বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০১৭

লাল শাড়ী

ঈদের আর মাত্র তিন দিন বাকী।এবারের ঈদটা আমার খুব ভালই কাটবে ভেবে মনে মনে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললাম।আর ভাল কাটবেই না কেন এবছর অন্য সকল বছরের থেকেও তিনগুন বেশি টাকা ইনকাম করেছি।আর বিশাল একটা বাড়ি তৈরি করেছি।
.
ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে একটা রাজপ্রাসাদতুল্য বিশাল বাড়ি তৈরী করব।বাড়িটির সামনে থাকবে একটা সুন্দর ফুল বাগান।সে বাড়িটি সাজানো হবে আমার পরম মমতাময়ী মা আর আমার ত্যাগী বাবার মনের মাধুরী দিয়ে।সে বাড়িতে থাকবে কমপক্ষে পাচ জন চাকর চাকরানী।সে বাড়িতে আমার মা আর বাবার হুকুম চলবে।
.
আজ যে সেই বাড়ির কাজ সম্পন্ন হলো।তাই ফুরফুরে মেজাজে মনের সুখে আমার স্বপ্নের বাড়ির সৌন্দয্য উপভোগ করছি।হঠাৎ করে একটা কথা মনে হল সেটা হল আজ এলাকার গরীব ও দুস্থ মানুষের জন্য ঈদ এর কিছু সামগ্রী বিতরণ করবো।আর এটার দায়িত্ব আমার চাচার উপরে দিয়েছি।ফোন করে জিজ্ঞেস করে নিলাম কোথায় আছেন তিনি।বলল আর দুই এক ঘন্টা সময় লাগবে আসতে।
.
হঠাৎ ২০ বছর আগের কথা মনে পড়েগেল।আমার বয়স তখন ৯ কি ১০ বছর হবে।আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম।গ্রামের মধ্যে বসবাস করতাম আমাদের পরিবারের সাথে।আমাদের পরিবারে আমি আমার ছোট দুইটা বোন আর আমার বাবা মা সবাই একসাথে থাকতাম।
.
আমাদের তেমন টাকা পয়সা ছিল না বাবা সারাদিন রিক্সা চালাতো আর আমার মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে যা আয় করতো তা দিয়ে আমাদের সংসার কোনভাবে চলতো।আর
সম্বল বলতে শুধু ভিটেটাই ছিল।সবসময় অভাবের মধ্যেই কাটতো আমাদের সংসার।তবুও আমাদের সংসারে সুখ ছিল।
.
এভাবে দেখতে দেখতে রমজান মায়া চলে আসলো।রোজার মাসে আব্বু আম্মু আগের মতই কাজ করতে থাকলো।কিন্তু দেখা গেল আমাদের সংসার চালিয়ে বাড়তি কোন টাকা বা চাহিদা মেটানোর মত টাকা আয় করতে সক্ষম হয়নি।আগের বছরগুলির মতই ঈদ কাটাতে হবে।
.
আগের বছর গুলিতে আমাদের ঈদ কাটতো একদম সাদাসিধে ভাবে।আমার মা বাসায় বাসায় কাজ করতো তাদের কাজ থেকে পুরনো কাপড় নিয়ে আসতো আমাদের জন্য।নতুন কাপড় কোনদিন চাইনি আব্বু আম্মুর কাছে যা তারা দিত তাই নিয়েই খুশি থাকতাম।
.
দেখতে দেখতে রোজার পঁচিশ দিন চলে গেল আর মাত্র পাচ দিন পর ঈদ।ভাবতেই ভাল লাগছে ঈদের আর বেশি নেই।ঈদের আর কিছু না পাই একটু সেমাই খাব,তারপর সব বন্ধুদের নিয়ে হৈ চৈ আর মজায় কাটানো যায় দিনটা।ভাবতেই মনটা আনন্দে নেচে উঠলো।
.
রহিমা খালা এসে আমাদের বাড়িতে বলল কাল নাকি চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে গরিবদের জন্য শাড়ী আর লুঙ্গী বিতরণ করা হবে।আমার মা কে বিকেলে যেতে বলে গেলেন।
আমার মা যাবেন বলে হ্যা সুচক মাথা নাড়ালেন।
.
বিকেলে আমিও সাথে গেলাম মার সাথে চেয়ারম্যান বাড়িতে।সেখানে দেখলাম প্রচুর মানুষ ভিড় করছে শাড়ী আর লুঙ্গী নেয়ার জন্য।আর সবাই লাইনে দাঁড়িয়েছে আমার মাও লাইনে দাঁড়ালো।আমি এক সাইটে দাঁড়িয়ে আছি।
.
দেখতে দেখতে আমার মাও সামনে গেল। যথারীতি মার হাতে একটা শাড়ী দিল।শাড়ীর রংটা কালো ছিল।তাই মা বলছিল,,চাচা আমারে লাল রঙের শাড়ীটা দেন।প্রতিউত্তরে চেয়ারম্যান সাহেব বলছিল,,যেইটা পাইছিস সেটা নিয়ে বাড়ি যা।তারপরেও মা আরেকটু অনুরোধ করেছিল।
.
কিন্তু অনুরোধ তো রাখেনি বরং ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল।গেটের কোনায় লেগে মার হাতে ব্যাথা পায়।আমার সামনে মা এভাবে অপমানিত হওয়ায়।লজ্জায় মুখ আচল দিয়ে ঢেকে ফেলেছিলেন।আর আমি তার চোখে পানি দেখেছিলাম।
.
রাতে বুঝতে পারলাম মার হাত ভেংগে গেছে।কারন কিছুই হাতে তুলতে পারছিলেন না আর খুব ব্যাথা পাচ্ছিলেন।গ্রামের ডাক্তার গফুর চাচাকে দেখিয়েছিলাম তিনি বলেছিলেন হাতের হাড্ডি ভেংগে গেছে।তাকে শহরের ভাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ভাল হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
.
তিনবেলা ঠিক মত খেতেই পাইনা আমরা আর কিভাবে বাবা মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।আমার মাকে আর ডাক্তারের কাছে নিয়ে হয়নি।এভাবেই ভাংগা হাত নিয়েই আস্তে আস্তে কাজ করতেন।।আস্তে আস্তে ব্যাথা কমে যায় কিন্তু হাতটা বাকাই ছিল।তখন থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল আমি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেখাবো।
.
আজ আমি সমাজের বিত্তবানদের একজন কোটি কোটি টাকা আছে আমার আর সাথে এক হাত ভাংগা মা আর রিক্সা চালক বাবাও আছে।কিন্তু আমাকে আজ রিক্সাওয়ালার ছেলে বা কাজের মহিলার ছেলে বলেনা।সবাই বলে আজ আদনান সাহেব বলে।
.
গাড়ির শব্দে আমার কল্পনার সমাপ্তি হল।আমার বড় চাচা এসেছে গরিবদের ঈদ সামগ্রী নিয়ে।বিকেলবেলা এইগুলা আমার মা আর বাবা নিজ হাতে গরিবদের মাঝে বিতরণ করবে এগুলা।
.
বিকেলে আমার বাড়ির সামনে প্রচুর মানুষ ভিড় করলো। এক কথায় অসংখ্য মানুষ ভিড় করেছে।চাচাকে বলে দিলাম কারো সাথে যেন কোন রকম খারাপ ব্যবহার করা না হয়।সবার সাথে যেন ভাল ভাবে ব্যবহার করতে।
.
তারপর আমার মা আর বাবাকে বললাম নিজ হাতে এইগুলা বিতরণ করতে।আমি খেয়াল করে দেখলাম আমার মমতাময়ী মায়ের চোখের কোনা দিয়ে ফোটা ফোটা পানি পরছে।আমি জানি এটা কিসের অশ্রু।শুনেছি মানুষ যখন খুব বেশি আনন্দিত হয় তখন চোখের পানি পড়ে।আর সেটাই আমার মা ক্ষেত্রে ঘটেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন