ছেলেটা তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, বিন্দাস জীবন চলছিলো ভার্সিটির। নিজের এলাকায় যাওয়ার পরেই ইন্টার পড়ুয়া এক মেয়ের সাথে রিলেশন হয় ছেলেটার। মাঝেমাঝে এলাকায় গেলেই মেয়ের সাথে দেখা হয়। আর দূরে থাকলে অত্যাধুনিক মিডিয়ার যুগে ইমো, ফেসবুক, মোবাইলে কথা চলতে থাকে। মেয়েটার অর্থের অভাবে যখন লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম, ছেলেটা তখন মেয়েটার পাশে দাঁড়ায়। তাকে মানসিকভাবে সাহস দিতে থাকে, যতটুকু সম্ভব মেয়েটাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে থাকে। ছেলেটার সাথে একসময় মেয়েটার পরিবারেরও ভালো সখ্যতা গড়ে উঠে। রিলেশনের বিষয়টা মেয়ের পরিবার যে একেবারেই জানতো না, ব্যপারটা তা নয়। বিষয়গুলো এমন হয়ে গেলো যে, একসময় মেয়েটির পরিবারের পাশেও ছেলেটি দাঁড়ায়। মেয়েটির পরিবার মনেই করে নিলো, ছেলেটা আমাদের ঘরের। মেয়েটা একসময় ইন্টার পাশ করে ভার্সিটি কোচিংএ ভর্তি হয়, ছেলেটার পারামর্শেই। মেয়েটার ভার্সিটি কোচিং থেকে শুরু করে, থাকা, খাওয়া যাবতীয় খরচ ছেলেটাই দেওয়ার চেষ্টা করে। মেয়েটা একসময় বিভিন্ন ভার্সিটিতে ভর্তি পরিক্ষা দেওয়া শুরু করে। সৌভাগ্যক্রমে মেয়েটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যায়। মেয়েটা যখন টাকার অভাবে ভার্সিটিতে ভর্তি হতে হিমশিম খাচ্ছিলো, তখনো এই বেকার ছেলেটার টাকায় মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায়। আপনার হয়তো ভাবতে পারেন। ছেলেটার ফ্যামেলি ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক ভালো ছিলো, মেয়েটাকে অনেক ভালো লেগেছে। তাই মেয়েটাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছে। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। ছেলেটাকে দেখতাম দৈনিক ৩/৪ টা টিউশনি করাতো, পরিবার থেকে সহযোগিতা করার মতো কোনো অবস্থা ছিলো না। একদিন দেখলাম রাতে কাঁচুমাচু করে ছেলেটা আমার রুমে এসো বললো, ভাই আপনার কাছে কিছু টাকা হবে, খুব দরকার। রিলেশনের ব্যাপারটা তো আগেই জানতাম। তাই একটু মজা করেই বললাম, টাকা টা কি তোর দরকার, না ওর। ছেলেটা একটু হাসিমুখ করে বলার চেষ্টা করলো, ভাই, আসলে মেয়েটার ভার্সিটিতে ভর্তি হতে আরো কিছু টাকা দরকার। আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলাম না। শুধু জিজ্ঞাসা করলাম খাইছস কিছু। ছেলেটা শুধু মাথা নাড়ালো। পাবলিক ভার্সিটিতে পড়া স্টুডেন্ট হিসেবে, এর অর্থ আমি আমার মতো করে বুঝে নিলাম। যাওয়ার সময় শুধু বলে গেলো, ভাই আসলে ভাবছিলাম আজ টিউশনির টাকাটা পাবো কিন্তু পেলাম না। আমি শুধু বললাম, আর কিছু বলতে হবে না। বুঝতে পারছি। ছেলেটা সেদিন চলে যায়, আমি তার দিকে চেয়ে থাকার চেষ্টা করি কিন্তু আমার চোখ ধরে আসে।
মেয়েটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার পরেও ছয় মাস রিলেশনটা ভালোই চলছিলো। বিপত্তি শুরু হয় কিছুদিন পর, ছেলেটার তখন ফোর্থ ইয়ার পরিক্ষা সামনে। হঠাৎ করেই মেয়েটার আচার আচরন অভাবনীয় পরিবর্তন হতে শুরু করে। ফোন দিলে আগের মতো আর রেন্সপন্স পাওয়া যেতো না। আগে যেখানে মেয়েটা একমুহুর্ত কথা না বলে থাকতে পারতো না। সেখানে মেয়েটা এখন ছেলেটার কোনো খোঁজখবর নেওয়ারই প্রয়োজনবোধ করে না। বারবার ফোন দিলে বলে, এতো ফোন দেওয়ার কি আছে? বারবার বিরক্ত করছো কি জন্য, তুমি আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছো কি জন্য। এরকম নানা কথার বাহানা শুরু হয়ে যায়। রিলেশনটার একপ্রকার ভেঙ্গে যাওয়ার মতো অবস্থা! ভালবাসার মানুষের অবহেলায় আর নির্মম কথার আঘাতে ছেলেটার পড়াশুনাও একসময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কাঠের মনেহয় শেষ পেরেকটা ঠোকাটা বাকি ছিলো। মেয়েটা একদিন ফোন করে জানিয়ে দেয়। ছেলেটার পড়াশুনা বন্ধ হলে তার কিছু আসে যায় না, সে একা থাকতে চায়। সে পড়াশুনা করবে, তার অনেক স্বপ্ন আছে। ছেলেটার জন্য সে অপেক্ষা করতে চায় না। কোনো বাধা গন্ডির মধ্যে সে থাকতে চায় না। ছেলেটাকে তার নিজের পথ খুঁজে নিতে বলে। ছেলেটার তখন পরিক্ষার ঠিক কয়েকদিন বাকী ছিলো। পড়াশুনাও তেমন হয়ে ওঠে না। মেয়েটাকে শেষবারের মতো অনুরোধ করে পরিক্ষার কয়েকটা দিন পাশে থাকার জন্য কিন্তু মেয়েটা তাতেও সায় দেয় না। ছেলেটার অনেকদিন যোগাযোগ না হওয়ায় এতো কিছু জানতাম না। শুধু জানতাম একটু আধটু নাকি এখন মাঝেমাঝে অভিমান হয় কিন্তু জল এতো ঘোলা হয়েছে তা আমার ধারনার বাইরে ছিলো। পরিক্ষার কয়েকদিন আগে ছেলেটা আমার কাছে এসে বললো, ভাই! আমি এখন কি করবো? ছেলেটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার কাছে ছিলো না। শুধু বললাম, এতো চিন্তা করিস না। পরিক্ষা সামনে এই ধাপটা পার হতে হবে, যে করেই হোক। ভালবাসার মানুষ চলে গেছে কিন্তু পরিক্ষায় পাশ না করলে সার্টিফিকেটাও পাবি না। যা নিজেকে একটু স্থির রাখার চেষ্টা কর। জীবন কারো জন্য কখনো থেমে থাকে না। ছেলেটা বারবার বলছিলো, একটা মেয়ে কিভাবে পারে ভাই, এরকম করতে, কিভাবে? আমার মাথায় আসে না, ভাই। ছেলেটার চোখ বেঁয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। ছেলেটাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু আমার কথায় কাজ হলো কি না বুঝতে পারলাম না। আসলে এই পরিস্থিতিতে যতকিছুই ভালবাসার মানুষটাকে বোঝানো হোক না কেনো? কোনো কথাই ঠিক মাথায় ঢুকতে চায় না। ছেলেটে অঝরে কাঁদছে, মন খুলে একটু কাঁদুক। কেঁদেও যদি কষ্ট কিছুটা কম হয়। তাও ভালো।
ভালবাসায় গড়া তিলেতিলে একটা গড়া সম্পর্ক মুহুর্তেই মধ্যে যারা ভেঙ্গে দিতে পারে, আর যাই হোক তাদের সম্পর্কের প্রতি কোনো সম্মান বা ভালবাসা থাকে না। ভালবাসায় কেউ কাউকে ছেড়ে দিতে চাইলে, আপনি কাকে অপরাধী করবেন? ভালবাসাকে, নাকি যে ছেড়ে যেতে চায় তাকে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন। তাদের ভালবাসার পথটা কিন্তু ঠিকই একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎই কেনো মেয়েটা এরকম বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো? ব্যাখ্যাটা আসলে আপনি কিভাবে দাঁড় করাবেন? ভার্সিটিতে চান্স হওয়ার পর পরিবেশের সাথে খাওয়াতে, নিজের স্বপ্নের পথে পা বাড়াতেই হয়তো মেয়েটা আর সম্পর্ক রাখতে চাইছে না? ভালবাসার মানুষকে হয়তো কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় কিন্তু ভালবাসাকে নয়। মেয়েটা ইচ্ছে করলে সম্পর্কটা রাখতে পারতো কিন্তু তার ইচ্ছে হয় নি। যাস্ট ইচ্ছে হয় নি। নয়তো নিজের জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারনে সে আর সম্পর্কটাকে নিয়ে আর সামনে আগাতে চায় নি। আমি কিন্তু বলছি না মেয়েটা ভালবাসার প্রথম থেকেই এরকম প্রতারণা করবে বলে ভেবেছিলো। আসলে সময়ের সাথেসাথে মানুষের মন পরিবর্তনশীল। মনকে জোর করে বেঁধে রাখা যায় না। হয়তো মেয়েটাও সেই পরিবর্তেনের জোঁয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। ভালবাসাকে যারা খেলনা ভেবে দু'পায়ে পদদলিত করে, আসলে অপরাধটা শুধু তারই, সেই অকৃতজ্ঞ মানুষগুলোর। ভালবাসায় কোনো অপরাধ নেই, থাকে না। আমরা নিজেরাই স্বার্থের জন্য ভালবাসাকে কলুষিত করি। মানুষের হৃদয়ে অবিশ্বাসের বীজ বুনে দেই। আমি বিশ্বাস করি, ভালবাসার মানুষগুলো ফিরে আসবে বারবার। শুদ্ধতম ভালবাসা বেঁচে থাকবে স্বর্গে মর্তে, বিশ্বাসীদের হৃদ মাঝারে, আমার আপনার বুকের ভিতর।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন