চাঁদটা তার আটটি দশার মধ্যে এখন ঠিক কোন দশায় আছে তা ঠিক অনুধাবন করা যাচ্ছেনা। তবে শীগ্রই যে তা ভরা পূর্ণিমায় রুপ নিবে তাতে সন্দেহ নেই। সে যাক! চাঁদকে ভরা পূর্ণিমা পেতে হলেতো একটু অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু চৈতি কে তা করতে হবেনা। এখনি ওর মন-প্রাণ জুড়ে সুখের ভরা পূর্ণিমার জোয়ার বইছে। কিন্তু দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার দিকে তাকাতেই ওর মনে অমবস্যা নেমে এল। রাত প্রায় ২টা! অথচ অভ্র এখনো এলোনা। ধ্যাৎ! বাসর রাতে কেউ এরকম করে? কিজানি! মানুষ টা না জানি কতো বিরক্তিকর হবে? চৈতি মনে মনে ঠিক করে রাখে,খুব অভীমান করে থাকবে ও অভ্রর উপর। অভ্র যতোক্ষণ পাগলামী দিয়ে ওর রাগ ভাঙ্গাচ্ছে ততোক্ষণ একটুও কথা বলবেনা ও অভ্রর সাথে।
.
আরও অনেক্ষণ পর অভ্র ঘরে ডুকল। চৈতি মুখ ফিরিয়ে খুব অভীমান করে বসে আছে। ভাবছে আজ অভ্র খুব মজা দেখাবে। কিন্তু আশায় গুড়েবালি। অভ্র এসেই বললো,আপনি ঘুমাননি এখনো? অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমান। চৈতির ভিতরটা যেনো কে সজোরে নাড়া দিলো। কিছুই বুঝতে পারছেনা ও। তাই রাগ-অভীমান সব ভুলে অভ্রকে প্রশ্ন করলো---
~ আমি ঘুমাবো মানে? এতো রাত করে আসলেন তাও এখন ঘুমাতে বলছেন? চলেন না দুজন গল্প করি? জানেন আমার কতো স্বপ্ন ছিলো,আমি আর আমার হাজবেন্ড একটা কুঁড়েঘরে থাকবো! ভালোবাসার কুঁড়েঘর। তার আনাড়ি দেয়ালে একটা ফুটফুটে বাচ্চার ছবি ঝোলানো থাকবে। ঘরের কোণায় থাকবে একটা কৃত্রিম গোলাপ ফুলের টব। আর....
~ উফ! থামুনতো, এতো ন্যাকামি আমার পছন্দ না। ঘুমাতে বলছি,চুপচাপ ঘুমান।
বলেই একটা সিগারেট ধরালো অভ্র!
~ আর এ আপনি সিগারেট ধরালেন যে? সিগারেটের ধোঁয়া একদম সহ্য করতে পারিনা আমি? আর এরকম একটা রাতে আপনি কি করছেন এসব?
~ আমার যা ইচ্ছে করছি। তাতে আপনার কি? ভালো না লাগলে বাইরে গিয়ে ঘুমান।
~ তাহলে আমাকে বিয়ে করলেন কেনো?
~ আমি চাইনি নিশিকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে। আমি নিশিকেই ভালোবাসি আজও। শুধু বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে আমাকে বিয়েটা করতে হয়েছে। বাবা অনেক আগ থেকেই হুইল চেয়ারটাকে আপন করে নিয়েছেন। মায়ের অবস্থাও ভালোনা। ভালো করেই জানেন আমি বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। তাই উনাদের সুখী করতেই আপনাকে উনাদের পছন্দমতো বিয়ে করা!
~ কিন্তু আমিতো অন্য কাউকে ভালোবাসিনা। কখনো অপরিচিত কোনো ছেলের সাথে কথা পর্যন্ত বলিনি,শুধু আমার হাজব্যান্ডের জন্য নিজেকে হেফাজত রাখবো বলে.......
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো চৈতি। কিন্তু অভ্রের চোখের চোখ পড়তেই ও চুপ হয়ে গেলো। ভীষণ রকম রক্তিম দেখাচ্ছে অভ্রর চোখগুলো। চৈতি কখনো প্রেম করেনি,তবুও অভ্রের মনের কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারছে। তাই নীরবে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো ও।
.
চৈতি সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। সূর্যের আলো ভালো করে ফোটার আগেই ও ফ্রেশ হয়ে বসে আছে। কিন্তু অভ্র ঘুমিয়েছে বেঘোরে। অভ্র ঘুম থেকে উঠে একটা কথাও বললোনা চৈতির সাথে। চুপচাপ ওয়াসরুমে চলে গেলো। ততোক্ষণে চৈতি অভ্রর জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসলো। অভ্র আসতেই ওর হাতে চা এগিয়ে দিলো চৈতি। অভ্র চায়ের কাপটাকে সজোরে মেঝেতে আছাড় দিয়ে বের হয়ে গেলো। আবার একটু পর ই ফিরে আসলো সাথে সাথে। এসেই আস্তে করে চৈতির কানে কানে বললো-
~ মা আসছেন, প্লিজ উনার কাছে এসবের কিছুই বলবেন না। খুব কষ্ট পাবেন উনি।
বলেই কাপের ভাঙ্গা টুকরোগুলো সরিয়ে সদ্য কেনা গামছাটা দিয়ে মেঝের চাগুলো পরিষ্কার করতে লাগলো অভ্র। চৈতি আনমনে ভাবছে,অভ্র কি একবারও ওর ফোলা চোখগুলো দেখেনি? ওরতো কতো স্বপ্ন ছিলো এই গামছাটা দিয়ে সকালে মাথার পানি মুছতে মুছতে পর্দাটা ফাঁক করে দিবে। আর অভ্রর চোখে সূর্যের আলো পড়তেই ঘুম ভাঙ্গবে ওর। কিন্তু......
~ বৌমা আসবো?
অভ্রর মায়ের ডাকে ঘোর কাটে চৈতির।
~ হুম,আসুন মা। কেমন আছেন?
~ আমি খুব ভালো। আর থাকবোইনা কেনো বলো? এতোদিন পর একজনকে পেলাম আমার পাগল ছেলেটাকে আগলে রাখতে। ওকে ইচ্ছেমতো শাসন করতে!
বলেই চৈতির কপালে দু'টো চুমু খেলেন তিনি। আর হাসতে হাসতে বললেন,একটা তোমার আর একটা আমার ফুটফুটে মিষ্টি নাতিটার জন্য! হঠাৎ নিচে কাজ আছে বলে চলে গেলেন তিনি। চৈতী কিছু না বলে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লো। অভ্র বেরিয়ে গেলো বাইরে। সারাদিন আর পাত্তা মিললনা অভ্রর। আসলো রাত দশটায়। অভ্র দেখেই চিৎকার শুরু করে দিলো ওর আম্মু---
~ পেয়েছিস টা কি হ্যাঁ? নতুন বউকে ফেলে কেউ এরকম বাইরে বাইরে ঘুরে? মানুষ হলিনা আর। শুন কাল বউমাকে নিয়ে মার্কেট এ যাবি। কেনাকাটা করে আসবি কিছু।
অভ্র হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। রীতিমতো ভিমরি খেলেন তিনি। চৈতি বিষয়টা বুঝতে পেরে বললো---
~ কিছু হয়নি। আমি দেখছি মা।
অভ্র খাটে বসে একমনে সিগারেট টানছে। চৈতি পাশে গিয়ে বসলো। একটা কথা বলবো অভ্র?
~ নাহ্!
~ কিন্তু আপনাকে শুনতে হবে। মায়ের খুশীর জন্য হলেও।
~ বলছিনা শুনবোনা?
~ তাহলে আগামীকাল যাচ্ছি মার্কেট করতে এইতো?
অভ্র কথা না বলে স্বশব্দে একটা চড় দিলো চৈতিকে। কিন্তু চৈতি কাঁদলোনা একটুও। বসার টুলটা টেনে নিয়ে জানালাটা একটু ফাঁক করে সারা রাত আকাশ দেখলো ও। কিন্তু ওদিকে অভ্রের ভ্রুক্ষেপ নেই একটুও।
.
অভ্র পৃথিবীর সব অবহেলা করতে পারে শুধু মা-বাবাকে ছাড়া। তাই সকালে উঠেই চৈতি কে মার্কেট এ যাওয়ার জন্য তৈরী হতে বললো। চৈতি বিনা বাক্য ব্যয়ে বাধ্য মেয়ের তৈরি হয়ে নিলো। প্রায় দেড় ঘন্টা পর মার্কেট এ এসে পৌঁছলো ওরা। অবশ্য ওদের বাসা থেকে ২০মিনিট দূরত্বে একটা মার্কেট আছে। কিন্তু ওটা অতো ভালো মানের না। তাই আসার সময় এ মার্কেটে আসতে আদেশ করছিলো অভ্রর আম্মু। চৈতি শাড়ি দেখছে একটা একটা করে। অভ্র নিশ্চুপ এ সব।
.
হঠাৎ করেই ও যেনো নিশির কণ্ঠ শুনতে পেলো। কিন্তু এখানে নিশি আসবে কোথা থেকে? ওতো তিন বছর আগে হারিয়ে গেছে ওর লাইফ থেকে। কিন্তু না,অভ্র মিথ্যে দেখেনি। সত্যিই নিশি পাশের দোকানটায় দেড় বছরের একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে কান্না থামানো চেষ্টা করছে। ছেলেটা জুস খেতে খুব কান্না করছে। তখন ই একটা ভদ্রলোক ছেলেটাকে নিশির কোল থেকে নিয়ে বাইরে দোকানে চলে গেলো। আর নিশিকে দাঁড় করিয়ে গেলো এতোক্ষণ ধরে কেনাকাটা করার ব্যাগগুলো নিয়ে।
.
অভ্রের চোখে চোখ পড়তেই নিশি কেমন চমকে উঠলো। অভ্র খুব দ্রুত পায়ে নিশির সামনে এগিয়ে গেলো---
~ এতোদিন কোথায় ছিলে নিশি? কতো খুঁজছি তোমাকে জানো? কেনো এমন করলে আমার সাথে?
~ আপনি কে? আপনাকে আমি চিনিনা।
~ আমাকে চিনোনা নিশি? আমি অভ্র! সেই ভার্সিটির পাগলু ছেলেটা। যে সবার রিলেশন ঠিক করে দিতো। কিন্তু নিজে কখনো লাভ করতোনা। অনেক মেয়েই আমাকে লাভ করতে চেয়েছিলো। বাট ওদের সবাইকে আমি অগ্রাহ্য করেছি। পারিনি শুধু তোমাকে!
~ হুম পারেন নি জানি! বাট এটা ছিল শুধু অভীনয়। বন্ধুদের সাথে বাজি। কিন্তু যখন বুঝলাম আপনি সত্যিই লাভ করেন আমাকে তখন,একটা ছেলে আমাকে খুব ডিস্টার্ব করে,আব্বুকে এরকম বুঝিয়ে বাসা চেঞ্জ করে আমরা চলে যাই। তারপর কেটে গেলো তিনটা বছর। আর এখনতো সব দেখতেই পারছেন!
নিশির হাজবেন্ড ওদের বাচ্চাটা কোলে নিয়ে ফিরে আসতেই ওরা চলে গেলো। বাচ্চার মতো সেখানেই অঝর কাঁদতে লাগলো অভ্র! হঠাৎ পিছনে কারো কোমল স্পর্শ অনুভব করলো ও। লজ্জা-শরম ভুলে চৈতিও খুব কাঁদছে। তারপর অভ্রকে বললো,কিছু হবেনা। সব ঠিক হয়ে যাবে আবার আগের মতো। অভ্র কিছু বললোনা। বাইরে এসে চৈতিকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে একটা লেকের পাড়ে এসে বসলো।
.
জীবনের হিসেব মেলাতে মেলাতে কখন যে বিকেল ঘনিয়ে এল,বুঝতেই পারলোনা ও। হঠাৎ কেনো জানি চৈতিকে খুব অনুভব করতে লাগলো অভ্র! থাপ্পর খেয়ে চৈতির চুপচাপ বসে থাকা। দুরন্ত- চঞ্চল,অবাধ্য কিশোরির মতো বাসর ঘরে নিজের স্বপ্নগুলো বলা। অনিচ্ছা থাকা স্বত্তেও ওর খুশীর জন্য! ওর বাবা-মায়ের খুশীর জন্য ভাঙ্গা মন নিয়ে চৈতির মার্কেট করতে আশা। সবশেষে ওকে এতো কষ্ট দেয়ার পরও অভ্রকে সব আগের মতো ঠিক করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া,এক এক করে সব যেনো জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠছে অভ্রের চোখের সামনে।
.
হুম! আজকেও অভ্র দেরী করে রাতে বাসায় ফেরে। তবে তা অনিচ্ছাকৃত। কিন্তু চৈতিকে কোথাও খুঁজে পায়না ও। অবশেষে বাড়ির ছাদে দেখা মিললো চৈতির। চুপচাপ বসে আকাশ দেখছে। অভ্রকে দেখেই সচেতন হয়ে উঠলো চৈতি। তারপর একরাশ বিষ্ময় নিয়ে বললো--
~তোমার হাতে ওসব কি?
~ একটা কৃত্রিম গোলাপ ফুলের টব। আর এটা একটা কিউট বাচ্চার ছবি!
~ এসব কেনো?
~ কুঁড়েঘর সাজাবো বলে! ভালোবাসার কুঁড়েঘর।
~ পাগলামী করো?
~ ছাদে সেটা আর পারছি কই? রুমে চলো,ওটাকে কুঁড়েঘর বানিয়ে তারপর দেখাবো পাগলামী কাকে বলে?
~ চৈতি একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললো আমি পারবোনা যেতে। এখানেই ভালো লাগছে!
অভ্রকে ফাঁকি দেয়া অতো সোজা নয়। চৈতির হাসিটার অর্থ সে ঠিক বুঝে গেলো। তাই চৈতিকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে,আড়কোলে করে ওকে রুমে নিয়ে গেলো অভ্র। রুমটাকে ওরা কুঁড়েঘর বানাবে কিনা কেউ জানেনা। হয়তো বানালেও এতো তাড়াহুড়োর মাঝে তা পারফেক্ট হবেনা। কিন্তু পাগলামীটা যে আজ ঠিক পারফেক্ট হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই!!!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন