ে একটা সুদীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। হাবিব যদিও এখনো স্বীকার করেনি এই রক্ষিতা রাখার কথা, কিন্তু উড়ে উড়ে অনেক কথাই এতদিন কানে এসেছে খুশির। আর এ নিয়ে দুবেলা হাবিবের সাথে অশান্তি, ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে তার, অথচ আজ যখন প্রমাণ তার হাতের নাগালে তখন হাবিবের সাথে ঝগড়াঝাঁটির কোন আগ্রহ-ই পেল না খুশি। বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাবিব আর শাম্মির অন্তরঙ্গ মূহুর্তের অসংখ্য ফটোগ্রাফ, ব্যথিতা মনে ফের একবার সেদিকে চোখ বুলালো খুশি। সত্যি বলতে এতদিন এই নিয়ে হাবিবের সাথে ঝগড়া, মনোমালিন্য হলেও খুশি যেন ঠিক মন থেকে বিশ্বাস করেনি হাবিব সত্যি সত্যি তাকে ছাড়া অন্য কারো প্রতি আসক্ত হতে পারে.... আজ যখন অবিশ্বাসের কিছুই নেই তখন খুশি ভীষণ রকম শান্ত, নিরব।
সে অস্বাভাবিক শান্ত ভাবে হাবিবের তিন বছর আগের লেখা ডাইরি-টা হাতে নিয়ে পাতা উলটে পালটে দেখতে লাগল,
.
১৪.০৪.১৪
আজ কেকেএসে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম ছিল। যথারীতি সংগঠকের মহান দায়িত্ব নিয়ে কাজে নেমে পড়লাম আজ সঞ্চালকের দায়িত্বে মঞ্চে উঠে নিজের পরিচয় দিলাম, আমি আপনাদের সবার প্রিয় হাবিব সংকেত! মুহুর্তে সবার অনুরোধ, হাবিব ভাই, সেই গানটা, সেই গানটা! যেই সবার প্রিয় সেই " খালি কলসি বাজে বেশি, ভরা কলসি বাজে না, রুপ নাই তার সাজন বেশি, রুপের মাইয়া সাজে না!" গানটা গেয়ে উঠেছি। ঠিক তক্ষণী আমার গানের কথাগুলো মিথ্যে করে দিয়ে চোখে ভেসে উঠলো সামনের সারির ডানদিকে বসা সুসজ্জিতা এক অপরূপা রুপসীর দিকে! পরবর্তী সময়ে গান যে কিভাবে শেষ করলাম আল্লাহ'য় জানে!!
গান শেষে দেখি হুরপরী আমার দিকেই এগিয়ে আসছে!! চোখের ভূল ভেবে চোখ কচলাতেই দেখি রূপসী আমার চোখের সম্মুখে! হেসে বলছে! দারুণ গেয়েছেন হাবিব সংকেত ভাইয়া!
সহসা কেন জানি লজ্জা পেলাম হানিফ সংকেত কে নকল করে নিজের নামে হাবিব সংকেত লাগিয়ে এলাকায় বিভিন্ন প্লান প্রোগ্রাম করি বলে! আচ্ছা মেয়েটা সত্যি প্রশংসা করে গেল? নাকি মশকারা!!
যাহ, মেয়েটার নাম-ই তো জানা হলো না!!
.
খুশি ডাইরি টা বুকে জড়িয়ে ধরে অনবরত কেঁদে যাচ্ছিল এক বুকভাঙ্গা নিঃশব্দ কান্নায়, খুশবু ঘুম ভেঙে কেঁদে ওঠায় ডাইরিটা রেখে ছেলেকে কোলে নিলো খুশি, কেন জানি খুশবুকে বুকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। তারপর কিছুক্ষণ খুশবুকে কোলে নিয়ে পায়চারি করে ছেলেকে ফের ঘুম পারালো খুশি। ডাইরিটা আর পড়তে ইচ্ছে করছে না, আজ হাবিবের সেদিনের সেইসব আবেগ অনুভূতি সবকিছু মূল্যহীন।
খুশি জানালা খুলে তাকিয়ে রইল নিখাদ অন্ধকারের দিকে.....
.
১৬ এপ্রিল হাবিবের সাথে ফের দেখা মডেল স্কুলে। খুশিকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে চিরচেনা ভঙ্গিমায় হাসল হাবিব, খুশিও মৃদু হাসল, হাবিব এলাকায় বিভিন্ন প্রোগ্রামে গান করে, উপস্থাপনা করে এককথায় এলাকার সবাই তাকে হাবীব সংকেত বলে একনামে চেনে, হাবিবের সাথে কথা বলতে পেরে ভালোই লাগছিল খুশির, কি মিষ্টি সূরে মিষ্টি করে কথা বলে ছেলেটা, হাবিব খুশির নাম ধাম ক্লাস রোল জেনে নিলো এক ফাঁকে, শেষে বলল, ওহ! তুমি হোমে থাকো?? তোমাকে দেখে তো মনেই হয়না যে তুমি হোমের মেয়ে!
কথাটা হয়তো প্রশংসা সূচক ছিল, কিন্তু খুশির মন খারাপ হয়ে গেল মূহুর্তেই। হাবিবের এই এক কথায় নিমিষেই পরিষ্কার হয়ে গেল খুশির অবস্থান ঠিক কোথায়.... সে হোমের মেয়ে আরো নির্দিষ্ট করে বললে সে এক নিকৃষ্ট পতিতাকন্যা।
যদিও তার মা একজন নিকৃষ্ট মহিলা কিন্তু উৎকৃষ্ট মা। তাই তিনি মেয়েকে নিজের সাথে পল্লীতে না রেখে হোমে ( বিদেশি সংস্থা সেফ দ্যা চিলড্রেন কর্তৃক পরিচালিত সেচ্ছাসেবী সংঘটন, যারা ব্রোথেলের কন্যা শিশুদের বাইরের একটা সুন্দর সুস্থ পরিবেশে রেখে লেখাপড়া করায়, উপযুক্ত হলে সম্মানজনক চাকরীর ব্যবস্থাও করে দেয়) রেখেছেন। যদিও সে ব্রোথলের বাইরে থেকে মূলধারার ছেলেমেয়ের সাথে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে,কিন্তু কাক যতই ময়ূরপুচ্ছ লাগাক, দিন শেষে তার পরিচয় হোমের মেয়ে.....
খুশির মুখের হাসিহাসি ভাবটা কেটে অন্ধকার মেঘ নেমেছে দেখে প্রসঙ্গ পাল্টালো হাবিব, সে ব্যস্ত হয়ে উঠল যে কোন কথায় খুশিকে হাসাতে... এটা অবশ্য সে ভালোই পারে। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল তারা কোন সামান্য রসিকতায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে, খুশি কিছু মনে রাখেনি, যন্ত্রণার অনুভূতি মনে রাখতে নেই।
.
মায়ের সাথে কদিন ধরে মনোমালিন্য হচ্ছে খুশির। হাবিবের সাথে খুশির সম্পর্কের প্রায় এক বছর হতে চলল, ওরা ঠিক করেছে বিয়ে করবে, হাবিবের বাবামায়ের নাকি খুব একটা আপত্তি নেই। কিন্তু খুশির মা এ বিয়েতে রাজি হচ্ছে না। সে মেয়েকে নানাভাবে বুঝাচ্ছে এটা বিয়ে নয়, পুতুল খেলা, ওরা তোকে সত্যিকারের ঘরের বউ হিসাবে কোনদিন মেনে নেবে না, গ্রামের আর দশটা বউ ঝি'রা তোর সাথে মিশবে না। তবু কেন যে বিয়েতে তারা আপত্তি করছে না এটা তুই বুঝবি না.....
খুশি কিছুতেই বুঝ মানেনি, এক পর্যায়ে সে বলে বসেছে, কেন মা? যদি না আমায় স্বামী সংসার নিয়ে সুখী হতে দেবে তবে কেন সেই ছোটবেলা থেকে আমায় তোমার সাথে ঐ নরকে না রেখে দূরে সরিয়ে রেখেছিলে?
কেন এতটা লেখাপড়া করাচ্ছ? তুমি কি চাও আমিও তোমার মত ঐ নরকে গিয়ে পঁচে মরি? মায়ে আর্তনাদ করে কেঁদে উঠেছে, না, সে কখনোই তা চায় না, সে চায় মেয়ে স্বাবলম্বী হোক, নিজের সৎ উপার্জনে বেঁচে থাকুক। মেয়ে স্বামী সংসার নিয়ে সুখী হবে এই দুরাশা মায়ে করেনি কোনদিন। যদিও আজ তেমন সুযোগ এসেছে, এতে মায়ের চেয়ে খুশি আর কে হতে পারে...?
কিন্তু মায়ের ভয়টা যে কোথায় এটা মেয়ে বুঝবে না কিছুতেই। দুদিনের মেয়ে সে, জীবনের নির্মমতা তার দেখা হয়নি কিছুই। হাবিবের মনোভাব জানে না খুশির মা, কিন্তু খুব ভালো করেই জানে খুশির শ্বশুর খুশিকে ছেলের বউ নয়, টাকা উৎপাদনের মেশিন ভেবে ঘরে নিবে। অবশ্য এ নিয়ে আপসোস নেই খালেদার, এতদিনের যত সঞ্চয় সব তো মেয়ের ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবেই? খালেদার যা আছে সে সবকিছু মেয়ে জামাইকে দিয়ে দেবে।কিন্তু মেয়ে কি তার আদৌ সুখি হবে?
অবশেষে খুশির ইচ্ছার কাছে হার মেনেছে খালেদা বাড়িওয়ালী। ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছে হাবীব খুশির। অবশ্য তার আগেই খালেদা হাবিবদের বাড়ির চেহারা পালটে দিয়েছে, চৌচালা টিনের ঘর একতলা হয়েছে, নানান অত্যাধুনিক আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে মেয়ে জামাই বাড়ি। হাবীব কে বড় হোটেল করে দিয়েছে।সব কিছু খালেদা নিজের তত্ত্বাবধানে করেছে। সে জানে বেচে থাকা অবধি তাকে অনবরত দিতেই হবে। তবু যেন মেয়েটা সুখে থাকে....
.
হু, বড্ড সুখেই কেটেছে খুশির বিয়ের প্রথম বছর, শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদ জা নিয়ে একটা পরিপূর্ণ সংসার পেয়েছে খুশি....
জন্ম থেকে সে যা পায়নি....!!
ইতিমধ্যে তার কোলজুড়ানো ছেলে হয়েছে খুশবু, নাতির জন্যই হোক, বা তাকে সোনার ডিম পাড়া হাঁস ভেবেই হোক শ্বশুর বাড়ির সবাই তাকে মাথায় করে রাখে। মাঝে মাঝে মায়ের ভয়ের কথা ভেবে হাসি পায় খুশি। মা অযথাই ভয় পেয়েছিল এরা নাকি খুশিকে সম্মান দেবে না! কই ভালোই তো আছে সে এই সংসারে।
কিন্তু খুশির সুখে ছাই পড়ল সহসাই এক অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদে, হাবিবের ইদানীং পল্লীর অভ্যন্তরে চলাচল বেড়ে গেছে....
যদিও সে শাশুড়ির এরিয়া এড়িয়ে চলে, কিন্তু সমগ্র এরিয়াটাই যে খালেদা বাড়িওয়ালীর নখদর্পণে। সে ফোন করে মেয়েকে বলে, খুশি বিশ্বাস করে না, খালেদা নিজেও মেয়েকে জোর করে বিশ্বাস করাতে চায় না, থাক ও যা নিয়ে সুখী হয়ে।
কিন্তু শেষ অবধি তাকে বলতেই হলো কেননা হাবীব নিজের লিমিটক্রশ করে পল্লীতেই একটা উপপত্নী রেখেছে। খুশি এটা শুনলে কি করবে খালেদা ভেবে পায় না, এই ভয়টাই সে করেছিল বিয়ের আগে। এরা অমানুষ, সুখী করবে না তোকে। মেয়ে কানে তোলেনি সে কথা....
অতঃপর সে প্রমাণ জোগাড় করে মেয়ের হাতে দিয়েছে। আজ সেইসব প্রমাণ হাতে নিয়েই মুখে মনে এক আকাশ মেঘ নিয়ে নিরবে বসে আছে খুশি।
হঠাৎ দরজায় সেই পরিচিত নকের ধ্বনি!
ধ্বক করে উঠল খুশির বুকের ভেতরটায়, হাবীবের আগমন সংবাদে সে আজো প্রথম দিনের মতই শিহরিত হয়, সেই প্রিয়জন আর তার নেই, এই কথা কি এত সহজে বিশ্বাস হয়? খুশি ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল ১২ টা বাজার ৩ মিনিটস বাকি!! পরম আনন্দে নেচে উঠল খুশির হৃদয়! তার মানে হাবীব ভোলেনি তাদের বিবাহবার্ষিকীর এই দিনটির কথা!! আর সেই জন্যই সে আজ এত দেরি করে ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক সময়ে বাড়ি এসেছে!!
মুহুর্তে খুশির রাগ অভিমান মনখারাপ কোথায় ধুয়ে মুছে গেল! মুহুর্তে সে ভুলে গেল হাতের ফটোগ্রাফের জলজ্যান্ত প্রমাণ। সে নিজেকে আয়নায় দেখল ফের। নাহ, মন খারাপ থাকায় কিচ্ছুটি করা হয়নি, মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে, চুলগুলো এলোমেলো, হাবিব দেখলে খুব রাগ করবে, হাতে তিন মিনিট সময় আছে, ইতিমধ্যে তাকে যে পরিপাটি হতে হবে। ঠিক ১২ টা ১ মিনিটে সে দরজা খুলে দেবে। নিশ্চিত হাবীব হাতে করে তার প্রিয় রজনীগন্ধার বোকে নিয়ে এসেছে সেই প্রথম বিবাহবার্ষিকীর মত-ই!
তড়িঘড়ি করে খুশি চুল আছড়ালো, খোলা চুলে তাকে দেখতে ভীষণ পছন্দ হাবীবের! কপালে একটা কালো টিপ দিলো খুশি। কাজল পড়ার দরকার, হাবীব খুব পছন্দ করে... কিন্তু সময় নেই, ওপাশে অনবরত নক করে যাচ্ছে সে। শাড়িটা চেঞ্জ করা দরকার! যাহ সময় নেই! নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে খুশির। আজ সন্ধ্যে থেকে তার প্রস্তুত হওয়া দরকার ছিল, কেন যে সে মাঝে মাঝে সবার কানকথা বিশ্বাস করে!
শাড়ি চেঞ্জ না করলেও তড়িঘড়ি করে সে কুচি গুলো ঠিক করল,আচল টা যত্নকরে পিঠের উপর সাজিয়ে রাখতে রাখতে দরজা খুলে দিলো, যাহ ১২ টা ৩ বেজে গেছে!! মানে ৬ মিনিটস ধরে হাবীব অনবরত নক করে গেছে! অন্যদিন হলে হাবীব নিশ্চিত রেগে যেতো, আজ নিশ্চয় রাখবে না ভাবতে ভাবতে দরজা খুলেই একটা বদ গন্ধ পেলো খুশি। সামনেই মাতালের মত দুলছে হাবিব। খুশিকে দেখেই সে খুশির মাকে তুলে বিশ্রী একটা গালি দিয়ে বলল, এতক্ষণ লাগল কেন দরজা খুলতে? আর এত সেজেছিস কেন? কে আছে ঘরে??.......... মায়ের মত দেহব্যবসায় নামবি তো মায়ের কাছে যা, আমার ঘরে এসব নষ্টামি চলবে না.....
খুশি চলৎশক্তিহীন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে সামনে মাতলামি করতে থাকা হাবীবকে টেনে রুমে নিতেও ভুলে গেছে ঘটনার আকর্শিকতায়। অন্য ঘর থেকে শ্বশুরের গলা পেয়ে হুশ ফিরল তার।
টেনে সে হাবিবকে ঘরে নিয়ে গেল, হাবিব তখনো শাশুড়ি আর খুশিকে জড়িয়ে আজেবাজে নানান কথা বলে যাচ্ছে। খুশি টেনে হাবিবকে বাথরুমে নিয়ে মাথায় পানি ঢেলে দিলো, অবুঝ বাচ্চার মত জবুথবু হয়ে বসে আছে হাবীব, খুশি নিজ হাতে স্বামীর গোছল করিয়ে রুমে এনে বসালো। হাবীব কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে, চুপচাপ খুশির হাতের পুতুলের মত নির্দেশ পালন করতে লাগল সে। খুশি হাবীবের জন্য এনে রাখা ভাত মাখিয়ে ওকে খাইয়ে দিতে লাগল প্রতিদিনের মত, অন্যদিন হলে হাবীব নিজেও খুশিকে খাইয়ে দিতো কেননা খুশি যে হাবীবের অপেক্ষাতেই এত রাত পর্যন্ত অভুক্ত। কিন্তু আজ হাবীব কোন আগ্রহ দেখালো না, খুশি নিজেও নিজের হাতে মুখে তুলল না একনলা ভাত ও। হাবীব ছেলের পাশে শুয়ে পড়েছে, প্রতিদিন যেপাশে ঘুমায় তার বিপরীতে।
খুশি খাবার হাতে ঝিম ধরে বসে আছে, সে স্বামীকে নিষেধ করল না ওখানে শুতে। কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ, হাবীব ঘুমাচ্ছে না, শুধু এপাশ ওপাশ করছে দেখে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল খুশি। মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে ঘুমাতে পারেনা হাবীব। খুশি ভীষণ শান্ত ভাবে হাবীবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল....
.
রাত পনে একটা,
হাবীব ঘুমিয়েছে, খুশবুও ঘুমিয়ে আছে বাবার পাশে। খুশি ফের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকদিন পর, চেহারায় যেন আলাদা এক জ্যোতি ফুটেছে। তবে কি যেন অসম্পূর্ণ, খেয়াল করে দেখল খুশি, হুম, চোখে কাজল নেই, খুশি ভালো করে চোখে কাজল দিলো, শাড়ি পাল্টালো। হাতভরে চুড়ি পড়ে নতুন বধুর মত গিয়ে হাবীবের শিওরে গিয়ে বসল।
কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বাবা ছেলে.....
খুশি দুজনের কপালে চুমু একে দিলো পরম মমতায়, তারপর ডেসিং টেবিলে বসে অতি দ্রুততার সাথে লিখে ফেলল, সুইসাইড নোট.....
"......আমার মৃত্যুর জন্য কোনভাবেই হাবীব দায়ী নয়, তাই আমার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে যেন এ নিয়ে আমার হাবিবকে বিন্দুমাত্র হেনস্তা না করা হয়। পৃথিবীর প্রতি বিতৃষ্ণা থেকেই চলে যাচ্ছি। হে বন্ধু, তোমাকে বিদায়....."
............................খুশী।
.
মাত্র-ই খুলে রাখা শাড়িতে ঝুলছে খুশির নববধূ বেশে সজ্জিত দেহ, ঝুলে পড়ার পর তার মনে হচ্ছে ছেলেটা রাতে কেঁদে উঠলে তাকে কে থামাবে? সে মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে হাবীব কিভাবে ঘুমাবে??
ননদটা প্রতি সন্ধ্যায় চুল বাঁধতে কার কাছে যাবে? আর মা? যে মহিলা তার সমগ্র জীবন নরকে কাটিয়ে তার সঞ্চিত সকল সম্পদ দিয়ে মেয়ের সুখ দেখতে চেয়েছিল? সে কি আঁকড়ে ধরে বাঁচবে?
খুশবুকে কে দেখবে? তার মায়ের জন্য, ছেলের জন্য হলেও বাঁচা দরকার....
খুশি বাঁচতে চায়, ঐ তো পাশেই খুশবু নড়ে উঠেছে, তাকে বুকে জড়িয়ে না নিলে সে কেঁদে উঠবে। খুশির খুব ইচ্ছে করছে খুশবুকে বুকে জড়িয়ে নিতে।
কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
সকালে তাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী, হাবীব ঘুম ভেঙে এই সুন্দর দিনে খুশির দেয়া সবচেয়ে চমকপ্রদ উপহার হিসাবে খুশির বধুবেশে ঝুলন্ত মৃত দেহ পাবে।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন