বুধবার, ৩ মে, ২০১৭

বিবেকের বদলা

--এই ছাড়ো, জাহিদ দেখে ফেলবে তো।
--অফিসে যাওয়ার আগে বউকে একটু আদর করবোনা?
--জাহিদ অন্য রুমে থাকলে করতে, এখন করলে দেখে ফেলবে না?
--ধ্যাত, এমন জানলে বাচ্চাই নিতামনা।
--ওই, বাচ্চাকে নিয়ে কিছু বলবানা।
--থাকো তুমি তোমার বাচ্চাকে নিয়ে, আমি অফিসে গেলাম।
--সাবধানে যেও।
--আচ্ছা, বাই।
.
জান্নাত এবং জাকিরের বিয়ের দশবছর পূর্ণ হবে মাত্র পাঁচদিন পর। বিয়েটা হয়েছিলো পারিবারিকভাবে, তবে বিয়ের পর দুবছর পর্যন্ত দুজনের মধ্যে মতের মিলন হয়নি খুব একটা। কয়েকদিন পরপরই জাকিরকে নিয়ে মেয়ে সংঘটিত বিভিন্ন কাহিনী শুনতো। বিয়ের দুবছর পর ঝগড়া, অবহেলাকে উপেক্ষা করেই তাদের একমাত্র সন্তান জাহিদ পৃথিবীতে আসে। জাহিদকে কেন্দ্র করেই জাকির এবং জান্নাতের সম্পর্কে দৃঢ়তা আসে। সেই জাহিদেরই বয়স এখন আট, তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। জাহিদকে নিয়ে জান্নাত এবং জাকিরের সংসারটা চলছে ভালোবাসামাখা মুহূর্তগুলোকে সঙ্গী করেই।
.
রাতে জাকির বাসায় ফিরলো চোখে-মুখে কিছুটা বিষন্নতা নিয়ে। জান্নাত অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলো এর কারণ, কিন্তু বলেনি জাকির। জান্নাতের কথার কোন উত্তর না দিয়ে শুয়ে পড়ে জাকির। অতঃপর জান্নাত......
--আচ্ছা তোমার কি হয়েছে আমাকে একটু বলবা প্লিজ?
--হয়তো আমার চাকরিটা আর থাকবেনা।
--কেনো? কি হয়েছে?
--রিয়াদ স্যারের সাথে একটা অন্যায় করেছি।
--কি অন্যায় করেছো? আর তুমিতো সবসময়ই বলতে তোমার রিয়াদ স্যার তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
--হ্যাঁ, কিন্তু আমার চেয়েও অন্য একজনকে হাজারগুণ বেশি ভালোবাসে।
--কাকে?
--তোমার নামেরই একটা মেয়েকে।
--তুমি কি ওই মেয়ের সাথে কিছু করছো?
--ওই মেয়েকে চিনলে তো তার পায়ে পড়তাম গিয়ে।
--ধ্যাত, ঠিক করে বলনা কি হয়েছে?
--পরে বলবো, আগে স্যারকে একটা কল করে আবারো সরি বলে নিই, তুমি খাবার রেডি করো।
.
খাবার-দাবার শেষ করে জাকির এবং জান্নাত দুজনই শুয়ে আছে, পাশেই ঘুমিয়ে আছে জাহিদ। জান্নাত জাকিরকে বললো.....
--তোমার রিয়াদ স্যার কি বললো?
--কল পিক করেনি, হয়তো রেগে আছে।
--কেনো? কি করেছো তুমি?
--সবসময়ই স্যারের ব্যাগ থেকে লেপটপ কিংবা এটা-ওটা বের করতে গেলেই একটা ডায়রি দেখতাম। স্যার যেখানেই যায়, ব্যাগে করে সেটাও নিয়ে যায়। তাই খুব ইচ্ছে হলো ডায়রিটা পড়ার। অনেক চেষ্টার পর আজকে সুযোগ পেয়ে গেলাম। স্যার লাঞ্চের সময় ব্যাগটা নিয়ে গেলেও ভুল করে ডায়রিটা নেয়নি, আসলে আমরা কয়েকজন মিলেই যুক্তিকরে ডায়রিটা সরিয়ে রাখি। স্যার চলে যাওয়ার পর ডায়রিটা পড়ে অনেককিছু জানতে পারি।
.
--তোমার চাকরি কেনো যাবে বললেনাতো?
--ডায়রি টা পড়ার অপরাধেই চাকরি যাবে।
--কিহ? তুমিতো বলতে তোমার স্যার তোমাকে অনেক ভালোবাসে, একটা সামান্য ডায়রি পড়ার জন্য চাকরি যাবে সেটা কেমন কথা?
--ওইটা সামান্য ডায়রি নয়, অসামান্য ডায়রি।
--তবুও একটা মানুষের চেয়ে তো আর দামী নয়।
--দামী মানুষকে ঘিরেই যে তার ডায়রিটা।
--ভনিতা না করে কাহিনী টা বলো।
--স্যার জান্নাত নামের একটা মেয়েকে ভালোবাসে, খুব ভালোবাসে। ১২বছর আগে স্যারের সম্পর্ক ছিলো মেয়েটার সাথে, তখন দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসতো। আসলে স্যার মেয়েটাকে ভালোবেসেছিলো মেয়েটার সীমাহীন ভালোবাসা দেখেই। কিন্তু হঠাত করেই বদলে যায় মেয়েটা, স্যারের ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দেয়। স্যার অনেক চেষ্টা করেছিলো তাকে ফেরানোর, মেয়েটার পিছনে কুত্তার মতো ঘুরেছিলো। কিন্তু কোন লাভ হয়নি, মেয়েটা ফিরে আসেনি। শেষমেশ স্যারের ভালোবাসার প্রমাণ দেখতে চেয়েছে ওই নিষ্ঠুর মেয়েটা। প্রমাণস্বরূপ মেয়েটার সাথে যোগাযোগ করতে পারবেনা, মেয়েটার কথা কাউকে বলতে পারবেনা, মেয়েটার খোজ নিতে পারবেনা, শুধু দূর থেকে অজানাভাবে ভালোবেসে যেতে পারবে। স্যার মেয়েটিকে কথা দিয়েছিলো তাকে ছাড়া অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করবেনা। সব মিলিয়ে স্যার মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসে তার প্রমাণ দিয়েছে। এখনো মেয়েটাকে স্যার খুব ভালোবাসে, তাই এখনো বিয়ে করেনি, মেয়েটার কথা কাউকে বলেনা, মেয়েটার খোজ রাখেনা। শুধু কষ্ট কমানোর জন্য ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করে।
স্যারের লেখাগুলো পড়ে আমরা সবাই কেঁদে ফেলেছিলাম। এত্তো ভালোবাসার পরও যে মেয়েটা ভালোবাসা বুঝেনা, সে মেয়েটা মানুষনা, তাকে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া উচিত।
.
ততক্ষণে জাকিরের চোখে আবারো জল চলে আসে। জান্নাতও তার চোখের জল মুছতে মুছতেই বললো...
--আমার চোখেও পানি এসে গেছে। তোমার স্যার সত্যিই অনেক মহান মানুষ, খুব যত্ন করেই ভালোবাসতে পেরেছে, তবে বোকা মেয়েটা বুঝলো না। ওই বেয়াদব মেয়েটাকে সামনে পাইলে আমি একঘন্টা ধরেই থাপরাইতাম।
--আমি ওরে পাইলে তো একদম খুন করতাম.
.
--আচ্ছা জাকির, তুমি আমাকে তোমার স্যারের মতো ভালবাসো?
--যদি সত্যি বলি, তাহলে উত্তরটা "না" হবে। আসলে সবাই এতোটা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারেনা। কাউকে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা এবং কষ্ট পেয়েও তাকেই ভালোবাসার মাঝে পার্থক্যটা আকাশসম।
--হুম, সেটা ঠিক। আচ্ছা তোমার স্যার ওই বেয়াদব মেয়েটার জন্য কেনো নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে?
--চুপ, আর এইভাবে বলোনা। আমরা ডায়রিটা পড়ার পর স্যারকে সবকিছু জানাই এবং বোঝানোর জন্য এই কথাটা বলার পরই স্যার অনেক বেশি রেগে যায়। স্যারের মতে যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে খারাপ ভাবা যায়না।
--হুম, সত্যিই তোমার স্যার একটা পাগল, পাগলের মতোই এখনো ভালোবাসে মেয়েটাকে। তবে আফসোস সেই বোকা মেয়েটার জন্য, যে বুঝলোনা ভালোবাসা।
--হুম, মেয়েটা আসলেই অনেক বোকা। জানিনা মেয়েটা এখন কোথায় আছে, তবে সুখী হতে পেরেছে কিনা সন্দেহ।
--আচ্ছা জাকির, স্যারের রাগ কমলে আমাদের দশম বিবাহবার্ষিকীতে স্যারকে ইনভাইট করো।
--আমিও তাই ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু ডায়রিটা পড়ার পরই সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেলো। তবুও চেষ্টা করবো।
.
পরেরদিন জাকির এবং অন্য সবাইমিলে রিয়াদ স্যারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। সবার সম্মিলিত আবদার নাকোচ করার মতো এতো শক্ত মানুষ রিয়াদ স্যার নয়, তাই ক্ষমা করেই দেয়। তবে আদেশ এবং অনুরোধ করে যেনো ডায়রির লেখাগুলো না পড়ে, কারন জান্নাত নামের মেয়েটা চেয়েছিলো তার কথা অন্য কাউকে না জানাতে।
সব মেনে নেয় জাকির এবং তার কলিগরা। অতঃপর স্যারকে সহ অন্য সব কলিগকে জাকির-জান্নাতের দশম বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা হয়। স্যার প্রথমে রাজি না হলেও অন্য সব কলিগদের অনুরোধে রাজি হতে হয়।
.
অফিস তাড়াতাড়ি শেষ করে সন্ধ্যার মধ্যেই সবাই চলে আসে জাকিরের বাসায়। রিয়াদ স্যারও আসে আটটার কাটা অতিক্রম করার আগেই। অফিসের সবাই জাকিরের বউয়ের সাথে এসেই পরিচিত হয়েছে, কিন্তু জাকিরের বউয়ের স্পেশাল মেহমান রিয়াদ স্যারের সাথে পরিচয় হয়নি এখনো। জাকির জাহিদকে কোলে করে এসে রিয়াদকে বললো, "স্যার, এই আমার ছেলে জাহিদ, ক্লাস থ্রিতে পড়ে।"
রিয়াদ জাহিদের সাথে কিছুক্ষণ দুষ্টামি করলো আর এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলো জাহিদকে। কিছুক্ষণ পর জাহিদকে খুঁজতে আসে জাকিরের বউ, তখন জাকির রিয়াদ স্যারের সাথে তার বউয়ের পরিচয় করিয়ে দেয়। রিয়াদ জাকিরের বউয়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়, নিশ্চুপ হয়ে বসে পড়ে তত্ক্ষণাত্। কারন জাকিরের বউই যে রিয়াদের ভালোবাসার মানুষ, জান্নাত। কিন্তু জান্নাত এতটাই স্মৃতিহারা হয়েছে যে, সে চিনতেই পারেনি তার প্রেমের পাগলটাকে৷ অতঃপর অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য খুব একটা কথা না বলে চলে যায় জান্নাত, তবে অনুষ্ঠান শেষে আড্ডার দাওয়াত দিয়েই গেছিলো রিয়াদ স্যারকে।
.
কেক কাটা হলো, আনন্দ মাস্তি খুব একটা হওয়ার আগেই খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শুরু হয়ে গেলো। অনুষ্ঠানের সব আলোই রিয়াদ স্যারকে ঘিরে, সব আয়োজনই স্যারকে কেন্দ্র করে। তাই চোখের জলকে বের হতে দিচ্ছেনা রিয়াদ, টলমলকৃত জলগুলোও স্বাধীনতা পাচ্ছেনা। রিয়াদ স্যার খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাসায় ফেরার তাগিদ দেখালেও কাজ হয়নি অন্য সবার জন্য। কারন একটা আড্ডার আয়োজন করা হয়েছিলো ভালোবাসার গল্প নিয়ে। জান্নাত তখনও চিনতে পারেনি রিয়াদকে, জানেইনা স্যারের গল্পের নায়িকা সে নিজেই।
.
সবাই অন্যসব কাজ শেষ করে রিয়াদ স্যারকে ঘিরেই বসলো। জাকির এবং জান্নাত স্যারের সামনে, জান্নাতের খুব রিকুয়েস্ট ছিলো স্যারের ভালোবাসাময় গল্পটা প্রকাশ করার। হয়তো জান্নাত ছাড়া অন্যকেউ এই কথাটা বললে রেগে যেতো রিয়াদ, তবে না রাগলেও না বলার জন্য বিনীত অনুরোধ করেছে সবার কাছে। স্যারের চোখে পানি দেখে সবাই চুপ, আবারো সবাই স্যারের ভালোবাসাকে সম্মান প্রদর্শন করলো এবং ভালোবাসার গল্পকে আড্ডার বিষয় থেকে বিচ্যুতি দেয়া হলো। অতঃপর এই কথা সেই কথায় জমিয়ে আড্ডা হচ্ছিলো স্যারের মন ভালো করার জন্য। কিন্তু স্যারের মন ভালো হওয়ার সব দরজা যে বন্ধ হয়ে গেছে কেউ তা জানেইনা।
.
আড্ডা শেষে জান্নাত রিয়াদ স্যারকে তার গ্রামের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলো, পাশ থেকে জাকির উত্তর দিলো, "আমাদের রামগঞ্জেই স্যারের বাড়ি।"
কৌতুহলী কণ্ঠে জান্নাত আবারো জিজ্ঞেস করলো, "রামগঞ্জ এর কোন গ্রাম?"
এবারো জাকিরই উত্তরটা দিলো, "পূর্ব ভাদুর"
এবার একদমই এক্সাইটেড হয়েই বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলো জান্নাত, তবে কোন উত্তর পায়নি। জান্নাত আবারো জিজ্ঞেস করলো, "স্যার আপনাদের কি বাড়ি বললেন না তো?"
তখন রিয়াদ বাধ্য হয়েই উত্তর দিলো, "বাড়ির কথা সবাইকে জানালে ডাকাতির ভয় থাকে, তাই জানাতে পারলাম না।"
উত্তরটা দিয়েই স্যার বাসায় ফেরার তাগিদে প্রস্থান করলো জাকিরের বাসা থেকে।
.
রিয়াদ স্যার চলে গেলেও অন্য সবাই বসে রইলো আড্ডায়। ওদের আড্ডা টা ছিলো রিয়াদ স্যারের ভালোবাসাকে ঘিরেই। একজন বলছে মেয়েটাকে পেলে মারবে, কাটবে, উষ্টাবে, হ্যান করবে, ত্যান করবে ইত্যাদি এবং অন্যজন বলছে মেয়েটাকে পেলে তার পায়ে ধরে হলেও স্যারের কাছে এনে দিবে। কথার একপর্যায়ে একজন তো মেয়েটাকে গালি দিয়ে বলেই ফেললো, "কু*র বাচ্চা, শু*র বাচ্চা, ভালোবাসা যদি না ই বুঝস, তাহলে কেনো স্যারের মনে ভালোবাসা জাগাইলি, কেনো স্যারকে শয়তান বর, পাগল বর বলে আপন করে দূরে ঠেলে দিলি?"
কথাটা শুনে একটা শক খেলো জান্নাত। অতঃপর জান্নাত রিয়াদ স্যারের গ্রামের বাড়ির নাম জানতে মরিয়া হয়ে উঠলো। একজন কলিগ স্যারের ফুল ডিটেলস জানতো, তাই সে জান্নাতকে উত্তর বলে দেয়।
.
আড্ডা শেষ করে একে একে সবাই ফিরে যায় যে যার পথে। জাকির এবং জান্নাতও সব ঠিকঠাক করে শুয়ে পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারেনি জান্নাত, জাকির কাছে ঘেঁষতে চাইলেও কাছে নেয়নি মন খারাপের ছলে। জান্নাত শুয়ে শুয়ে ভাবছে, "যে মেয়েটাকে পেলে আমি একঘন্টা ধরে, থাপরাইতাম, যে মেয়েটাকে আমার স্বামী খুন করতে চায়, যে মেয়েটাকে অফিসের সবাই খারাপ মেয়ে হিসেবে গালি দেয়, সেই মেয়েটাকেই রিয়াদ স্যার পাগলের মতো ভালোবাসে এবং আর সেই খারাপ মেয়েটাই আমি।"
.
পরদিন সকালে জাকির অফিসে যাওয়ার আগেই তার ফোন থেকে রিয়াদ স্যারের নাম্বার রেখে দেয় জান্নাত। অতঃপর একটা সময় জান্নাত রিয়াদ স্যারকে ভয়ে ভয়েই কল করে.....
--হ্যালো
--হ্যালো, কে বলছেন?
--আপনি কি আবির?
--নাহ, কল কেনো করেছেন?
--একটু কথা ছিলো ফারহান আবিরের সাথে।
--আর কোন কথা না থাকাটাই ভালো।
--আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
--নাহ, আর চিনতেও চাইনা। সুখে আছেন, সুখেই থাকেন।
--আর আপনি? আপনি কেনো বিয়ে না করে অসুখী হচ্ছেন?
--আমি একজনকে ভালোবাসি, আর আমার মতে ভালোবাসার অর্থ এটাই।
--ভুল অর্থ, ভালোবাসা মানে তো সুখে থাকা, সুখে রাখা।
--হয়তো। কিন্তু আমাকে সে সুখে রাখেনি, তাই আমি অসুখী। আর কল না দিলেই ভালো হবে৷ ভালো থাকবেন, বাই।
.
কলটা ইচ্ছে করে কেটেছে ঠিকই, কিন্তু এই মানুষটার সাথেই ঘণ্টার পর ঘন্টা কথা বলার অতৃপ্তিটা রয়ে গেছে রিয়াদের। চোখের জল তার প্রমাণও দিচ্ছে সঠিকভাবে, ওপাশে জান্নাতও ভেঙ্গে পড়েছে কান্নায়। কেউ তাকে এতো ভালোবাসে, কিন্তু না বুঝে তাকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে আজ নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে তার। তার কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে, তবে জাকির এবং জাহিদের অবাধ্য বাধাটা ডিঙ্গানোর ক্ষমতাও তার নেই। তাই চোখের জলেই মাশুল গুনছে সে।
.
জাকির এবং জান্নাতের সম্পর্কটা আগের মতো নেই, বদলে গেছে জান্নাত। সবসময় চুপচাপ থাকে সে, জাকিরের সাথেও খুব একটা কথা বলেনা। জান্নাতের এমন আচরণের কারনে সংসারে সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। জাকিরও আজকাল জান্নাতের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে, কারন জান্নাত ভালোভাবে কথা বলছেনা, জাহিদের দিকেও খুব একটা খেয়াল রাখছেনা। জান্নাত এমন করছে কিসের জন্য, তার নির্দিষ্ট কারণটাও জানতে পারেনি জাকির। সমস্যাটা একসময় প্রবল রূপ নেয়, ফলে ডিভোর্সের কথা চিন্তা করে জাকির।
.
বিয়ের এগারো বছরে জাহিদের মতো সুন্দর একটা সন্তানকে রেখেও ডিভোর্স দিতে হবে, এমনটা কখনো ভাবেনি জাকির। রিয়াদের কানে কথাটা যাওয়ার পরই রিয়াদ দেখা করে জাকির জান্নাতের সাথে। জান্নাত চোখের জলে ভাসছে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে। জাকিরের কাছ থেকে সব কাহিনী শুনে জান্নাতকে উদ্দেশ্য করেই বললো, "এমনটা কেনো করছেন?" অতঃপর জান্নাত উত্তর দিলো, "আমার জন্য একজনের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে, তাই তার প্রায়শ্চিত্ত করছি।"
কথাটা বলার পরেই জান্নাতের গালে কষে একটা থাপ্পড় দিয়ে রিয়াদ নিজেই কান্না শুরু করেছে। চোখের জলে ভাসতে ভাসতেই বললো.......
--জীবন নষ্ট হয়েছে একজনের, তাই বলে আরো দুজনের নষ্ট করবেন? জাকির তো আপনাকে ভালোবাসে, সে তো আপনার স্বামী, তাকে কেনো কষ্ট দিচ্ছেন? আর জাহিদের কি দোষ? সে তো এখনো আপনাকে ছাড়া চলতে শিখেনি, তাহলে কেনো এমন পাগলামী করছেন?
.
সবাই নিশ্চুপ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাত্ করেই জান্নাত এসে রিয়াদকে জড়িয়ে ধরলো আর কাঁদতে কাঁদতে! বললো.....
--পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন, আমি আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আপনার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি।
জান্নাতের এমন কাহিনী দেখে কারো বুঝতে বাকি নেই, রিয়াদ স্যার যে মেয়েটাকে এখনো পাগলের মতো ভালোবাসে, সে জান্নাতই হলো জাকিরের বউ জান্নাত।
অতঃপর রিয়াদ জান্নাতকে ছাড়িয়ে বললো, 
--"আমাকে আমার মতো থাকতে দেন, আমার যা হবার হয়ে গেছে। তবে জাহিদ, জাকিরকে কষ্ট না দিলে আমি একটু হলেও সুখী হবো। যদি ভাবেন আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন, তাহলে জাহিদ, জাকিরকে সুখী করলেই আমি আমার কষ্ট সেরে যাবে।"
.
সবকিছু বুঝে-শুনে জাকির চোখের জল মুছতে মুছতেই বললো.....
--"স্যার, আপনি চাইলে জান্নাতকে নিয়ে যেতে পারেন। হয়তো আপনার কাছে থাকলেই জান্নাত বেশি সুখী হবে, আপনিও সুখী হবেন৷ আর এইরকম কিছু হলেই আমরা খুশি হবো।"
তখন রিয়াদ বলতে বাধ্য হলো......
--আমি জান্নাতকে কখনো আমার করে পাওয়ার আশায় ভালোবাসিনি, শুধু তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ভালোবেসেছি। যদি সে কখনো আমাকে ভালোবেসে থাকে, তবেই আমার ভালোবাসা স্বার্থক এবং আমার কাছে ভালোবাসার মানে হলো এটাই।
তাছাড়া জান্নাত আমার কাছে থাকলে কেউ সুখী হতে পারবোনা, বরং জান্নাত যদি জাহিদ এবং তোমাকে নিয়ে আগের মতো করেই থাকে, তাহলে আমিও সুখী হবো।
.
রিয়াদের এমন মন্তব্যে জান্নাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো......
--"কাউকে কষ্ট দেয়ার বদলে কষ্ট পেতে হয়, সময় হয়তো অন্য কোন মানুষ দ্বারা কিংবা নিজ বিবেক দ্বারাই বদলা নেয়। তবে বিবেক দ্বারা কষ্ট পাওয়াটা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন শাস্তিস্বরূপ এবং এই কঠিন শাস্তিটাই আমি পাচ্ছি।
রিয়াদ স্যারের ভালোবাসা সম্পর্কে জানার পর থেকেই আমি মরণ যন্ত্রণায় ভুগছিলাম, খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো নিজেকে। জাহিদ-জাকির একপাশে এবং অন্যপাশে রিয়াদ স্যারের ভালোবাসা, কোনটা সঠিক বুঝতে পারছিলাম না, যার জন্য আজকের এই দিন দেখতে হলো। রিয়াদ স্যার যেহেতু বলছে আমি জাহিদ-জাকিরকে নিয়ে থাকলে তিনি খুশি হবেন, তাহলে আমি তাই করবো৷ কিন্তু শর্ত হলো তিনিও যেনো বিয়ে করে তার উজাড় করা ভালোবাসা দিয়ে বউকে ঘিরে রাখে, তাহলে আমিও কিছুটা স্বস্তি পাবো।"
.
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর রিয়াদ উত্তর দিলো......
--"আমি অন্য কাউকে উজাড় করে ভালোবাসতে পারবোনা, তাই কাউকে বিয়ে করে ঠকাতে চাইনা। তবে আমার মতে ভালোবাসা মানে সবসময় ভালোবাসার মানুষের জন্য মঙ্গল কামনা করা, যেনো সে যেখানেই থাকে, ভালো থাকে সবসময়। আমিও সেটাই চাই এবং আমি বিয়ে করলে যদি সে একটু স্বস্তি পায়, তাহলে তাই করবো৷
সুখে থাকুক প্রিয় মানুষটি।"
.
প্রকৃতপক্ষে এটাই বাস্তব যে, কাউকে কষ্ট দিয়ে সুখী হওয়া যায়না৷ হয়তো ক্ষণিকের জন্য সুখী হতে পারলেও একটা সময় অর্জিত সুখগুলোও অশান্তিতে রূপ নেয়৷ মানুষকর্তৃক কষ্ট না পেলেও বিবেকের আদালতে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন