বুধবার, ৩ মে, ২০১৭

নিজের বাড়ি

দেখতে দেখতে তিনটা বছর হয়ে গেছে।আজ আবারও শাহেদ তার অতি আদরের লক্ষ্মী বোন রিসার বাড়িতে যাচ্ছে।এই তিন বছরে অনেকবারই গিয়েছ ওর বাড়িতে।তবে আজকের দিনটা একটু বেশিই স্পেশাল।কারণ আজ রিসার জন্মদিন।আবার এই দিনেই রিসা বাবার বাড়ি ছেড়ে অন্যের বাড়িতে পাড়ি জমায়।যদিও এখন সেটা তারই বাড়ি।এখন পর্যন্ত কোনো জন্মদিনেই দুই ভাই বোন কখনো আলাদা হয়নি।যদিও তিন বছর আগের জন্মদিনটা ছিল একটু অন্যরকমই।কারণ ঐ দিনেই সব থেকে প্রিয় ভাইয়াটাকে ছেড়ে আসতে হয় রিসার।
..
রিসা আইসক্রিম,চকলেট খুব পছন্দ করতো।শাহেদ অনেকগুলো চকলেট আর আইসক্রিম নিলো সাথে।ছুটে চলছে তার আদরের বোনটার কাছে।আর তার মনে পড়ে যাচ্ছে বোনের সাথে কাটানো পুরোনো স্মৃতিগগুলো।
..
..
রিসা শাহেদের থেকে চার বছরের ছোট।তবে বয়সের ব্যবধানটা ভাই বোনের ভিতর কখনোই ফুটে ওঠেনা।আর এর ব্যতিক্রম তাদের বেলায়ও হয়নি।সারাক্ষণ মারামারি করতেই থাকতো।আবার একজন একটু চোখের আড়াল হলেই অন্যজন পাগল হয়ে যেত।একবার শাহেদ মামা বাড়ি গিয়েছিল অার রিসা বাড়িতে ছিল।আর তাতেই রিসা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল।দুই দিন জ্বরে বেহুস হয়ে ছিল।ভাই বোনের এ ভালোবাসা ছিল অতুলনীয়।কেও একজন অসুস্থ হলে আর একজনের যেন আরো বেশি কষ্ট হয়।সেবার রিসা অসুস্থ হলে শাহেদ সারা রাত তার পাশে বসে ছিল।আর কেঁদেছিল।তাদের দুটি দেহ কিন্তু প্রাণ ছিল একটা।
..
..
আর জন্মদিন আসলে ২জনের চোখে আর ঘুম আসতো না।কি গিফ্ট দেবে।কি খাবে।কোথায় যাবে।প্লানের যেন আর শেষ হয়না।
..
..
এসব কথা ভাবতেই শাহেদের মুখের কোণে হাসি জমতে থাকলো।হয়তো কোনো বোকামির কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে।মনে পড়ে যাচ্ছে দুজনে মারামারি করে কান্না করার কথা।তারপর দুজনেই আম্মুর হাতে মার খাওয়ার কথা।কত কথাই তো মনে পড়ে।কিন্তু অতীত তো আর ফিরে পাওয়া যায়না।সবই এখন স্মৃতি।
..
..
রিসার বাড়ির কাছাকাছি চলে আসলো শাহেদ।দূর থেকেই ওর বাড়িটা দেখা যাচ্ছে।অনেক ছোট।একটা ইটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা।তিন বছর আগে এই বাড়িতে আসে রিসা।সব বন্ধন ছিড়ে চলে আসতে হয়।এটাই তো নিয়ম।
..
শাহেদ আবার হারিয়ে গেল তিন বছর আগের সেই দিনটাতে।
..
..
সেদিন ছিল রিসার ১৭তম জন্মদিন।পুরো বাড়িতে রঙ বেরঙের বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছিল।আত্নীয়স্বজনদে­র বলার মতো অনুষ্ঠান ছিলনা।তাই নিজেরাই সবাই ছিল।সেদিন রিসার প্রিয় খাবার গুলো রান্না করা হয়েছিল।শাহেদ বাজারে গিয়েছিল ওর চকলেট আর আইসক্রিম আনতে।ওটা না হলে রিসার চলবেইনা।আর সকলের জন্মদিনেই ওদের আম্মু পায়েস তৈরী করবেই।সব কিছু তৈরী হয়ে গিয়েছিল।শুধু পায়েস রান্না হচ্ছিল।আর কিছুক্ষণ লাগবে হয়ত।এমন সময় রিসাকে ওর আম্মু বললো একটু রান্না ঘরে দিয়ে পায়েসটা দেখতে।উনি ততক্ষণে বাইরের দিকটা গুছিয়ে নেবে।রিসা রান্না ঘরে গেল।
..
২মিনিট পর
..
হঠাৎই একটা বিকট শব্দ।মনে হলো কোনো কিছু ফেটে গেছে।কেও কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখতে পেলো রান্না ঘর থেকে দাও দাও করে আগুন জ্বলছে।কারো বুঝতে পাকি রইলোনা যে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটেই এটা ঘটেছে।চারিদিক থেকে মানুষজন ছুটে এলো।সকলের সহযোগীতায় আগুন নেভানো হলো।বের করে আনা হলো রিসার ঝলসে যাওয়া শরীরটা।তাকানোর মতো ছিলনা।কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো।
ততক্ষণে চকলেট, আইসক্রিম নিয়ে চলে এসেছে শাহেদ।একটি বারের জন্য আদোরের বোনটার ঝলসানো মুখটা দেখতে পেল।কিন্ত ও বিশ্বাস করতে চাইনা যে এই তার বোন।চিৎকার করে বলতে লাগল
--আমি বিশ্বাস করিনা।এ আমার পাগলি রিসা না।আমার রিসার মুখটা এতো কালো নয়।ওর মুখটা অনেক সুন্দর ছিল।ও আম্মু, অাম্মু।তুমি বলোনা এ আমার রিসা হতে পারেনা মা।প্লিজ একবার বলো মা।তোমরা কেও বলোনা কেন।কি হইছে তোমাদের।আচ্ছা থাক আমি আমার বোনকে ডেকে নিচ্ছি।ও বোন,বোন.কই তুই।তোর চকলেট নিবিনা।দেখ কত চকলেট আনছি।আইসক্রিম ও আনছি।কি হলো কই তুই।আই।নাহলে আমি চলে যাবো কিন্তু।
..
কিন্তু কোনো ডাকে আর সাড়া পেলোনা শাহেদ।তখন তার চিৎকারে যে আকাশ ভারী হয়ে যাচ্ছিল।এদিকে শাহেদের আম্মু সেই প্রথম থেকেই নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে রইল।তারপর থেকে আর কখনো কথা বলেনি।হয়তো সেদিন সে রিসাকে ওখানে না পাঠালে এটা হতোনা।সেই কষ্টে সে আর কথা বলেনি।
..
..
রিসা সেদিন আদোরের ভাইয়াকে ছেড়ে চলে অাসে অন্য এক বাড়িতে।সম্পূর্ণই ভিন্ন সে বাড়ি,ভিন্ন সে জগৎ।যে বাড়ি থেকে আর কোনো দিন ফিরে যেতে পারবেনা ভাইয়ার কাছে।কখনো বলতে পারবেনা ভাইয়া,আইসক্রিম খাবো।এনে দেনা প্লিজ।কিন্তু শাহেদ মনে করে আজও রিসা ওর কাছে আইসক্রিম এনে দিতে বলে।আবার ভাবে, নাহ হয়ত ওই বাড়িতেও কোনো ভাইয়াকে পেয়েছে যে ওকে চকলেট আইসক্রিম এনে দেয়।তবুও যখনই শাহেদ ছোট বোনের কবরটা একবার দেখতে আসে তখনই নিয়ে আসে অনেক চকলেট,আইসক্রিম।
আজও সে ভুল করনি।
.
হাটতে হাটতে এগিয়ে গেল পাচিল দেওয়া কবরটার কাছে।তারপর মাথার কাছে গিয়ে কবরের ওপর রেখে দিল আইসক্রিম আর চকলেটগুলো।
--আজ তোর জন্মদিনরে,বোন।কোথায় রে তুই।তোর জন্য আনছি এগুলো রে বোন।তোর তো আমাকে মনেই নেই।নিশ্চয় নতুন ভাইয়া কে পাইছিস।কিন্তু আমি তো তোকে আর পেলাম নারে।আমাকে একটু তোর কাছে নিবি।নে না রে।অনেক চকলেট দেবো তাইলে।জানিস কিছুদিন পর আমার বিয়ে।তোর ভাবি আসবে।তুই তো বলেছিলি যে আমার বিয়েতে অনেক মজা করবি।চলে আই বোন।তোর জন্য আম্মু আজও কথা বলেনা।আমাকেও ডাকেনা।আম্মু তোরে অনেক ভালবাসে রে।প্লিজ ফিরে আই একটি বার।
কান্নার করতে করতে কথাগুলো বলল শাহেদ।ওর কান্নার যেন আর শেষ হয়না।সেই তিন বছর আগের মতোই চিৎকার করতে লাগলো।
--তুই আসবিনা আমি জানি।তুই খুব খারাপ।আচ্ছা থাক আসতে হবেনা।আমি চলে যাচ্ছি।আর ডাকবোনা তোকে।
.
উঠে চলে আসল শাহেদ
..
--ভাইয়া........(মনের­ ভুলে ডাক শুনতে পেল)
পিছনে ফিরে তাকলো শাহেদ।কিন্তু কেও নেই।শুধুও শুন্যতা।আর পড়ে আছে ওই আইসক্রিম।সেটাও বা কতক্ষণ থাকবে।রোদ্রের তাপে গলে যাবে আইসক্রিম।তারপর বাতাসের সঙ্গে মিশে জলীয় বাস্পে পরিণত হবে।আর তার থেকে নামবে বৃষ্টি।যে বৃষ্টির কয়েকটা পড়বে রিসার কবরের ওপর।যাতে মিশে থাকবে তার ভাইয়ার আইসক্রিম এর স্বাদ।কিন্তু আদৌ সেই স্বাদটা রিসা পাবে তো!!!!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন