শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৫

নিশিমন পরী

১১;৪৫। বার্সার খেলা চলছে। একপলকে তাকিয়ে খেলা দেখছে আবির। হঠাত ফোনটা বেজে উঠল। সায়েম ফোন করেছে।
-কিরে তুই কোথায়?
-কোথায় থাকার কথা এখন আমার?
-না মানে, বাসায়?
-হ্যা। কেনো?
-কি করিস? ব্যাস্ত?
-বার্সার খেলা দেখি, না ব্যস্ত না। কোনো দরকার?
-আর্জেন্ট আমার বাসার সামনে আসবি প্লিজ?
-এখন? অসম্ভব। খেলা দেখছি আমি।
-আরে আয়না? প্লিজ প্লিজ প্লিজ? আমার শরীর খারাপ লাগছে। ডক্টরের কাছে যেতে হবে।
-কি হইছে?
-মাথা ঘোরাচ্ছে বমি বমি লাগছে। যেকোনো সময়......
-থাম! আচ্ছা আমি আসছি।
মুচকি হাসল আবির।
-ওকে ডান।
বিশ মিনিট পর...
বনানীর বিয়াল্লিশ নম্বর বাড়ির সামনে সাদা এলিয়নে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। পড়নে লাল ফর্মাল একটা শার্ট, কালো প্যান্টের সাথে ইন করে পড়ে আছে। দুহাত পকেটে ঢোকানো। ছেলেটা আবির।
আবিরের মাথার উপর ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম আলো জ্বলছে। তার পিছনে অর্থাৎ রাস্তার বাম পাশে একটা মিডনাইট ক্লাব থেকে হালকা স্বরের মিউজিক আসছে। তার সামনেই বিয়াল্লিশ নম্বর বাড়ির পুরোটাই সাদা রঙ করা। সাততলা বাড়ির তিনতলায় সায়েমের ফ্যাট।
আবির আসার পর অলরেডি সায়েমকে দুবার ফোন দিয়েছে, সায়েম ধরেনি। কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে সায়েম এখনও নীচে নেমে আসেনি। দাঁড়িয়ে থাকার ফলে আবিরের চোখ হালকা ঢুলছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার চোখ লেগে এসেছিল, হঠাত তার কাধে আস্তে করে কেউ চাপড়ে দিল। আবির চমকে ফিরে তাকাল। একটা অপরিচিত মেয়ে তার পাশে এসে দাড়িয়েছে অথচ সে খেয়াল করেনি!
মেয়েটা তার পাশেই তার মত গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুচকি একটা হাসি দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আবির?’
আবির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। মুখ হা হয়ে গেছে। কোনো রকমে মাথা নেড়ে হ্যা সূচক জবাব দিল।
মেয়েটা অপরূপ সুন্দরী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে হালকা গোলাপি রঙয়ের একটা টি-শার্ট আর আকাশি জিন্স পড়ে আছে। মেয়েটার আরেকটা ব্যাপার হল চুলে বাদামি রঙ করা। সোডিয়ামের আলোয় তা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ঠোটে কড়া করে লিপস্টিক লাগিয়েছে। মেয়েটা হয়ত চুইংগাম চিবুচ্ছে তাই অনবরত মুখ নড়ছে। মুখে মিষ্টি হাসিটা লেগেই আছে। এতকিছুর পরও আবির মেয়েটার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখালনা, মুখ ঘুরিয়ে নিল।
মেয়েটা সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘অনুমান করেছিলাম।’
আবির কিছু বললনা, চুপ করে গেল। মেয়েটা কেমন যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। ব্যাপারটা আবিরের ভাল লাগলনা। বোঝা যাচ্ছে এ মেয়ে নিজে থেকে বেশি কথা বলবে।
মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, ‘কারো জন্য অপেক্ষা করছ?’
আবির এবারো কিছু বললনা, মাথা নাড়ল। মেয়েটা আবার বলল, ‘তুমি জানো? আমি অনুমান করে অনেক কিছুই বলে দিতে পারি।’
আবির নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘ও তাই?’
‘বিশ্বাস হচ্ছেনা তোমার? মেয়েটা অবাক হওয়ার মত করল। ‘আমি শিওর তোমার পকেটে লুমিয়া ১০২০ আছে। তাইনা?’
আবির হঠাত হকচকিয়ে যায়। পকেটে হাত দিয়ে তার লুমিয়াটা বের করে আনল। সে মনে মনে ভেবে পাচ্ছেনা মেয়েটা কিভাবে জানল ব্যাপারটা। অপরিচিত কারো জানার কথা নয়।
মেয়েটা মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘কি বিশ্বাস হয়? তুমি আরও প্রমাণ চাও?’ আবির হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছে। ‘তুমি কারো জন্য অপেক্ষা করছিলেনা? তাকে আবার ফোন কর তো? এবার নিশ্চিত বন্ধ পাবে।’
আবির সাথে সাথেই সায়েমকে ফোন করল, ‘এই মূহুর্তে আপনার কাঙ্খিত নাম্বারে......’ সত্যিই ফোন বন্ধ। মেয়েটা মুচকি হেসে উঠে বলল, ‘কি বলেছিলাম?’ গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘শোনো, তুমি চমকে যাচ্ছ। চমকাবার কিছু নেই। আমি আনুমান করে যা বলি তা স্বাভাবিক ভাবেই মিলে যায়।’ মুচকি হেসে একবার চোখ টিপল।
আবিরের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মেয়েটা আবার বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই বাসায় চলে যাবে এমন কিছু চিন্তা করছ আর আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছোনা তাইনা? দেখ, আমি নিশ্চিত বাসার পথে যাওয়ার সময় তুমি এক্সিডেন্ট করতে পার।’
আবির চোখে আবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার কথা যেরকম বিশ্বাস করতে পারছেনা সেরকম অবিশ্বাসও করতে পারছেনা।
‘আবির তুমি এরকম কনফিউজড হয়ে পড়ছ কেনো? আমি যা বলছি সব অনুমান করেই বলছি। আর তা সত্যিও হয়ে যাচ্চে এটা তুমি এখন অবিশ্বাস করতে পারনা। আমি তোমাকে একটা অফার করব?’
আবির মুখ ফসকে বলে ফেলল, ‘বল?’
‘আজ রাত তো বাসায় জরুরী কোনো তাড়া নেই তাইনা? আর বাসার পথ ধরাও তো ঠিক হবেনা। চল এক কাজ করি রাতটা আমরা গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াই পুরো শহর।’
আবির এতক্ষণে বুলি ফোটাল, ‘তোমার অনুমান বেশ খারাপ।’
মেয়েটা চমকে গেল, ‘কেনো?’
‘রাতটা ঘোরার মত যথেষ্ট তেল আমার আমার নেই।’
‘ও, এই কথা! আচ্ছা চল কোথাও গিয়ে বসব নাহয়।’
ব্যাপারটায় আবিরের বেশ কৌতুহল হচ্ছে। মেয়েটা তার কাছে কি চাইছে তা জানার আগ্রহ বাড়ছে। তাই সে আর না করলনা। বলল, ‘চল।’
আবির ড্রাইভিং সীটে উঠে বসতেই মেয়েটা তার পাশের সীটে উঠে বসল। আবির জিজ্ঞস করল, ‘কোথায় যাব প্রথমে?’
‘তুমি যেদিকে ভাল মনে কর?’
আবির জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নামটা জানা হলনা।’
‘আনিকা!’
‘রূপসী। সুন্দর নাম।’ আবির ড্রাইভিং করছে আর সামনে তাকিয়া কথা চালিয়ে যাচ্ছে।
‘হুম! তোমার সম্পর্কে আরেকটা অনুমান আমার হচ্ছে।’
‘কি অনুমান?’
‘তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে তাইনা?’
আবির সামনে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘হুম! ঠিক অনুমান করেছ। তার নামটা অনুমান করতে পারবে?’
আনিকা একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘উম, সরি বলতে পারছিনা।’
আধ ঘন্টা পর...
আবির আর আনিকা রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। সামনে খোলা মাঠ। রুটির মত খোলা চাদটা সারা মাঠ আলোকিত করে বেড়াচ্ছে। সবদিকে অপরূপ স্নিগ্ধতার সাথে শহরের কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেছে। পরিবেশের সাথে আনিকা মেয়েটাও নিশ্চুপ হয়ে গেছে। আবির একটু আগের আনিকার সাথে এখন এই নিশ্চুপ আনিকার মিল খুজে পাচ্ছেনা।
আবির নিরবতা ভেঙ্গে বলল, ‘তুমিত অনেক অনুমান করলে, সত্যিও হল। এবার আমি একটু অনুমান করি?’
আনিকা না তাকিয়েই জানতে চাইল, ‘কি অনুমান করবে?’
আবির চাদটার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাল। সে বলতে শুরুর করল, ‘সপ্তাহখানেক আগে থেকে একটা অপরিচিত মেয়ে আমাকে প্রতিনিয়ত আমাকে ফোন করে আমার খোজখবর রাখে। যেমন খেয়েছি কিনা, ঘুমোলাম কিনা, কোথায় গেলাম না গেলাম এসব। মেয়েটির সাথে কথা বলতে বলতে আমারো ভালো লেগে যায়। মেয়েটি আমার খোজ খবর নিয়েছে কারণ সে আমাকে ভালোবাসে।’ আবির একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, ‘আর আমি নিশ্চিত আমার পাশে বসা মেয়েটিই সেই মেয়েটি তাইনা? তুমিই পারিশা নওকি?’ কথাটা বলে আবির অল্প হাসছে।
মেয়েটি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। ‘আ...আ...আজ্জব! তু... তুমি কি করে বুঝলে?’
আবির হেসে হেসে বলল, ‘পুরো ব্যাপারটাই এখন আমার কাছে পরিষ্কার। আমার অনুমান সত্যি হলে, তুমি আর সায়েম আগে থেকেই প্ল্যান করে নিয়েছিলে সব। আমাকে কল করে ডেকে আনবে। অনুমানের কথা আমাকে হতভম্ব করে দিবে। তারপর যেন আমি তোমার কথাগুলো শুনতে বাধ্য হই আর তোমার সাথে সময়টা কাটাই। তাইনা?’
পারিশা এবার একেবারে হা হয়ে গেছে, ‘হ্যা!’
এবার আরেকটা অনুমান করি। তোমার এতসব ঘটনা বানানোর কারণ নিশ্চয়ই আমাকে সামনাসামনি প্রপোজ করে আরো বোকা বানানোর জন্য। তাইনা?’
‘অনেকটাই ঠিক। কিন্তু তুমিত বললে তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে।’
‘ হাহা! সেখানেই তুমি ধরা খেয়েছ। তুমি আমার কাছ থেকে না আশা করছিলে কিন্তু আমি হ্যা বলায় তুমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। নাম জিজ্ঞেস করায় তুমি আরও থতমত খেয় যাও। আর এরপর থেকে পুরোটা সময়ই তুমি চুপচাপ হয়ে ছিলে।’
পারিশা এবার খিল খিল করে হেসে দিল। ‘উফফ! কি মানুষরে বাবা। আচ্ছা মাফ চাইছি এতসবের জন্য। কিন্তু এতকিছু যার জন্য করলাম তার উত্তরটা কি পাবনা?’
আবিরও হেসে দেয়। ‘আমার নিশিমন পরী উত্তরটা নিশ্চয়ই আপনি ভালো অনুমান করতে পারছেন। হ্যা ভালোবাসি তোমাকে। চাদের নিঃস্বার্থ আলোর মত ভালোবাসি তোমাকে।’
আবির পারিশাকে কাছে টেনে নেয়। পারিশাও তার কাধে মাথা গুজে দেয়। এই নিরবতায় আর কোনো কথা হবেনা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন