সকাল দশ টা বেজে পনেরো মিনিট। কত সেকেন্ড বলতে পারছিনা। সেকেন্ড বড্ড অস্থির হয়। সারাক্ষণ দৌড়ায়। মানুষ কে আমার কোনো একটা দিক দিয়ে সেকেন্ড টাইপের ই মনে হয়। জন্ম নেয়ার পর থেকেই দৌড়াচ্ছে.. টাকার জন্যে, পরিবারের জন্যে, ভালোবাসার জন্যে, বেঁচে থাকার জন্যে..! নানা কারনে দৌড়াচ্ছে, কেউ কেউ আবার কোনো কারন ছাড়াই দৌড়াচ্ছে...! আমি দৌড়াচ্ছিনা, তবে হাঁটছি..! একা। এমনিতেই একা হাঁটার অভ্যেস নেই আমার। তবে কিছু করার নেই। তৃপ্তি নেই। তৃপ্তি আমার বন্ধু, জানপাখি, প্রানপাখি। প্রায়ই ওকে বলতাম, "ইশশ.. আমি যদি ছেলে হতাম, তবে তোর সাথে পাঁচ ছয় বৎসর মাখো মাখো প্রেম করে বিয়ে করে নিতাম তোকে। বিয়ের পর সারাদিন - সারারাত জ্বালাতাম!" তৃপ্তি হাসতো। তৃপ্তি কে মিস করছি। সিলেট চলে গিয়েছে, ওখানেই নাকি পড়াশোনা করবে। এখানে কি হয়েছে সেটাও খোলাসা করে বলছেনা। ভীষন রাগ হয়েছিলো আমার। একবার ভাবলাম "ভালোবাসা" টাইপের কোনো সমস্যা না তো! পরমুহুর্তে ভাবলাম, "দুর!" তৃপ্তি ভালোবাসা শব্দ টার ঘোর বিরোধী। এসব ন্যাকামো মনে হয় তার কাছে। মেয়েটি সিলেট যাওয়ার অনেক অনেক দিন আগে থেকেও কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলো। কথা বলতোনা, একা থাকতে পছন্দ করতো। এই একমাত্র বন্ধু ছিলো, যার সাথে ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারতাম, কথা বলতাম। তৃপ্তির কথা ভাবতে গিয়ে আমার চোখে জল এলো, অতি অল্পতেই আমার চোখে জল আসে। বড্ড ইমোশনাল আমি...! আমার হাতের বাঁ পাশে মায়াপুরী পার্ক। ঢোকার রাস্তার গেইটের উপরে বড় করে লেখা আছে, "মায়াপুরী পার্ক!" পার্ক শব্দটার রেফ এর অবস্থা খারাপ, কালি উঠে যাচ্ছে। খুব শীঘ্রই পার্ক শব্দটা রেফ হারিয়ে পাক এ রুপান্তরিত হবে! তখন কিছু ভদ্রলোক রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ঐ দিকে চোখ রাখবে, তারপর মুখটা বাঁকা করে "ছিঃ.." বলবে, কেউ কেউ "ছিঃ.." এর সাথে সাথে একদলা থু থু ও ফেলবে। পাক শব্দটা নিয়ে নোংরা কোনো কিছু কল্পনা করে নেবে। অধিকাংশ অভদ্র লোকের যেটা সহজে মাথায় আসেনা, এই কিছু কিছু ভদ্রলোকেদের মাথায় সেটা দ্রুত আসে.. ওদের মুখ বাঁকা হয়, থু থু ও আসে দ্রুত! আমি দেখেছি বেশিরভাগ নোংরা মানসিকতার মানুষগুলো উপরে উপরে বেশ ফিটফাট হয়, ভদ্রলোক হয়! ভেতরে ভেতরে ছদরঘাট হয়। বড্ড জটিল এই দুনিয়া, তারচেয়ে ও জটিল এই দুনিয়ার একেক টা মানুষ! আমার ডান পাশে রাস্তার পাশে অনেকগুলো বেঞ্চি.. কাঠের বেঞ্চি! এই রাস্তা টা সবসময় সুনসান.. পনেরো/বিশ মিনিট পর পর মাঝে মাঝে দু'একটা রিকশা যায়..! পার্কের ভেতর টা অনেক সুন্দর তবে এই পার্কে কেন মানুষ আসেনা আমার জানা নেই। পার্কের পাশের রাস্তার এই বেঞ্চিগুলোয় মাঝে মাঝে অনেক কে বসে থাকতে দেখি। বসে থেকে বই পড়ে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়.. কয়েকটা বৃদ্ধ কে প্রায়ই দেখি হাসাহাসি করতে! ভালো লাগে দেখতে। এখানে আমি সপ্তাহে দু'দিন আসি। কেউ একজন কে দুর থেকে দেখতে। কেউ একজন টা আমার পাশের বাসায় থাকে, কিন্তু বাসায় তাকে দেখার সুযোগ হয়না। মানুষটা বাসায় ই থাকেনা সবসময়। যখন থাকে, তখন কোনো সাড়াশব্দ ও পাওয়া যায়না। প্রচন্ড চুপচাপ মানুষ! মানুষটা কে দেখে আমার প্রায়ই মনে হয় মানুষটা সকালে উঠে মনে মনে ঠিক করে নেয়, "আজ সারাদিন পঞ্চাশ টা বাক্য বলবো, এর বেশি একটি ও নয়!" এজন্যেই হয়তো কথা বলার সময় মানুষটি হঠাৎ ই চুপ করে হতাশ দৃষ্টিতে অন্যদিকে চেয়ে থাকে, এরপর আর হাজার চেষ্টায় ও মুখ খোলেনা! আমি মানুষটার সাথে কথা বলেছি পনেরো ষোল বারের মতো.. প্রত্যেকবার এমন হয়। রাগ করা উচিৎ আমার, কিন্তু রাগ করতে পারিনি! এর মানে কিন্তু এটা নয় যে আমি খুব নরম মনের মেয়ে, রাগ করতে পারিনা! এই মানুষটির উপর রাগ করতে পারিনা। এমনিতেই কিন্তু আমি ভয়ংকর রাগী। দু'মাস আগে একটা ছেলেকে কষে থাপ্পড় পর্যন্ত দিয়েছিলাম একটা মার্কেটের সামনে। প্রেম নিবেদন করতে আসছিলো। বাসে ভুলবশত একটা অপরাধ আর অল্প কিছু কথা হয়েছিলো ছেলেটির সাথে, তারপর থেকে পিছু পিছু! আমি ভাবলাম ছেলে হয়তো ভালো ই হবে। বন্ধুত্ব করলাম। এরপর থেকে বুঝলাম ফেঁসে গেছি আমি। ছেলেটি আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করলো ভালোবাসে আমায়! আমি বুঝেও না বোঝার ভান করলাম, আমার বুকের বাঁ পাশ টায় যে অনেক আগে থেকেই একজন বসে আছে। প্রচন্ডরকম চুপচাপ টাইপের একজন মানুষ এখানে চুপটি করে লেপ্টে আছে, আমি ছাড়া কেউ জানেনা সেটা। ঐ মানুষটা ও জানেনা। ছেলেটি কোথা থেকে জানবে? নিষেধ উপেক্ষা করে বারবার ডিস্টার্ব করার জন্যে চড় থাপ্পড় ও দিলাম, ভাবলাম আর ডিস্টার্ব করবেনা। কিন্তু না। ছেলে টা ভীষন বেহায়া, নাছোড়বান্দা টাইপের। তারপর একটু ভেবেচিন্তে একদিন ছেলেটি কে জানালাম সব। বললাম একটা মানুষকে ভালোবাসি, জানালাম ভালোবাসার মানুষটির কথা, কতটা ভালোবাসি মানুষটি কে সেটাও জানালাম। এরপর ছেলেটার সব পাগলামো বন্ধ। আর কখনো সামনে আসতে দেখিনি। মানুষ কে দুর্বল করে শারীরিক আঘাত নয়, মানসিক আঘাত। শরীর ভীষন শক্ত.. অনেক শক্ত.. মন টা বড্ড নরম। একটুতেই কষ্ট পায়..! ছেলেটিও কষ্ট পেয়েছে, বুঝতে পেরেছি.. কিন্তু কিছু করার নেই। জোৎস্না রাতে চাঁদে চুমু দেওয়ার ইচ্ছে সবার থাকে, চুমু না দিতে পারার আক্ষেপে কষ্ট পাওয়া বোকামি..! দেশে জনসংখ্যা ই বাড়ছেনা শুধু.. পাল্লা দিয়ে বোকার সংখ্যা ও বাড়ছে..!!
.....
প্রত্যেকদিন এই মানুষটা এইখানে বসে থাকে। না হাতে থাকে কোনো বই, না পাশে কোনো বন্ধু.. না সময় কাটানোর কিছু। কি করে একটা মানুষ দিনের অর্ধেক সময় চুপচাপ একা একজায়গায় বসে থাকতে পারে মাথায় আসেনা আমার। আমার তো এই দু'দিন সময় কাটে মানুষটি কে দেখে দেখে, মানুষটির কিভাবে সময় কাটে জানিনা। আজ ও আমি বসে আছি, দুরে মানুষটি। চুপচাপ। এই জায়গায় ফালতু লোক দেখা যায়না তেমন, আজ কপাল খারাপ। আমার থেকে একটু দুরে যে দু'টো ছেলে বসে আছে, তারা বখাটে টাইপের। আমার দিকে তাকিয়ে শিষ দিচ্ছে মাঝে মাঝে, শিষের ঐ সুরে বিশ্রী একটা গানের বিশ্রী একটা লাইন মিশে আছে। গান টার প্রথম লাইন হচ্ছে, "ও বন্ধু লাল গোলাপি... "। গান টা কলেজ থেকে ক্লাস শেষে ফিরে আসার সময় গলির মোড়ের দোকানটায় শুনতাম..! কলেজের নাম ইকবাল মেমোরিয়াল ডিগ্রী কলেজ। অসম্ভব সুন্দর কলেজটা। একটা দীঘি আছে সামনে, কি টলটলে পানি। দীঘির পাড়ে সিঁড়ি আছে, সিঁড়ি তে বসে টলটলে পানি তে পা ডুবিয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করে আমার প্রায়ই। ক্লাস শেষে চমৎকার সময় কাঁটতো এখানে, তারপর ফিরে আসার সময় গলির মোড়ে এসে এই গান টা শুনে চমৎকার সময়টার সমস্ত স্মৃতি ফুড়ুৎ করে উড়ে যেতো। প্রচন্ড রাগ হতো, শুনতে শুনতেই গান টা পুরো মুখস্ত হয়ে গেছে। এই লাইনটা পরের লাইন থেকে কিঞ্চিত ভালো হলেও, পরের লাইন টা আরো অশ্লীল! বখাটের শিষ আমায় একা বসে থাকার ইচ্ছে আর সাহস, কোনোটাই দিলোনা। আমি দ্রুতপায়ে হেঁটে মানুষটির পাশে বসলাম। মানুষটি হঠাৎ আচমকা আমায় দেখে চমকালো। জিজ্ঞেস করলো,
-- নুপুর.. তুমি? এখানে?
হায় খোদা! মানুষটারে দেখার জন্যে সপ্তাহে দু'দিন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এইখানেই বসে থাকি, মানুষটা সেটাও জানেনা। মুখে হাসি এনে বললাম,
-- হুম। ঘুরতে এলাম। জায়গাটা বেশ ভালো..!
মানুষটি চুপ। দুর..! মানুষটি মানুষটি বলতে আর ভালো লাগছেনা। নাম ধরেই বলি। রোদ্দুর। ভীষন আজিব নাম মানুষটির। আমি রোদ্দুর ডাকবোনা, আমি ডাকবো রোদ। এমনিতে আমি ভয়ংকর চটপটে, পরিচিত এবং ভালোলাগার মানুষদের সাথে কথা শুরু করার পর সেটা বন্ধ করতে ভুলে যাই। বন্ধ করতে পারিই না। রোদ আমায় অপছন্দ করে, বুঝতে পারি আমি। বকবক করার কারনেই হয়তো। চুপচাপ মানুষ গুলো বকবক মানুষদের অপছন্দ করে। ব্যক্তিগত ধারনা এটা আমার। আমি রোদ এর সামনে সামলে রাখি নিজেকে। খুবই অল্প কথা বলার চেষ্টা করি। ভয়ে ভয়ে থাকি, কোনদিন জানি মুখ ফসকে বলে দিই ভালোবাসার কথা। মুখে এসে কিছু কথা জমে আছে অনেকক্ষণ ধরে, বের করতে না দিলে পেট ফুলে মরে যেতে পারি। অনেক ভেবে শেষে বের করতে হলো, জিজ্ঞেস করলাম,
-- এইখানে বসে থাকেন কেন? আজকাল রোদ খুব কড়া, গায়ে লাগাচ্ছেন। অসুখ করবেনা আপনার..?
রোদ মুচকি মুচকি হাসছে। অসুখের কথা বলে রোদ কে চুপিসারে জানিয়ে দিচ্ছি আমি, তার কেয়ার করার মানুষ আছে পৃথিবীতে। একা না সে। রোদের মুচকি হাসি আমায় লজ্জ্বায় ফেললো। রোদ কথা বলছে,
-- এইখানে বসে থাকার হয়তো কোনো কারন আছে, হয়তো নেই। তুমি জেনে কি করবে?
সম্ভবত প্রথমবারের মতো রোদের এতো লম্বা কথায় অবাক আর আনন্দিত হয়ে এবং সাথে অতিমাত্রায় উৎসাহী হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি,
-- গল্প আছে কোনো?
.........
রোদ আমার চোখে চোখ রাখলো, ওর চোখে প্রশ্ন প্রশ্ন ভাব। চোখ থেকে সেটি দ্রুত ঠোঁটে এসে পড়লো, জিজ্ঞেস করলো,
-- গল্পের ভেতরে ও গল্প, তার ভেতরেও গল্প... বুঝতে পারবে তো?
আমি অতি উৎসাহে মাথা পাঁচ ছয়বার নাড়ালাম। ভালোবাসার মানুষের সব কথায় অতি দ্রুত সাড়া দিতে হয়। রোদ নড়েছড়ে বসলো। বসে সামনে তাকালো, জিজ্ঞেস করলো,
-- নুপুর.. ঝুম বৃষ্টিতে কাউকে কখনো ভিজতে দেখেছো?
-- অনেক দেখেছি। আমি নিজে ও ভিজি ঝুম বৃষ্টিতে.. আমার ভীষন ভালো লাগে।
রোদ হাসলো, বললো,
-- আমিও অনেক দেখেছি। মানুষ ই বৃষ্টি তে ভিজে, ইচ্ছে করেই। এটা অদ্ভুত কোনো ব্যাপার নয়। একটা মেয়েকে ও আমি এই বেঞ্চিতে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে দেখেছিলাম। চুপচাপ, শান্ত। অনেক মানুষ কে ভিজতে দেখেছি, এইরকম ই.. ঐদিন কেন জানিনা মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একটা দৃশ্য দেখছি আমি। যে দৃশ্য পৃথিবীতে আর কখনো হয়নি, কেউ দেখেনি.. আর কেউ কখনো দেখবেও না। শুধু আমি দেখছি। মেয়েটির সমস্ত কাপড় ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে, পেছনের খোলা চুল ও বৃষ্টিজলে ভিজে সারা পিঠে লেপ্টে আছে। এই মেয়ের কিছু খেয়াল নেই। বৃষ্টি গায়েই মাখাচ্ছেনা মেয়েটি, আমার কেন জানি মনে হলো মেয়েটি এই জগতেই নেই, অন্য কোনো জগতে চলে গেছে। এই ঝুম বৃষ্টি উপেক্ষা করে কোনো মানুষ চুপচাপ শান্ত হয়ে এইভাবে বসে থাকতে পারে জানা ছিলোনা আমার। নুপুর তুমি ভাবছো, মেয়েটিকে প্রথম দেখছি আমি। উহু.. এই মেয়েটি কে আমি একটা মাস ধরে দেখছি.. প্রতিদিন সকাল বেলায় এসে এই বেঞ্চিতে বসে থাকে। চুপচাপ, শান্ত। কারো সাথে কথা বলেনা। সম্ভবত এইসময়টায় রোদ বৃষ্টি কোনোকিছুই গায়ে মাখায়না। আমি কখনো কথা বলার চেষ্টা করিনি মেয়েটির সাথে, তবে দুর থেকে দেখতে ভালো লাগতো। ঐদিন প্রচন্ড বৃষ্টিতে মেয়েটি কে ভিজতে দেখে মেয়েটির সাথে কথা বলার তীব্র ইচ্ছা জন্মালো। আমি কারো সাথে কথা বলতে পারিনা। তবে কেন জানি মনে হলো, এই মেয়েটির সাথে মন খুলে কিছু কথা বলা যাবে। এই মেয়ে কিছু মনে করবেনা। কথা বলার ফাঁকে চোখে চোখ ও রাখতে দেবে হয়তো। হয়তো না। আমি ঠিক টের পেয়েছি, মেয়েটির প্রতি টান সৃষ্টি হয়েছে আমার। মনে মনে ভাবলাম কি সর্বনাশ! ভালোবাসা না তো এটা! পাশে গিয়ে বসলাম। মেয়েটি চমকালো। মেয়েটির ফর্সা চেহারায় বৃষ্টি লেপ্টে আছে, আর কিছু কষ্ট। আমায় জিজ্ঞেস করলো, "কে আপনি?" আমি হাসলাম। হেসে বললাম, "আমি রোদ!" মেয়েটির চোখে একটুকরো হাসি দেখলাম। বললো, "রোদ বৃষ্টি একসাথে হতে কখনো দেখেছেন?" আমি বললাম, "হ্যাঁ। অনেক দেখেছি। এটা নিয়ে একটা ছড়া ও আছে.. মজার ছড়া তবে সরি, ছড়া টা মনে নেই আমার!" মেয়েটি হাসলো শব্দ করে। মেয়েটির সাথে প্রথম কথা বলা। আমি জানিনা, মেয়েটি কে ঠিক কোন কারনে আমার এতো ভালো লাগে। আর দশটা মেয়ের মতোই রহস্যময়ী। আর দশটা মেয়ের মতোই হাঁটে, বসে, কথা বলে, হাসে.. ভ্রুঁ বাকা করে, চোখ বড় করে.. ঠোঁটে কামড় দেয়। তবুও মেয়েটি কথা বললে আমার মনে হতো, অনেকগুলো লাল চুড়ি টুং টাং শব্দ করছে, আমার কি তৃষ্ণা সেই শব্দ পান করার। মেয়েটার সাথে ভালোই বন্ধুত্ব হলো। আমি ভার্সিটি ক্লাস ফেলে মাঝে মাঝে এখানে এসে বসতাম, সঙ্গ দিতাম তাকে। কথা হতো দু'জনের, অনেক টা সময় ধরে। মেয়েটিকে জানতে পারছিলাম একটু একটু করে। আরো জানার ইচ্ছে টা প্রতিদিন তাড়া করে আমায়। মেয়েটি কে যেদিন ভালেবাসি বলবো বলে ঠিক করেছি, সেদিনের আগের রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছিলো। আমি ভাবলাম, যাক.. কাল ও বৃষ্টি থাকবে। বৃষ্টি তে ভিজে থেকে প্রপোস করবো। দু'জন ভেজা থাকবো, ভালোবাসা ভেজা থাকবে। সারারাত ঘুম হলোনা, মেয়েটি একচেপ্ট করবে তো! সকালে চোখ লেগে এলো, চোখ খুলতে খুলতে সাড়ে দশটা। কোথায় মেঘলা আকাশ, কোথায় ঝুম বৃষ্টি। বাইরে ঝলমলে রোদ। আশাহত হলাম। হুড়মুড় করে রেডি হয়ে দৌড় দিলাম। মেয়েটি বসে আছে, বেঞ্চিতে.. একা। আমি পাশে বসতেই আমার দিকে ভীষন অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো,
-- আজ যে কথাটা বলবে বলে ঠিক করেছো, প্লিজ সেটা বলোনা..!
.........
রোদ হঠাৎ চুপ করে গেলো। একসাথে এতোগুলা কথা বলার পর এখন চুপ করে থাকাই স্বাভাবিক তার জন্যে। কখনো একসাথে এতোকথা বলেছে কিনা জানা নেই আমার। হায় খোদা! আমি এখন কি করবো? আমার যে গল্পটা শুনতে ইচ্ছে করছে। এরপর কি হলো? আমার প্রচন্ড অস্থিরতা রোদ কে স্পর্শ করলো কিনা জানিনা, তবে রোদ আবার বলতে শুরু করলো,
-- মেয়েদের যে একটা অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছে, ঐ দিনই পুরোপুরি বিশ্বাস হলো আমার। মেয়েটি কি করে বুঝলো, আজ ই তাকে আমি ভালোবাসি বলবো বলে ঠিক করেছি। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বারবার কষ্ট পাচ্ছি, এই মেয়ে গতরাতে প্রচুর কেঁদেছে। চেহারা আর চোখে সেটা স্পষ্ট। আমি কি করবো ভেবে পাইনা। মেয়েটি পাশে অনেকক্ষণ বসে থেকে হঠাৎ মুখ খুললো, বলতে শুরু করলো। অনেক গোছানো কথা, তবে গলায় প্রচন্ড আবেগ, স্বরভর্তি কান্না মিশে আছে, "আমি জানি আপনি আমায় কি বলবেন। আমি আপনার অনুভুতি বুঝতে পারছি। কারন একিই অনুভুতি তে আমি ও ভিজেছি, এই এখানেই... একটা রোদ দুপুরে।" আমার অবাক চোখের চাহনি দেখে মেয়েটি বললো, "গল্পের ভেতরে গল্প, তার ভেতরেও গল্প.. বুঝতে পারবেন তো?" আমি মাথা নাড়লাম। মেয়েটি বলতে শুরু করলো......
"দুই মাস আগে আমিও এমন করে ভালোবেসেছি কাউকে। আপনার মতোই, তীব্র আবেগ নিয়ে, কিছু না জেনেই। প্রতিদিন এই বেঞ্চিতে একটা ছেলে এসে বসে থাকতো। আমার ভীষন মায়া লাগতো। আমি আমার ফ্রেন্ড ছাড়া কোথাও একা বের হইনা। কি একটা কাজে সেদিন এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। একা। জায়গাটা বেশ সুন্দর দেখে রিকশা দাঁড় করিয়ে বসলাম। দুরে বেঞ্চিতে একটা ছেলে বসা। আমি যেখানে বসেছি সেখানে ছায়া হলেও, ছেলেটি যেখানে বসেছে সেখানে প্রচুর রোদ। মধ্য দুপুরের কড়া রোদ। কিন্তু ছেলেটা সেটা গায়েই মাখছে না। একমনে তাকিয়ে আছে সামনে। কোনোদিকেই খেয়াল নেই তার। আমি অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম ছেলেটা কে। তারপর দাঁড় করিয়ে রাখা রিকশায় করে ফিরলাম বাসায়। মন পড়ে থাকলো মায়াপুরী তে। ঐ বেঞ্চিতে..! অবাক হলাম আমি। ছেলেটার নিষ্প্রান দৃষ্টি, অন্যমনস্ক ভাব যেন টানছিলো আমায় ঐ জায়গাটায় আরেক টা বার যেতে। আমি আমার ফ্রেন্ডের সাথে সব বিষয় শেয়ার করি, কিন্তু এই বিষয় করতে পারলাম না। কারন আমার প্রত্যেকটা ফ্রেন্ড জানে, আমি ভালোবাসা নামক ব্যাপার টার ঘোর বিরোধী। মনে মনে লজ্জ্বা পেলাম, এটাকে ভালোবাসা ভাবছি কেন? একটা ছেলের আনমনা ভাব দেখেও কি প্রেমে পড়া যায়? কাউকে ব্যাপার টা জানালাম না। এমনকি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড টা কেও না। তারপর থেকে শুরু। প্রতিদিন এখানে আসা। লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখা। একদিন ছেলেটা ওখানে না আসলে কি যে কষ্ট হতো আমার। মাঝে মাঝে ভয় হতো, ভালোবাসার কথা যত তাড়াতাড়ি বলা যায় তত ভালো। কিন্তু মেয়ে হয়ে কি করে বলবো। লজ্জ্বা, ভয় আর ভালোবাসা... এই তিনটা জিনিস কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমায় তখন। একরাতে পৃথিবীর সমস্ত সাহস একত্র করে, লজ্জ্বা ভয় একপাশে ফেলে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। কাল ই বলবো ভালোবাসার কথা।"
...........
রোদ একটু থামলো। মাথার উপরে কড়া রোদ, আমার গায়েই লাগছেনা। কারন আমি একটা ঘোরের মধ্যে আছি। রোদ বলতে শুরু করেছে আবার,
-- মেয়েটি আমায় এতটুকু বলে থামলো, আমার কেমন জানি অদ্ভুত একটা কষ্টে বুক টা ফেটে যাচ্ছিলো। ঠিক বুঝে গিয়েছি তখন, এটা আমার আর ওর গল্প ছিলোনা, অন্য কারো গল্পে ঢুকে গিয়েছিলাম আমি। মেয়েটি কে জিজ্ঞেস করলাম, "তারপর। পরের দিন বলেছিলেন ভালোবাসার কথা?" মেয়েটি বলতে শুরু করলো.......
"পরেরদিন এখানে এসে দেখি দুপুর রোদে ছেলেটা ঘামে চটচটে হয়ে আছে, তবে আগের মতোই সেটা গায়ে মাখাচ্ছেনা। ছেলেটার কি কোনো অনুভুতি ই নেই, কোনো কিছু নিয়েই কি মাথাব্যথা নেই। চিন্তা নেই, আজ থেকে হবে, কারন আজ থেকে তার গল্পে আমি থাকবো। ছেলেটার পাশে গিয়ে বসলাম। ছেলেটা চমকালো না। যেন জানতো, আমি তার পাশে এসে বসবো। কিছু বলবো। ছেলেটা আমার দিকে তাকালো, চোখে জল। আমি অবাক হলাম, কাঁদছে কেন। কাঁদোস্বরে ছেলেটি প্রথম কথা বললো আমার সাথে, সেটি হচ্ছে, "আমি জানি আপনি প্রতিদিন এখানে আসেন, আমায় দেখতে। আজ যা বলতে এসেছেন, প্লিজ সেটা বলবেন না...!" আমি হতভম্ব হয়ে চুপ করে গেলাম। ছেলেটা আনমনে বসে থেকে এতোকিছু জানলো কি করে, বুঝলো কি করে। আমি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। ছেলেটার চোখে জল জমে আছে, কাঁদছেই বা কেন ছেলেটি। সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, জানিনা কোথা থেকে এতো সাহস আসলো সেদিন, "কাউকে ভালোবাসেন?" ছেলেটি চুপ করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে, তারপর স্পষ্ট স্বরে বললো, "ভালোবাসি। একটা মেয়ে। একটা বাস, একটা অপরাধ, কিছু অনুভুতি.. প্রচন্ড ভালোবাসা.. অন্য একটা গল্প। শুনবেন?" আমি মাথা নাড়লাম, ছেলেটি বলতে শুরু করলো......
"মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় একটা বাসে। পাবলিক বাসে। প্রচন্ড ঠেলাঠেলি। ধাক্কাধাক্কি তে মেয়েটি আমার পায়ে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি উহু.. বলে চিৎকার দিতেই সরে এসে সরি বলে। আমি কাঁদোমুখে "ইটস ওকে" বলি। কিছুক্ষণ পর আবারো। আবার সরি, আবার কাঁদোমুখে ইটস ওকে। এইরকম প্রায় চারবার হবার পর, আমি আমার সামনে থাকা কিছু লোক কে সামনে ঠেলে, পেছনের গুলা রে একটু পেছনে ঠেলে লম্বা হয়ে বাসের মধ্যেই শুয়ে পড়লাম। শুয়ে পড়ে বললাম,"ম্যাডাম, যে পায়ে পা দিচ্ছেন বারবার, পা টা গতকাল কেটেছে, কাটা জায়গায় ঝাল ঘষে দিচ্ছেন। পায়ের উপর পা না দিয়ে, এই যে আমি শুয়ে পড়েছি, আমার বুকে পা দিয়ে দাঁড়ায় থাকেন।" মেয়েটি লজ্জ্বা পেলো ভীষন। তড়িঘড়ি করে সামনের স্টপেজেই নেমে পড়লো। নেমে পড়ার পর আমার মনে হলো, একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। পাবলিক বাসে তো এসব হয় ই। এরপর থেকে মেয়েটির পিছু নেয়া শুরু। ক্ষমা চাইতেই হবে আমাকে। সবচেয়ে অদ্ভুত কথা হলো, পেছন পেছন ঘুরতে ঘুরতে মেয়েটির সাথে ভালো বন্ধুত্ব হলো ঠিকই, কিন্তু ক্ষমা করলো না মেয়েটি আমায়। আমি ভাবলাম, বাপরে! কি জেদী মেয়ে। আমার বাবা মা চাচ্ছিলো তাড়াতাড়ি ই বিয়ে টা করে নিতে। বাসায় জানানো হয়ে গিয়েছে আমার, মেয়ে পেয়ে গেছি। তবে আমার ব্যাপার টা ছিলো অন্য। বাবা মা কে বলে দিয়েছিলাম, মেয়েটা কে আমি পছন্দ করবো, এবং বিয়ের আগে মেয়েটি কে ও আমায় পছন্দ করতে হবে। মেয়েটির পিছু পিছু ঘুরতে ঘুরতে সুযোগ খুঁজছিলাম একটা সঠিক সময়ের। সঠিক সময় পেলাম না, তবে একটা কষ্টকর সত্য জানতে পারলাম... মেয়েটি বিরক্ত হচ্ছে আমার উপর। ভয় পেলাম। মেয়েটি কে হারাবো না তো। সময় সুযোগ পাশে ফেলে রেখে একদিন গিয়ে ডাইরেক্ট বলে ফেললাম, ভালোবাসি। মেয়েটি কড়া মুখে জানালো সম্ভব না। তারপর ও হাল ছাড়লাম না। পেছন পেছন ঘুরলাম। এমন কি একদিন একটা বড় মার্কেটের সামনে অনেকগুলা মানুষের সামনে ঠাটিয়ে চড় ও মারলো, আমি তাতেও লজ্জ্বা পেলাম না। কেমন যেন জেদ চেপে গিয়েছিলো। চাইলে বাসায় বাবা মা কে পাঠিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারতাম, মেয়েটির বাবা মা পাত্র হিসেবে আমায় অপছন্দ করবে তেমন কোনো কারন ও ছিলোনা, কিন্তু সেটাও করলাম না। আমি শুধু জানতে চাইছিলাম, মেয়েটি কেন ই বা আমায় ভালোবাসবেনা, কারন টা কি? একদিন কারন জানা হলো। মেয়েটি ভালোবাসে কাউকে। তাদের পাশের বাসার একটি মানুষ। ঐ মানুষটি কে ভীষনরকম ভালোবাসে, তবে মানুষটি জানেনা সেটা। মানুষটি নাকি প্রচন্ড রকম চুপচাপ, কারো সাথে কথা বলেনা। অন্যমনস্ক। আমি আর কখনো মেয়েটির সামনে যাইনি। কখনোই না। যেটা আমার গল্প ভেবেছি, আসলে আমি জানতাম না, সেটা অন্য কারো গল্প ছিলো। অজান্তে অন্য কারো গল্পে ঢুকে গিয়েছিলাম আমি!"
এতটুকু বলে ছেলেটি থামলো..! আমি উঠে এখান থেকে চলে গেলাম। পনের দিন ঘর থেকে বের হলাম না। ষোলদিন পর এখানে এসে দেখি, ছেলেটা নেই। বেঞ্চি খালি। কেমন যেন একটা চরম শুন্যতা লেপ্টে আছে আশেপাশে। এখানে এসে বসলাম, তারপর থেকেই এখানে এসে বসি। ছেলেটা কোথায় জানা নেই আমার। জানতে ইচ্ছে ও করেনা...!"
আমি মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলাম, অনুভব করলাম, অন্য কারো গল্পে নিজে ঢুকে যাওয়া কতটা কষ্টের। আমি নিজেই যে এখন অন্য কোনো গল্পের অংশ হয়ে গিয়েছি। এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আমায় বেঞ্চিতে রেখে মেয়েটি উঠে চলে আসলো। মাথার উপরে ছিলো মধ্য দুপুরের রোদ, কড়া রোদ.. আর পাশে অল্পকিছু গল্প। না পাওয়ার গল্প।
.........
রোদ সামনে তাকিয়ে আছে, আমি তখনো একটা ঘোরের মধ্যে, জিজ্ঞেস করলাম,
-- মেয়েটি কে আর দেখেন নি। তাইনা?
-- হুম। সিলেট চলে গিয়েছে। যাওয়ার আগে বলেছিলো, "ছেলেটা যে মেয়েটা কে পছন্দ করে, সে আমার ই বেস্ট ফ্রেন্ড। কেমন একটা কষ্টে বুক টা ফেটে গিয়েছিলো এটা জানার পর। ছেলেটা জানেনা, তার প্রচন্ডরকম ভালোবাসার মানুষটি আমার ও প্রচন্ডরকম ভালোবাসার মানুষ। বেস্ট ফ্রেন্ড হয় আমার। আমায় জানপাখি প্রানপাখি ডাকে ঐ মেয়েটি। ভাবলাম, ফ্রেন্ড টি যদি কিছু জানতে পারে কষ্ট পাবে সে, একটা অদ্ভুত কষ্টে ভুগবে তিনটে মানুষ। কাউকেই কিছু জানাইনি আর। আমি এখানে আসবোনা আর কখনো। বেঞ্চি টা খালি থাকবে। সব ছেড়ে সিলেট চলে যাচ্ছি। ভালো থাকবেন।"
রোদ থামলো, গল্প শেষ। ওর চোখে কষ্ট, সেটা জল আকারে নামছে। আমি রোদ এর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-- শেষ কবে অবাক হয়েছেন?
-- অনেক অনেক আগে।
-- অবাক হতে ইচ্ছে করে?
রোদ জবাব দিলোনা, আমি রোদের ঘামে ভেজা হাতে হাত রেখে বললাম,
-- যে গল্প টা এখানে বসে আপনি শুরু করেছিলেন, সে গল্পের শেষ টা ও আপনার পাশে বসে আছে...! অদ্ভুত না...??
রোদ অবাক হয়ে তাকালো। আমার কাঁদতে ইচ্ছে হলো রোদের চোখের দিকে তাকিয়ে, পারলাম না। অনেকদিন ধরে যারা অবাক হয়না, তারা হঠাৎ অবাক হলে দেখতে কি সুন্দর লাগে। রোদের অবাক চোখে চোখ রেখে বললাম,
-- যে মেয়েটি কে ভালোবেসেছেন, সে আমার ই বেস্ট ফ্রেন্ড। তৃপ্তি। তৃপ্তি যে ছেলেটা কে ভালোবাসতো, সে ছেলেটার পছন্দের মানুষটি আমি। নুপুর। আর আমি যে মানুষটির জন্যে ছেলেটা কে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, সে মানুষটি আপনি!! আমি জানি আপনি কি ভাবছেন? আমি ভালোবাসা চাইবোনা, দিয়ে গেলাম। আমি এটাও জানি, আপনি কাল থেকে এখানে আর আসবেন না। তবে বেঞ্চিটা খালি থাকবেনা..! এখানে কেউ একজন কে বসতে হবে, অন্য কারো গল্পের অংশ হয়ে যাওয়ার প্রচন্ড কষ্ট সামলাতে হবে, চুপচাপ থেকে, আনমনা হয়ে...!
মাথার উপর কড়া রোদ। আমি একা বসে আছি, বেঞ্চিতে। সামনে রাস্তা, রাস্তার ওপাশে মায়াপুরী পার্ক। আমার পাশে কাঠের বেঞ্চিতে একহাজার গল্প। না পাওয়ার। দু'টো মানুষের পাওয়ার গল্পের পেছনে ও অন্য দু'টো মানুষের না পাওয়ার গল্প থাকে। যে মানুষটি যে মানুষটি কে পেয়েছে, সে দু'টি মানুষকেই হয়তো অন্য দু'টি মানুষ হারিয়েছে। খুব কম মানুষেরই পাওয়ার গল্প টায় চাওয়ার মানুষটি থাকে... কেন জানিনা, চাওয়ার মানুষটি সবসময় অন্য কারো পাওয়ার গল্পে ই থাকে..!
.....
প্রত্যেকদিন এই মানুষটা এইখানে বসে থাকে। না হাতে থাকে কোনো বই, না পাশে কোনো বন্ধু.. না সময় কাটানোর কিছু। কি করে একটা মানুষ দিনের অর্ধেক সময় চুপচাপ একা একজায়গায় বসে থাকতে পারে মাথায় আসেনা আমার। আমার তো এই দু'দিন সময় কাটে মানুষটি কে দেখে দেখে, মানুষটির কিভাবে সময় কাটে জানিনা। আজ ও আমি বসে আছি, দুরে মানুষটি। চুপচাপ। এই জায়গায় ফালতু লোক দেখা যায়না তেমন, আজ কপাল খারাপ। আমার থেকে একটু দুরে যে দু'টো ছেলে বসে আছে, তারা বখাটে টাইপের। আমার দিকে তাকিয়ে শিষ দিচ্ছে মাঝে মাঝে, শিষের ঐ সুরে বিশ্রী একটা গানের বিশ্রী একটা লাইন মিশে আছে। গান টার প্রথম লাইন হচ্ছে, "ও বন্ধু লাল গোলাপি... "। গান টা কলেজ থেকে ক্লাস শেষে ফিরে আসার সময় গলির মোড়ের দোকানটায় শুনতাম..! কলেজের নাম ইকবাল মেমোরিয়াল ডিগ্রী কলেজ। অসম্ভব সুন্দর কলেজটা। একটা দীঘি আছে সামনে, কি টলটলে পানি। দীঘির পাড়ে সিঁড়ি আছে, সিঁড়ি তে বসে টলটলে পানি তে পা ডুবিয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করে আমার প্রায়ই। ক্লাস শেষে চমৎকার সময় কাঁটতো এখানে, তারপর ফিরে আসার সময় গলির মোড়ে এসে এই গান টা শুনে চমৎকার সময়টার সমস্ত স্মৃতি ফুড়ুৎ করে উড়ে যেতো। প্রচন্ড রাগ হতো, শুনতে শুনতেই গান টা পুরো মুখস্ত হয়ে গেছে। এই লাইনটা পরের লাইন থেকে কিঞ্চিত ভালো হলেও, পরের লাইন টা আরো অশ্লীল! বখাটের শিষ আমায় একা বসে থাকার ইচ্ছে আর সাহস, কোনোটাই দিলোনা। আমি দ্রুতপায়ে হেঁটে মানুষটির পাশে বসলাম। মানুষটি হঠাৎ আচমকা আমায় দেখে চমকালো। জিজ্ঞেস করলো,
-- নুপুর.. তুমি? এখানে?
হায় খোদা! মানুষটারে দেখার জন্যে সপ্তাহে দু'দিন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এইখানেই বসে থাকি, মানুষটা সেটাও জানেনা। মুখে হাসি এনে বললাম,
-- হুম। ঘুরতে এলাম। জায়গাটা বেশ ভালো..!
মানুষটি চুপ। দুর..! মানুষটি মানুষটি বলতে আর ভালো লাগছেনা। নাম ধরেই বলি। রোদ্দুর। ভীষন আজিব নাম মানুষটির। আমি রোদ্দুর ডাকবোনা, আমি ডাকবো রোদ। এমনিতে আমি ভয়ংকর চটপটে, পরিচিত এবং ভালোলাগার মানুষদের সাথে কথা শুরু করার পর সেটা বন্ধ করতে ভুলে যাই। বন্ধ করতে পারিই না। রোদ আমায় অপছন্দ করে, বুঝতে পারি আমি। বকবক করার কারনেই হয়তো। চুপচাপ মানুষ গুলো বকবক মানুষদের অপছন্দ করে। ব্যক্তিগত ধারনা এটা আমার। আমি রোদ এর সামনে সামলে রাখি নিজেকে। খুবই অল্প কথা বলার চেষ্টা করি। ভয়ে ভয়ে থাকি, কোনদিন জানি মুখ ফসকে বলে দিই ভালোবাসার কথা। মুখে এসে কিছু কথা জমে আছে অনেকক্ষণ ধরে, বের করতে না দিলে পেট ফুলে মরে যেতে পারি। অনেক ভেবে শেষে বের করতে হলো, জিজ্ঞেস করলাম,
-- এইখানে বসে থাকেন কেন? আজকাল রোদ খুব কড়া, গায়ে লাগাচ্ছেন। অসুখ করবেনা আপনার..?
রোদ মুচকি মুচকি হাসছে। অসুখের কথা বলে রোদ কে চুপিসারে জানিয়ে দিচ্ছি আমি, তার কেয়ার করার মানুষ আছে পৃথিবীতে। একা না সে। রোদের মুচকি হাসি আমায় লজ্জ্বায় ফেললো। রোদ কথা বলছে,
-- এইখানে বসে থাকার হয়তো কোনো কারন আছে, হয়তো নেই। তুমি জেনে কি করবে?
সম্ভবত প্রথমবারের মতো রোদের এতো লম্বা কথায় অবাক আর আনন্দিত হয়ে এবং সাথে অতিমাত্রায় উৎসাহী হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি,
-- গল্প আছে কোনো?
.........
রোদ আমার চোখে চোখ রাখলো, ওর চোখে প্রশ্ন প্রশ্ন ভাব। চোখ থেকে সেটি দ্রুত ঠোঁটে এসে পড়লো, জিজ্ঞেস করলো,
-- গল্পের ভেতরে ও গল্প, তার ভেতরেও গল্প... বুঝতে পারবে তো?
আমি অতি উৎসাহে মাথা পাঁচ ছয়বার নাড়ালাম। ভালোবাসার মানুষের সব কথায় অতি দ্রুত সাড়া দিতে হয়। রোদ নড়েছড়ে বসলো। বসে সামনে তাকালো, জিজ্ঞেস করলো,
-- নুপুর.. ঝুম বৃষ্টিতে কাউকে কখনো ভিজতে দেখেছো?
-- অনেক দেখেছি। আমি নিজে ও ভিজি ঝুম বৃষ্টিতে.. আমার ভীষন ভালো লাগে।
রোদ হাসলো, বললো,
-- আমিও অনেক দেখেছি। মানুষ ই বৃষ্টি তে ভিজে, ইচ্ছে করেই। এটা অদ্ভুত কোনো ব্যাপার নয়। একটা মেয়েকে ও আমি এই বেঞ্চিতে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে দেখেছিলাম। চুপচাপ, শান্ত। অনেক মানুষ কে ভিজতে দেখেছি, এইরকম ই.. ঐদিন কেন জানিনা মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একটা দৃশ্য দেখছি আমি। যে দৃশ্য পৃথিবীতে আর কখনো হয়নি, কেউ দেখেনি.. আর কেউ কখনো দেখবেও না। শুধু আমি দেখছি। মেয়েটির সমস্ত কাপড় ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে, পেছনের খোলা চুল ও বৃষ্টিজলে ভিজে সারা পিঠে লেপ্টে আছে। এই মেয়ের কিছু খেয়াল নেই। বৃষ্টি গায়েই মাখাচ্ছেনা মেয়েটি, আমার কেন জানি মনে হলো মেয়েটি এই জগতেই নেই, অন্য কোনো জগতে চলে গেছে। এই ঝুম বৃষ্টি উপেক্ষা করে কোনো মানুষ চুপচাপ শান্ত হয়ে এইভাবে বসে থাকতে পারে জানা ছিলোনা আমার। নুপুর তুমি ভাবছো, মেয়েটিকে প্রথম দেখছি আমি। উহু.. এই মেয়েটি কে আমি একটা মাস ধরে দেখছি.. প্রতিদিন সকাল বেলায় এসে এই বেঞ্চিতে বসে থাকে। চুপচাপ, শান্ত। কারো সাথে কথা বলেনা। সম্ভবত এইসময়টায় রোদ বৃষ্টি কোনোকিছুই গায়ে মাখায়না। আমি কখনো কথা বলার চেষ্টা করিনি মেয়েটির সাথে, তবে দুর থেকে দেখতে ভালো লাগতো। ঐদিন প্রচন্ড বৃষ্টিতে মেয়েটি কে ভিজতে দেখে মেয়েটির সাথে কথা বলার তীব্র ইচ্ছা জন্মালো। আমি কারো সাথে কথা বলতে পারিনা। তবে কেন জানি মনে হলো, এই মেয়েটির সাথে মন খুলে কিছু কথা বলা যাবে। এই মেয়ে কিছু মনে করবেনা। কথা বলার ফাঁকে চোখে চোখ ও রাখতে দেবে হয়তো। হয়তো না। আমি ঠিক টের পেয়েছি, মেয়েটির প্রতি টান সৃষ্টি হয়েছে আমার। মনে মনে ভাবলাম কি সর্বনাশ! ভালোবাসা না তো এটা! পাশে গিয়ে বসলাম। মেয়েটি চমকালো। মেয়েটির ফর্সা চেহারায় বৃষ্টি লেপ্টে আছে, আর কিছু কষ্ট। আমায় জিজ্ঞেস করলো, "কে আপনি?" আমি হাসলাম। হেসে বললাম, "আমি রোদ!" মেয়েটির চোখে একটুকরো হাসি দেখলাম। বললো, "রোদ বৃষ্টি একসাথে হতে কখনো দেখেছেন?" আমি বললাম, "হ্যাঁ। অনেক দেখেছি। এটা নিয়ে একটা ছড়া ও আছে.. মজার ছড়া তবে সরি, ছড়া টা মনে নেই আমার!" মেয়েটি হাসলো শব্দ করে। মেয়েটির সাথে প্রথম কথা বলা। আমি জানিনা, মেয়েটি কে ঠিক কোন কারনে আমার এতো ভালো লাগে। আর দশটা মেয়ের মতোই রহস্যময়ী। আর দশটা মেয়ের মতোই হাঁটে, বসে, কথা বলে, হাসে.. ভ্রুঁ বাকা করে, চোখ বড় করে.. ঠোঁটে কামড় দেয়। তবুও মেয়েটি কথা বললে আমার মনে হতো, অনেকগুলো লাল চুড়ি টুং টাং শব্দ করছে, আমার কি তৃষ্ণা সেই শব্দ পান করার। মেয়েটার সাথে ভালোই বন্ধুত্ব হলো। আমি ভার্সিটি ক্লাস ফেলে মাঝে মাঝে এখানে এসে বসতাম, সঙ্গ দিতাম তাকে। কথা হতো দু'জনের, অনেক টা সময় ধরে। মেয়েটিকে জানতে পারছিলাম একটু একটু করে। আরো জানার ইচ্ছে টা প্রতিদিন তাড়া করে আমায়। মেয়েটি কে যেদিন ভালেবাসি বলবো বলে ঠিক করেছি, সেদিনের আগের রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছিলো। আমি ভাবলাম, যাক.. কাল ও বৃষ্টি থাকবে। বৃষ্টি তে ভিজে থেকে প্রপোস করবো। দু'জন ভেজা থাকবো, ভালোবাসা ভেজা থাকবে। সারারাত ঘুম হলোনা, মেয়েটি একচেপ্ট করবে তো! সকালে চোখ লেগে এলো, চোখ খুলতে খুলতে সাড়ে দশটা। কোথায় মেঘলা আকাশ, কোথায় ঝুম বৃষ্টি। বাইরে ঝলমলে রোদ। আশাহত হলাম। হুড়মুড় করে রেডি হয়ে দৌড় দিলাম। মেয়েটি বসে আছে, বেঞ্চিতে.. একা। আমি পাশে বসতেই আমার দিকে ভীষন অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো,
-- আজ যে কথাটা বলবে বলে ঠিক করেছো, প্লিজ সেটা বলোনা..!
.........
রোদ হঠাৎ চুপ করে গেলো। একসাথে এতোগুলা কথা বলার পর এখন চুপ করে থাকাই স্বাভাবিক তার জন্যে। কখনো একসাথে এতোকথা বলেছে কিনা জানা নেই আমার। হায় খোদা! আমি এখন কি করবো? আমার যে গল্পটা শুনতে ইচ্ছে করছে। এরপর কি হলো? আমার প্রচন্ড অস্থিরতা রোদ কে স্পর্শ করলো কিনা জানিনা, তবে রোদ আবার বলতে শুরু করলো,
-- মেয়েদের যে একটা অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছে, ঐ দিনই পুরোপুরি বিশ্বাস হলো আমার। মেয়েটি কি করে বুঝলো, আজ ই তাকে আমি ভালোবাসি বলবো বলে ঠিক করেছি। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বারবার কষ্ট পাচ্ছি, এই মেয়ে গতরাতে প্রচুর কেঁদেছে। চেহারা আর চোখে সেটা স্পষ্ট। আমি কি করবো ভেবে পাইনা। মেয়েটি পাশে অনেকক্ষণ বসে থেকে হঠাৎ মুখ খুললো, বলতে শুরু করলো। অনেক গোছানো কথা, তবে গলায় প্রচন্ড আবেগ, স্বরভর্তি কান্না মিশে আছে, "আমি জানি আপনি আমায় কি বলবেন। আমি আপনার অনুভুতি বুঝতে পারছি। কারন একিই অনুভুতি তে আমি ও ভিজেছি, এই এখানেই... একটা রোদ দুপুরে।" আমার অবাক চোখের চাহনি দেখে মেয়েটি বললো, "গল্পের ভেতরে গল্প, তার ভেতরেও গল্প.. বুঝতে পারবেন তো?" আমি মাথা নাড়লাম। মেয়েটি বলতে শুরু করলো......
"দুই মাস আগে আমিও এমন করে ভালোবেসেছি কাউকে। আপনার মতোই, তীব্র আবেগ নিয়ে, কিছু না জেনেই। প্রতিদিন এই বেঞ্চিতে একটা ছেলে এসে বসে থাকতো। আমার ভীষন মায়া লাগতো। আমি আমার ফ্রেন্ড ছাড়া কোথাও একা বের হইনা। কি একটা কাজে সেদিন এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। একা। জায়গাটা বেশ সুন্দর দেখে রিকশা দাঁড় করিয়ে বসলাম। দুরে বেঞ্চিতে একটা ছেলে বসা। আমি যেখানে বসেছি সেখানে ছায়া হলেও, ছেলেটি যেখানে বসেছে সেখানে প্রচুর রোদ। মধ্য দুপুরের কড়া রোদ। কিন্তু ছেলেটা সেটা গায়েই মাখছে না। একমনে তাকিয়ে আছে সামনে। কোনোদিকেই খেয়াল নেই তার। আমি অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম ছেলেটা কে। তারপর দাঁড় করিয়ে রাখা রিকশায় করে ফিরলাম বাসায়। মন পড়ে থাকলো মায়াপুরী তে। ঐ বেঞ্চিতে..! অবাক হলাম আমি। ছেলেটার নিষ্প্রান দৃষ্টি, অন্যমনস্ক ভাব যেন টানছিলো আমায় ঐ জায়গাটায় আরেক টা বার যেতে। আমি আমার ফ্রেন্ডের সাথে সব বিষয় শেয়ার করি, কিন্তু এই বিষয় করতে পারলাম না। কারন আমার প্রত্যেকটা ফ্রেন্ড জানে, আমি ভালোবাসা নামক ব্যাপার টার ঘোর বিরোধী। মনে মনে লজ্জ্বা পেলাম, এটাকে ভালোবাসা ভাবছি কেন? একটা ছেলের আনমনা ভাব দেখেও কি প্রেমে পড়া যায়? কাউকে ব্যাপার টা জানালাম না। এমনকি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড টা কেও না। তারপর থেকে শুরু। প্রতিদিন এখানে আসা। লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখা। একদিন ছেলেটা ওখানে না আসলে কি যে কষ্ট হতো আমার। মাঝে মাঝে ভয় হতো, ভালোবাসার কথা যত তাড়াতাড়ি বলা যায় তত ভালো। কিন্তু মেয়ে হয়ে কি করে বলবো। লজ্জ্বা, ভয় আর ভালোবাসা... এই তিনটা জিনিস কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমায় তখন। একরাতে পৃথিবীর সমস্ত সাহস একত্র করে, লজ্জ্বা ভয় একপাশে ফেলে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। কাল ই বলবো ভালোবাসার কথা।"
...........
রোদ একটু থামলো। মাথার উপরে কড়া রোদ, আমার গায়েই লাগছেনা। কারন আমি একটা ঘোরের মধ্যে আছি। রোদ বলতে শুরু করেছে আবার,
-- মেয়েটি আমায় এতটুকু বলে থামলো, আমার কেমন জানি অদ্ভুত একটা কষ্টে বুক টা ফেটে যাচ্ছিলো। ঠিক বুঝে গিয়েছি তখন, এটা আমার আর ওর গল্প ছিলোনা, অন্য কারো গল্পে ঢুকে গিয়েছিলাম আমি। মেয়েটি কে জিজ্ঞেস করলাম, "তারপর। পরের দিন বলেছিলেন ভালোবাসার কথা?" মেয়েটি বলতে শুরু করলো.......
"পরেরদিন এখানে এসে দেখি দুপুর রোদে ছেলেটা ঘামে চটচটে হয়ে আছে, তবে আগের মতোই সেটা গায়ে মাখাচ্ছেনা। ছেলেটার কি কোনো অনুভুতি ই নেই, কোনো কিছু নিয়েই কি মাথাব্যথা নেই। চিন্তা নেই, আজ থেকে হবে, কারন আজ থেকে তার গল্পে আমি থাকবো। ছেলেটার পাশে গিয়ে বসলাম। ছেলেটা চমকালো না। যেন জানতো, আমি তার পাশে এসে বসবো। কিছু বলবো। ছেলেটা আমার দিকে তাকালো, চোখে জল। আমি অবাক হলাম, কাঁদছে কেন। কাঁদোস্বরে ছেলেটি প্রথম কথা বললো আমার সাথে, সেটি হচ্ছে, "আমি জানি আপনি প্রতিদিন এখানে আসেন, আমায় দেখতে। আজ যা বলতে এসেছেন, প্লিজ সেটা বলবেন না...!" আমি হতভম্ব হয়ে চুপ করে গেলাম। ছেলেটা আনমনে বসে থেকে এতোকিছু জানলো কি করে, বুঝলো কি করে। আমি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। ছেলেটার চোখে জল জমে আছে, কাঁদছেই বা কেন ছেলেটি। সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, জানিনা কোথা থেকে এতো সাহস আসলো সেদিন, "কাউকে ভালোবাসেন?" ছেলেটি চুপ করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে, তারপর স্পষ্ট স্বরে বললো, "ভালোবাসি। একটা মেয়ে। একটা বাস, একটা অপরাধ, কিছু অনুভুতি.. প্রচন্ড ভালোবাসা.. অন্য একটা গল্প। শুনবেন?" আমি মাথা নাড়লাম, ছেলেটি বলতে শুরু করলো......
"মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় একটা বাসে। পাবলিক বাসে। প্রচন্ড ঠেলাঠেলি। ধাক্কাধাক্কি তে মেয়েটি আমার পায়ে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি উহু.. বলে চিৎকার দিতেই সরে এসে সরি বলে। আমি কাঁদোমুখে "ইটস ওকে" বলি। কিছুক্ষণ পর আবারো। আবার সরি, আবার কাঁদোমুখে ইটস ওকে। এইরকম প্রায় চারবার হবার পর, আমি আমার সামনে থাকা কিছু লোক কে সামনে ঠেলে, পেছনের গুলা রে একটু পেছনে ঠেলে লম্বা হয়ে বাসের মধ্যেই শুয়ে পড়লাম। শুয়ে পড়ে বললাম,"ম্যাডাম, যে পায়ে পা দিচ্ছেন বারবার, পা টা গতকাল কেটেছে, কাটা জায়গায় ঝাল ঘষে দিচ্ছেন। পায়ের উপর পা না দিয়ে, এই যে আমি শুয়ে পড়েছি, আমার বুকে পা দিয়ে দাঁড়ায় থাকেন।" মেয়েটি লজ্জ্বা পেলো ভীষন। তড়িঘড়ি করে সামনের স্টপেজেই নেমে পড়লো। নেমে পড়ার পর আমার মনে হলো, একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। পাবলিক বাসে তো এসব হয় ই। এরপর থেকে মেয়েটির পিছু নেয়া শুরু। ক্ষমা চাইতেই হবে আমাকে। সবচেয়ে অদ্ভুত কথা হলো, পেছন পেছন ঘুরতে ঘুরতে মেয়েটির সাথে ভালো বন্ধুত্ব হলো ঠিকই, কিন্তু ক্ষমা করলো না মেয়েটি আমায়। আমি ভাবলাম, বাপরে! কি জেদী মেয়ে। আমার বাবা মা চাচ্ছিলো তাড়াতাড়ি ই বিয়ে টা করে নিতে। বাসায় জানানো হয়ে গিয়েছে আমার, মেয়ে পেয়ে গেছি। তবে আমার ব্যাপার টা ছিলো অন্য। বাবা মা কে বলে দিয়েছিলাম, মেয়েটা কে আমি পছন্দ করবো, এবং বিয়ের আগে মেয়েটি কে ও আমায় পছন্দ করতে হবে। মেয়েটির পিছু পিছু ঘুরতে ঘুরতে সুযোগ খুঁজছিলাম একটা সঠিক সময়ের। সঠিক সময় পেলাম না, তবে একটা কষ্টকর সত্য জানতে পারলাম... মেয়েটি বিরক্ত হচ্ছে আমার উপর। ভয় পেলাম। মেয়েটি কে হারাবো না তো। সময় সুযোগ পাশে ফেলে রেখে একদিন গিয়ে ডাইরেক্ট বলে ফেললাম, ভালোবাসি। মেয়েটি কড়া মুখে জানালো সম্ভব না। তারপর ও হাল ছাড়লাম না। পেছন পেছন ঘুরলাম। এমন কি একদিন একটা বড় মার্কেটের সামনে অনেকগুলা মানুষের সামনে ঠাটিয়ে চড় ও মারলো, আমি তাতেও লজ্জ্বা পেলাম না। কেমন যেন জেদ চেপে গিয়েছিলো। চাইলে বাসায় বাবা মা কে পাঠিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারতাম, মেয়েটির বাবা মা পাত্র হিসেবে আমায় অপছন্দ করবে তেমন কোনো কারন ও ছিলোনা, কিন্তু সেটাও করলাম না। আমি শুধু জানতে চাইছিলাম, মেয়েটি কেন ই বা আমায় ভালোবাসবেনা, কারন টা কি? একদিন কারন জানা হলো। মেয়েটি ভালোবাসে কাউকে। তাদের পাশের বাসার একটি মানুষ। ঐ মানুষটি কে ভীষনরকম ভালোবাসে, তবে মানুষটি জানেনা সেটা। মানুষটি নাকি প্রচন্ড রকম চুপচাপ, কারো সাথে কথা বলেনা। অন্যমনস্ক। আমি আর কখনো মেয়েটির সামনে যাইনি। কখনোই না। যেটা আমার গল্প ভেবেছি, আসলে আমি জানতাম না, সেটা অন্য কারো গল্প ছিলো। অজান্তে অন্য কারো গল্পে ঢুকে গিয়েছিলাম আমি!"
এতটুকু বলে ছেলেটি থামলো..! আমি উঠে এখান থেকে চলে গেলাম। পনের দিন ঘর থেকে বের হলাম না। ষোলদিন পর এখানে এসে দেখি, ছেলেটা নেই। বেঞ্চি খালি। কেমন যেন একটা চরম শুন্যতা লেপ্টে আছে আশেপাশে। এখানে এসে বসলাম, তারপর থেকেই এখানে এসে বসি। ছেলেটা কোথায় জানা নেই আমার। জানতে ইচ্ছে ও করেনা...!"
আমি মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলাম, অনুভব করলাম, অন্য কারো গল্পে নিজে ঢুকে যাওয়া কতটা কষ্টের। আমি নিজেই যে এখন অন্য কোনো গল্পের অংশ হয়ে গিয়েছি। এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আমায় বেঞ্চিতে রেখে মেয়েটি উঠে চলে আসলো। মাথার উপরে ছিলো মধ্য দুপুরের রোদ, কড়া রোদ.. আর পাশে অল্পকিছু গল্প। না পাওয়ার গল্প।
.........
রোদ সামনে তাকিয়ে আছে, আমি তখনো একটা ঘোরের মধ্যে, জিজ্ঞেস করলাম,
-- মেয়েটি কে আর দেখেন নি। তাইনা?
-- হুম। সিলেট চলে গিয়েছে। যাওয়ার আগে বলেছিলো, "ছেলেটা যে মেয়েটা কে পছন্দ করে, সে আমার ই বেস্ট ফ্রেন্ড। কেমন একটা কষ্টে বুক টা ফেটে গিয়েছিলো এটা জানার পর। ছেলেটা জানেনা, তার প্রচন্ডরকম ভালোবাসার মানুষটি আমার ও প্রচন্ডরকম ভালোবাসার মানুষ। বেস্ট ফ্রেন্ড হয় আমার। আমায় জানপাখি প্রানপাখি ডাকে ঐ মেয়েটি। ভাবলাম, ফ্রেন্ড টি যদি কিছু জানতে পারে কষ্ট পাবে সে, একটা অদ্ভুত কষ্টে ভুগবে তিনটে মানুষ। কাউকেই কিছু জানাইনি আর। আমি এখানে আসবোনা আর কখনো। বেঞ্চি টা খালি থাকবে। সব ছেড়ে সিলেট চলে যাচ্ছি। ভালো থাকবেন।"
রোদ থামলো, গল্প শেষ। ওর চোখে কষ্ট, সেটা জল আকারে নামছে। আমি রোদ এর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-- শেষ কবে অবাক হয়েছেন?
-- অনেক অনেক আগে।
-- অবাক হতে ইচ্ছে করে?
রোদ জবাব দিলোনা, আমি রোদের ঘামে ভেজা হাতে হাত রেখে বললাম,
-- যে গল্প টা এখানে বসে আপনি শুরু করেছিলেন, সে গল্পের শেষ টা ও আপনার পাশে বসে আছে...! অদ্ভুত না...??
রোদ অবাক হয়ে তাকালো। আমার কাঁদতে ইচ্ছে হলো রোদের চোখের দিকে তাকিয়ে, পারলাম না। অনেকদিন ধরে যারা অবাক হয়না, তারা হঠাৎ অবাক হলে দেখতে কি সুন্দর লাগে। রোদের অবাক চোখে চোখ রেখে বললাম,
-- যে মেয়েটি কে ভালোবেসেছেন, সে আমার ই বেস্ট ফ্রেন্ড। তৃপ্তি। তৃপ্তি যে ছেলেটা কে ভালোবাসতো, সে ছেলেটার পছন্দের মানুষটি আমি। নুপুর। আর আমি যে মানুষটির জন্যে ছেলেটা কে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, সে মানুষটি আপনি!! আমি জানি আপনি কি ভাবছেন? আমি ভালোবাসা চাইবোনা, দিয়ে গেলাম। আমি এটাও জানি, আপনি কাল থেকে এখানে আর আসবেন না। তবে বেঞ্চিটা খালি থাকবেনা..! এখানে কেউ একজন কে বসতে হবে, অন্য কারো গল্পের অংশ হয়ে যাওয়ার প্রচন্ড কষ্ট সামলাতে হবে, চুপচাপ থেকে, আনমনা হয়ে...!
মাথার উপর কড়া রোদ। আমি একা বসে আছি, বেঞ্চিতে। সামনে রাস্তা, রাস্তার ওপাশে মায়াপুরী পার্ক। আমার পাশে কাঠের বেঞ্চিতে একহাজার গল্প। না পাওয়ার। দু'টো মানুষের পাওয়ার গল্পের পেছনে ও অন্য দু'টো মানুষের না পাওয়ার গল্প থাকে। যে মানুষটি যে মানুষটি কে পেয়েছে, সে দু'টি মানুষকেই হয়তো অন্য দু'টি মানুষ হারিয়েছে। খুব কম মানুষেরই পাওয়ার গল্প টায় চাওয়ার মানুষটি থাকে... কেন জানিনা, চাওয়ার মানুষটি সবসময় অন্য কারো পাওয়ার গল্পে ই থাকে..!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন