সোমবার, ৮ মে, ২০১৭

প্রহর আলোয় প্রথম তুমি

সকাল ৫ টা।এলার্ম বেজে উঠল।চোখ ডলতে ডলতে এলার্ম বন্ধ করে অপলক চোখে অন্ধকারে তাকিয়ে আছে শিহাব।কোথায় তাকিয়ে আছে তার অবশ্য তেমন খেয়াল নেই।মনোযোগ দিয়ে ফজরের আযান শুনছে।
.
বাসা থেকে ওযু করে মসজিদের দিকে রওনা হলো।ফজরের নামায জামায়াতে পড়লে সারাদিনটা অনেক ভাল যায়।
.
ঝাপসা অন্ধকার।রাস্তার পাশের হেডলাইট গুলোও যেন সকালের আড়মোড়া ভেঙে উঠতে পারে নি।কেমন যেন আবছা আলো দিচ্ছে।
.
বাড়ি থেকে ৫ মিনিট হেটে সবচেয়ে কাছের মসজিদ।মসজিদের বিপরীতেই একটা ছোট্ট বাসা।রাস্তা থেকে একটা রুমের ভেতরটা দেখা যায়।
.
প্রতি সকালে মসজিদে যাওয়ার সময় বিছানায় একজনকে নামায পড়তে দেখে শিহাব।নিচেও একটা অবয়ব দেখতে পাওয়া যায়,হয়ত তার মা।
.
প্রতি সকালে আড়চোখে খুব বেশিক্ষণ নয়,চার,পাঁচ সেকেন্ডের মতো তাকিয়ে থাকা নেশায় পরিণত হয়ে গেছে।
.
হালকা নিয়নের আলো,বাতাসে শরীরে জড়ানো ওড়না টা খানিকটা উড়ছে।প্রতিদিন দেখে তবু নতুন লাগে।
.
নামায শেষে বাসায় এসে শুয়ে পড়ল শিহাব।একটা কথা রোজ ভাবে,মেয়েটিকে তো সে দেখে কখনো কি মেয়েটি তাকে দেখেছে!
.
.
শিহাব ভার্সিটি পড়ছে।বিএসসি করছে কম্পিউটার সাইন্সে।যদিও পরিবারে তেমন সচ্ছলতা নেই।নিজের টিউশানি থেকে পড়ার খরচ জোগায়।
.
দুপুর গড়িয়ে হালকা রোদের সমাগম।শিহাব ভার্সিটি থেকে ফিরছে।সকালের মেয়েটিকে মনে করতে লাগল।সাথে মুচকি হাসি।চোখ হঠাৎ থমকে গেল।কারো ছায়ার সীমানায় আঁটকে আছে দৃষ্টি।
.
রোজ সকালে যেখানে দৃষ্টি কিছু মুহূর্তের জন্য থমকে যায়,তাকে দেখছে সে।ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢাকা।ফর্সা গালের রোদের সীমানায় চিকচিক করছে ঘাম।নাকের অগ্রভাগ লালিমাময়।কি কিনছে যেন দোকান থেকে।
.
দেখতে দেখতে হাটছিল।হঠাৎ সাইকেলের সাথে ধাক্কা লাগতে নিচে পড়ে গেল।আশেপাশের মানুষ তাকিয়ে আছে।মেয়েটিও তাকিয়ে আছে।তার চেয়ে থাকা পলকে নিচ থেকে উঠতে ভুলে গেছে শিহাব।পাশ থেকে "ওই মিয়া" চিৎকারে হুশ ফিরে এলো।
.
ততক্ষণে মেয়েটি চলে গেছে।
.
দু একজন বন্ধুবান্ধব ছাড়া তেমন কোন আড্ড দেবার জায়গা নেই তার।লজ্জায় বলল না কিছু।
.
এভাবে দেখে মাঝে মাঝে।আড়চোখে হয়ত দু একটা কথা ও হতো রাস্তায় দেখলে।
.
এক বৃষ্টিমুখর দুপুরে।মেয়েটি রিক্সা থেকে নামল।বৃষ্টি হচ্ছিল।শিহাব দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছে।মেয়েটি ছাতা খুলে চলে যাচ্ছে।শিহাব বৃষ্টির প্রতি বেখেয়ালি হয়ে মেয়ের পিছু চলল।
.
সামান্য যেতেই দাঁড়িয়ে গেল মেয়ে।শিহাব হেটে সামনে যেতেই ছাতা শিহাবের মাথায় ধরে বসল।হৃদ-কম্পনও বাড়তে লাগল বৃষ্টির তালে তালে।সম্পূর্ণ রাস্তা খালি।শুধু শিহাব আর সে।বৃষ্টির বেগ আরো বাড়ল।
.
কোন একটি কথাও হয়নি।ওভাবেই হেটে গেল কিছুটা পথ একসাথে।
.
একদিন বাসে,শিহাব ভার্সিটি যাবার জন্য উঠল।
-এক্সকিউজ মি(শিহাব)
-জ্বি
.
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দুজন।মেয়েটি তার সামনেই।
.
-বসতে পারি?(শিহাব)
-জ্বি অবশ্যই
-কোথায় যাচ্ছেন?
-জ্বি,ভার্সিটি যাচ্ছি।
-কোন ভার্সিটি?
-জাবি।
-কি সাবজেক্ট?কোন ইয়ার?
-কেমিস্ট্রি।আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
-আমিও ভার্সিটি যাচ্ছি।বিএসসি কম্পিউটার সাইন্স
-হা হা প্রশ্ন করার আগেই বলে দিলেন
-হা হা হা
-আচ্ছা আসি।নামব।
.
মেয়েটি চলে গেল।হাসি খুব সুন্দর।মাতাল করা হাসি।
.
-এই যাহ্ নাম ই তো জিজ্ঞেস করা হলো না!
.
নিজেকেই নিজে ধমকে দেবার মতো রাগ তৈরি হলো।আবারও ভাবছে,এতেই বা কম কিসে!
.
পরদিন একই সময়ে শিহাব ওই বাসের জন্যই অপেক্ষা করছে।ভার্সিটি নেই।তবু যদি বাসে দেখা হয়!
.
-আজ আবারো দেখা!(শিহাব)
-হা হা জ্বি
-নাম কি তোমার?
-তুলি।
-তুমি বললাম বলে রাগ করো না!
-না না ঠিক আছে
-আমি শিহাব।ময়মনসিংহে বাসা।এখানে মেসে থাকি।
.
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।তবে আড়চোখের কথা চলল।
.
-ফজরে উঠতে পারো?(শিহাব)
-হুম।আপনাকে গত দুইদিন দেখছি না যে(তুলি)
-আরে উঠতে পারছি না।ডেকে দেবে?
-দিব।
-কীভাবে?
-জানি না তো
-নাম্বান নাও।কল দিও।
-আচ্ছা
.
তুলি নেমে গেল।শিহাবের মন খুলে হাসতে ইচ্ছে করছে।খুব খুশি লাগছে!
.
পরদিন ভোরে আযানের আগেই উঠে বসেছিল কলের জন্য।আযানের ১০ মিনিট আগে কল আসল।ধরবে নাকি ধরবে না ভাবতে ভাবতেই কল কেটে গেল।
.
এভাবে চলছে।মাঝে মাঝে কথা হতো তাদের।হাসি ঠাট্টার মাঝেই অনেকটা সময় কেটে যেত।
.
-এইযে মিস শুনছেন হ্যালো!(শিহাব)
-সালাম দাও(তুলি)
-আচ্ছা।আসসালামু আলাইকুম
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।
-একটু আসতে পারবে?
-কোথায়?
-রাস্তার ধারে
-কেন?
-প্লিজ এসো।দরকার
-আসছি।কিন্তু মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য
-আচ্ছা।আমি দাঁড়িয়েছি।এসো
.
তুলি ওড়না মাথায় বাহিরে গেল।
.
-একটা কথা বলব(শিহাব)
-কি কথা?(তুলি)
-আমি তোমাকে ভালবাসি।
.
লাল গোলাপের তোড়াটা এগিয়ে দিল।
.
তুলির নরম গাল বেয়ে পানি ঝরছিল।শিহাব চোখের পানি মুছিয়ে দিতেই তুলি জড়িয়ে ধরল।
.
নিজেই লজ্জা পেয়ে দৌড়ে চলে আসছিল।
-এই তুলি!গোলাপ নিয়ে যাও।
.
আবার ফিরে এসে গোলাপ নিয়ে দৌড়ে চলে গেল।শিহাব মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।শুধু অবাক চাহনি!ভালবাসা ভরা দৃষ্টি।
.
.
দুই মাস পর......................
.
.
বিকেল...তুলির ফোনে কল বেজে উঠল।
-আসসালামু আলাইকুম।(তুলি)
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।(শিহাব)
-কই থাকো?খুঁজে পাই না কেন?
-একটু সমস্যায় আছি।
-হ্যাঁ যত সমস্যা আমার সামনেই আসে।সারাদিনে খবর নাও একবারও?
-আম্মু অসুস্থ।
-তিন সপ্তাহের বেশি হয়ে গেল ভালভাবে খোঁজ নাও না।তিন সপ্তাহ ধরে অসুস্থ?
-হ্যাঁ
-ধুর!
.
কেটে দিল।শিহাব ভাবছো তুলি বদলে যাচ্ছে।কল আসল তুলির।
-হ্যালো(তুলি)
-কি হয়েছে?(শিহাব)
-বুঝতে পারছ না তুমি।
-কি বুঝব?কিচ্ছু বোঝার নেই।তুমি পাল্টে গেছ।আর কখনো কল দেবে না।
.
কেটে দিল।
.
.
রাত সাড়ে ৮ টা।তুলি আর শিহাব অপারেশন থ্রিয়েটারের সামনে বসে আছে।
.
-সেদিন যখন প্রথম আম্মু সমস্যায় পড়ল আজ থেকে ২২ দিন আগে।(তুলি)
-তারপর?
-আম্মু শুকিয়ে যাচ্ছিল।প্রচুর রক্তপাত হতো।ঠিকমতো মলমূত্র ত্যাগ করতে পারত না।
-তারপর?
-আম্মুর খুব উচ্চ রক্তচাপও।সেদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেল।আব্বু অফিসে সামান্য কর্মচারী তো জানোই।আব্বুকে কল দিয়ে জানাই।ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলাম।আব্বুও আসল।কিছু টেস্ট দিল।
-তারপর?
.
-তারপর?
চোখ মুছল তুলি।
.
-টেস্টে আম্মুর কিডনি ক্যান্সার ধরা পড়ল।ডক্টর বলল,কিডনি কেটে ফেলে দিতে হবে।কিন্তু একটা কিডনি জোগাড় করতে।একটা থাকতে হবে শরীরে।
.
-তারপর?
-আব্বুকে বলা হয়েছিল অনেক টাকা লাগবে কিডনি কিনতে আর অপারেশন করাতে।আব্বু জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেল।
-হুম।পরে?
-টাকাটা লোন চেয়েছিল।দেয়নি।২ লাখের মতো লাগত।কিছু আত্নীয়ের কাছে ঘুরতে ঘুরতে আব্বুর জুতাও ছিড়ে গেছিল।আব্বু জোগাড় করতে পেরেছিল ৫০ হাজার।
.
-পরে?
-আম্মু আব্বুর হাত ধরো বলেছিল,হ্যাঁ গো,জোগাড় হয়েছে?
-পুরোটা না।হয়ে যাবে ভেব না।
.
আম্মু আব্বুর পাশে বসে বলল,
-অপারেশন করতে হবে না।যে কয়দিন বাঁচি।
.
আব্বু আম্মুর হাত ধরেছিল।কান্নার পানি হাতে পড়ছিল।আব্বুর ডান পায়ে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল।সেটা ফেটে পানি বের হচ্ছিল।
.
-তোমার একটা কিডনি দিয়ে দিলে।(তুলি)
-আমারও তো আম্মু হয়।(শিহাব)
-কিডনির ১ লাখ তো তোমার কিডনি দিয়েই হলো।বাকী ৫০ হাজার টাকা তুমি জোগাড় করলে কীভাবে শিহাব?
-ও হয়ে গেছে একভাবে।
.
শিহাব তুলির হাত ধরে আছে।
.
-খুব ভালবাসি তোমায়।(শিহাব)
-আমিও।(তুলি)
.
শিহাবের একটা কল আসল।দূরে গিয়ে ফোন উঠালো।
-হ্যালো(শিহাব)
-এক সপ্তাহের মাঝে ৫০ হাজার টাকা ফেরত না দিলে গলা কাইট্টালামু শালা!
-দিয়ে দেব।
.
চোখে কিছুটা ভয়ার্ত ক্লান্তির ছায়া দেখা গেলেও তুলির দিকে তাকিয়ে ভালবাসার চাহনির ছায়া সারা অঙ্গে ছড়িয়ে গেল।হাত ধরে আছে দুজন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন