কয়েকদিন প্রচন্ড খরার পর বিকেল থেকে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। কিন্তু বৃষ্টির কোনো লক্ষণই নেই, ঘরের ভিতর ভ্যাঁপসা গরম লাগছে।
রাত কয়টা বাজে বলতে পারছি না, তবে গভীর রাত এটা বুঝতে পারছি। আজ রাতেও হয়তো ঘুম হবে না। কয়েকদিন ধরে বাজে একটা অভ্যাস হয়েছে, রাত জাগা। জেগে থাকলেই হাজারটা চিন্তা এসে ভর করে। আজকাল ঘুমের ঔষধেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না।
বাবা মারা যাওয়ার পর মাও শয্যাশায়ী হলেন। বাবা অবশ্য কিছুটা সঞ্চয় রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে মায়ের চিকিৎসা, আমার আর মাহিমের পড়াশোনা চলছিল না। বাধ্য হয়ে তাই আমাকে সংসারের হাল ধরতে হলো। একটা স্কুলে চাকরি নিলাম আর কয়েকটা টিউশন করাই। তাতেই চলে যাচ্ছে একরকম। বাবা থাকতে অভাব আমাদের কোনদিনই স্পর্শ করেনি, আজ বুঝতে পারছি বাবাদের কষ্ট।
এতো পরিশ্রমেও আমি ভেঙে পড়িনি কারন আমার পাশে জিতু ছিলো। সে আমাকে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়েছে। জিতুর সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ কয়েক বছরের। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ সে আমাকে কেমন অবহেলা করছে। ওর সাথে কোন যোগাযোগ হচ্ছে না। বুঝতে পারছি না কেন সে এমন করছে।
.
ভোরের দিকে ঘুমটা লেগেছিল। তাই বেশ দেরি হয়ে গেল সকালে উঠতে। তাড়াহুড়ো করে নাশতা করে বেরুতে যাচ্ছি তখনই মাহিম এসে বলল,
-আপু, ৫০০ টাকা লাগবে। একটা বই কিনতে হবে।
-দু'দিন অপেক্ষা কর ভাই, বেতনটা পেয়ে গেলেই দিয়ে দিবো।
বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। স্কুল প্রায় ২ কিলোমিটার দূর। প্রতিদিন হেঁটেই যাওয়া আসা করি। আজ দেরি হয়ে গেছে বিধায় রিক্সা নিলাম। মাহিমের বই, মায়ের ঔষধ এখন অনেক টাকার দরকার।ভাগ্যিস বাবা বাড়িটা রেখে গিয়েছিলেন তাই মাথার উপর ছাদটা আছে। কি জানি আজ বেতন হবে কি না! অনি ভাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে। অনি ভাইও এই স্কুলে পড়ান। অনি ভাই খুব ভালো মানুষ, এমন মানুষ আমি আর দেখিনি।
.
স্কুলে, ক্লাসে মন বসাতে পারলাম না। মাথার উপর হাজার রকমের চিন্তা নিয়ে কি পড়ানো যায়!
অনি ভাই এসে বসলেন সামনের চেয়ারটায়। আমি মাথা টেবিলের উপর রেখে বসে আছি, অনি ভাইয়ের উপস্থিতি তাই খেয়ালে আসেনি।
-মায়া! কোন সমস্যা?
-না অনি ভাই ঠিক আছি।
একটু থেমে বললাম,
-বেতনটা কি আজ পাওয়া যাবে?
-হুম, আজই তো হওয়ার কথা।
আমি আর কিছু বললাম না।
বেতনটা আজই হয়ে গেল। মাহিমকে টাকা দিয়ে মায়ের ঔষধ কিনে আনলাম। যা যা প্রয়োজন মিটে গেছে তবুও মনটা কেমন ভারি হয়ে আছে। সন্ধ্যা নেমে গেছে, অনেকক্ষণ মায়ের কাছে বসেছিলাম। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এমন আকাশ ভাঙা বৃষ্টি অনেকদিন হয়নি। এমন বৃষ্টি সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার কথা। কিন্তু বৃষ্টির কণা আমার তপ্ত ভারী মনটাকে ভাসাতে পারলোনা। মনের কোণে জিতুর মুখটা বারবার ভেসে উঠছে। থেমে থেমে জিতুকে ফোন করে যাচ্ছি, ফোন তো তুলছেই না বরঞ্চ কিছুক্ষণ আগে থেকে ফোনটা বন্ধ দেখাচ্ছে। মনের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠলো, কিছু হয়নি তো আবার!
.
বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। সেই সন্ধ্যার পর থেকে জিতুর ফোনটাও বন্ধ। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে পরিবেশটা বেশ শান্ত। কিন্তু আমার মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। বারবার জিতুর কথা মনে পড়ছে।
স্কুল থেকে হেঁটেই বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎই একটা ছেলে সামনে এসে দাঁড়ালো।
-আপনি মায়া না!
-জ্বি;কিন্তু আপনি কে?
-আমি জিতুর বন্ধু। পার্কে একদিন দেখা হয়েছিল।
-ভাইয়া জিতু কোথায়? আমি ওর কোন খোঁজ পাচ্ছিনা।
-কেন? আপনি জানেন না জিতু বিয়ে করেছে?
চমকে উঠলাম আমি। হঠাৎই মাথাটা ঘুরে গেল, টলে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম।
-আপনি ঠিক আছেন তো! রিক্সা ডেকে দিই?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
- না লাগবে না। আমি ঠিক আছি।
পাশ কাটিয়ে চলে এলাম আমি। জিতু কেন এমনটা করলো! সে মুক্তি চাইতেই পারতো! আমি মুক্তি দিতাম। কিন্তু কাপুরুষের মত কেন? সে চলে গেছে ভেবে আমার এতটাও কষ্ট লাগছেনা, যতটা লাগছে তাকে কাপুরুষ ভাবতে। এলোমেলো পায়ে আনমনে হাঁটছিলাম। বেখেয়ালে ধাক্কা লাগল একটা ল্যাম্পপোস্টের সাথে। কপালটা ব্যথায় টনটন করে উঠলো।
পাশ থেকে কেউ একজন বললো, কি আপা! দেখে হাঁটতে পারেন না!
আমি কিছু না বলে চলে এলাম বাসায়। ঘরে এসেই ধপ করে পড়লাম বিছানার উপর। খুব ক্লান্ত লাগছে আমার, বাবা মারা যাওয়ার পর কোনদিন এতো ক্লান্ত লাগেনি। এতদিনের পরিশ্রম এতো চাপ যে মানসিক শক্তি দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম তা আজ পুরোপুরি ভেঙে গেছে। বাবাকে আজ বড্ড মনে পড়ছে, ইচ্ছে হচ্ছে বাবাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদি।
.
বিকেলবেলা ছাদে পায়চারি করছিলাম। মাহিম এসে বলল অনি ভাই এসেছেন। বসার ঘরে অনি ভাইকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলাম। আমাকে দেখে বললেন,
-শুনলাম তুমি ছুটি নিয়েছো! কিছু হয়েছে কি না দেখতে এলাম।
-আপনি বসুন আমি চা নিয়ে আসছি।
আমি চা বানাতে চলে এলাম। জিতুর খবরটা শুনে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। কোনকিছুতে মনযোগ দিতে পারছিলাম না। সপ্তাহ খানেক পর তাই কয়েকদিনের ছুটি নিলাম।
চা নিয়ে এসে দেখি অনি ভাই আগের মতোই বসে আছেন। চা নিতে নিতে অনি ভাই বললেন,
-মায়া তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
-বলুন আমি শুনছি।
-ছাদে চল ওখানেই বলব।
ছাদে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে আছি, অনি ভাই আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। শেষ বিকেলের রক্তিম আলো এসে পড়লো আমাদের উপর।
-আমি জানি মায়া তোমার কি হয়েছে আর কেন তুমি ছুটি নিয়েছো!
আমি অবাক হয়ে তাকালাম অনি ভাইয়ের দিকে। সন্দেহ নেই উনি সত্যি বলছেন, আমি জানি অনি ভাই মিথ্যা বলেন না।
অনি ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
-যাকে ভালোবাসি তার ব্যপারে একটু খোঁজ তো রাখতেই হয়।
আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম,
-স্বপ্ন দেখাচ্ছেন?
-নাহ, একটা স্বপ্নের পূর্ণতা দিতে চাইছি।
-কিন্তু আপনি তো এই বিপর্যস্ত মায়াকে চান নি!
-হয়তো চাই নি। কিন্তু আমার বেঁচে থাকার জন্য তোমাকেই প্রয়োজন ছিল।
অনি ভাই আমার হাত ধরলেন, আমার হাতটা কেঁপে উঠলো। দুজনেই খানিকক্ষণ চুপ ছিলাম। সময় যেন এখানে থমকে এসে দাঁড়িয়েছে।
-মায়া! কিছু বলবে না!
অনি ভাইয়ের কথায় ঘোর কাটলো আমার। হাতটা সরিয়ে নিলাম আমি।
-সেটা আর সম্ভব না অনি ভাই। চলে যান আপনি।
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অনি ভাই সত্যি চলে গেলেন। একটা দীর্ঘঃশ্বাস বের হলো বুকের মধ্যে থেকে যা অনেকক্ষণ চাপা পড়েছিল।
.
তারপর অনেকদিনটা কেটে গেল। মা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে, মাহিমও পড়াশুনা শেষ করে বিদেশ পাড়ি জমালো। অনি ভাইও শুনেছি বেশ সুখে আছেন। আমিও ভালো আছি। একদম নিজের মতো করেই ভালো আছি। বাচ্ছাদের গান শেখাই, বেশ ভালো একটা চাকরিও করছি।
বিকেলবেলাটায় পার্কে হাঁটি। মাঝেমধ্যেই স্কুল কলেজের বন্ধুদের সাথে দেখাও হয়ে যায়। ছেলেমেয়ে নিয়ে সবার জীবনই ষোলকলা পূর্ণ। শুধুমাত্র আমিই একা পড়ে আছি। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলি, ভালোই তো আছি একা। একাকীত্বটা তো আমি নিজেই বরণ করে নিয়েছিলাম।
তেমনই একদিন হঠাৎই জিতুর সাথে দেখা হয়ে যায়। স্ত্রী আর মেয়ের সাথে ঘুরতে এসেছিল মনে হয়। খুব যে খারাপ আছে দেখে বুঝা যায় না। বেচারা আমাকে দেখে একদম ঘাবড়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়ে কথা বলতে এসেছিল কিন্তু আমি না চেনার ভান করে চলে আসি।
ওর ব্যাপারে আমি সেই কবেই ভাবা ছেড়ে দিয়েছি! ওকে ঘৃণা করতে পেরেছিলাম ঠিকই তার কাপুরুষতার জন্যে কিন্তু ওর প্রতি আমার ভালবাসাটাকে কিছুতেই ঘৃণা করতে পারি নি। কারন আমার সেই ভালবাসাটা পবিত্র ছিল আজও আমি আমার সেই ভালবাসাকে ভালবাসি।
রাত কয়টা বাজে বলতে পারছি না, তবে গভীর রাত এটা বুঝতে পারছি। আজ রাতেও হয়তো ঘুম হবে না। কয়েকদিন ধরে বাজে একটা অভ্যাস হয়েছে, রাত জাগা। জেগে থাকলেই হাজারটা চিন্তা এসে ভর করে। আজকাল ঘুমের ঔষধেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না।
বাবা মারা যাওয়ার পর মাও শয্যাশায়ী হলেন। বাবা অবশ্য কিছুটা সঞ্চয় রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে মায়ের চিকিৎসা, আমার আর মাহিমের পড়াশোনা চলছিল না। বাধ্য হয়ে তাই আমাকে সংসারের হাল ধরতে হলো। একটা স্কুলে চাকরি নিলাম আর কয়েকটা টিউশন করাই। তাতেই চলে যাচ্ছে একরকম। বাবা থাকতে অভাব আমাদের কোনদিনই স্পর্শ করেনি, আজ বুঝতে পারছি বাবাদের কষ্ট।
এতো পরিশ্রমেও আমি ভেঙে পড়িনি কারন আমার পাশে জিতু ছিলো। সে আমাকে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়েছে। জিতুর সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ কয়েক বছরের। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ সে আমাকে কেমন অবহেলা করছে। ওর সাথে কোন যোগাযোগ হচ্ছে না। বুঝতে পারছি না কেন সে এমন করছে।
.
ভোরের দিকে ঘুমটা লেগেছিল। তাই বেশ দেরি হয়ে গেল সকালে উঠতে। তাড়াহুড়ো করে নাশতা করে বেরুতে যাচ্ছি তখনই মাহিম এসে বলল,
-আপু, ৫০০ টাকা লাগবে। একটা বই কিনতে হবে।
-দু'দিন অপেক্ষা কর ভাই, বেতনটা পেয়ে গেলেই দিয়ে দিবো।
বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। স্কুল প্রায় ২ কিলোমিটার দূর। প্রতিদিন হেঁটেই যাওয়া আসা করি। আজ দেরি হয়ে গেছে বিধায় রিক্সা নিলাম। মাহিমের বই, মায়ের ঔষধ এখন অনেক টাকার দরকার।ভাগ্যিস বাবা বাড়িটা রেখে গিয়েছিলেন তাই মাথার উপর ছাদটা আছে। কি জানি আজ বেতন হবে কি না! অনি ভাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে। অনি ভাইও এই স্কুলে পড়ান। অনি ভাই খুব ভালো মানুষ, এমন মানুষ আমি আর দেখিনি।
.
স্কুলে, ক্লাসে মন বসাতে পারলাম না। মাথার উপর হাজার রকমের চিন্তা নিয়ে কি পড়ানো যায়!
অনি ভাই এসে বসলেন সামনের চেয়ারটায়। আমি মাথা টেবিলের উপর রেখে বসে আছি, অনি ভাইয়ের উপস্থিতি তাই খেয়ালে আসেনি।
-মায়া! কোন সমস্যা?
-না অনি ভাই ঠিক আছি।
একটু থেমে বললাম,
-বেতনটা কি আজ পাওয়া যাবে?
-হুম, আজই তো হওয়ার কথা।
আমি আর কিছু বললাম না।
বেতনটা আজই হয়ে গেল। মাহিমকে টাকা দিয়ে মায়ের ঔষধ কিনে আনলাম। যা যা প্রয়োজন মিটে গেছে তবুও মনটা কেমন ভারি হয়ে আছে। সন্ধ্যা নেমে গেছে, অনেকক্ষণ মায়ের কাছে বসেছিলাম। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এমন আকাশ ভাঙা বৃষ্টি অনেকদিন হয়নি। এমন বৃষ্টি সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার কথা। কিন্তু বৃষ্টির কণা আমার তপ্ত ভারী মনটাকে ভাসাতে পারলোনা। মনের কোণে জিতুর মুখটা বারবার ভেসে উঠছে। থেমে থেমে জিতুকে ফোন করে যাচ্ছি, ফোন তো তুলছেই না বরঞ্চ কিছুক্ষণ আগে থেকে ফোনটা বন্ধ দেখাচ্ছে। মনের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠলো, কিছু হয়নি তো আবার!
.
বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। সেই সন্ধ্যার পর থেকে জিতুর ফোনটাও বন্ধ। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে পরিবেশটা বেশ শান্ত। কিন্তু আমার মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। বারবার জিতুর কথা মনে পড়ছে।
স্কুল থেকে হেঁটেই বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎই একটা ছেলে সামনে এসে দাঁড়ালো।
-আপনি মায়া না!
-জ্বি;কিন্তু আপনি কে?
-আমি জিতুর বন্ধু। পার্কে একদিন দেখা হয়েছিল।
-ভাইয়া জিতু কোথায়? আমি ওর কোন খোঁজ পাচ্ছিনা।
-কেন? আপনি জানেন না জিতু বিয়ে করেছে?
চমকে উঠলাম আমি। হঠাৎই মাথাটা ঘুরে গেল, টলে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম।
-আপনি ঠিক আছেন তো! রিক্সা ডেকে দিই?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
- না লাগবে না। আমি ঠিক আছি।
পাশ কাটিয়ে চলে এলাম আমি। জিতু কেন এমনটা করলো! সে মুক্তি চাইতেই পারতো! আমি মুক্তি দিতাম। কিন্তু কাপুরুষের মত কেন? সে চলে গেছে ভেবে আমার এতটাও কষ্ট লাগছেনা, যতটা লাগছে তাকে কাপুরুষ ভাবতে। এলোমেলো পায়ে আনমনে হাঁটছিলাম। বেখেয়ালে ধাক্কা লাগল একটা ল্যাম্পপোস্টের সাথে। কপালটা ব্যথায় টনটন করে উঠলো।
পাশ থেকে কেউ একজন বললো, কি আপা! দেখে হাঁটতে পারেন না!
আমি কিছু না বলে চলে এলাম বাসায়। ঘরে এসেই ধপ করে পড়লাম বিছানার উপর। খুব ক্লান্ত লাগছে আমার, বাবা মারা যাওয়ার পর কোনদিন এতো ক্লান্ত লাগেনি। এতদিনের পরিশ্রম এতো চাপ যে মানসিক শক্তি দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম তা আজ পুরোপুরি ভেঙে গেছে। বাবাকে আজ বড্ড মনে পড়ছে, ইচ্ছে হচ্ছে বাবাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদি।
.
বিকেলবেলা ছাদে পায়চারি করছিলাম। মাহিম এসে বলল অনি ভাই এসেছেন। বসার ঘরে অনি ভাইকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলাম। আমাকে দেখে বললেন,
-শুনলাম তুমি ছুটি নিয়েছো! কিছু হয়েছে কি না দেখতে এলাম।
-আপনি বসুন আমি চা নিয়ে আসছি।
আমি চা বানাতে চলে এলাম। জিতুর খবরটা শুনে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। কোনকিছুতে মনযোগ দিতে পারছিলাম না। সপ্তাহ খানেক পর তাই কয়েকদিনের ছুটি নিলাম।
চা নিয়ে এসে দেখি অনি ভাই আগের মতোই বসে আছেন। চা নিতে নিতে অনি ভাই বললেন,
-মায়া তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
-বলুন আমি শুনছি।
-ছাদে চল ওখানেই বলব।
ছাদে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে আছি, অনি ভাই আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। শেষ বিকেলের রক্তিম আলো এসে পড়লো আমাদের উপর।
-আমি জানি মায়া তোমার কি হয়েছে আর কেন তুমি ছুটি নিয়েছো!
আমি অবাক হয়ে তাকালাম অনি ভাইয়ের দিকে। সন্দেহ নেই উনি সত্যি বলছেন, আমি জানি অনি ভাই মিথ্যা বলেন না।
অনি ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
-যাকে ভালোবাসি তার ব্যপারে একটু খোঁজ তো রাখতেই হয়।
আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম,
-স্বপ্ন দেখাচ্ছেন?
-নাহ, একটা স্বপ্নের পূর্ণতা দিতে চাইছি।
-কিন্তু আপনি তো এই বিপর্যস্ত মায়াকে চান নি!
-হয়তো চাই নি। কিন্তু আমার বেঁচে থাকার জন্য তোমাকেই প্রয়োজন ছিল।
অনি ভাই আমার হাত ধরলেন, আমার হাতটা কেঁপে উঠলো। দুজনেই খানিকক্ষণ চুপ ছিলাম। সময় যেন এখানে থমকে এসে দাঁড়িয়েছে।
-মায়া! কিছু বলবে না!
অনি ভাইয়ের কথায় ঘোর কাটলো আমার। হাতটা সরিয়ে নিলাম আমি।
-সেটা আর সম্ভব না অনি ভাই। চলে যান আপনি।
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অনি ভাই সত্যি চলে গেলেন। একটা দীর্ঘঃশ্বাস বের হলো বুকের মধ্যে থেকে যা অনেকক্ষণ চাপা পড়েছিল।
.
তারপর অনেকদিনটা কেটে গেল। মা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে, মাহিমও পড়াশুনা শেষ করে বিদেশ পাড়ি জমালো। অনি ভাইও শুনেছি বেশ সুখে আছেন। আমিও ভালো আছি। একদম নিজের মতো করেই ভালো আছি। বাচ্ছাদের গান শেখাই, বেশ ভালো একটা চাকরিও করছি।
বিকেলবেলাটায় পার্কে হাঁটি। মাঝেমধ্যেই স্কুল কলেজের বন্ধুদের সাথে দেখাও হয়ে যায়। ছেলেমেয়ে নিয়ে সবার জীবনই ষোলকলা পূর্ণ। শুধুমাত্র আমিই একা পড়ে আছি। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলি, ভালোই তো আছি একা। একাকীত্বটা তো আমি নিজেই বরণ করে নিয়েছিলাম।
তেমনই একদিন হঠাৎই জিতুর সাথে দেখা হয়ে যায়। স্ত্রী আর মেয়ের সাথে ঘুরতে এসেছিল মনে হয়। খুব যে খারাপ আছে দেখে বুঝা যায় না। বেচারা আমাকে দেখে একদম ঘাবড়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়ে কথা বলতে এসেছিল কিন্তু আমি না চেনার ভান করে চলে আসি।
ওর ব্যাপারে আমি সেই কবেই ভাবা ছেড়ে দিয়েছি! ওকে ঘৃণা করতে পেরেছিলাম ঠিকই তার কাপুরুষতার জন্যে কিন্তু ওর প্রতি আমার ভালবাসাটাকে কিছুতেই ঘৃণা করতে পারি নি। কারন আমার সেই ভালবাসাটা পবিত্র ছিল আজও আমি আমার সেই ভালবাসাকে ভালবাসি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন