মেয়েটা একটু পর পর আমার কাঁধে মাথা রাখতেছে। অামি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছিনা।
ট্রেনের দুইজনের সিটে তিনজন বসছি। অামি অামার বন্ধু রফিক বসেছিলাম। আখাউড়া থেকে চারটা মেয়ে উঠল। একজনের হাতে গায়ে হলুদের কুলো।
এমনিতেই সারাপথ দাড়িয়ে থাকার পর সিট পেয়েছি। যাব চট্টগ্রাম পর্যন্ত। তাই ইচ্ছে হয়নি যে নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে মেয়েদের বলব আপনারা বসুন।
একটু পর একটি মেয়ে বলল, "এখানে ইচ্ছে করলেতো তিনজন বসা যায়। আমার বোনটা সারারাত ঘুমায়নি। দাড়িয়ে থাকতে ওর কষ্ট হচ্ছে, একটু বসতে দাওতো। "
বয়সে বড় একটি মেয়ের এমন আবদার ফেলতে পারিনি। তাই রফিককে একটু জানালার দিকে সরিয়ে আমার পাশে মেয়েটিকে বসতে দিয়েছিলাম। এখন দেখি মেয়েটি একটু পর পর আমার কাঁধে মাথা রেখে ঝিমিয়ে পড়ে। দুইবার বড় আপুর দিকে তাকানোর পর তিনি তার বোনের মাথা আমার কাঁধ থেকে সরিয়ে নিল। তৃতীয়বার মাথায় ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দিল, থাকুক, সারারাততো ঘুমায়নি একটু ঘুমাক।
সেটা দেখে রফিক হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এমনকি অামার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলতেছে, "দোস্ত, তুইনা জানালার পাশে বসতে চেয়েছিলি? এবার তুই জানালার পাশে বস। "
অামি মুখ ঘুরিয়ে বলে দিলাম, "নারে, এখানেই খুব ভাল লাগতেছে। "
মনে হয় রফিক মনে মনে রেগে ফেটে যাচ্ছে। সকাল দশটায় ট্রেনে উঠার পর এগারোটার সময়ই আমরা ঘেমে প্রায় ভিজে যাচ্ছিলাম। আর এখন জানালার পাশে বসার পরও রফিক আমার জায়গায় বসতে চাইছে।
.
বড় আপুনি হঠাৎ রফিককে ডেকে বলল, " ভাই কুলোটা হাতে দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, একটু ধরোতো। "
এত সুন্দর করে বলাতে রফিক অার না করতে পারেনি। গায়ে হলুদের কুলো কোলে নিয়ে বসে দাতে কিড়মিড় করে অামার দিকে তাকাচ্ছে। কাঁধে ঘুমন্ত মেয়েটি এবার আমার হাত চেপে ধরে ঘুমোচ্ছে। বড় আপুটি বাদাম বিক্রেতার কাছ থেকে দুই টাকার বাদাম কিনে রফিকের হাতে ধরিয়ে দিল। রফিক মনে হয় আরো জ্বলতেছে।
.
রফিককে আমি ইচ্ছে করে রাগাচ্ছিনা। কারন তাকে রাগানোটাও ঠিকনা। সে এত কষ্ট করে ওর মায়ের ব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকা চুরি করে নিয়ে এসেছে। আমার পকেটে শুধু এক টাকার একটি লাল কয়েন ছিল।
প্রথমে ভেবেছি তিনজনে পালাব বাড়ি থেকে। আরেকজন বন্ধু আসবে বলেও আসেনি। দশম শ্রেণীর ছাত্র অামি, রফিক লেখাপড়া ছেড়েছে অনেক অাগে। কিশোর মনের কৌতূল, দেশ ঘুরে দেখব। কাজ করব, খাব আর ঘুরব।
রফিকই বলল, টাকা পাঁচশত চুরি করছি। তুই কিন্তু পরে কাজ করে অামাকে আড়াইশত টাকা ফেরত দিবি।
আমি রাজী হলাম। আর সকাল দশটার কর্ণফুলী ট্রেনে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
.
গলাটা শুকিয়ে গেছে, পানি খাওয়া দরকার। পরের স্টেশন ট্রেন থামার অপেক্ষায় অাছি। কর্ণফুলী লোকাল ট্রেণটি প্রায় প্রতিটি স্টেশন থামে।
রেলগাড়ী থামার সাথে সাথে দেখি ছোট ছোট ছেলেরা বোতলে করে পানি বিক্রি করছে। বোতল সহ কিনলে দুই টাকা। আর পানি খেয়ে বোতল ফেরত দিলে এক টাকা।
বোতল সহ কিনে পানি খাইলাম আর খালি বোতল দিয়ে আরো দুই টাকা দিয়ে বললাম আরো দুই টাকার পানি দে, পরে তৃষ্ণা পেলে খাব।
সে দূরে কলস থেকে বোতলে পানি ঢালতেছে। যখন ট্রেন হুইসেল দিল যে ছেড়ে দিবে। তখন ছেলেটি এক ফোটা দুই ফোটা করে পানি ঢালতেছে বোতলে। ডাকতেছি, ভাই তারাতারি দে। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। ছেলেটি দুষ্ট হাসি দিয়ে বলতেছে, "আরেকদিন অাসলে খাইয়েন"
এই কথা শুনে আমার কাঁধের মেয়েটি হাসতেছে। ফিরে দেখি মেয়েটি সজাগ হয়ে গেছে। অামার তাকানো দেখে হাসি বন্ধ করে দিছে। কারন এখনই কেবল বুঝতে পারল সে এতক্ষন আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল। সম্ভবত সেভেন এইটে পড়ে মেয়েটি। আমারও কিশোর বয়স। যদিও ভালবাসা আসেনি মনে, তবে এতটুকু বুঝেছিলাম যে তাকে দেখার পর মনে ভাল লাগা কাজ করতেছে। লজ্জারাঙ্গা হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে অাছে।
.
পরের স্টেশনে যখন মেয়েরা নেমে গেল, রফিক খুশিতে অাত্মহারা। আমার পাশে মেয়েটি বসাতে সে এতক্ষন হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল।
আমি করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম মেয়েটির দিকে। কেন যেন মনে হচ্ছিল খুব কাছের আপনজনকে হারিয়ে ফেলতেছি। মনের ভিতর একটা হাহাকার কাজ করতেছে। ইচ্ছে হচ্ছিল আমিও মেয়েটির পিছন পিছন হেটে যাই অজানার পথে।
.
চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌছলাম রাত নয়টা পঁয়ত্রিশে। হোটেল থেকে খাওয়ার পর মনে হল এতটুকু ভ্রমন করে ক্লান্ত লাগছে। খুব করে একটা ঘুম দিতে হবে। কিছুক্ষন ঘুরাঘুরির পর বুঝলাম স্টেশনেই ঘুমাতে হবে।
ভালই লাগছিল পানির বোতল মাথার নীচে দিয়ে ঘুমাতে। সাথে অনেক ভিক্ষুকও অাছে। যাদের এই শহরে কোন ঘরবাড়ি নেই। সারাদিন ভিক্ষে করার পর এই স্টেশনটাই ওদের ঠিকানা। অসহায় মানুষদের সাথে ঘুমাতে পেরে নিজের কাছে ভাল লাগছিল।
.
মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠেছি।
আম্মু অসুস্থ্য, আমার নাম ধরে বারবার দেখতে চাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেললাম। বাবা মায়ের একটি মাত্র ছেলে হয়ে বাড়ি থেকে এভাবে পালিয়ে অাসাটা ঠিক হয়নি।
সকালে রফিক বলতেছে, "দোস্ত যদি রাস্তায় পাঁচশত টাকা পাই তাহলে বাড়ি ফিরে যাব। মায়ের হাতে টাকাটা দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেব।
ফোনের দোকান খুঁজতেছি। যে বন্ধুটি সাথে অাসেনি তাকে ফোন করলে বাড়ির খুঁজ খবর পাওয়া যাবে।
রফিক পেছন থেকে ডাকতেছে, "দোস্ত, দুই টাকা কুড়িয়ে পাইছি।"
ঐদিকে নজর না দিয়ে ফোনের দোকান থেকে ফোন দিলাম।
সে বন্ধুটি জানাল, অামাকে খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির মানুষের ঘুম নেই। আম্মু এই পর্যন্ত পানি ছাড়া কিছু খায়নি। শুধু কান্না কররতেছে"
রফিককে বললাম, "দোস্ত আমি বাড়ি যাব, এর বেশী কিছু জানিনা।"
সে বলল, আমিতো অারো অাগে যেতে চাই। তোর জন্য কিছু বলতে পারিনি।
সে বন্ধুটিকে আবার ফোন দিয়ে বললাম, "আম্মুকে বল ভাত খাইতে তাহলে অামি আসব। আমি রওনা দিতেছি। "
আবার সকাল দশটার ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে নরসিংদী রওনা দিলাম।
.
অাম্মু অামাকে বুকে নিয়ে কতটা কান্না করেছে বুঝাতে পারবনা। আম্মুর কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম আম্মুর অনুমতি না নিয়ে দূরে কোথাও যাবনা। অাম্মু পরম মমতায় কপালে চুমো দিল।
.
গভীর রাতে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটি ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। জানালার পাশে সেই মেয়েটি। আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। আমি দৌড়ে ট্রেন ধরার বৃথা চেষ্টা করছি। হঠাৎ পায়ে পাথরের চোট লেগে নীচে পড়ে গেলাম। মেয়েটি কান্না করছে। আর আমি কান্না করতে করতে দেখি ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
এই স্বপ্নটি অামি একবার নয় দুইবার নয় এই ছয় বছরে হাজারোবার দেখেছি। প্রতিবারই ঘুম ভাঙ্গার পর মেয়েটির জন্য মনটা হাহাকার করে উঠত।
.
এই প্রথম আলাদা করে মেয়েটিকে নিয়ে কোন স্বপ্ন দেখলাম। স্টেশনে ট্রেন থামার পর নীচে নেমে দেখি মেয়েটি দূরে অামার জন্য অপেক্ষা করছে। হাত নেড়ে বলতেছে, "এইযে আমি এখানে"
স্বপ্নটি দেখার পর ঘুম ভেঙ্গে গেল। মোবাইলে তাকিয়ে দেখি তিনটা বেজে সতেরো মিনিট।
আজ অার ঘুম হবেনা।
সকালে অাবার নাস্তা করেই বিয়ের বরযাত্রীতে যেতে হবে। চাচাত ভাই অাখাউরা বিয়ে করতেছে। এত দূরে কেউ বিয়ে করে?
মেয়েটি অাখাউড়া থেকেই ট্রেনে উঠেছিল। ইসসস, স্বপ্নটা যদি সত্যি হত। দশ বছর পর অামাকে দেখেকি মেয়েটি চিনতে পারবে? মনে করতে পারবে যে সে একটি ছেলের কাঁধে ঘুমিয়ে ছিল অনেকটা সময়।
"অাসো তুমি অাসো ফিরে
স্বপ্ন নয় সত্যি হয়ে
অামার ভালবাসার নীড়ে"
ট্রেনের দুইজনের সিটে তিনজন বসছি। অামি অামার বন্ধু রফিক বসেছিলাম। আখাউড়া থেকে চারটা মেয়ে উঠল। একজনের হাতে গায়ে হলুদের কুলো।
এমনিতেই সারাপথ দাড়িয়ে থাকার পর সিট পেয়েছি। যাব চট্টগ্রাম পর্যন্ত। তাই ইচ্ছে হয়নি যে নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে মেয়েদের বলব আপনারা বসুন।
একটু পর একটি মেয়ে বলল, "এখানে ইচ্ছে করলেতো তিনজন বসা যায়। আমার বোনটা সারারাত ঘুমায়নি। দাড়িয়ে থাকতে ওর কষ্ট হচ্ছে, একটু বসতে দাওতো। "
বয়সে বড় একটি মেয়ের এমন আবদার ফেলতে পারিনি। তাই রফিককে একটু জানালার দিকে সরিয়ে আমার পাশে মেয়েটিকে বসতে দিয়েছিলাম। এখন দেখি মেয়েটি একটু পর পর আমার কাঁধে মাথা রেখে ঝিমিয়ে পড়ে। দুইবার বড় আপুর দিকে তাকানোর পর তিনি তার বোনের মাথা আমার কাঁধ থেকে সরিয়ে নিল। তৃতীয়বার মাথায় ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দিল, থাকুক, সারারাততো ঘুমায়নি একটু ঘুমাক।
সেটা দেখে রফিক হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এমনকি অামার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলতেছে, "দোস্ত, তুইনা জানালার পাশে বসতে চেয়েছিলি? এবার তুই জানালার পাশে বস। "
অামি মুখ ঘুরিয়ে বলে দিলাম, "নারে, এখানেই খুব ভাল লাগতেছে। "
মনে হয় রফিক মনে মনে রেগে ফেটে যাচ্ছে। সকাল দশটায় ট্রেনে উঠার পর এগারোটার সময়ই আমরা ঘেমে প্রায় ভিজে যাচ্ছিলাম। আর এখন জানালার পাশে বসার পরও রফিক আমার জায়গায় বসতে চাইছে।
.
বড় আপুনি হঠাৎ রফিককে ডেকে বলল, " ভাই কুলোটা হাতে দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, একটু ধরোতো। "
এত সুন্দর করে বলাতে রফিক অার না করতে পারেনি। গায়ে হলুদের কুলো কোলে নিয়ে বসে দাতে কিড়মিড় করে অামার দিকে তাকাচ্ছে। কাঁধে ঘুমন্ত মেয়েটি এবার আমার হাত চেপে ধরে ঘুমোচ্ছে। বড় আপুটি বাদাম বিক্রেতার কাছ থেকে দুই টাকার বাদাম কিনে রফিকের হাতে ধরিয়ে দিল। রফিক মনে হয় আরো জ্বলতেছে।
.
রফিককে আমি ইচ্ছে করে রাগাচ্ছিনা। কারন তাকে রাগানোটাও ঠিকনা। সে এত কষ্ট করে ওর মায়ের ব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকা চুরি করে নিয়ে এসেছে। আমার পকেটে শুধু এক টাকার একটি লাল কয়েন ছিল।
প্রথমে ভেবেছি তিনজনে পালাব বাড়ি থেকে। আরেকজন বন্ধু আসবে বলেও আসেনি। দশম শ্রেণীর ছাত্র অামি, রফিক লেখাপড়া ছেড়েছে অনেক অাগে। কিশোর মনের কৌতূল, দেশ ঘুরে দেখব। কাজ করব, খাব আর ঘুরব।
রফিকই বলল, টাকা পাঁচশত চুরি করছি। তুই কিন্তু পরে কাজ করে অামাকে আড়াইশত টাকা ফেরত দিবি।
আমি রাজী হলাম। আর সকাল দশটার কর্ণফুলী ট্রেনে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
.
গলাটা শুকিয়ে গেছে, পানি খাওয়া দরকার। পরের স্টেশন ট্রেন থামার অপেক্ষায় অাছি। কর্ণফুলী লোকাল ট্রেণটি প্রায় প্রতিটি স্টেশন থামে।
রেলগাড়ী থামার সাথে সাথে দেখি ছোট ছোট ছেলেরা বোতলে করে পানি বিক্রি করছে। বোতল সহ কিনলে দুই টাকা। আর পানি খেয়ে বোতল ফেরত দিলে এক টাকা।
বোতল সহ কিনে পানি খাইলাম আর খালি বোতল দিয়ে আরো দুই টাকা দিয়ে বললাম আরো দুই টাকার পানি দে, পরে তৃষ্ণা পেলে খাব।
সে দূরে কলস থেকে বোতলে পানি ঢালতেছে। যখন ট্রেন হুইসেল দিল যে ছেড়ে দিবে। তখন ছেলেটি এক ফোটা দুই ফোটা করে পানি ঢালতেছে বোতলে। ডাকতেছি, ভাই তারাতারি দে। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। ছেলেটি দুষ্ট হাসি দিয়ে বলতেছে, "আরেকদিন অাসলে খাইয়েন"
এই কথা শুনে আমার কাঁধের মেয়েটি হাসতেছে। ফিরে দেখি মেয়েটি সজাগ হয়ে গেছে। অামার তাকানো দেখে হাসি বন্ধ করে দিছে। কারন এখনই কেবল বুঝতে পারল সে এতক্ষন আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল। সম্ভবত সেভেন এইটে পড়ে মেয়েটি। আমারও কিশোর বয়স। যদিও ভালবাসা আসেনি মনে, তবে এতটুকু বুঝেছিলাম যে তাকে দেখার পর মনে ভাল লাগা কাজ করতেছে। লজ্জারাঙ্গা হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে অাছে।
.
পরের স্টেশনে যখন মেয়েরা নেমে গেল, রফিক খুশিতে অাত্মহারা। আমার পাশে মেয়েটি বসাতে সে এতক্ষন হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল।
আমি করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম মেয়েটির দিকে। কেন যেন মনে হচ্ছিল খুব কাছের আপনজনকে হারিয়ে ফেলতেছি। মনের ভিতর একটা হাহাকার কাজ করতেছে। ইচ্ছে হচ্ছিল আমিও মেয়েটির পিছন পিছন হেটে যাই অজানার পথে।
.
চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌছলাম রাত নয়টা পঁয়ত্রিশে। হোটেল থেকে খাওয়ার পর মনে হল এতটুকু ভ্রমন করে ক্লান্ত লাগছে। খুব করে একটা ঘুম দিতে হবে। কিছুক্ষন ঘুরাঘুরির পর বুঝলাম স্টেশনেই ঘুমাতে হবে।
ভালই লাগছিল পানির বোতল মাথার নীচে দিয়ে ঘুমাতে। সাথে অনেক ভিক্ষুকও অাছে। যাদের এই শহরে কোন ঘরবাড়ি নেই। সারাদিন ভিক্ষে করার পর এই স্টেশনটাই ওদের ঠিকানা। অসহায় মানুষদের সাথে ঘুমাতে পেরে নিজের কাছে ভাল লাগছিল।
.
মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠেছি।
আম্মু অসুস্থ্য, আমার নাম ধরে বারবার দেখতে চাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেললাম। বাবা মায়ের একটি মাত্র ছেলে হয়ে বাড়ি থেকে এভাবে পালিয়ে অাসাটা ঠিক হয়নি।
সকালে রফিক বলতেছে, "দোস্ত যদি রাস্তায় পাঁচশত টাকা পাই তাহলে বাড়ি ফিরে যাব। মায়ের হাতে টাকাটা দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেব।
ফোনের দোকান খুঁজতেছি। যে বন্ধুটি সাথে অাসেনি তাকে ফোন করলে বাড়ির খুঁজ খবর পাওয়া যাবে।
রফিক পেছন থেকে ডাকতেছে, "দোস্ত, দুই টাকা কুড়িয়ে পাইছি।"
ঐদিকে নজর না দিয়ে ফোনের দোকান থেকে ফোন দিলাম।
সে বন্ধুটি জানাল, অামাকে খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির মানুষের ঘুম নেই। আম্মু এই পর্যন্ত পানি ছাড়া কিছু খায়নি। শুধু কান্না কররতেছে"
রফিককে বললাম, "দোস্ত আমি বাড়ি যাব, এর বেশী কিছু জানিনা।"
সে বলল, আমিতো অারো অাগে যেতে চাই। তোর জন্য কিছু বলতে পারিনি।
সে বন্ধুটিকে আবার ফোন দিয়ে বললাম, "আম্মুকে বল ভাত খাইতে তাহলে অামি আসব। আমি রওনা দিতেছি। "
আবার সকাল দশটার ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে নরসিংদী রওনা দিলাম।
.
অাম্মু অামাকে বুকে নিয়ে কতটা কান্না করেছে বুঝাতে পারবনা। আম্মুর কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম আম্মুর অনুমতি না নিয়ে দূরে কোথাও যাবনা। অাম্মু পরম মমতায় কপালে চুমো দিল।
.
গভীর রাতে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটি ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। জানালার পাশে সেই মেয়েটি। আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। আমি দৌড়ে ট্রেন ধরার বৃথা চেষ্টা করছি। হঠাৎ পায়ে পাথরের চোট লেগে নীচে পড়ে গেলাম। মেয়েটি কান্না করছে। আর আমি কান্না করতে করতে দেখি ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
এই স্বপ্নটি অামি একবার নয় দুইবার নয় এই ছয় বছরে হাজারোবার দেখেছি। প্রতিবারই ঘুম ভাঙ্গার পর মেয়েটির জন্য মনটা হাহাকার করে উঠত।
.
এই প্রথম আলাদা করে মেয়েটিকে নিয়ে কোন স্বপ্ন দেখলাম। স্টেশনে ট্রেন থামার পর নীচে নেমে দেখি মেয়েটি দূরে অামার জন্য অপেক্ষা করছে। হাত নেড়ে বলতেছে, "এইযে আমি এখানে"
স্বপ্নটি দেখার পর ঘুম ভেঙ্গে গেল। মোবাইলে তাকিয়ে দেখি তিনটা বেজে সতেরো মিনিট।
আজ অার ঘুম হবেনা।
সকালে অাবার নাস্তা করেই বিয়ের বরযাত্রীতে যেতে হবে। চাচাত ভাই অাখাউরা বিয়ে করতেছে। এত দূরে কেউ বিয়ে করে?
মেয়েটি অাখাউড়া থেকেই ট্রেনে উঠেছিল। ইসসস, স্বপ্নটা যদি সত্যি হত। দশ বছর পর অামাকে দেখেকি মেয়েটি চিনতে পারবে? মনে করতে পারবে যে সে একটি ছেলের কাঁধে ঘুমিয়ে ছিল অনেকটা সময়।
"অাসো তুমি অাসো ফিরে
স্বপ্ন নয় সত্যি হয়ে
অামার ভালবাসার নীড়ে"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন