যদিও এখন গরম তুলনামূলক কম তবুও ছেলেটা ঘামে প্রায় গোসল করে ফেলতাছে। আকাশে সূর্যের কোন নামগন্ধ নাই। আকাশে শুধু মেঘ আর মেঘ তবুও ছেলেটা অনেক ঘামতাছে। সেই সকাল 10 টায় এসে লাইন দাঁড়িয়েছিলো আর এখন বাজে 2.35 পিএম। আসলে এই সময়টা দুপুরের সীমানায় পড়ে নাকি বিকালের আওতায় পড়ে তা নিয়ে আমি সন্দিহান। অন্যকোন কারণে লাইনে দাঁড়ালে সে কখনোই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতো না। তার অনেক কষ্ট হইতেছে দাঁড়িয়ে থাকতে তবুও দাঁড়িয়ে আছে। কারণ এইটা যে তার ভার্সিটি ভর্তি হওয়ার লাইন। এই লাইনের শেষমাথায় আছে তার সেই স্বপ্নের লালিত ভার্সিটিতে প্রবেশের জন্য আইডি কার্ড।
.
ছেলেটির নাম সাদী। যে খুবই সুন্দর সুন্দর মানুষ পটানোর মতো কথা বলতে পারে। যতহোক,কমার্সের স্টুডেন্ট বলে কথা। কিন্তু এখন তার মেজাজটা খারাপ কারণ তার সামনে ৮ টা মেয়ে আর সবার চোখেই চশমা। পিছনের অবস্থাও একইরকম। পিছনে আরো তিনটা মেয়ে যদিও তাদের চোখে চশমা নাই। চশমা তার কাছে খারাপ লাগে না কিন্তু সে যেহেতু নিজেই একজন পরঘোষিত কানা তাই অন্যকোন কানীই তার ভালো লাগে না।
এর পরেও তার মনে আপাতত এতটুকু একটা প্রশান্তি আছে যে, অনেকগুলো মেয়ের মাঝে সে শুধু একটা ছেলে। সে পরিকল্পনা করে ফেল্লো, ভার্সিটিতে আইসা যেমনেই হোক একটা প্রেম করবেই। তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য আগেই বলছি যে সে প্রচুর কথা বলে এবং মানুষের সাথে ভাব জমানো। এইটা তারজন্য কোন কাজের মধ্যেই পরিগণিত হয় না। তার সামনের মেয়েটার সাথে সে কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজতেছিলো কিন্তু ঐ মেয়ে আবার তার সামনের মেয়ের সাথে কথাবার্তায় অনেক ব্যস্ত। যাইহোক, তার মধ্যে একটু বৈজ্ঞানিক টাইপ গুণাবলী ছিলো যদিও সে কমার্সের স্টুডেন্ট।
-এই যে আপু!!
-কি!! আমাকে বলতাছেন?
-জ্বি, আমার সামনে তো আপনিই সেই হিসাবে আপনাকেই বলতাছি।
-কি বলবেন বলেন?
-কি বলবো তা এখনো ঠিক করতে পারতেছি না।
-তাইলে, যখন ঠিক করতে পারবেন তখন বইলেন।
-আচ্ছা, আমি সাদী। আপনার নাম?
-আমি মিলি ।
-ওহ,আপনার বাসা কোথায়?
-ময়মনসিংহ। আপনার?
-আমরা কাছাকাছি এলাকার মানুষ। আমার বাসা নেত্রকোণা।
-ওহ, আমার বাসাও নেত্রকোণা। তবে নেত্রকোণা বল্লে অনেকেই চিনে না তাই ময়মনসিংহ বলি।
. (এই কথা শুইন্না সাদী সাহেবের মাথার তার একটু একটু কইরা গরম হওয়া শুরু হইলো। এমনিতেই অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া আছেন এইটার রাগ এবং মেয়ের কথা শুনার পরের রাগ সব একত্রিত হওয়া শুরু হইলো। রাগে উনার মুখ লাল থেকে অধিক লাল হইতে থাকলো। কিন্তু উনি মেয়েটাকে কিছুই বলতে পারলেন না।)
-ওহ,তাই বলেন। আমরা তো এক জায়গার ই মানুষ। চিনে না তো কি হইছে, চিনাবেন তাদেরকে।
-চিনাবো কিভাবে?
-নেত্রকোণা বাংলাদেশের একটা জেলা। ভারতের সীমান্তে অবস্থিত। একমাত্র চীনামাটির পাহাড় আমাদের জেলায়। এইসব বলবেন তাইলেই হয়।
-ভাই, আমার এত ধৈর্য নাই যে একজনকে লেকচার দিয়ে দিয়ে বলবো আমি নেত্রকোণার।
-লেকচার দেওয়ার কি আছে!! নিজের জেলার নাম বলতে কি লজ্জা পান নাকি আপনি?
-লজ্জা পাওয়ার তো কিছুই নাই। তারা যেহেতু ঐ জায়গা চিনে না তাই ময়মনসিংহ এর কথা বলি।
-আচ্ছা। আপনার ইচ্ছা হইছে বলবেন। আমি দুইটা গল্প বলি শুনেন,
.
" (১) 1972 সাল বাংলাদেশের এক লোক কাজের সন্ধানে দেশ থেকে চলে গেলো। অনেক চরাই উৎরাই উপেক্ষা করে সে ব্রাজিল গিয়ে পৌছলো। সে ঐ জায়গায় কি করবে না করবে কিছুই বুঝতেছিলো না। তারপরো আল্লাহ্ র ইচ্ছায় তার একটা কাজের ব্যবস্থা হইলো। তখন তাকে তার দেশ সম্বন্ধে জিজ্ঞাস করা হলো। সে বাংলাদেশের কথা বলায় কেউই তার দেশ চিনতে পারে নাই। তখন সে বাংলাদেশের অনেক বিবরণ দিলো। বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে ঐ জায়গার মানুষকে স্পষ্ট ধারণা দিলো কিন্তু কোন কাজ হলো না। কারণ সে তখন মোটামুটি একটা শহরে অবস্থান করছিলো। অর্থাৎ ব্রাজিলের রাজধানীতে ছিলো না। তবুও তারা তাকে কাজ দেয় এবং সে তার কাজ খুব ভালোভাবেই করতে থাকে। 1972 সালের 15 মে ব্রাজিল, বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। এই খবর একটা পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় এবং ঐ লোক এই খবর ব্রাজিলের বাসিন্দাদের দেখিয়ে বলে যে এই বাংলাদেশ ই আমার দেশ। তারপর, দুই দেশের সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং ঐ লোক ব্রাজিলের বাসিন্দা হয়। তাছাড়া, ব্রাজিলের অনেককে নিয়েই সে বাংলাদেশে বেড়াতে আসে এতে করে দেশের পর্যটনখাত কিছু টাকাও পায়।
.
(২) ঐ লোকের আরেক বন্ধু ছিলো সেও দেশ ছাড়ে জীবিকার সন্ধানে। সে আর্জেন্টিনায় গিয়ে পৌঁছে। বাংলাদেশ কে কেউ না চিনায় সে ভারতের পরিচয় দেয় কারণ ভারতকে সবাই চিনে। তারপর ভারতের দূতাবাসের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় যে সে ভারতের না বরং বাংলাদেশের। তারজন্য ঐ ব্যাক্তিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয় তারা। ঐ লোক এখন একটা বৃদ্ধাশ্রমে আছে। আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় 25 মে, 1972। "
. গল্প দুইটা কেমন লাগলো!!
-সমস্যা কি আপনার? আমার ইচ্ছা হইছে আমি ময়মনসিংহ বলবো এতে আপনার কি? তাছাড়া, ময়মনসিংহ আমার বিভাগ কিন্তু ভারতের অংশ বাংলাদেশ না। ময়মনসিংহ বল্লে কেউ আমাকে এখান থেকে বের করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। গল্প বলবেন ভালো কথা কিন্তু এইরকম অমিলের গল্প বলতে যাইয়েন না।
-গল্পটাতে কি কোন ভুল ছিলো নাকি!! আচ্ছা যাইহোক, ভুল হইয়া গেলে তো সমস্যাই। তাইলে আরেকটা বলি কেমন?
-থাক থাক আর বলতে হবে না। এইসব বাদ দেন। আপনার এইসব গল্প শুনলে আমি আর এখানে থাকতে পারবো না। আমাকে নিশ্চিত পাবনা যাইতে হবে।
-পাবনা গিয়ে লাভ নাই!! পাবনা যাইতে হবে না। পাবনা গেলে তো আর আপনাকে ক্লাসরুমে পাবো না। একটা কথা জিজ্ঞাস করবো?
-জ্বি করেন।
-আপনি কি সেকেন্ড টাইম না ফার্স্ট টাইম??
-দুইটাই বলতে পারেন। কারণ এইচএসসি 15,16 দুইবার দিছি। ভার্সিটি পরীক্ষা 15 তে শুধু ঢাবি তেই দিছিলাম। তবে এই ভার্সিটির জন্য কিন্তু ফার্স্ট টাইম। আপনি কি ফার্স্ট টাইম?
-আরে না। আপনার কাহিনীই আমার কাহিনী। আপনার এসএসসি এবং এইচএসসি র ব্যাকগ্রাউন্ড কি ছিলো?
-সাইন্স আছিলো। আপনার?
-আমি জন্মের পর থাইকাই পিউর কমার্স।
-জন্মের পর থাইকা!! তারমানে জন্ম হওয়ার সাথে সাথেই ক্লাস ৯ এ ভর্তি হইছিলেন??
-আরে না, আমি বলতে চাইছি ক্লাস 9 থেকেই আমি কমার্সে। সাইন্সের স্টুডেন্টের এই এক সমস্যা তারা একটু বেশিই বুঝে।
-তারা বেশি বুঝে না বরং তারা ভুলগুলো ধরে ফেলে।
-এত জ্ঞানী হইয়া তো আর লাভ নাই। কারণ এখন তো আপনিও বিবিএর স্টুডেন্ট।
-হুম্ম,,তাই তো দেখতাছি।
-আসছেন কোথায় থেকে? ময়মনসিংহ!!
-হুম্ম,,ময়মনসিংহ ছিলাম। ঐখান থেকেই আসছি।
-ভালো। নেত্রকোণা থেকে তো আর বাস নাই। আসলে তো ময়মনসিংহ থেকেই আসতে হয়।
.
. মিলি কিছু একটা বলতে চাইছিলো কিন্তু আর বলা হয়ে উঠে নাই। কারণ এখন তার সিরিয়াল এসে গেছে। মিলি ভর্তি হওয়ার পরে সাদীকে শুধু বল্লো, " বাই, ক্লাসে দেখা হবে। " সাদীর মনে হয়, মেয়েটার প্রতি কিছুটা দূর্বলতা সৃষ্টি হয়ে গেছিলো তাই তার কিছুটা খারাপ লাগলো। তাছাড়া বর্তমান ডিজিটাল যুগের নির্দেশন স্বরূপ সে মিলির মোবাইল নাম্বার বা ফেসবুক আইডি কিছুই রাখতে পারে নাই। কিন্তু ক্লাসে তো দেখা হবেই এই আশায় সে আর তেমন দুঃখ অনুভব করে নাই। সেও ভর্তি হয়ে তার বাড়িতে চলে আসলো। সে এখন পাবলিক ভার্সিটির স্টুডেন্ট তাই সে এখন অনেক আনন্দে আছে।
.
একদিন সকালে তার পরিচিত এক ভাইকে বল্লো যে সে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইছে। তখন হঠাৎ করে উল্কাপিন্ডের মতো এক লোক আবির্ভূত হইয়া বল্লো, আমার মেয়েও তো চান্স পাইছে। তুমি একটু বসো তোমার সাথে আমার আলাপ আছে। ঐ লোককে তখন সে তাদের বাসায় নিয়ে গেলো এবং তার আব্বা-আম্মার সাথেও ঐ লোক কথা বল্লো। উনি উনার মেয়ের যাতায়াত নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন। ভর্তি হওয়ার সময় ময়মনসিংহ এর আরেক ছেলের সাথে উনি উনার মেয়েকে দিছিলেন। তাছাড়া, ঐ লোক এবং সাদীর আব্বা র মধ্যে একটা পারিবারিক যোগসূত্র ছিলো যা কথা বলার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ঐ লোক সাদীর নাম্বার নেয় এবং বলে শুভেচ্ছা ক্লাসের আগে সাদীর সাথেই উনার মেয়েকে দিবে। এইটা নিয়ে তার একটু খারাপ লাগা ছিলো কারণ মিলির প্রতি তার একটু ভালোবাসা তৈরি হইছিলো। কিন্তু যাইতে হইবো আরেক মেয়ের সাথে। তবে সে এই আশাও করতেছিলো যেন ঐ মেয়েটা মিলিই হয়। কারণ, মিলির বাড়ি আর ঐ মেয়ের বাড়ি এক জেলায় এবং দুইজনই একই ইউনিটে। কিন্তু ঐ লোক মেয়ের নাম আরেকটা বল্লো। যেহেতু, তার মাথায় মিলির কথা ঘুরতেছিলো তাই সে ঐ মেয়ের নাম ভুইল্লা গেলো।
.
পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী সে বাসস্ট্যান্ডে উপস্থিত হলো। বাসস্ট্যান্ডে উপস্থিত হয়ে সে মিলি কে খুঁজতেছিলো। কিছুক্ষণ ঐ লোক এবং মিলি রিকশা থেকে নামলো। সে তো পুরাই হতবাক যে মিলি ই ঐ লোকের মেয়ে। তার এতকিছু চিন্তা করার সময় নেই। সে মিলিকে পাইছে এইটাই বড় কথা। বাস ছাড়ার আগে আগেই তারা বাসে উঠলো। সাদীর ইচ্ছা ছিলো জানালার পাশে বসার কিন্তু এইটা আর হয়ে উঠে নাই। কারণ মিলি বাসে উঠেই বলে ফেল্লো যে সেই জানালার পাশে বসবে। কিছুই করার ছিলো না সাদীর।নিজের হৃৎপিন্ডের চালচলনের উপরে সে বন্ধী ছিলো। বাস ছাড়ার পর সে তার স্বভাবসুলভ একটা ছবি তুলে ফেসবুকে দিতে চায়!! তার ইচ্ছা ছিলো মিলিকে নিয়ে একটা সেলফি তুলে তা ফেসবুকে পোস্ট করবে। কিন্তু -
-আরে বাবা, না করলাম তো আমি ছবি তুলবো না।
-আরে ছবি তুল্লে সমস্যা কোথায়?? একটাই তো তুলবো!
-সমস্যা আছে। কারণ ছবি তুলেই তুমি তা ফেসবুকে দিবে এবং তোমার ফ্রেন্ডরা আমাকে তোমার সাথে জড়িয়ে অনেক কথা বলবে।
-ওহ, তাই!! ফেসবুকে কি তুমি তোমার পিক দেও নাই নাকি???
-কবে দিলাম?? আমার পিক তো ফেসবুকে নাই।
-কিভাবে বিশ্বাস করবো!!
-হুম্ম,, বুঝতে পারছি। আমার আইডির নাম জানতে চাইতাছো। এইটা সরাসরি বল্লেই তো পারো।
-যেহেতু বুঝতে পারছো সুতরাং দিয়ে দাও।
-আচ্ছা।
.
আইডি শেয়ার করার মাধ্যমে একজন আরেকজনের সাথে ফেসবুকে কানেক্টেড হইয়া গেলো। সাদী আর কোন পিক না তুলেই শুধু ট্রাভেলিং টু দিনাজপুর দিয়া দিলো। বাসে উঠলে সাদীর প্রচুর ঘুম পায়। কিন্তু আজকে অনেকক্ষণ হইলো সে ঘুমাইতাছে না। কারণ তার সাথে তার অতিপ্রিয় একজন মানুষ বসা। সে কিভাবে ঘুমাবে??? মিলিকে সে কিছুক্ষণ পরপর খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতাছে সে কি করে না করে ইত্যাদি। মেয়েটার মধ্যে বোধহয় রসের বড়ই অভাব। কারণ সাদীর মতো এইরকম একটা হ্যান্ডসাম ছেলে তার সাথে বসা কিন্তু সে দিকে কোন খেয়াল না করেই ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে পড়া শুরু করে দিলো। সাদীও কোন কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ যাওয়ার পরে সাদী ঘুমিয়ে পড়লো। সাদী ঘুমের ঘোরে মিলির কাধে তার মাথা এলিয়ে দিলো। মিলি রাগতস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
-জীবনে কি কোনদিন বাসে উঠো নাই নাকি??
-কেন কি হইছে! আস্তে কথা বলো। বাসের অন্যযাত্রী রা কি বলবে?
-রাখো তোমার অন্যযাত্রী। যা জিজ্ঞাস করছি তাই বলো।
-বাসে উঠবো কেন!!! ছোট থাইকাই বাসের ভিতরেই থাকি।
-এই কারণেই এই সমস্যা। ঘুমাইবা ভালো কথা কিন্তু কাধ আমার এইদিকে আসলে খবর আছে কিন্তু।
-আচ্ছা আর আসবে না।
সাদীর লালিত ইচ্ছা তখনই শেষ হয়ে গেলো কারণ সামান্য কাধে মাথা ভুলে লাগায় যা করছে। সে আরো চিন্তা করছিলো তার ভালোবাসার কথা বলবে কিন্তু মিলির এই অবস্থা দেখে ভালোবাসার কথা বলার ইচ্ছাই চলে গেছে তার হয়তো ভয়ের কারণে।
.
কিছুক্ষণ পরে মিলির চেহারা ফ্যাকাশে হওয়া শুরু হইলো। সে সাদীকে বল্লো, "আমার বমি বমি আসতাছে তাড়াতাড়ি পলিথিন আনো।"
সাদী বাসের কন্টেক্টার এর কাছ থাইকা পলিথিন নিয়ে মিলি কে দেওয়া মাত্রই সে গড়গড় করে বমি করা শুরু করে দিলো। বমির কিছু ছিটেফোঁটা সাদীর শরীরেও লাগলো। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারলো না যদিও রাগে তার মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালাস একেবারে টগবগ করতেছিলো। বমি করার পর সে মোটামুটি স্বাভাবিক হইলো। তখন আস্তে আস্তে সাদীর মুখ খোলা শুরু হইলো।
-কি!! আমি জীবনেও বাসে উঠি নাই তাই বাসে ঘুমাই। আর তুমি তো বাসের অনেক নামীদামী যাত্রী তাই বমি করো।
- তুমি কি আমাকে অপমান করতেছো!! এমনে বলো কেন? আমি কি ইচ্ছা করে বমি করছি নাকি!!!
-না,, তুমি বমি করে আমার কাপড় ছ্যাদাব্যাধা কইরা দিছো আবার এইটাতে তোমার কোন দোষ নাই। কিন্তু আমি সামান্য একটু ঘুমাইয়া তোমার কাধে হেলান দিলাম তাতেই যত দোষ!!!
-বুঝতে পারছি তো। আমার ভুল হইছে তোমাকে তখন ঐভাবে বলা। যাও আমি দুঃখিত, আমাকে মাফ করো এখন!!!
-ফ্রিতে কি মাফ করা যায়??
-তাইলে কি চাও??
-ট্রিট দিতে হবে। (সাদী আর কিছু পারুক আর না পারুক এই ট্রিট অন্যের কাছ থাইকা খুব সুন্দর করে আদায় করে নিতে পারে।)
-কিসের ট্রিট??
-এখন আমাকে খাওয়াতে হবে।
-কি খাওয়াবো?
-এত কথা বলে লাভ নাই। যখন বাস বিরতি দিবে তখন দেখা যাবে!!
.
সাদী কে দেখে পটকা মনে হইলেও সে অনেক খেতে পারে। সাদী শুধু একাই প্রায় 642 টাকা বিল তুলে ফেলেছিলো। যা দেখে মিলি হতবাক। সে যে আসলেই অনেক বড় ভুল করেছিলো তা তখন বুঝতে পারছিলো। খাওয়া শেষ করে সে আনন্দের ঢেঁকুর তুলতে তুলতে যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হচ্ছিলো তখন পাশের দোকান থেকে দুই টাকা দিয়ে দুইটা চকলেট কিনে নিয়ে আসে। বাসে উঠে মিলি চুপচাপ সে প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে গেছিলো। তখন তাদের এই নীরবতা ভঙ্গ করে সাদী মিলিকে একটা চকলেট দেয়। মিলি বেশিকিছু না বলে সাদীকে শুধু একটা ধন্যবাদ দেয় এবং চকলেট টা গলাধঃকরণ করে। সাদী সম্পূর্ণ বিস্মিত হয়ে পড়ে। কিন্তু সেও আর ঐ বিষয়ে আর কিছুই বলে না।
এভাবেই তাদের ঐদিনের বাস ভ্রমণ শেষ হয়ে যায়।
.
ভার্সিটিতে যথারীতি তাদের ক্লাস শুরু হয়। সাদী এবং মিলি তারা পাশাপাশি বসে। একসাথে ক্লাসের পরে ক্যাফেটেরিয়া তে যায়। সাদী লাইব্রেরী তে যেতে না চাইলেও মিলির কারণে প্রতিদিনই তাকে লাইব্রেরী তে যেতে হয়। রাত 12 টা বাজতেই মিলি ফোন দিয়ে বলবে ঘুমানোর জন্য। তাছাড়া সকাল ঠিক 6.30 এ ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙ্গাবে। সাদীর একটা বদভ্যাস আছে আর তা হলো সে বেশিরভাগ সময়ই ব্রাশ করে না। এরজন্যও মিলি সাদীকে অনেক ঝাড়ি দেয়। সাদী যেহেতু সবকিছুই বেশি বুঝে তাই মিলির সাথে তার প্রচুর কথা কাটাকাটি হয়। তাদের ভার্সিটির ক্যাম্পাসটা খুবই সুন্দর। তাদের ক্যাম্পাসের ভিতরেই একটা ছোটখাটো লিচু বাগান আছে। তারা এই লিচু বাগানেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। তাদের মধ্যে অনেক বিষয়েই আলাপ-আলোচনা হয়। এইসবের মধ্যে তাদের ভালোলাগা, পছন্দের বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত থাকে। সাদী আগে প্রচুর কথা বলতো কিন্তু মিলির কল্যাণে এখন সে আগের তুলনায় কথা কিছু কম বলে। মিলি, সাদীর রাতের ঘুম থেকে শুরু করে আবারো ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যতটুকু সময় সে জাগ্রত থাকে তার সবটুকু সময়ই মনিটরিং করে। সে পড়তে বসলো কিনা, খাওয়া খেলো কিনা, গোসল করলো কিনা!! কোন লেকচার তুলতে না পারলে মিলি নিজেই আবার সে লেকচার তাকে লিখে দেওয়ার পাশাপাশি বুঝিয়েও দেয়। সাদীর প্রতি মিলির এত আগ্রহ থেকে সাদী ধরেই নিছিলো যে মিলি তাকে খুবই ভালোবাসে। সামনে তাদের নবীনবরণ তাই সাদীর ইচ্ছা ঐদিনই তার মনের কথা মিলিকে বলবে সে।
.
দেখতে দেখতে তাদের নবীনবরণ এসে পড়ে। সাদী, মিলিকে কি দিবে তা নিয়ে খুবই চিন্তিত। অনেক চিন্তাভাবনা করে 400 টাকা দিয়ে একটা চকলেট বক্স কিনলো এবং 600 টাকা দিয়ে একটা পারফিউম কিনে নিয়ে আসে। নবীনবরণ এর দিন সাদী সদ্য কিনা একটা সবুজ রঙ্গের পাঞ্জাবী পড়ে যায়। তারা মাকাঝাকা চুলগুলো কে একটু স্টাইল করে কাটছাঁট করে। সে যেহেতু ভার্সিটির হলেই থাকে তাই সে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই চলে আসে। এসে মিলিকে খুঁজতে থাকে। মিলি কিছুক্ষণ পরে আসে। মিলিকে দেখে তো সাদীর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। মিলিও একটা সবুজ শাড়ি পড়েছিলো। তার উপরে সাদা ও কমলা রঙ্গের মিশ্রিত একটা হিজাব ব্যবহার করেছিলো। সাদী যদিও কোনদিন পরী দেখে নাই কিন্তু মিলিকেই তার কাছে পরী মনে হইতেছিলো। মিলি সাদীর সামনে এসে দাড়ায় এবং কথা বলা শুরু করে।
-দোস্ত,তোকে তো অনেক সুন্দর লাগতাছে আজকে। উন্নতি হইছে দেখা যায় তোর।
-কি বলোস এইসব। তোকে তো অনেক সুন্দর লাগতাছে। একদম পরীর মতো।
-সত্যি বলতাছস!!! আজকে তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
-কি সারপ্রাইজ?? তাড়াতাড়ি দে। ( সাদী উদগ্রীব হয়ে ছিলো কারণ সে মনে করছিলো মিলি তাকে ভালোবাসার কথা বলবে।)
-এত অধৈর্য হইলে কিভাবে হবে!! অপেক্ষা করো কিছুক্ষণ।
-আইচ্ছা,, অপেক্ষা করতাছি তবে বেশিক্ষণ পারতাম না। যা করবি খুব দ্রুত কর।
. মিলি তাকে দাড় করিয়ে রেখে একটু দূরে চলে যায় ফোনে কথা বলার জন্য। কথা বলে আসার পরে সাদীকে নিয়ে ক্যাফেটেরিয়া তে যায়। ক্যাফেটেরিয়া তে তারা দুইজন অনেকক্ষণ কোন কথাবার্তা ছাড়াই বসে ছিলো। প্রায় 8 মিনিট পরে মিলির ফোনে একটা কল আসে। এবং মিলি, সাদীকে বসিয়ে রেখে বাইরে যায়। ৩ মিনিট পরে আবার যখন সে ফিরে আসে তখন তার সাথে ছিলো তার 5 জন ফ্রেন্ড। তাদের মধ্যে ছিলো দিনাজপুর মেডিকেলের স্টুডেন্ট এবং হাবিপ্রবি র স্টুডেন্ট। মিলি সবার সাথে সাদীর পরিচয় করিয়ে দেয়। এবং বলে সাদী আজকে তাদের ট্রিট দিবে। এই কথা বলেই মিলি খাবারের অর্ডার দেয়। তখন সাদীর মুখটা দেখার মতো ছিলো। সে খাইতে পারতেছিলো না। তার গলবিল মনে হয় সংকুচিত হয়ে গেছিলো। মুখে কোন লালারস উৎপাদিত হইতেছিলো না। তারপরোও সে খাওয়ার অভিনয় করে গেলো। সবশেষে, তারা 9350 টাকা বিল তুল্লো। বিদায় মুহূর্তে মিলি বল্লো, " সন্ধ্যা সময় অবশ্যই মাগরীবের নামাজ পইরাই পড়তে বসবি কেমন!! আমি ওদের সাথে মেডিকেল কলেজে যাইতেছি। তারপরোও আমি কল দিবো চিন্তা করিস না। "
.
সাদী কিভাবে বিল দিবে সেই চিন্তা করতেছিলো। কারণ এখন মাসের শেষ পকেটের অবস্থাও খারাপ। তবুও বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিয়ে সে বিল মিটিয়ে চলে আসলো। মিলির জন্য কিনা গিফটগুলো সে সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিলো। সন্ধ্যার পরে নিজের স্বভাবসুলভ মিলি তাকে কয়েকবার ফোন দেয় এবং সে খাইছে কিনা, নামাজ পড়ছে কিনা, পড়া শেষ করছে কিনা। ইত্যাদি বিষয়গুলো জানে। এবং ঠিক 12 টায় সাদী তার সেই পরিচিত কন্ঠের "Good Night" শব্দটা শুনতে পায়। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই কারণ এতগুলা টাকা কিভাবে পরিশোধ করবে??? পরদিন মিলি তাকে জরুরী কি বলবে বলে ফোন দেয়। মিলি জানায় তার জন্য একটা প্রাইভেট ম্যানেজ করছে সে।
-কিরে দোস্ত!! তোর জন্য একটা প্রাইভেট ম্যানেজ করলাম। কি করবি এখন??
-না,, আমি এইসব প্রাইভেট ট্রাইভেট পড়াইতে পারুম না।
-তুমি কইলেই তো হবে না চান্দু। তোমাকে পড়াইতেই হবে। এই নাম্বার নেও ছাত্রের বাপের। আর কাল থেকে ঠিকঠাক মতো প্রাইভেট পড়াও।
সাদী কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু সাদীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মিলি তার হলে চলে যায়। সাদী আর কোন উপায় না দেখে ঠিক করে প্রাইভেট পড়াবে। প্রাইভেট পড়িয়ে সে তার বন্ধুদের কাছ থেকে যে টাকাগুলো ধার করেছিলো সেগুলো পরিশোধ করে ফেলে।
.
অন্যদিকে,, সাদীর পড়ার ব্যাপারে তার থাইকাও মিলি বেশি চিন্তাশীল। সে লেকচারের কোন অংশ না বুঝলে মিলি নিজেই বুঝিয়ে দেয়। তাকে লাইব্রেরী তে নিয়ে যায়। এখন আর তারা বাইরে সময় বেশি ব্যয় করে না। তারা তাদের বেশিরভাগ সময়ই এখন লাইব্রেরী তে কাটায়। যদিও সাদী যেতে চায় না তবু তাকে জোর করেই মিলি নিয়ে যায়। এভাবে তাদের দেখতে দেখতে অনার্স শেষ হয়ে যায়। তাদের দুইজনেরই রিজাল্ট ভালো হয়। মাস্টার্স এর পরীক্ষার রিজাল্টে দেখা যায় মিলি ফার্স্ট আর সাদী সেকেন্ড। ভার্সিটি থেকে মিলিকে চাকরীর জন্য অফার দেওয়া হয় কিন্তু সে তা ফিরিয়ে দেয়। তখন মিলি এবং তার স্যারদের ইচ্ছায় সাদীই ভার্সিটিতে যোগ দেয়। সে যেদিন প্রথম ভার্সিটিতে যোগ দিবে তার আগেরদিন মাগরীবের নামাজের কিছুক্ষণ পরে মিলি তাকে ফোন দেয়।
-দোস্ত,তুই কই? একটু ডিবক্সের সামনে আসবি প্লিজ।
-কিরে! তুই এভাবে কথা বলতাসিস কেন?
তোর কি কোন সমস্যা হইছে??
-না, তুই আগে আয়। তোর সাথে কথা আছে।
. সাদী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। সে দেখে মিলি দাঁড়িয়ে আছে। আজকেও মিলি একটা শাড়ি পড়ছে তবে কালারটা সে বুঝতে পারতেছিলো না। কারণ মোটামুটি অন্ধকার ছিলো জায়গাটা।
-কিরে এত জরুরী তলব। ঘটনা কি?
-তোরে একটা কথা বলতে চাইতাছি। প্লিজ না করবি না ক??
-আরে,বলেন ম্যাডাম বলেন। আপনি কোনদিন কিছু বলছেন আর আমি না করছি!!!
-তা করস নাই। তবে আজকের কথাটা একটু ভিন্ন।
-আরে রাখ তোর ভিন্ন। তুই আগে বল।
-দোস্ত, আমি!! আমি না তোকে খুবই ভালোবাসি বলেই সে সাদী কে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়।
. সাদী কি বলবে তা বুঝতেছিলো না। সাদী, মিলিকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেস্টা করে কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার আগেই সে নিজেও কেঁদে ফেলে। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর তারা স্বাভাবিক হয়। মিলি, সাদীকে একটা সবুজ পাঞ্জাবী দিয়ে বলে, " তুই কালকে এই পাঞ্জাবীটা পড়ে তোর চাকরীতে যোগ দিবি। আমাকে কথা দে!!! "
-আচ্ছা কথা দিলাম। কিন্তু এই এতদিন পরে এই কথা বল্লি কেন?
-আমি তো প্রথম দিনই বুঝতে পারছিলাম তুই আমাকে ভালোবাসোস। কিন্তু তুই যেহেতু বলতে পারস না তাই আমিই বল্লাম।
-তা ঠিক তবে আগে বলতি।
-আগে বল্লে কি আর তুমি এই ভার্সিটির টিচার হইতে পারতা???
.
তাদের এই ভালোবাসার কথা তাদের পরিবারকে জানানো হয়। তখন তাদের দুই পরিবার মিলে খুবই ধুমধাম করে তাদের বিয়ের আয়োজন করে এবং তাদের বিয়ে হয়। বাসর রাতে সাদী একটা বক্স নিয়ে হাজির হয়। মিলি জিজ্ঞেস করে এই বক্সে কি আছে? তখন সাদী বক্সটা খুলে। আর বক্স খুলার সাথে সাথে সেখানে কয়েকটা শুকনো ডালিয়া,গোলাপ, একটা চকলেটের বক্স দেখা যায়। মিলি হাতে নিয়ে বুঝতে পারে এইগুলো একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের। তখন সাদী তার মুখ খুলে
-এইগুলো আমি তোমাকে দেওয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম নবীনবরণ এর দিন। কিন্তু আর দেওয়া হয়ে উঠেনি। আমি জানতাম ডালিয়া এবং গোলাপ তোমার প্রিয় ফুল এবং চকলেট খেতে তুমি খুবই পছন্দ করো। তাই আমার আশা আছিলো আমি যদি এইগুলো দিয়ে তোমাকে প্রপোজ করি তাইলে তুমি আমাকে ফেরাতে পারবে না।
-হইছে আর কথা বলতে হবে না। প্রথম প্রপোজ আমিই করছি তাও পাঞ্জাবী দিয়ে।
তোমার এইসব কথার কোন মূল্য নাই।
-হুম্ম এখন তো তাই ঠিক। আপনি তো আমার চকলেট ওয়াইফ!! আপনি যা বলবেন তাই সঠিক।
-এত পাম দিও না। পাম দিলে কিন্তু আবারো লাইব্রেরী র প্যারায় পড়তে হবে।
-দুর, এখন আর লাইব্রেরী কইত্তে আসলো!! এখন আর লাইব্রেরী নাই।
-ঘরকে লাইব্রেরী করে ফেলবো। তুমি কি কিন্তু আমার রাগ উঠাইতাছো।
-আচ্ছা কানে ধরতাছি। চকলেট বউ প্লিজ রাগ কইরো না প্লিজ।
-তোমার উপর কি আমি রাগ করে থাকতে পারি?? তুমি তো আমার পটকা বর। আমি যে তোমার অর্ধাঙ্গিনী।
. এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার তারা দুইজনই বাথরুমে চলে যায় এবং অজু করে ফিরে আসে। তারপর তারা দুই রাকাত নামাজ আদায় করে বিছানায় যাওয়া মাত্রই রুমের সব লাইট অফ হয়ে যায় এবং রুমে নিস্তব্ধতা এসে ভর করে।
.
ছেলেটির নাম সাদী। যে খুবই সুন্দর সুন্দর মানুষ পটানোর মতো কথা বলতে পারে। যতহোক,কমার্সের স্টুডেন্ট বলে কথা। কিন্তু এখন তার মেজাজটা খারাপ কারণ তার সামনে ৮ টা মেয়ে আর সবার চোখেই চশমা। পিছনের অবস্থাও একইরকম। পিছনে আরো তিনটা মেয়ে যদিও তাদের চোখে চশমা নাই। চশমা তার কাছে খারাপ লাগে না কিন্তু সে যেহেতু নিজেই একজন পরঘোষিত কানা তাই অন্যকোন কানীই তার ভালো লাগে না।
এর পরেও তার মনে আপাতত এতটুকু একটা প্রশান্তি আছে যে, অনেকগুলো মেয়ের মাঝে সে শুধু একটা ছেলে। সে পরিকল্পনা করে ফেল্লো, ভার্সিটিতে আইসা যেমনেই হোক একটা প্রেম করবেই। তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য আগেই বলছি যে সে প্রচুর কথা বলে এবং মানুষের সাথে ভাব জমানো। এইটা তারজন্য কোন কাজের মধ্যেই পরিগণিত হয় না। তার সামনের মেয়েটার সাথে সে কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজতেছিলো কিন্তু ঐ মেয়ে আবার তার সামনের মেয়ের সাথে কথাবার্তায় অনেক ব্যস্ত। যাইহোক, তার মধ্যে একটু বৈজ্ঞানিক টাইপ গুণাবলী ছিলো যদিও সে কমার্সের স্টুডেন্ট।
-এই যে আপু!!
-কি!! আমাকে বলতাছেন?
-জ্বি, আমার সামনে তো আপনিই সেই হিসাবে আপনাকেই বলতাছি।
-কি বলবেন বলেন?
-কি বলবো তা এখনো ঠিক করতে পারতেছি না।
-তাইলে, যখন ঠিক করতে পারবেন তখন বইলেন।
-আচ্ছা, আমি সাদী। আপনার নাম?
-আমি মিলি ।
-ওহ,আপনার বাসা কোথায়?
-ময়মনসিংহ। আপনার?
-আমরা কাছাকাছি এলাকার মানুষ। আমার বাসা নেত্রকোণা।
-ওহ, আমার বাসাও নেত্রকোণা। তবে নেত্রকোণা বল্লে অনেকেই চিনে না তাই ময়মনসিংহ বলি।
. (এই কথা শুইন্না সাদী সাহেবের মাথার তার একটু একটু কইরা গরম হওয়া শুরু হইলো। এমনিতেই অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া আছেন এইটার রাগ এবং মেয়ের কথা শুনার পরের রাগ সব একত্রিত হওয়া শুরু হইলো। রাগে উনার মুখ লাল থেকে অধিক লাল হইতে থাকলো। কিন্তু উনি মেয়েটাকে কিছুই বলতে পারলেন না।)
-ওহ,তাই বলেন। আমরা তো এক জায়গার ই মানুষ। চিনে না তো কি হইছে, চিনাবেন তাদেরকে।
-চিনাবো কিভাবে?
-নেত্রকোণা বাংলাদেশের একটা জেলা। ভারতের সীমান্তে অবস্থিত। একমাত্র চীনামাটির পাহাড় আমাদের জেলায়। এইসব বলবেন তাইলেই হয়।
-ভাই, আমার এত ধৈর্য নাই যে একজনকে লেকচার দিয়ে দিয়ে বলবো আমি নেত্রকোণার।
-লেকচার দেওয়ার কি আছে!! নিজের জেলার নাম বলতে কি লজ্জা পান নাকি আপনি?
-লজ্জা পাওয়ার তো কিছুই নাই। তারা যেহেতু ঐ জায়গা চিনে না তাই ময়মনসিংহ এর কথা বলি।
-আচ্ছা। আপনার ইচ্ছা হইছে বলবেন। আমি দুইটা গল্প বলি শুনেন,
.
" (১) 1972 সাল বাংলাদেশের এক লোক কাজের সন্ধানে দেশ থেকে চলে গেলো। অনেক চরাই উৎরাই উপেক্ষা করে সে ব্রাজিল গিয়ে পৌছলো। সে ঐ জায়গায় কি করবে না করবে কিছুই বুঝতেছিলো না। তারপরো আল্লাহ্ র ইচ্ছায় তার একটা কাজের ব্যবস্থা হইলো। তখন তাকে তার দেশ সম্বন্ধে জিজ্ঞাস করা হলো। সে বাংলাদেশের কথা বলায় কেউই তার দেশ চিনতে পারে নাই। তখন সে বাংলাদেশের অনেক বিবরণ দিলো। বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে ঐ জায়গার মানুষকে স্পষ্ট ধারণা দিলো কিন্তু কোন কাজ হলো না। কারণ সে তখন মোটামুটি একটা শহরে অবস্থান করছিলো। অর্থাৎ ব্রাজিলের রাজধানীতে ছিলো না। তবুও তারা তাকে কাজ দেয় এবং সে তার কাজ খুব ভালোভাবেই করতে থাকে। 1972 সালের 15 মে ব্রাজিল, বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। এই খবর একটা পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় এবং ঐ লোক এই খবর ব্রাজিলের বাসিন্দাদের দেখিয়ে বলে যে এই বাংলাদেশ ই আমার দেশ। তারপর, দুই দেশের সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং ঐ লোক ব্রাজিলের বাসিন্দা হয়। তাছাড়া, ব্রাজিলের অনেককে নিয়েই সে বাংলাদেশে বেড়াতে আসে এতে করে দেশের পর্যটনখাত কিছু টাকাও পায়।
.
(২) ঐ লোকের আরেক বন্ধু ছিলো সেও দেশ ছাড়ে জীবিকার সন্ধানে। সে আর্জেন্টিনায় গিয়ে পৌঁছে। বাংলাদেশ কে কেউ না চিনায় সে ভারতের পরিচয় দেয় কারণ ভারতকে সবাই চিনে। তারপর ভারতের দূতাবাসের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় যে সে ভারতের না বরং বাংলাদেশের। তারজন্য ঐ ব্যাক্তিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয় তারা। ঐ লোক এখন একটা বৃদ্ধাশ্রমে আছে। আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় 25 মে, 1972। "
. গল্প দুইটা কেমন লাগলো!!
-সমস্যা কি আপনার? আমার ইচ্ছা হইছে আমি ময়মনসিংহ বলবো এতে আপনার কি? তাছাড়া, ময়মনসিংহ আমার বিভাগ কিন্তু ভারতের অংশ বাংলাদেশ না। ময়মনসিংহ বল্লে কেউ আমাকে এখান থেকে বের করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। গল্প বলবেন ভালো কথা কিন্তু এইরকম অমিলের গল্প বলতে যাইয়েন না।
-গল্পটাতে কি কোন ভুল ছিলো নাকি!! আচ্ছা যাইহোক, ভুল হইয়া গেলে তো সমস্যাই। তাইলে আরেকটা বলি কেমন?
-থাক থাক আর বলতে হবে না। এইসব বাদ দেন। আপনার এইসব গল্প শুনলে আমি আর এখানে থাকতে পারবো না। আমাকে নিশ্চিত পাবনা যাইতে হবে।
-পাবনা গিয়ে লাভ নাই!! পাবনা যাইতে হবে না। পাবনা গেলে তো আর আপনাকে ক্লাসরুমে পাবো না। একটা কথা জিজ্ঞাস করবো?
-জ্বি করেন।
-আপনি কি সেকেন্ড টাইম না ফার্স্ট টাইম??
-দুইটাই বলতে পারেন। কারণ এইচএসসি 15,16 দুইবার দিছি। ভার্সিটি পরীক্ষা 15 তে শুধু ঢাবি তেই দিছিলাম। তবে এই ভার্সিটির জন্য কিন্তু ফার্স্ট টাইম। আপনি কি ফার্স্ট টাইম?
-আরে না। আপনার কাহিনীই আমার কাহিনী। আপনার এসএসসি এবং এইচএসসি র ব্যাকগ্রাউন্ড কি ছিলো?
-সাইন্স আছিলো। আপনার?
-আমি জন্মের পর থাইকাই পিউর কমার্স।
-জন্মের পর থাইকা!! তারমানে জন্ম হওয়ার সাথে সাথেই ক্লাস ৯ এ ভর্তি হইছিলেন??
-আরে না, আমি বলতে চাইছি ক্লাস 9 থেকেই আমি কমার্সে। সাইন্সের স্টুডেন্টের এই এক সমস্যা তারা একটু বেশিই বুঝে।
-তারা বেশি বুঝে না বরং তারা ভুলগুলো ধরে ফেলে।
-এত জ্ঞানী হইয়া তো আর লাভ নাই। কারণ এখন তো আপনিও বিবিএর স্টুডেন্ট।
-হুম্ম,,তাই তো দেখতাছি।
-আসছেন কোথায় থেকে? ময়মনসিংহ!!
-হুম্ম,,ময়মনসিংহ ছিলাম। ঐখান থেকেই আসছি।
-ভালো। নেত্রকোণা থেকে তো আর বাস নাই। আসলে তো ময়মনসিংহ থেকেই আসতে হয়।
.
. মিলি কিছু একটা বলতে চাইছিলো কিন্তু আর বলা হয়ে উঠে নাই। কারণ এখন তার সিরিয়াল এসে গেছে। মিলি ভর্তি হওয়ার পরে সাদীকে শুধু বল্লো, " বাই, ক্লাসে দেখা হবে। " সাদীর মনে হয়, মেয়েটার প্রতি কিছুটা দূর্বলতা সৃষ্টি হয়ে গেছিলো তাই তার কিছুটা খারাপ লাগলো। তাছাড়া বর্তমান ডিজিটাল যুগের নির্দেশন স্বরূপ সে মিলির মোবাইল নাম্বার বা ফেসবুক আইডি কিছুই রাখতে পারে নাই। কিন্তু ক্লাসে তো দেখা হবেই এই আশায় সে আর তেমন দুঃখ অনুভব করে নাই। সেও ভর্তি হয়ে তার বাড়িতে চলে আসলো। সে এখন পাবলিক ভার্সিটির স্টুডেন্ট তাই সে এখন অনেক আনন্দে আছে।
.
একদিন সকালে তার পরিচিত এক ভাইকে বল্লো যে সে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইছে। তখন হঠাৎ করে উল্কাপিন্ডের মতো এক লোক আবির্ভূত হইয়া বল্লো, আমার মেয়েও তো চান্স পাইছে। তুমি একটু বসো তোমার সাথে আমার আলাপ আছে। ঐ লোককে তখন সে তাদের বাসায় নিয়ে গেলো এবং তার আব্বা-আম্মার সাথেও ঐ লোক কথা বল্লো। উনি উনার মেয়ের যাতায়াত নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন। ভর্তি হওয়ার সময় ময়মনসিংহ এর আরেক ছেলের সাথে উনি উনার মেয়েকে দিছিলেন। তাছাড়া, ঐ লোক এবং সাদীর আব্বা র মধ্যে একটা পারিবারিক যোগসূত্র ছিলো যা কথা বলার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ঐ লোক সাদীর নাম্বার নেয় এবং বলে শুভেচ্ছা ক্লাসের আগে সাদীর সাথেই উনার মেয়েকে দিবে। এইটা নিয়ে তার একটু খারাপ লাগা ছিলো কারণ মিলির প্রতি তার একটু ভালোবাসা তৈরি হইছিলো। কিন্তু যাইতে হইবো আরেক মেয়ের সাথে। তবে সে এই আশাও করতেছিলো যেন ঐ মেয়েটা মিলিই হয়। কারণ, মিলির বাড়ি আর ঐ মেয়ের বাড়ি এক জেলায় এবং দুইজনই একই ইউনিটে। কিন্তু ঐ লোক মেয়ের নাম আরেকটা বল্লো। যেহেতু, তার মাথায় মিলির কথা ঘুরতেছিলো তাই সে ঐ মেয়ের নাম ভুইল্লা গেলো।
.
পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী সে বাসস্ট্যান্ডে উপস্থিত হলো। বাসস্ট্যান্ডে উপস্থিত হয়ে সে মিলি কে খুঁজতেছিলো। কিছুক্ষণ ঐ লোক এবং মিলি রিকশা থেকে নামলো। সে তো পুরাই হতবাক যে মিলি ই ঐ লোকের মেয়ে। তার এতকিছু চিন্তা করার সময় নেই। সে মিলিকে পাইছে এইটাই বড় কথা। বাস ছাড়ার আগে আগেই তারা বাসে উঠলো। সাদীর ইচ্ছা ছিলো জানালার পাশে বসার কিন্তু এইটা আর হয়ে উঠে নাই। কারণ মিলি বাসে উঠেই বলে ফেল্লো যে সেই জানালার পাশে বসবে। কিছুই করার ছিলো না সাদীর।নিজের হৃৎপিন্ডের চালচলনের উপরে সে বন্ধী ছিলো। বাস ছাড়ার পর সে তার স্বভাবসুলভ একটা ছবি তুলে ফেসবুকে দিতে চায়!! তার ইচ্ছা ছিলো মিলিকে নিয়ে একটা সেলফি তুলে তা ফেসবুকে পোস্ট করবে। কিন্তু -
-আরে বাবা, না করলাম তো আমি ছবি তুলবো না।
-আরে ছবি তুল্লে সমস্যা কোথায়?? একটাই তো তুলবো!
-সমস্যা আছে। কারণ ছবি তুলেই তুমি তা ফেসবুকে দিবে এবং তোমার ফ্রেন্ডরা আমাকে তোমার সাথে জড়িয়ে অনেক কথা বলবে।
-ওহ, তাই!! ফেসবুকে কি তুমি তোমার পিক দেও নাই নাকি???
-কবে দিলাম?? আমার পিক তো ফেসবুকে নাই।
-কিভাবে বিশ্বাস করবো!!
-হুম্ম,, বুঝতে পারছি। আমার আইডির নাম জানতে চাইতাছো। এইটা সরাসরি বল্লেই তো পারো।
-যেহেতু বুঝতে পারছো সুতরাং দিয়ে দাও।
-আচ্ছা।
.
আইডি শেয়ার করার মাধ্যমে একজন আরেকজনের সাথে ফেসবুকে কানেক্টেড হইয়া গেলো। সাদী আর কোন পিক না তুলেই শুধু ট্রাভেলিং টু দিনাজপুর দিয়া দিলো। বাসে উঠলে সাদীর প্রচুর ঘুম পায়। কিন্তু আজকে অনেকক্ষণ হইলো সে ঘুমাইতাছে না। কারণ তার সাথে তার অতিপ্রিয় একজন মানুষ বসা। সে কিভাবে ঘুমাবে??? মিলিকে সে কিছুক্ষণ পরপর খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতাছে সে কি করে না করে ইত্যাদি। মেয়েটার মধ্যে বোধহয় রসের বড়ই অভাব। কারণ সাদীর মতো এইরকম একটা হ্যান্ডসাম ছেলে তার সাথে বসা কিন্তু সে দিকে কোন খেয়াল না করেই ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে পড়া শুরু করে দিলো। সাদীও কোন কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ যাওয়ার পরে সাদী ঘুমিয়ে পড়লো। সাদী ঘুমের ঘোরে মিলির কাধে তার মাথা এলিয়ে দিলো। মিলি রাগতস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
-জীবনে কি কোনদিন বাসে উঠো নাই নাকি??
-কেন কি হইছে! আস্তে কথা বলো। বাসের অন্যযাত্রী রা কি বলবে?
-রাখো তোমার অন্যযাত্রী। যা জিজ্ঞাস করছি তাই বলো।
-বাসে উঠবো কেন!!! ছোট থাইকাই বাসের ভিতরেই থাকি।
-এই কারণেই এই সমস্যা। ঘুমাইবা ভালো কথা কিন্তু কাধ আমার এইদিকে আসলে খবর আছে কিন্তু।
-আচ্ছা আর আসবে না।
সাদীর লালিত ইচ্ছা তখনই শেষ হয়ে গেলো কারণ সামান্য কাধে মাথা ভুলে লাগায় যা করছে। সে আরো চিন্তা করছিলো তার ভালোবাসার কথা বলবে কিন্তু মিলির এই অবস্থা দেখে ভালোবাসার কথা বলার ইচ্ছাই চলে গেছে তার হয়তো ভয়ের কারণে।
.
কিছুক্ষণ পরে মিলির চেহারা ফ্যাকাশে হওয়া শুরু হইলো। সে সাদীকে বল্লো, "আমার বমি বমি আসতাছে তাড়াতাড়ি পলিথিন আনো।"
সাদী বাসের কন্টেক্টার এর কাছ থাইকা পলিথিন নিয়ে মিলি কে দেওয়া মাত্রই সে গড়গড় করে বমি করা শুরু করে দিলো। বমির কিছু ছিটেফোঁটা সাদীর শরীরেও লাগলো। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারলো না যদিও রাগে তার মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালাস একেবারে টগবগ করতেছিলো। বমি করার পর সে মোটামুটি স্বাভাবিক হইলো। তখন আস্তে আস্তে সাদীর মুখ খোলা শুরু হইলো।
-কি!! আমি জীবনেও বাসে উঠি নাই তাই বাসে ঘুমাই। আর তুমি তো বাসের অনেক নামীদামী যাত্রী তাই বমি করো।
- তুমি কি আমাকে অপমান করতেছো!! এমনে বলো কেন? আমি কি ইচ্ছা করে বমি করছি নাকি!!!
-না,, তুমি বমি করে আমার কাপড় ছ্যাদাব্যাধা কইরা দিছো আবার এইটাতে তোমার কোন দোষ নাই। কিন্তু আমি সামান্য একটু ঘুমাইয়া তোমার কাধে হেলান দিলাম তাতেই যত দোষ!!!
-বুঝতে পারছি তো। আমার ভুল হইছে তোমাকে তখন ঐভাবে বলা। যাও আমি দুঃখিত, আমাকে মাফ করো এখন!!!
-ফ্রিতে কি মাফ করা যায়??
-তাইলে কি চাও??
-ট্রিট দিতে হবে। (সাদী আর কিছু পারুক আর না পারুক এই ট্রিট অন্যের কাছ থাইকা খুব সুন্দর করে আদায় করে নিতে পারে।)
-কিসের ট্রিট??
-এখন আমাকে খাওয়াতে হবে।
-কি খাওয়াবো?
-এত কথা বলে লাভ নাই। যখন বাস বিরতি দিবে তখন দেখা যাবে!!
.
সাদী কে দেখে পটকা মনে হইলেও সে অনেক খেতে পারে। সাদী শুধু একাই প্রায় 642 টাকা বিল তুলে ফেলেছিলো। যা দেখে মিলি হতবাক। সে যে আসলেই অনেক বড় ভুল করেছিলো তা তখন বুঝতে পারছিলো। খাওয়া শেষ করে সে আনন্দের ঢেঁকুর তুলতে তুলতে যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হচ্ছিলো তখন পাশের দোকান থেকে দুই টাকা দিয়ে দুইটা চকলেট কিনে নিয়ে আসে। বাসে উঠে মিলি চুপচাপ সে প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে গেছিলো। তখন তাদের এই নীরবতা ভঙ্গ করে সাদী মিলিকে একটা চকলেট দেয়। মিলি বেশিকিছু না বলে সাদীকে শুধু একটা ধন্যবাদ দেয় এবং চকলেট টা গলাধঃকরণ করে। সাদী সম্পূর্ণ বিস্মিত হয়ে পড়ে। কিন্তু সেও আর ঐ বিষয়ে আর কিছুই বলে না।
এভাবেই তাদের ঐদিনের বাস ভ্রমণ শেষ হয়ে যায়।
.
ভার্সিটিতে যথারীতি তাদের ক্লাস শুরু হয়। সাদী এবং মিলি তারা পাশাপাশি বসে। একসাথে ক্লাসের পরে ক্যাফেটেরিয়া তে যায়। সাদী লাইব্রেরী তে যেতে না চাইলেও মিলির কারণে প্রতিদিনই তাকে লাইব্রেরী তে যেতে হয়। রাত 12 টা বাজতেই মিলি ফোন দিয়ে বলবে ঘুমানোর জন্য। তাছাড়া সকাল ঠিক 6.30 এ ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙ্গাবে। সাদীর একটা বদভ্যাস আছে আর তা হলো সে বেশিরভাগ সময়ই ব্রাশ করে না। এরজন্যও মিলি সাদীকে অনেক ঝাড়ি দেয়। সাদী যেহেতু সবকিছুই বেশি বুঝে তাই মিলির সাথে তার প্রচুর কথা কাটাকাটি হয়। তাদের ভার্সিটির ক্যাম্পাসটা খুবই সুন্দর। তাদের ক্যাম্পাসের ভিতরেই একটা ছোটখাটো লিচু বাগান আছে। তারা এই লিচু বাগানেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। তাদের মধ্যে অনেক বিষয়েই আলাপ-আলোচনা হয়। এইসবের মধ্যে তাদের ভালোলাগা, পছন্দের বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত থাকে। সাদী আগে প্রচুর কথা বলতো কিন্তু মিলির কল্যাণে এখন সে আগের তুলনায় কথা কিছু কম বলে। মিলি, সাদীর রাতের ঘুম থেকে শুরু করে আবারো ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যতটুকু সময় সে জাগ্রত থাকে তার সবটুকু সময়ই মনিটরিং করে। সে পড়তে বসলো কিনা, খাওয়া খেলো কিনা, গোসল করলো কিনা!! কোন লেকচার তুলতে না পারলে মিলি নিজেই আবার সে লেকচার তাকে লিখে দেওয়ার পাশাপাশি বুঝিয়েও দেয়। সাদীর প্রতি মিলির এত আগ্রহ থেকে সাদী ধরেই নিছিলো যে মিলি তাকে খুবই ভালোবাসে। সামনে তাদের নবীনবরণ তাই সাদীর ইচ্ছা ঐদিনই তার মনের কথা মিলিকে বলবে সে।
.
দেখতে দেখতে তাদের নবীনবরণ এসে পড়ে। সাদী, মিলিকে কি দিবে তা নিয়ে খুবই চিন্তিত। অনেক চিন্তাভাবনা করে 400 টাকা দিয়ে একটা চকলেট বক্স কিনলো এবং 600 টাকা দিয়ে একটা পারফিউম কিনে নিয়ে আসে। নবীনবরণ এর দিন সাদী সদ্য কিনা একটা সবুজ রঙ্গের পাঞ্জাবী পড়ে যায়। তারা মাকাঝাকা চুলগুলো কে একটু স্টাইল করে কাটছাঁট করে। সে যেহেতু ভার্সিটির হলেই থাকে তাই সে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই চলে আসে। এসে মিলিকে খুঁজতে থাকে। মিলি কিছুক্ষণ পরে আসে। মিলিকে দেখে তো সাদীর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। মিলিও একটা সবুজ শাড়ি পড়েছিলো। তার উপরে সাদা ও কমলা রঙ্গের মিশ্রিত একটা হিজাব ব্যবহার করেছিলো। সাদী যদিও কোনদিন পরী দেখে নাই কিন্তু মিলিকেই তার কাছে পরী মনে হইতেছিলো। মিলি সাদীর সামনে এসে দাড়ায় এবং কথা বলা শুরু করে।
-দোস্ত,তোকে তো অনেক সুন্দর লাগতাছে আজকে। উন্নতি হইছে দেখা যায় তোর।
-কি বলোস এইসব। তোকে তো অনেক সুন্দর লাগতাছে। একদম পরীর মতো।
-সত্যি বলতাছস!!! আজকে তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
-কি সারপ্রাইজ?? তাড়াতাড়ি দে। ( সাদী উদগ্রীব হয়ে ছিলো কারণ সে মনে করছিলো মিলি তাকে ভালোবাসার কথা বলবে।)
-এত অধৈর্য হইলে কিভাবে হবে!! অপেক্ষা করো কিছুক্ষণ।
-আইচ্ছা,, অপেক্ষা করতাছি তবে বেশিক্ষণ পারতাম না। যা করবি খুব দ্রুত কর।
. মিলি তাকে দাড় করিয়ে রেখে একটু দূরে চলে যায় ফোনে কথা বলার জন্য। কথা বলে আসার পরে সাদীকে নিয়ে ক্যাফেটেরিয়া তে যায়। ক্যাফেটেরিয়া তে তারা দুইজন অনেকক্ষণ কোন কথাবার্তা ছাড়াই বসে ছিলো। প্রায় 8 মিনিট পরে মিলির ফোনে একটা কল আসে। এবং মিলি, সাদীকে বসিয়ে রেখে বাইরে যায়। ৩ মিনিট পরে আবার যখন সে ফিরে আসে তখন তার সাথে ছিলো তার 5 জন ফ্রেন্ড। তাদের মধ্যে ছিলো দিনাজপুর মেডিকেলের স্টুডেন্ট এবং হাবিপ্রবি র স্টুডেন্ট। মিলি সবার সাথে সাদীর পরিচয় করিয়ে দেয়। এবং বলে সাদী আজকে তাদের ট্রিট দিবে। এই কথা বলেই মিলি খাবারের অর্ডার দেয়। তখন সাদীর মুখটা দেখার মতো ছিলো। সে খাইতে পারতেছিলো না। তার গলবিল মনে হয় সংকুচিত হয়ে গেছিলো। মুখে কোন লালারস উৎপাদিত হইতেছিলো না। তারপরোও সে খাওয়ার অভিনয় করে গেলো। সবশেষে, তারা 9350 টাকা বিল তুল্লো। বিদায় মুহূর্তে মিলি বল্লো, " সন্ধ্যা সময় অবশ্যই মাগরীবের নামাজ পইরাই পড়তে বসবি কেমন!! আমি ওদের সাথে মেডিকেল কলেজে যাইতেছি। তারপরোও আমি কল দিবো চিন্তা করিস না। "
.
সাদী কিভাবে বিল দিবে সেই চিন্তা করতেছিলো। কারণ এখন মাসের শেষ পকেটের অবস্থাও খারাপ। তবুও বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিয়ে সে বিল মিটিয়ে চলে আসলো। মিলির জন্য কিনা গিফটগুলো সে সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিলো। সন্ধ্যার পরে নিজের স্বভাবসুলভ মিলি তাকে কয়েকবার ফোন দেয় এবং সে খাইছে কিনা, নামাজ পড়ছে কিনা, পড়া শেষ করছে কিনা। ইত্যাদি বিষয়গুলো জানে। এবং ঠিক 12 টায় সাদী তার সেই পরিচিত কন্ঠের "Good Night" শব্দটা শুনতে পায়। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই কারণ এতগুলা টাকা কিভাবে পরিশোধ করবে??? পরদিন মিলি তাকে জরুরী কি বলবে বলে ফোন দেয়। মিলি জানায় তার জন্য একটা প্রাইভেট ম্যানেজ করছে সে।
-কিরে দোস্ত!! তোর জন্য একটা প্রাইভেট ম্যানেজ করলাম। কি করবি এখন??
-না,, আমি এইসব প্রাইভেট ট্রাইভেট পড়াইতে পারুম না।
-তুমি কইলেই তো হবে না চান্দু। তোমাকে পড়াইতেই হবে। এই নাম্বার নেও ছাত্রের বাপের। আর কাল থেকে ঠিকঠাক মতো প্রাইভেট পড়াও।
সাদী কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু সাদীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মিলি তার হলে চলে যায়। সাদী আর কোন উপায় না দেখে ঠিক করে প্রাইভেট পড়াবে। প্রাইভেট পড়িয়ে সে তার বন্ধুদের কাছ থেকে যে টাকাগুলো ধার করেছিলো সেগুলো পরিশোধ করে ফেলে।
.
অন্যদিকে,, সাদীর পড়ার ব্যাপারে তার থাইকাও মিলি বেশি চিন্তাশীল। সে লেকচারের কোন অংশ না বুঝলে মিলি নিজেই বুঝিয়ে দেয়। তাকে লাইব্রেরী তে নিয়ে যায়। এখন আর তারা বাইরে সময় বেশি ব্যয় করে না। তারা তাদের বেশিরভাগ সময়ই এখন লাইব্রেরী তে কাটায়। যদিও সাদী যেতে চায় না তবু তাকে জোর করেই মিলি নিয়ে যায়। এভাবে তাদের দেখতে দেখতে অনার্স শেষ হয়ে যায়। তাদের দুইজনেরই রিজাল্ট ভালো হয়। মাস্টার্স এর পরীক্ষার রিজাল্টে দেখা যায় মিলি ফার্স্ট আর সাদী সেকেন্ড। ভার্সিটি থেকে মিলিকে চাকরীর জন্য অফার দেওয়া হয় কিন্তু সে তা ফিরিয়ে দেয়। তখন মিলি এবং তার স্যারদের ইচ্ছায় সাদীই ভার্সিটিতে যোগ দেয়। সে যেদিন প্রথম ভার্সিটিতে যোগ দিবে তার আগেরদিন মাগরীবের নামাজের কিছুক্ষণ পরে মিলি তাকে ফোন দেয়।
-দোস্ত,তুই কই? একটু ডিবক্সের সামনে আসবি প্লিজ।
-কিরে! তুই এভাবে কথা বলতাসিস কেন?
তোর কি কোন সমস্যা হইছে??
-না, তুই আগে আয়। তোর সাথে কথা আছে।
. সাদী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। সে দেখে মিলি দাঁড়িয়ে আছে। আজকেও মিলি একটা শাড়ি পড়ছে তবে কালারটা সে বুঝতে পারতেছিলো না। কারণ মোটামুটি অন্ধকার ছিলো জায়গাটা।
-কিরে এত জরুরী তলব। ঘটনা কি?
-তোরে একটা কথা বলতে চাইতাছি। প্লিজ না করবি না ক??
-আরে,বলেন ম্যাডাম বলেন। আপনি কোনদিন কিছু বলছেন আর আমি না করছি!!!
-তা করস নাই। তবে আজকের কথাটা একটু ভিন্ন।
-আরে রাখ তোর ভিন্ন। তুই আগে বল।
-দোস্ত, আমি!! আমি না তোকে খুবই ভালোবাসি বলেই সে সাদী কে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়।
. সাদী কি বলবে তা বুঝতেছিলো না। সাদী, মিলিকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেস্টা করে কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার আগেই সে নিজেও কেঁদে ফেলে। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর তারা স্বাভাবিক হয়। মিলি, সাদীকে একটা সবুজ পাঞ্জাবী দিয়ে বলে, " তুই কালকে এই পাঞ্জাবীটা পড়ে তোর চাকরীতে যোগ দিবি। আমাকে কথা দে!!! "
-আচ্ছা কথা দিলাম। কিন্তু এই এতদিন পরে এই কথা বল্লি কেন?
-আমি তো প্রথম দিনই বুঝতে পারছিলাম তুই আমাকে ভালোবাসোস। কিন্তু তুই যেহেতু বলতে পারস না তাই আমিই বল্লাম।
-তা ঠিক তবে আগে বলতি।
-আগে বল্লে কি আর তুমি এই ভার্সিটির টিচার হইতে পারতা???
.
তাদের এই ভালোবাসার কথা তাদের পরিবারকে জানানো হয়। তখন তাদের দুই পরিবার মিলে খুবই ধুমধাম করে তাদের বিয়ের আয়োজন করে এবং তাদের বিয়ে হয়। বাসর রাতে সাদী একটা বক্স নিয়ে হাজির হয়। মিলি জিজ্ঞেস করে এই বক্সে কি আছে? তখন সাদী বক্সটা খুলে। আর বক্স খুলার সাথে সাথে সেখানে কয়েকটা শুকনো ডালিয়া,গোলাপ, একটা চকলেটের বক্স দেখা যায়। মিলি হাতে নিয়ে বুঝতে পারে এইগুলো একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের। তখন সাদী তার মুখ খুলে
-এইগুলো আমি তোমাকে দেওয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম নবীনবরণ এর দিন। কিন্তু আর দেওয়া হয়ে উঠেনি। আমি জানতাম ডালিয়া এবং গোলাপ তোমার প্রিয় ফুল এবং চকলেট খেতে তুমি খুবই পছন্দ করো। তাই আমার আশা আছিলো আমি যদি এইগুলো দিয়ে তোমাকে প্রপোজ করি তাইলে তুমি আমাকে ফেরাতে পারবে না।
-হইছে আর কথা বলতে হবে না। প্রথম প্রপোজ আমিই করছি তাও পাঞ্জাবী দিয়ে।
তোমার এইসব কথার কোন মূল্য নাই।
-হুম্ম এখন তো তাই ঠিক। আপনি তো আমার চকলেট ওয়াইফ!! আপনি যা বলবেন তাই সঠিক।
-এত পাম দিও না। পাম দিলে কিন্তু আবারো লাইব্রেরী র প্যারায় পড়তে হবে।
-দুর, এখন আর লাইব্রেরী কইত্তে আসলো!! এখন আর লাইব্রেরী নাই।
-ঘরকে লাইব্রেরী করে ফেলবো। তুমি কি কিন্তু আমার রাগ উঠাইতাছো।
-আচ্ছা কানে ধরতাছি। চকলেট বউ প্লিজ রাগ কইরো না প্লিজ।
-তোমার উপর কি আমি রাগ করে থাকতে পারি?? তুমি তো আমার পটকা বর। আমি যে তোমার অর্ধাঙ্গিনী।
. এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার তারা দুইজনই বাথরুমে চলে যায় এবং অজু করে ফিরে আসে। তারপর তারা দুই রাকাত নামাজ আদায় করে বিছানায় যাওয়া মাত্রই রুমের সব লাইট অফ হয়ে যায় এবং রুমে নিস্তব্ধতা এসে ভর করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন