বুধবার, ৩ মে, ২০১৭

তৃপ্তিকর হাসি

পাশাপাশি চেয়ারে বসিয়ে যখন ছবি তুলতে যাবে, তখন আমার বউয়ের দিকে আমার নজর পড়ল। দেখলাম বউয়ের মুখ একদম সাদা হয়ে আছে। খুব বিশ্রি লাগলো আমার কাছে। মা যখন অরণীর ছবি হাতে নিয়ে বলেছিল, দেখতো মেয়েটাকে পছন্দ হয় নাকি? মেয়েটা বেশী ফরশা না কিন্তু চেহারায় মায়াবী একটা ভাব আছে। আমি মাকে বলেছিলাম, মা তোমার পছন্দ হলে হবে আমাকে দেখতে হবে না। মা আমার কথা শুনে বলেছিল বিয়ে করবি তুই আর তুই দেখবি না? তুই দেখ পছন্দ না হলে তাদের জানিয়ে দিব। আমি মায়ের হাত থেকে ছবি নিয়ে দেখছিলাম শ্যামলা একটা মেয়ে মাথায় ওড়না দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে দেখে আমার মন ছুঁয়ে গেছিল, একদম মায়াবী চেহারা। মায়ের কথায় বিন্দুমাত্র ভুল নেই। শুধু ফরশা হলেই মেয়েরা সুন্দরী হয় এটা যেমন ভুল কথা। তেমনি কালো অথবা শ্যামলা হলে মেয়েরা অসুন্দরী হয় এটা ভুল কথা। সত্যিকার সুন্দরী মেয়েরা হয় মায়াবতী এদের চেহারায় সবসময় মায়া জাড়ানো থাকে। এই মুহূর্তে অরণীর সাথে ছবি তুলতে আমার খুব অসহ্য লাগছে। আমার খুব করে বলতে ইচ্ছে করছিল অরণী তোমার এই চেহারায় একদম ভাল লাগছেনা। কিন্তু বলতে পারলাম না মনের কথা মনেই থেকে গেল। ছবি তোলা শেষ হলে মেয়ের খালা মামা মামী সব আত্মীয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আমি সবাইকে সালাম করতে লাগলাম। গাড়ীতে উঠার সময় অরণী ওর মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে গাড়ীতে উঠলো। অরণীদের বাড়ি থেকে যখন রওনা দিলাম তখন প্রায় সন্ধে হয়ে গেছে। রওনা দেওয়ার কিছুক্ষণ পর আমি এদিকওদিক তাকিয়ে দেখে অরণীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, মেকআপে তোমার মায়াবী চেহারাটা একদম বিশ্রী হয়ে গেছে। অরণী আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। 
.
বাড়িতে আসার পর চিড়িয়াখানার প্রাণী দেখার মত সবাই আমার বউকে দেখতে আসলো। রাত ১১ টা পর্যন্ত এই কাজ চলতে থাকলো। ভীর কমলে মা প্লেটে খাবার নিয়ে গিয়ে অরণীকে খাইয়ে আসলো। প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় খালাতো বোনের বর এসে বলল, শালা বাবু এবার বউয়ের কাছে যাও। আর কতক্ষণ নতুন বউ রেখে বাইরে থাকবে? বুঝতেছিতো ভয় পাচ্ছো, ভয়ের কিছু নেই। দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুলাভাই মুচকি মুচকি হাসছে। আমি দুলাভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে রুমে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। রুমের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় ছোট ভাই এসে বলল, ভাইয়া মা তোকে ডাকে। মায়ের রুমে গেলে মা একটা গলার হাড় বের করে দিয়ে বলল, এটা বৌমাকে দিস। আমি হাড়টা হাতে নিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। মা আমার তাকানোর কারণ বুঝতে পেরে বলল, এই হাড় আর একজোড়া বালা তোর দাদী আমাকে দিয়েছিল। আমি এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছি এগুলা পড়ার বয়স আমার নেই। তুই এটা অরণীকে দিস, বালা জোড়া আবিরের বৌকে দিব। হাড়টা নিয়ে আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম অন্যরুমে ঢোকবার জন্য। যে রুমে ঢোকার জন্য প্রতিটা ছেলে মেয়ে আলাদা আলাদা স্বপ্ন বুনে। রুমে ঢোকার সময় সালাম দিয়ে তারপর রুমে ঢুকলাম। অরণী সালামের উত্তর দিল, দরজা আটকিয়ে বিছানার কাছে গেলে অরণী বিছানা থেকে নেমে এসে আমাকে সালাম করলো। অরণীকে দাড় করিয়ে পকেট থেকে হাড় বের করে ওর গলায় পরিয়ে দিলাম। তারপর ঘোমটা সরিয়ে ওর একগোছা চুল হালকা করে ধরে সূরা আলামনাশরহ পড়ে ওর মুখে ফুঁ দিলাম। এক মাওলানা ওয়াজ করার সময় বলেছিল, বাসার রাতে সূরা আলামনাশরহ পড়ে স্ত্রীর মুখে ফুঁ দিলে অনেকদিন পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর মনোমালিন্য হয় না। 
.
অরণীর চুল ছেড়ে দিয়ে বললাম, বাহ এখন অনেক ভাল লাগছে মেকআপ ধুয়ে ফেলছো তাই না? অরণী বলল, হ্যাঁ আপনি তখন বললেন মেকআপে বিশ্রি লাগছে তাই মুখ ধুয়ে ফেলছি। আচ্ছা আপনি আমার চুল ধরে কি পড়লেন তারপর আবার মুখে ফুঁ দিলেন? আমি অরণীর কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম মেয়েটা কত স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। আমি বললাম, এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলবে নাকি?আসো বিছানায় গিয়ে কথা বলি। অরণী বলল, আগেই বিছানায় যাওয়া যাবেনা। আগে দুই রাকাত নামাজ পড়বো তারপর,আপনার অজু না থাকলে বাতরুমে গিয়ে অজু করে আসুন।আমি বললাম, নামাজ পড়তেই হবে? অরণী শক্ত কন্ঠে বলল হ্যাঁ।অরণীর কথা শুনে আবারো আশ্চর্য হলাম প্রথম রাতেই কী শক্ত শক্ত কথা বলছে না জানি বাকি জীবন কী করে। আমি বললাম আমার সাথে কথা বলতে তোমার ভয় করছেনা? আবার প্রথম রাতেই অধিকার খাটাচ্ছো। অরণী আমার কথা শুনে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, আপনি কী বাঘ নাকি ভাল্লুক আপনাকে দেখে ভয় পেতে হবে। আর গত বাইশ বছর ধরে জমিয়ে রাখা অধিকার আর জমিয়ে রাখতে পারছিনা। তাই এখন থেকেই অধীকার খাটানো শুরু করে দিলাম। আমি বললাম, বাইশ বছর ধরে জমিয়ে রাখা অধিকার মানে কী? অরণী বলল, যে দিন থেকে বুঝেছি বিয়ে করে ঘরসংসার করতে হবে। সেদিন থেকেই অধিকার জন্মানো শুরু করেছি তাছাড়া আমার বয়স এখন বাইশ বছর ধরে নিন অধিকারটাও বাইশ বছরের। আমি বললাম, ওহ তার মানে তুমি সেই ছোট সময় থেকে অধিকার জমিয়ে রেখছো? অরণী আমার কথা শুনে কপাল কুঁচকে বলল মানে? আমি বললাম, মানে তুমি পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই অধিকার জমিয়ে রেখেছো।অরণী আমার দিকে তাকিয়ে বলল আমি তাই বলছি? আমি বললাম, তোমার বয়স বাইশ অধিকার বাইশ বছরের এর মানে কি বোঝায়? অরণী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,ভাল হচ্ছে না কিন্তু আমাকে রাগানোর চেষ্টা করছেন। আমি যা বলছি তাই ভুল বললেও সঠিক, সঠিক বললেও সঠিক। আমি হেসে দিয়ে বললাম আচ্ছা ঠিক আছে। অরণী বলল, এখন অজু করে এসে নামাজে দাঁড়ান। আমি বাতরুমের দিকে ঘুরে দাঁড়ালে অরণী বলল, চুল ধরে কী করলেন বলবেন না? আমি অরণীকে বিষয়টা বুঝিয়ে দিলাম।
.
ওজু করেতে করতে ভাবলাম যাক মেয়েটা খুব সহজেই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আসলে আমিও একটু নার্ভাস ছিলাম মেয়েটা নার্ভাসনেস কাটিয়ে দিল। ওজু করে আসার পর অরণী বলল, আপনি সামনে গিয়ে দাঁড়ান আমি আপনার পিছে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ব। আমি অরণীর কথামত সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নামাজ শেষে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। অরণীকে দেখলাম ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি অরণীকে ডাক দিয়ে বললাম আজ না আমাদের বাসর রাত তুমি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছো কেন? অরণী বলল, বাসর রাত তো কী একদম উল্টাপাল্টা চিন্তা করবেন না আমার ঘুম আসছে আমি ঘুমাব। আমি বললাম আচ্ছা ঘুমাবে কিন্তু কিছু কথা বলব। অরণী বলল, দুষ্টামি করবেননাতো? আমি বললাম, আরে নাহ তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো নাকি? অরণী আমার কথা শুনে আমার দিকে এগিয়ে এসে শুয়ে পড়ল। আমি বললাম, আমি তোমার কাছে কাছে একটা জিনিস চাইবো, সেটা হলো তুমি আমার মায়ের মধ্যে কখনো দেয়াল সৃষ্টি করবেনা। আমি জানি একটা বিবাহিত নারী তার স্বামীর কাছে আর কিছু না চাইলেও ভালবাসা চায়। তুমি যদি আমার মাকে ভালবাসতে পারো আমিও তোমাকে ভালবাস। তুমি হয়তো জানো আমার কোন বোন নেই। আসলে আমার একটা বোন ছিল মাত্র তিন দিন বয়সে মারা যায়। আমি চাইব তুমি আমার মায়ের কাছে তার মেয়ে হয়ে থাকবে। কথা বলা শেষ না হতেই দেখলাম অরণীর একটা হাত আমার গলার উপর চলে এসেছে। আমি বললাম, এটা কি হচ্ছে? আমার দম আটকে যাবেতো। অরণী ঘুমঘুম কন্ঠে বলল, এতটুকু সহ্য করতে না পারলে বিয়ে করছেন কেন?আমি বললাম, আমি এতক্ষণ কী বলছি তুমি শুনেছো? অরণী বলল হু। আমি অরণীকে আর ডিস্টার্ব করলাম না। বিয়ের দিন একটা মেয়ের উপর অনেক ধকল যায়। তারপর একটা বাড়ি ছেড়ে হুট করেই আর একটা বাড়িতে এসে বসবাস শুরু করতে হয়। বিয়ের চার দিন পর অরণীদের বাসায় থেকে ঘুরে আসার পর দুপুরে খেয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলাম। অরণীকে দেখলাম মায়ের রুমে গেল, বাসায় লোকজন না থাকলে মা আমার পাশের রুমেই থাকে। আমি বিছানায় শুয়ে থেকেই অরণীর কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। অরণী মায়ের কাছে যাওয়ার পরেই বলল মা আমি কিছু কথা বলতে চাই। মা বলল, বিছানায় এসে বসো তারপর যা বলার বলো। অরণী মনে হয় বিছানায় গিয়ে বসলো, তারপর বলল মা আমি আজ থেকে আপনাকে তুমি বলেই ডাকবো ঠিক আছে? আর আমাকে শুধু বৌমার চোখে দেখলে হবে না। আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালবাসতে হবে। আমাকে বৌমা বলে ডাকা যাবে না, আমাকে নাম ধরে তুই তুই করে ডাকতে হবে যেভাবে মা মেয়েকে ডাকে বুঝছো? মা মনে হয় অরণীর কথা শুনে আশ্চর্য হলে গেছিল প্রায় এক মিনিট পর বলল, পাকা পাকা কথা শিখে ফেলেছিল। এদিকে আয় দেখি,আমার কাছে আয়। মায়ের কথা শোনার পর আমি তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে উঠে মায়ের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উকি মারলাম। দেখলাম মা অরণীর মুখ দুই হাতে ধরে অরণীর কপালে চুমু এঁকে দিয়ে অরণীকে জড়িয়ে ধরে বলল আমি তোর সব কথা মেনে নিলাম। আজ থেকে তুই শুধু আমার ছেলের বউ না তুই আমার মেয়ে ছেলের বউ দুইটাই। বিয়ের একবছর গত হয়ে গেছে মা আর অরণীর সম্পর্ক এখনো মা মেয়ের মতোই আছে। আমি ছুটির দিনে বাসায় থাকলেও দুপুরে অরণী আমার কাছে শোয় না মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে। হঠাৎ যদি কখনো মা আরর অরণীর মধ্যে মনোমালিন্য হয় তখন মা বলে "আমিতো আর নিজের মা না " মায়ের কথা শুনে অরণী ভেঙচি দিয়ে বলে আমিও তোমার নিজের মেয়ে না বলে এমন হইছে। ওদের কথার মধ্যে আমি কিছু বললে অরণী আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বলবে আমাদের মা মেয়ের ব্যাপারে তোমাকে নাক গলাতে বলিনি। যেদিন একটু ঝগড়া লাগে ওইদিন অরণী দুপুরবেলা নিজের হাতে খাবার খায়না যতক্ষণ না মা অরণীর মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। মা আর অরণীর এমন মধুর সম্পর্ক দেখে আমার মুখে সবসময় একটা তৃপ্তিকর হাসির আভা লেগে থাকে।আমি মনে মনে আল্লাহতালার শুকরিয়া আদায় করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন