বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭

রাস্তার সেই ছেলেটি

নীলের ফোন বেজে চলছে কিন্তু রিসিভ করার কোনো নামই নেই ।। এই দিকে নীলের বন্ধুরা অপেক্ষা করছে তার জন্য ।। কারন অনেক দিন পর তারা এক সাথে আড্ডা দিবে ।। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে তারা একই কলেজে পড়তো ।। আর আজ পাঁচ বছর পর তারা এক সাথে হবে ।।
কিন্তু নীল ফোনই ধরছে না ।। সবাই তখন বলতে লাগলো নীল তো আজ ডক্টর হয়ে গেছে আমাদের কি আর মনে রাখে ।। এত বার ফোন দিচ্ছি তাও ধরছে না ।। আসলে এমনই হয় ।। এই সব বলতে বলতেই নীল ফোন ধরলো ,
- কিরে এত সময় লাগে ফোন ধরতে ??
- আর বলিস না দোস্ত !!! ফোন স্যাইলেন্ট ছিলো বলে বুঝতে পারি নাই ।।
- তুই এখন কোথায় ??
- এই তো দোস্ত ১০ মিনিট লাগবে আসতে ।।
- ওকে আয় তাহলে ।।
,
৩০ মিনিট পর নীল আসলো,
- এই তোর ১০ মিনিট ??
- সরি দোস্ত লেট হয়ে গেছে !!
- হুম , ছেলে এখন ডক্টর আমাদের কথা কি মনে থাকে নাকি ??
- এই ভাবে বলিস না দোস্ত ??
- তো কোন ভাবে বলবো ??
আচ্ছা বাদ দে ।। এখন কি করবি সেটা বল ??
আড্ডা দিবো !!! ওকে তাহলে বসে পর এখানে ।। নীল চুপচাপ বসে আছে কোনো কথা বলছে না ।।
এটা দেখে এক বন্ধু বলে উঠলো
- কি রে মন খারাপ নাকি ?? চুপ কেন ??
- না রে এমনি ।।
- না না এমনি তো না ।। কি হয়ছে সেটা বল ।। যখন ভার্সিটিতে আড্ডা দিতাম তখন তো তুই লেট করতি না ।। আজ লেট করে আসলি তাও আমার মন খারাপ কি হয়েছে বল !!
- নারে সে রকম কিছু না ।।
- ওকে না বললি ।। আমরা তো আর তোর বন্ধু না ।।
- আরে এভাবে বলছিস কেন ?? তোরাই আমার সব ।।
- তাহলে আমাদের বলছিস না কেন ??
- ওকে তাহলে শোন,
,
নীল বলতে শুরু করলো,
আজ তোরা আছিস, আজ আমার কত ফ্রেন্ড ।। আজ আমি তোদের কিছু খাওয়াতে পারছি ।।
কিন্তু আজ থেকে ২০-২২ বছর আগে কেউ ছিলো না আমার, না ছিলো ফ্রেন্ড না ছিলো টাকা ।।
,
যখন আমি ছোট ছিলাম তখন আমার বাবা ষ্টোক করে মারা যায় ।। তারপর থেকে মা সংসার চালাতে থাকে , কিন্তু মা এত টাকা কোথায় পাবে ?? তাই মা একটা বাড়িতে কাজ নেয় ।। মা যে টাকা পেত সেই টাকা দিয়ে শুধু সংসারটা চলতো কোনো রকম ।।
,
আমি যখন ৫ম শ্রেণী তে বৃত্তি পেলাম সেই টাকা দিয়ে নিজের লেখা পড়ার খরচ চালাতাম ।। কখনও দামি কোনো শার্ট আমি পরতে পারি নাই ।। টাকার অভাবে পেটে ক্ষুধা থাকে সত্বেও কিছু কিনে খেতে পারি নাই ।। আমার বলতে খারাপই লাগে মাঝে মাঝে যখন বাড়িতে খাবার থাকতো না পাশের বাড়ির ফেলে দেওয়া খাবার তুলে এনে নিজের ক্ষুধা মিটাতাম ।।
,
সব সময় কম দামি কাপুর পরতাম বলে অনেক লোকই আমাকে রাস্তার ছেলে বলে ডাকতো ।। কখনও কখনও একটা শার্ট, প্যান্ট দিয়ে বছরও পার করছি ।। অথচ আজ সেই নীলেরই এত এত কাপুর মানুষকে দান করছে ।। আমি নিম্ন ভাবে চলা ফেরা করতাম বলে কেউ আমার সাথে সঙ্গ দেয় নি ।।
,
কষ্ট টা তখনই লাগতো যখন বুঝতাম আমি গরিব বলে কেউ আমার পাশে নেই। কেউ আমার সাথে কথা বলে না ।। কিন্তু আজ দেখ আমার কত বন্ধু, সবাই আমার সাথে কথা বলার জন্য কত চেষ্টা করে ।। আমি নীল কিন্তু সে দিনের সেই রাস্তার ছেলে ।। শুধু পার্থক্য আমি আজ ডক্টর ।।
,
জানিস দোস্ত, মাঝে মাঝে দুই টাকার দুইটা বিস্কুট খেয়েও দিন পাড় করছি ।। ক্ষুধায় পেট টা জ্বলে যেতো কিন্তু সে দিন এই নীল কিছু বলতে পারতো না ।।
যখন টিভিন দিতো, আমার ক্লাসের সবাই ৫০, ৬০ টাকা দিয়ে খাবার কিনে খেতো কিন্তু আমি ৫টাকার কেক কেনা দেখে সবাই আমার দিকে অবাক ভাবে তাকিয়ে থাকতো ।।
,
টাকার অভাবে যখন স্কুলের বেতন ঠিক মত দিতে পারতাম না ।। স্কুলের প্রধান শিক্ষক তখন আমায় বলতো , টাকা নেই তো এই স্কুলে ভর্তি হয়ছো কেন ?? রাস্তার ছেলে তাও আবার পড়তে চায় বেতন ভুক্ত স্কুলে ।।
অথচ কিছু দিন আগে সেই শিক্ষক কে আমি নিজের হাতে চিকিৎসা দিছি কোনো টাকা ছাড়াই, যদিও আমাকে চিনতে পারে নাই ।। আমি সেই রাস্তার ছেলে, আমি সেই সে দিনের নীল।।
,
রাতে যখন পড়তে বসি, পাশের বাসার আন্টি তখন তার ছেলে বলে, বাবা তোর জন্য দুধ রেখে গেলাম রাতে মনে করে খেয়ে নিস ।। তখন ছেলেটা বলতো মা দুধ আর ভাল লাগে না ।। তুমি ফলের জুস নিয়ে এসো ।। আমি কথা গুলা শুনে নিরবে কাদতাম ।। কারন প্রতিদিন তো দুরের কথা বছরেও একবার দুধ খেতে পারতাম না ।।
,
বছরে দুই ঈদে মানুষের দান করা চিনি সেমাই রান্না করতো ।। তাই খেয়েই খুশি থাকতাম ।। শুধু তাই না ঈদের আগে মা যাকাত হিসাবে শাড়ী পেত সেই শাড়ী দিয়ে মা বছর পার করে দিতো ।।
,
কখনও ভাল খাবার কিনতে পারতাম না, বাড়ির পাশের শাক ছিলো আমাদের প্রধান খাদ্য ।। বাজারের নিম্ন মানের চাউল খেতাম আমরা ।। আমি যখন খেতে বসতাম, মা আমাকে অনেক কথা বলতো ।। আমি মনে মনে প্রতিঙ্গা করি , আমি বড় হবো অনেক বড় ।। আমি আমার মায়ের কষ্ট আর দেখতে চাই না ।।
স্কুল জীবন এই ভাবেই পাড় করি ।। সব থেকে খারাপ লাগছে কি জানিস, আমি গরীব বলে স্কুলের ছেলেরা আমার সাথে মিসতো না ।। আমার কোনো বন্ধু ছিলো না ।।
,
ইন্টার পাড় করি আরো কষ্টে, রাতে বিভিন্ন হোটেলে কাজ করতাম ফলে রাতের খাবার পেয়ে যেতাম ।। পাশাপাশি রাতে ছাত্র পড়াতাম এতে কষ্ট করে মাস চলে যেতো ।। তবে ইন্টার পড়া অবস্তায় এক স্যার আমার কাছ থেকে প্রাইভেটের টাকা নিত না ।। যার ফলে কিছুটা বেচে যেতাম ।।
,
ইন্টার পাশ করার পর মেডিকেল কোচিং এ ভর্তি হই ।। এত টাকা কোথায় পাবো অনেক চিন্তা মাথায় কাজ করতো।। দিনে কোচিং করতাম আর দুইটা ছাত্র পড়াতাম ।। কিন্তু যখন এই টাকায় হয় না তখন রাতে রিকশা চালানো শুরু করি ।। এতে মুটামুটি মাস চলে যেতো ।। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিতে হতো না ।।
,
অবশেষে আল্লাহর রহমতে আর মায়ের দোয়ায় মেডিকেলে চান্স পাই ।। জানিস আমার মা প্রতি রাতে নামাজ শেষে কাদতো আমার জন্য হয়তো সেই জন্যই আমি এত দুর আসতে পেরেছি।। মেডিকেলের হোষ্টলে থাকতাম বলে বেশি টাকা লাগতো না ।। এই ভাবেই পাড় করি মেডিকেল আর প্রতিমাসে ছাত্র পড়ানোর কিছু টাকা মাকে দিতাম ।।
,
আমি মেডিকেলে থাকা অবস্তায় তোদের সাথে মিসতাম, তোদের সাথে সময় দিতাম, তোরা যখন ডাকতি তখনই যেতাম কারন কি জানিস ?? কারন তোরা আমাকে গরিব বলে দুরে সরিয়ে দিস নাই ।। আমি গরিবের ছেলে জানা সত্বেও তোরা আমাকে কাছে টেনে নিছিস ।। যদিও তোরা কেউ আমার এত কিছু জানতি না ।।
,
আজ আমার মন খারাপের কারন একটাই, যখন আমি স্কুলে ছিলাম আমার তখন কোনো বন্ধু ছিলো না আমি রাস্তার গরিব ছেলে বলে ।। অথচ তোরা ঠিকই আমাকে আপন করে নিছিস ।। এক সময় আমার বন্ধু ছিলো না ।। কিন্তু আজ আমার কত বন্ধু ।।
,
নীল কথা গুলা বলছে আর চোখের পানি দিয়ে বুক ভিজাচ্ছে ।। নীল কথা গুলা শেষ করে চোখটা মুছে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় তার সব বন্ধুর চোখে পানি ।।
কিরে তোরা কাদছিস কেন ?? নীল প্রশ্ন করতেই সবাই নীলকে জরিয়ে ধরে কাদতে থাকে ।। নীল নিজেও কাদা শুরু করলো ।।
অবশেষে নীল তাদের থামলো ।। তখন নীলের বন্ধুরা বলতে লাগলো, তোর মত বন্ধু পেয়ে আমরা অনেক হ্যাপি ।। বন্ধুত্ব টাকা দেখে হয় না বন্ধুত্ব হয় মন মানুষিকতা দেখে ।।
নীল তখন বলতে থাকে সে দিনের সেই স্কুলের মানুষ গুলাকে বলতে চাই, আমি সেই রাস্তার ছেলে নীল ।। আমি সেই গরিব ছেলে নীল ।। কিন্তু আজ আমি ডক্টর ।।
"আমি সেই রাস্তার ছেলে নীল "

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন