শনিবার, ৬ মে, ২০১৭

এটা গল্প হলেও পারতো..

সকাল সকাল মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল।রেখা আজ আমাকে না নিয়ে একাই ভার্সিটি চলে গেছে।এমনিতেই ব্যাপারটার জন্য সেই লেভেলের মন খারাপ তার উপর আজ একটাও গাড়ী পাচ্ছিনা।ইচ্ছে করতেছে বাসায় চলে যায়।এখন বাসায় গেলেতো আম্মুর নন স্টপ ঝাড়ি শুনতে হবে।তাও ঠিক ছিল।কিন্ত আম্মু ফ্রিতে ভার্সিটি যাওয়ার রাস্তাটাও দেখিয়ে দিবে।যার কারণে আমাকে সব রাগ হজম করে গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।অবশেষে কিছুক্ষণ পর গাড়ী পেলাম।ভার্সিটি পৌঁছে গাড়ী থেকে নেমে গেইট দিয়ে যাওয়ার সময় সময় দেখি আমার ক্রাশও (সিয়াম)আসতেছে।সিয়ামকে দেখে সব রাগ কার্পূর মত উবে গেল।আর এই বজ্জাত ছেলেটা দেখি আমাকে পাশ কাটিয়ে না দেখার মত করে চলে যাচ্ছে।পেছন থেকে ডাক দিলাম,
--এই যে,কেমন আছেন?
--ভাল আছি।তুমি কেমন আছো?
--ভালো।
--তোমাকে একটা কথা বলা দরকার।সেটা হল,আমকে ভাইয়া বলে ডাকবে।'এই যে' বলে ডাকবেনা।প্রায় দেখি এই জিনিসটা।ভুলে যেওনা আমি তোমার সিনিয়র। ক্লাসে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
কথাগুলো বলে হনহন করে চলে গেল।আর আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেল।ক্লাসে গিয়ে নিরামিষটাকে (রেখা) আচ্ছামত ধোলাই দিলাম।সিয়ামের রাগগুলো ও তার উপর ঝাড়লাম।বেচারি অসহায় মুখে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।আর আমি ৩২টা দাঁত বের করে হাসতে লাগলাম।আমার অবস্থা দেখে বেচারি হাসবে না কাঁদবে বুঝতেই পারছেনা।
.
অনেক্ষণ তো বকবক করছি।এখন পরিচয় পর্বটা সেরে নিই।আমি জেসমিন। জেদি,পড়ালেখায় খুব ভাল না হলেও ঠিকঠাকমত পাশ করে ফেলতে পারি।আশেপাশের মানুষদের না গুতালে আমার পেটের ভাত হজম হয়না।প্রচন্ড দুষ্টুমি করি।আর আমার ঠিক উল্টো আমার জানের জান বান্ধুবি রেখা।শান্তশিষ্ট। সারাক্ষণ বই নিয়ে বসে থাকে।বইয়ের বাইরে তার আর কোন জগত নাই।অন্ততপক্ষে আমার এটাই মনে হয়।সে ছোটবেলা থেকেই আমাদের বন্ধুত্ত্ব।সবকিছু শেয়ার করি একে অপরের সাথে।কিন্তু সিয়ামকে যে আমি ভালবাসি তা কখনও শেয়ার করিনি।কেন করিনি তা নিজেও জানিনা।সিয়াম হচ্ছে আমাদের ভার্সিটির সেরা ছাত্রদের একজন।আমার সিনিয়র। প্রথম যেদিন ভার্সিটিতে যাই সেইদিন সিয়ামকে দেখে সেইরাম ক্রাশ খেয়েছিলাম।যে আমি প্রেমে বিশ্বাসী ছিলামনা সে আমি আজ সিয়াম বলতে পাগল।সিয়ামকে কখনও ভাইয়া বলে ডাকিনি।তাই সিয়াম আমাকে কিছুটা এড়িয়ে চলে।তবে কিছুটা আমার দুষ্টুমির জন্যও।তারপরও আমি খুঁজেফিরে সিয়ামের কাছেই হাজির হয় পড়া বুঝিয়ে নেওয়ার নাম করে।হয়তো বুঝতে পারে আমার চাওয়াটা কি, হয়তো নাও বুঝতে পারে।আমি জানিনা।আমি কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়।তাই যখনই সুযোগ পাই পিছু ছাড়িনা।
.
এইভাবে কেটে যাচ্ছে আমার ভার্সিটি লাইফ।মধ্যখানে হঠাৎ একদিন রেখার কথা শুনে আমাদের দুজনের বন্ধুত্ত্বটা শেষ হয়ে যায়।আসলে সেদিন আমিই রাগ করে রেখাকে দূরে টেলে দিয়েছি।রেখা বারবার আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে।কিন্তু আমি কথা বলিনি।
.
সেদিন ভার্সিটিতে ফাংশন থাকায় আমি আর রেখা নীল শাড়ী পড়েছিলাম।সিয়ামকে ও দেখি নীল পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে।যখনই রেখাকে আমার সিয়ামকে ভাললাগার কথাটা বলতে যাবো তখনই রেখা আমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে বলল,
--জেসমিন, তোকে একটা সারপ্রাইজ দিবো।জানিস,তুই খুব হাসবি।কারণ শেষ পর্যন্ত আমি কিনা বই এর ভালবাসার বাইরে আরো একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি।
খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন। আবার খুব খুশিও হয়েছিলাম এই ভেবে যে,নিরামিষ বান্ধুবিটা তাহলে এতদিনে বইয়ের বাইরে যে সুন্দর একটা দুনিয়া আছে সেটা বুঝতে পেরেছে।আমি খুশি হয়ে ফান করে বললাম,
--কে সে,হতভাগা?
--হতভাগা হতে যাবে কেন?আমি শুধু বই নিয়ে পড়ে থাকি বলে এই না যে ভালবাসতে জানিনা।
.
সেদিন আমি তার চোখে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম।ওর খুশি দেখে নিজেরও খুব ভাল লাগছিল।যখন হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে সিয়ামকে দেখাল তখন রেখাকে আমার পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মেয়ে মনে হচ্ছিল।শুধু মনে হচ্ছিল রেখা আমার শত্রু। এছাড়া আর কোন পরিচয় ওর নেই আমার কাছে।যখন আমিও আমার ভালবাসার কথা জানায় তখন সেও সেদিন খুব ঝগড়া করেছিল আমার সাথে।এরপর থেকে দুজন শত্রু হয়ে যায়।ভুলেও কেউ কারো মুখ দেখিনা।
.
কয়েকদিন ধরে রেখাকে দেখতেছি ভার্সিটিতে তেমন আসেনা।মাঝেমধ্যে আসে।যে মেয়েটা কোনদিন একটা ক্লাস ও বাদ দেইনি সে এখন কিনা অনিয়মিত।ভাবা যায়না।চেহারাটা কেমন যেন খুব মলিন লাগে।কোন অসুখ হয়নি তো!
.
এরমধ্যে অনেকবার আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল।কিন্তু আমি বলিনি।কেমন যেন জেদ চেপে গেছিল।হঠাৎ করে রেখা ভার্সিটি আসা বন্ধ করে দিল।এরি মধ্যে বাড়ী থেকে আমার বিয়েও ঠিক করে ফেলে আব্বুর বন্ধুর ছেলের সাথে।আমার আব্বুটাও আমার মতো।ওনার যেটা ঠিক মনে হবে ওনি সেটাই করবেন।কিন্তু কেউ আমাকে বিয়ের ব্যাপারে কিচ্ছু জানাইনি।
.
আজ নিজেকে প্রস্তুত করছি সিয়ামকে প্রপোজ করার জন্য।কিন্তু বারবার সব গুলিয়ে যাচ্ছে।আবার ভয়ও হচ্ছে রেখা আগে থেকে সিয়ামকে প্রপোজ করে ফেলেনি তো!অনেক্ষণ ধরে ভার্সিটির গেইটে সিয়ামের জন্য অপেক্ষা করার পরও সিয়াম আসেনি।তাই সিয়ামের নাম্বার জোগাড় করে বাড়ীতে চলে আসি।ভেবেছিলাম বাড়ীতে গিয়ে রাতে ফোন করব।
.
বিকেলে ছাদে বসে যখন গান শুনছিলাম হঠৎ ফোন বেজে উঠল।স্ক্রিনে রেখার নাম্বার জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।রাগ করার চাইতে আমি অবাক হয়েছি বেশি।কারণ সেদিন ঝগড়া হওয়ার পর থেকে রেখার আর আমার মাঝে ফোনে যোগাযোগ হয়নি।আমরা কেউ কাউকে ভুলেও কল দিনি।কল রিসিভ করবোনা করবোনা করেও ৩য় বারে কল রিসিভ করলাম।ওপাশ থেকে খুব দুর্বল একটা কন্ঠ আমার কানে ভেসে এল।এতদিনের বন্ধুত্ত্বে কন্ঠটা আমার না চেনার কথা নই।হ্যাঁ।ওপাশের কন্ঠটা রেখার।
.
এখন আমি রেখার পাশে বসে আছি।ফোন করার পরপরই আমি হাসপাতালে চলে আসি।রেখার মাথায় টিউমার ধরা পড়েছে। যেটা ওকে এতদিন খুঁড়ে খুঁড়ে খেয়েছে।কখন যে তাকে এ রোগে ধরেছে বুঝতেই পারেনি।ডাক্তার বলে দিয়েছে,চিকিৎসা করাতে অনেক দেরি করে ফেলছে।রেখার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে।
.
নিজেকে খুব অপরাধি মনে হচ্ছে।কেন যে সেদিন তার সাথে কথা বললামনা।রেখা আমার হাতে হাত রেখে বলল,
--জেসমিন, তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস।তোর ভালবাসার মানুষটার উপর ভাগ বসাতে চেয়েছিলাম।তোকে আমি খুব ভালবাসি রে।প্রতিবারের মতই সেদিনও তুই নিজের জেদকে প্রশ্রয় দিয়েছিস।একবারও আমার কথাটা শুনতে চাসনি।
.
জানিস,তোর সাথে ঝগড়া করার পর কেমন জানি খুব খারাপ লাগছিল।বারবার মনে হচ্ছিল আমি কোন ভুল করলামনা তো!আসলে তুই যদি আমাকে কথাটা আগে জানাতি তাহলে হয়তো এমনটা হতোনা।বারবার তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছি।কিন্তু তুই কথা বলিসনি।তাই আমিও আর কথা বলার চেষ্টা করিনি।আসলে আমার মাঝেও জেদ চেপে গেছিল।তবে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর কথা বলতে ছেয়েছি কিন্তু তখনও তুই কথা বলিসনি।
.
সিয়ামকে প্রপোজ করতে যাব বলে সেদিন ভার্সিটি যাওয়ার পথে একটা সিএনজির সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়।তেমন গুরুতর আহত নাহলেও মাথায় খুব ব্যথা পেয়েছিলাম।সেদিন বিভিন্ন পরীক্ষা করার ফলে আমার মাথায় টিউমার ধরা পড়ে। এরপর আর সিয়ামকে আমার ভালবাসার কথা বলতে যায়নি।
.
আজ আমার বিয়ে।হুমম।বিয়েটা সিয়ামের সাথেই হচ্ছে।সেদিন রেখা আমাদের সবাইকে ছেড়ে পরপারে চলে গেছে।তার মৃত্যু আমার মনে খুব অপরাধবোধ জাগিয়ে দিয়েছিল।তাই আমি সিয়ামকে আমার ভালবাসার কথা আর জানায়নি। বাড়ীতে বিয়ের কথা বলতেই সাথে সাথে রাজি হয়ে গেছিলাম।আমি দেখার জন্য ছেলের ছবি দিয়েছিল কিন্তু আমি না দেখে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। একদিন কি একটা খুঁজতে সেদিন আমি ড্রয়ারে সিয়ামের ছবিটা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম আমার সিয়ামের সাথেই বিয়ে হচ্ছে।
.
এখন আমরা দুজন ছাদে বসে আছি।হ্যাঁ।এতক্ষণ আমি তাকে আমাদের সব কথা বলেছি এতক্ষণ। সিয়াম আমাকে বলল,
জেসমিন, তোমাকে আমি আজ কিছু সত্যি কথা বলব।কারণ আজ থেকে আমরা স্বামী স্ত্রী। সারাটা জীবন আমাদের একসাথে কাটাতে হবে।তাই আজকের দিনে তোমাকে আমার সবকিছু জানা প্রয়োজন ।আর সবকিছু শুনার পর আমাকে ভুল বুঝুনা।
.
আমি জানতাম তুমি আমাকে পছন্দ করতে।কিন্তু আমি পছন্দ করতাম রেখাকে।ভালবাসার কথাটা রেখাকে অনেকবার বলতে চেয়েছিলাম।কিন্তু রেখার মাঝে তেমন কিছুই দেখিনি তাই আর সাহস হয়নি।এরপর ভেবেছিলাম একেবারে বিয়ের প্রস্তাব দিবো।কিন্তু হঠাৎ সেদিন তার এক্সিডেন্টের খবর শুনে তার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম।সেদিন জানতে পারি রেখার টিউমারের কথা।তারপরও আমি রেখাকে আমার ভালবাসার কথা বলেছিলাম।কিন্তু সেদিন রেখা আমাকে তার অসুস্থতার দোহাই দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিল।আর তোমাকে বিয়ে করার জন্য ওয়াদা করিয়েছিল।
.
বাড়ীতে এসে যখন আম্মু আমাকে তোমার ছবি দেখিয়েছিল আর না করিনি।রাজি হয়ে গেছি।
.
জেসমিন,আমি রেখাকে ভালবাসি এটা সত্য।কিন্তু এখন তুমি আমার স্ত্রী।আমার কর্তব্য তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া এবং তোমাকে ভালবাসা।আজ থেকে সব ভালবাসা তোমার জন্য।
.
মাঝেমধ্যে আমি পুরনো স্মৃতিতে ডুবে যাবো,সেদিন তুমিও আমার সাথে একই স্মৃতিতে ডুব দিবে তো?
এতক্ষণ আমি সিয়ামের কথা শুনছিলাম।শেষের কথাগুলো শুনে তার কাঁধে মাথা রেখে বললাম,
--হ্যাঁ।আমরা দুজন স্মৃতির মাঝে একসাথে ডুব দিব।কারণ আমাদের দুজনের স্মৃতি তো একই।
.
সিয়াম তার হাত আমার কাঁধে রেখে হালকা করে চাপ দিয়ে আমাকে বলল,
--আজ থেকে তাহলে শুরু হউক আমাদের পথ চলা।অতীতের সবকিছু ভুলে গড়ে তুলব আমাদের ছোট একটা পৃথিবী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন