বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০১৬

অসীম অপেক্ষা


>- এই হারামি তুই কইরে? ভার্সিটি আসিস না কেনো?
>- একি রে,,, তুই জানিস না!! আমি শ্বশুর বাড়ি।
>- আচ্ছা!! ভার্সিটি আয় আমি তোর শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার শখ বের করছি।
>- আচ্ছা আগামিকাল ভার্সিটি যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যাবি।
রাফি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে অনেক দিন ক্লাশে যায়নি। শারীরিকভাবে একটু অসুস্থ ছিলো তাই।
লাবন্য আর রাফির বন্ধুত্ব তাদের বাবা মায়ের বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করেই।
লাবন্যের বাবা আর রাফির বাবা খুব ভালো বন্ধু। পাশাপাশি এলাকায়ই দুজনের বাড়ি।
কিন্তু রাফির বাবা-মা দুজনেই আমেরিকা থাকে। রাফিকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু রাফি বলল সে ভার্সিটি ফাইনাল ইয়ারের পর যাবে। রাফির বাবা কিছুতেই রাফির কথা শুনতেন না যদি এখানে লাবন্যরা না থাকতো।
মধ্যরাতে হঠাৎ রাফির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কেমন যেনো অসস্থি লাগছে। মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। খুব পানির তৃষ্ণা পাচ্ছে। একটুও ঘুমাতে পারেনি রাফি।
যদিও মাঝে মাঝেই রাফির মাথা ব্যাথা করে কিন্তু কখনো এতো বেশি হয়নি। ইদানিং শরীরটাও কেমন দুর্বল লাগে। সময় করে একদিন ডাক্তার দেখাবে ভাবলো রাফি।
বিকেলে লাবন্যর ফোন,
>- ফোন ধরেই রাফি বলল, কিরে লেবু? 
>- বাঁদর কখনো মানুষ হয়না। তোরে কতবার নিষেদ করছি আমাকে লেবু বলবিনা? লাবন্য বলতে পারিস না এতো বড় হয়েছিস?
>- তুই তারাতারি ডাক্তার দেখা। তোর চোখে আসলেই প্রবলেম হইছে। এতো বড় মানুষটাকে তোর চোখে বাঁদরের সমান মনে হইলো কিভাবে?
>- আম্মু তোকে বাসায় আসতে বলছে, তারাতারি আসবি। আর আসার সময় পিঠে কম্বল বেধে আসবি।
যদিও রাফি আর লাবন্যের মধ্যে দা-কোমড়োর সম্পর্ক কিন্তু তাদের বন্ধুত্বে কোনো খাদ নেই।
রাফি লাবন্যদের বাসার ভিতর ঢুকেই কেমন ভয় পেয়ে গেলো।
এতো অন্ধকার কেনো!! এক পা দু' পা করে সামনে এগুতেই হঠাৎ লাইট জ্বলে উঠলো আর তার কানে ভেসে আসতে লাগলো,
হেপি বার্থডে টু ইউ
হেপি বার্থডে টু ইউ
হেপি বার্থডে টু ইউ রাফি
হেপি বার্থডে টু ইউ
সামনে তাকিয়ে দেখলো লাবন্য, লাবন্যের ছোট ভাই, লাবন্যের বাবা-মা, পাশে একটা লেপটপে ভিডিও কনফারেন্সিংএ রাফির বাবা-মা, তাদের সামনের টেবিলে ইয়া বড় একটা কেক আর পাশে সব ফ্রেন্ডসরা।
পার্টিতে সবাই অনেক মজা করলো। রাফিও অনেক হাসাহাসি করতেছে কিন্তু তার অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। আজো মাথার ব্যাথাটা তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো।
পার্টি শেষে সবাই চলে গেলো। রাফি আজ লাবন্যদের ওখানেই থাকবে। 
লাবন্য খেয়াল করলো রাফি চুপচাপ বসে আছে। 
>- বাঁদর আজ চুপচাপ!! চাঁদটা কি আজ আকাশ থেকে খসে পড়লো নাকি দেখে আসি তো!
>- তোর কি ধারনা আমি তোর মতো সারাক্ষন বকবক করি? আমি অনেক শান্ত আর ভদ্র ছেলে বুঝলি?
>- কি! তুই শান্ত! হি হি হি,,,জোকস অব দ্যা নাইট।
>- তোর বুদ্ধি সুদ্ধি দিন দিন লোপ পাচ্ছে। ভালো কথাকেও জোকস মনে হয় তোর। যা ভাগ, ঘুমো গিয়ে।
আজ রাতেও রাফি ঘুমাতে পারেনি। সকালে উঠে লাবন্য রাফিকে দেখে বলল,
>- কিরে? সারারাত জেগে প্রেম করেছিস নাকি? চোখমুখের অবস্থা এমন কেন?
>- রাতে ঘুমাতে পারিনি রে। মাথায় অনেক পেইন ছিলো।
>- জানি জানি এখন কতো বাহানাই দিবি।
>- নারে সত্যিই। লাস্ট কয়েকমাস ধরেই এমন।
লাবন্যের চোখেমুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। লাবন্য রাফিকে আজই ডাক্তার দেখাতে বলল। 
সকালে নাস্তা করে রাফি লাবন্যদের বাসা থেকে বের হয়ে ওর বাসায় আসলো।
বিকালের দিকে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হলো। 
রাত ৯টা। রাফি হসপিটালের একটা চেয়ারে বসে আছে। ডাক্তার আজকের মধ্যেই অনেকগুলো টেস্ট করতে দিয়েছেন।
টেস্টগুলো করে এসে বসে বসে রিপোর্ট আসার অপেক্ষা করছে।
সকালে লাবন্য অনেকবার ফোন দিয়েছে রাফি ধরেনি। ভার্সিটিতে গিয়ে রাফিকে অনেক খুঁজাখুঁজির পর ক্লাশরুমে 
গিয়ে দেখে রাফি একা বসে আছে।
>- হারামি তোর কানে কি ঠাডা পরছে? নাকি ফোনে?
>- না শুধু মাথায়।
> মানে?
>- আরে সব ঠিকাছে।
>- তাহলে কল দিছি যে দেখিসনি হারামি? জানিস একটা খুশির সংবাদ দেয়ার জন্য তোরে ফোন দিছিলাম।
>- বলে ফেল।
>- অনিক দেশে ফিরছে গতকাল।
>- কোন অনিক?
>- তুই কি সব খেয়ে ফেললি? যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
>- আচ্ছা ওই পেঁচাটার নাম তাহলে অনিক? 
>- খবরদার তুই ওরে পেঁচা বলবিনা। তোর বউ তো হবে ডাইনি, গাধী আর বাঁদরনী।
>- আমার বউ তোর থেকে অনেক ভালো আর কিউট হবে।
>- কোনো ভালো মেয়ে তোকে বিয়ে করবেনা,,গাধী ছাড়া।
>- দেখিস কেমন পরীর মতো বউ ঘরে আনি।
>- দেখা যাবে হুহ। 
তা তুই যে ডাক্তারের কাছে গেছিলি কি বলল? প্রেমরোগ তো? আজই অঙ্কেলকে বলে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করতেছি দাঁড়া।
>- আমি এখন যাইরে, একটা জরুরী কাজ ছিলো ভুলে গেছিলাম।
>- আরে দাঁড়া,,,এই রাফি,,,এই দাঁড়াবি নাকি দৌঁড়াবি??
লাবন্যের কোনো কথাই যেনো রাফির কানে যাচ্ছেনা। আশেপাশের কোনো কিছুতেই রাফির খেয়াল নেই। রাফিকে আজ যেতে হবে,,,অনেক দুরে,,,লাবন্যের নাগালের বাইরে।
বেশ কয়েকদিন হয়ে গেলো রাফির কোনো খবর নেই, ফোনও বন্ধ। পরদিন সকালে লাবন্য রাফির বাসায় আসলো।
অন্য সময় হলে বাসায় এসে রুমে না ঢুকেই আগে রাফিকে এত্তগুলা ঝারি দিতো। কিন্তু আজ এইগুলা দেখে লাবন্য আর কিছু বলতে পারলো না।
রুমের লাইট, জানালা সব বন্ধ। বিছানার চাদর মেঝেতে পরে আছে। কাপরগুলো এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পানির গ্লাস নিচে পরে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ রেগে সব ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।
আর রাফি ঘরের এক কোণে ফ্লোরে পরে আছে। পাশে সেদিনের টেস্টের সব রিপোর্টগুলোও।
লাবন্য তারাতারি বাসায় ফোন দিয়ে ওর মাকে হসপিটাল থেকে এম্বুলেন্স নিয়ে আসতে বলল।
সেদিন রাফির ব্রেন ক্যান্সার ধরা পরেছিলো। রাফি কাউকে কিছুই জানায়নি। কাউকে না জানিয়েই হয়তো চলে যেতে চাইছিলো সে।
রাফির বাবা-মা দেশে আসলেন দুইদিন হলো।
আজ ডাক্তার রাফিকে সিট থেকে নামিয়ে দিলো। রাফির চঞ্চল দেহটা আজ নিথর হয়ে আছে।
লাবন্যের হাজারো চিৎকার আজ রাফির কানে পৌঁছায়না। লেবু বলে আজ রাফি চেঁচিয়ে উঠেনা।
আজও রাফির জন্মদিনে সবাই একসাথে হয়েছে। মিলাদ আর দোয়া করার পর সবকিছুই সেদিনের মতো করা হয়েছে।
লাইট অফ করে রাফির অপেক্ষা করতে করতে জন্মদিনের তারিখটা আজ চলে গেলো কিন্তু রাফির আগমন ঘটলো না। হেপি বার্থডে গানিটা আজ কারোরই গাওয়া হলো না। সবার হাসির বদলে আজ কান্নাটাই বেশি হলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন