আজ ছুটির দিন কোথায় ঘুমাবো তা না বরং সকাল থেকে তনু ৮ বার কল করেছে। আজ তো বোধহয় কপালে খারাপই আছে। তাড়তাড়ি বের হয়েই বাসার সামনে দাড়ানো একটা রিকশায় চড়ে বসলাম। বেশি তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে খেয়ালই করিনি যে রিকশাওয়ালা পন্ঞ্চাশোর্ধ এক মুরুব্বি। আগে দেখলে আমি এই রিকশায় উঠতামই না। এমনিতে তো আস্তে চালাবে তার উপর এমন মুরুব্বির রিকশায় উঠতেও খারাপ লাগে। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। তার উপর তনু ওয়েট করছে। একটু জোর দিয়ে বললাম,
: চাচা, একটু তাড়াতাড়ি চালান। অপরপক্ষ থেকে কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে আমি ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে লগইন করলাম।
.
মেইন রোডের মুখে আসতেই দেখলাম সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারেক সাহেবের মিছিল বের হইছে। মনে পড়লো আজ তো আবার ২৬শে মার্চ। ইচ্ছা করছিলো নিজের চুল নিজে টাইনা ছিড়ে ফেলি। বিড়বিড় করে বললাম, "পুরা রাস্তা ব্লক কইরা দিছে। আরে ভাই যুদ্ধ কইরা কি মাথা কিনে নিছে নাকি" আমার কথায় রিকশাওয়ালা একটু হাসলেন। আমার দিকে ফিরে বললেন,
: হে তো যুদ্ধ করে নাই।
আমি একটু বিস্মিত হলাম।
: মানে ? আপনি কিভাবে জানলেন ? প্রতিউত্তরে মুরুব্বি আবার হাসলেন। : জানি। কারন হে তো আমার বাপের দোস্তো আছিলো। আর সংগ্রাম তো করছিলো আমার বাপে। হে করে নাই। আমি একটু বিরক্ত হলাম। তবু বুজলাম তার কাছে বলার মতো কিছু আছে।
: চাচা আপনার কথা কিছুই বুঝলাম না। একটু খুইলা বলেন।
: হুনো তাইলে। সংগ্রাম যহন শুরু অইলো তহন আমার বয়স বারো বছর। বাপজান তহন ডাকাতিয়ায় নৌকা বাইতো। লগে থাকতো আমগো এই বারেকসাব। এই বারেক চাচা। মাঝেমধ্যি বাপের লগে আমিও যাইতাম। তহন একদিন আচমকা হুনলাম ঘোষ বাড়িতে নাকি আগুন লাগছে।শেখের ভাষন রেডিওতে হুনছি। দেশে তহন মিলিটারি ডুকছে।
.
এর দুই দিন পর হঠাৎ আমার বাপ কই জানি চইলা গেলেন। আর আইলেন না। ঘরে আমার মা একলা। আমার কোন ভাই বোইন ও নাই। তার উপর ঘরে খাওন নাই। না খাইয়া শেষে রোজা রাখন শুরু করলাম। বাপের লাইগা কানতাম। আরো বেশি কানতাম ক্ষিদায়। এরপর থেইকা নিজেই রোজ নৌকা লইয়া ঘাটে যাইতাম। যা রোজগার অয় তাতেই খাওন অইতো।
তহন এতো বুঝ আছিলো না। তবু বুঝতাম দেশের অবস্থা ভালা না। ঘাট পার হবার সময় দুই একদিন খান সেনাও দেখছিলাম। তবু বুঝি নাই দেশের হাল কতো খারাপ। দুই মাস পর আচমকা এক রাইত বাপজান আইলো। হাতে রাইফেল, মাথায় গামছা বান্ধা। বাপরে দেইখা খুশি হইছিলাম না রাগ কইরা বইসাছিলাম ঠিক মনে করবার পারিনা।
.
তয় মনে আছে যেন আব্বা কইছিলো বারেক চাচারে যাতে না কই যে হে আইছিলো। আমি আব্বার দিকে চাইয়া রইলাম কিছু কইলাম না। কতোদিন বাপেরে দেহি না। কতো রাইত মনে নাই। তয় তহনো ফজরের আজানের অনেক দেরী, যখন বারেক চাচা আইলো। লগে দশ বারোজন খান সেনা ও ছিলো। দরজা ভাইঙ্গা ঘরে ঢুকলো। বারেক চাচাই আমারে টাইনা ঘরের বাইরে লইয়া আইলো।
দুইটা লাথি মাইরা কইলো, "শুয়ারের বাচ্চা চিল্লাবি না কইলাম, তোর বাপ হইলো দেশের দুশমন। বহুত দিন পর পাইছি আজ হেরা ছাড়বো না।"
আমারে উঠানের আম গাছটার লগে বাইন্ধা রাখলো।
.
যখন ছাড়লো তখন আজান দিতাছে। ঘরে ডুইকা দেহি রক্ত আর রক্ত। আমার বাপ তহনো মাটিতে পইড়া আছে, দুইডা চোখই নাই।কিছু বুঝলাম না। বুকটা ভিজা তাজা রক্তে। আমার মা তহন খাটে পইড়া আছে। পাগলের মতো কানতাছে। বুকেও কাপড় নাই।
আমারে দেইখা কইলো, "একটু পানি দে বাপ"
দেখলাম ঘরে পানি নাই। নদী বাড়ি থেইকা এক মাইল দূরে। আমি ছুটলাম। যতো জোরে পারি ছুটলাম। চোখে পানি ধরে না। আর হাতে পানির কলস। ঘরে আইসা দেহি মা গলায় দড়ি দিছে।
হাত থেইকা পানি পইড়া গেলো। আমার আর কিছুই করার ছিলো না। মাত্র একটা রাইতে আমি এতিম হইয়া গেলাম। ঘরে মা বাপের লাশ পইড়া আছে, কেউ আইলো না। কেউ না।
.
আমি উঠানে আইসা বইসা পড়লাম। সেইদিন বৃষ্টি হইলো, খুব বৃষ্টি। আমি চিৎকার কইরা কানলাম, কেউ দেখলো না।
আমি দেখলাম চাচার চোখে পানি। কথা বলতে গিয়ে স্বর ভেঙ্গে যাচ্ছে। তবু তিনি বলেই চলছেন,
দেশ স্বাধীন অইলো, রাজাকার বারেক হইলো মুক্তিযোদ্ধা আর আমি হইলাম রিকশাওয়ালা।
.
ততক্ষণে মিছিল চলে গেছে। রিকশা থেকে নেমে যা কিছু পকেটে ছিলো তাই চাচার হাতে দিয়ে বললাম, চাচা আপনার বাবার মতো শহীদদের কারনেই আজ দেশ স্বাধীন। কষ্ট নিয়েন না আজ না হলেও শেষ বিচারের দিন এরা কেউই ছাড় পাবে না। বড় রাস্তা ধরে হাঁটা ধরলাম। আজ নিজের দেশের জন্য গর্ব হচ্ছে। তবু চোখের কোনে জল। তনুকে টেক্সট করলাম, "আজ দেখা হবে না"
বাসায় যেতে হবে। ফ্রেশ হওয়া দরকার।
: চাচা, একটু তাড়াতাড়ি চালান। অপরপক্ষ থেকে কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে আমি ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে লগইন করলাম।
.
মেইন রোডের মুখে আসতেই দেখলাম সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারেক সাহেবের মিছিল বের হইছে। মনে পড়লো আজ তো আবার ২৬শে মার্চ। ইচ্ছা করছিলো নিজের চুল নিজে টাইনা ছিড়ে ফেলি। বিড়বিড় করে বললাম, "পুরা রাস্তা ব্লক কইরা দিছে। আরে ভাই যুদ্ধ কইরা কি মাথা কিনে নিছে নাকি" আমার কথায় রিকশাওয়ালা একটু হাসলেন। আমার দিকে ফিরে বললেন,
: হে তো যুদ্ধ করে নাই।
আমি একটু বিস্মিত হলাম।
: মানে ? আপনি কিভাবে জানলেন ? প্রতিউত্তরে মুরুব্বি আবার হাসলেন। : জানি। কারন হে তো আমার বাপের দোস্তো আছিলো। আর সংগ্রাম তো করছিলো আমার বাপে। হে করে নাই। আমি একটু বিরক্ত হলাম। তবু বুজলাম তার কাছে বলার মতো কিছু আছে।
: চাচা আপনার কথা কিছুই বুঝলাম না। একটু খুইলা বলেন।
: হুনো তাইলে। সংগ্রাম যহন শুরু অইলো তহন আমার বয়স বারো বছর। বাপজান তহন ডাকাতিয়ায় নৌকা বাইতো। লগে থাকতো আমগো এই বারেকসাব। এই বারেক চাচা। মাঝেমধ্যি বাপের লগে আমিও যাইতাম। তহন একদিন আচমকা হুনলাম ঘোষ বাড়িতে নাকি আগুন লাগছে।শেখের ভাষন রেডিওতে হুনছি। দেশে তহন মিলিটারি ডুকছে।
.
এর দুই দিন পর হঠাৎ আমার বাপ কই জানি চইলা গেলেন। আর আইলেন না। ঘরে আমার মা একলা। আমার কোন ভাই বোইন ও নাই। তার উপর ঘরে খাওন নাই। না খাইয়া শেষে রোজা রাখন শুরু করলাম। বাপের লাইগা কানতাম। আরো বেশি কানতাম ক্ষিদায়। এরপর থেইকা নিজেই রোজ নৌকা লইয়া ঘাটে যাইতাম। যা রোজগার অয় তাতেই খাওন অইতো।
তহন এতো বুঝ আছিলো না। তবু বুঝতাম দেশের অবস্থা ভালা না। ঘাট পার হবার সময় দুই একদিন খান সেনাও দেখছিলাম। তবু বুঝি নাই দেশের হাল কতো খারাপ। দুই মাস পর আচমকা এক রাইত বাপজান আইলো। হাতে রাইফেল, মাথায় গামছা বান্ধা। বাপরে দেইখা খুশি হইছিলাম না রাগ কইরা বইসাছিলাম ঠিক মনে করবার পারিনা।
.
তয় মনে আছে যেন আব্বা কইছিলো বারেক চাচারে যাতে না কই যে হে আইছিলো। আমি আব্বার দিকে চাইয়া রইলাম কিছু কইলাম না। কতোদিন বাপেরে দেহি না। কতো রাইত মনে নাই। তয় তহনো ফজরের আজানের অনেক দেরী, যখন বারেক চাচা আইলো। লগে দশ বারোজন খান সেনা ও ছিলো। দরজা ভাইঙ্গা ঘরে ঢুকলো। বারেক চাচাই আমারে টাইনা ঘরের বাইরে লইয়া আইলো।
দুইটা লাথি মাইরা কইলো, "শুয়ারের বাচ্চা চিল্লাবি না কইলাম, তোর বাপ হইলো দেশের দুশমন। বহুত দিন পর পাইছি আজ হেরা ছাড়বো না।"
আমারে উঠানের আম গাছটার লগে বাইন্ধা রাখলো।
.
যখন ছাড়লো তখন আজান দিতাছে। ঘরে ডুইকা দেহি রক্ত আর রক্ত। আমার বাপ তহনো মাটিতে পইড়া আছে, দুইডা চোখই নাই।কিছু বুঝলাম না। বুকটা ভিজা তাজা রক্তে। আমার মা তহন খাটে পইড়া আছে। পাগলের মতো কানতাছে। বুকেও কাপড় নাই।
আমারে দেইখা কইলো, "একটু পানি দে বাপ"
দেখলাম ঘরে পানি নাই। নদী বাড়ি থেইকা এক মাইল দূরে। আমি ছুটলাম। যতো জোরে পারি ছুটলাম। চোখে পানি ধরে না। আর হাতে পানির কলস। ঘরে আইসা দেহি মা গলায় দড়ি দিছে।
হাত থেইকা পানি পইড়া গেলো। আমার আর কিছুই করার ছিলো না। মাত্র একটা রাইতে আমি এতিম হইয়া গেলাম। ঘরে মা বাপের লাশ পইড়া আছে, কেউ আইলো না। কেউ না।
.
আমি উঠানে আইসা বইসা পড়লাম। সেইদিন বৃষ্টি হইলো, খুব বৃষ্টি। আমি চিৎকার কইরা কানলাম, কেউ দেখলো না।
আমি দেখলাম চাচার চোখে পানি। কথা বলতে গিয়ে স্বর ভেঙ্গে যাচ্ছে। তবু তিনি বলেই চলছেন,
দেশ স্বাধীন অইলো, রাজাকার বারেক হইলো মুক্তিযোদ্ধা আর আমি হইলাম রিকশাওয়ালা।
.
ততক্ষণে মিছিল চলে গেছে। রিকশা থেকে নেমে যা কিছু পকেটে ছিলো তাই চাচার হাতে দিয়ে বললাম, চাচা আপনার বাবার মতো শহীদদের কারনেই আজ দেশ স্বাধীন। কষ্ট নিয়েন না আজ না হলেও শেষ বিচারের দিন এরা কেউই ছাড় পাবে না। বড় রাস্তা ধরে হাঁটা ধরলাম। আজ নিজের দেশের জন্য গর্ব হচ্ছে। তবু চোখের কোনে জল। তনুকে টেক্সট করলাম, "আজ দেখা হবে না"
বাসায় যেতে হবে। ফ্রেশ হওয়া দরকার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন