রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে শিশির। প্রতিদিনই একি জায়গায় শিশিরকে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কারনটা বিথী, বিথীকে ও ভীষণ ভালবাসে কিন্তু ওকে কিছু বলতে পারে না। শুধু দূর থেকে তাকিয়ে ওর হেটে যাওয়ার মূহুর্তগুলো গভীর মনযোগে উপভোগ করে। একটা মেয়ের হেঁটে যাওয়া দেখতে কি প্রতিদিনই ভাল লাগে? বড়ই অবাক দৃশ্য। দীর্ঘ চার বছর যাবত ও এটাই করে আসছে। এমন দৃশ্য খুবই বিরল। লোকে মাঝমধ্যে পাগল ভাবে শিশিরকে। কিন্তু শিশিরের এটাই ভীষণ ভাললাগে। চোখে কালো ফ্রেমের ইয়া বড় একটা চশমা, চুলগুলো এলোমেলো, পায়ে চটি জুতো। আজ শিশিরকে দেখে মনে হচ্ছে বাসা থেকে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। যাক অবশেষে বোকাটার বুদ্ধি বেড়েছে...
.
--বিথী শুনোও, তোমার সাথে কিছু কথা আছে। (শিশির)
--হুমমমম, বলো। কিন্তু যা বলার দ্রুত বলবে। আমার কাজ আছে।(বিথী)
--বিথী, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। তুমি বিশ্বাস করো আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে প্রতিদিন দেখি। ভীষণ ভালবাসি, আর ভাবলাম যাকে ভালবাসি তাকে যদি ভালবাসার কথাটা না বলতে পারি সব বৃথা যাবে। তাই বলে দিলাম তোমাকে।
--আরো কিছু বলবে??
--হু না, আর কিছু নয়। এটাই বলার ছিল।
বিথী মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে, পেছন থেকে লাজুক চেহারার ছেলেটা ডাক দেয়....
--বিথী, কিছুতো বলে গেলে না।
শিশির বিথীকে একটু ভয়ও পায়, তাই কথাটা আস্তে করেই বলল।
--কি বলব তোমাকে। আমাকে বিয়ে করলে কি খাওয়াবা আমাকে?? কিছু খাওয়াতে পারবে? চাকরি করো তুমি? বেকার কোথাকার!!
বিথীর এমন জবাবে শিশিরের মনটা খনিকেই ভেঙে গেল। পাল্টা জবাবের কোন কথাই তার কাছে নেই। সত্যিই তো অনার্স পাস করে কোন চাকরিই তো পাচ্ছে না। আর চাকরি ছাড়া কোন মেয়ে ঝুটবে তার কপালে? শুধু শুধু ভালবাসার হয়রানি। শিশিরের মত ছেলেদের দূর থেকে ভালবেসে যাওয়াই শ্রেয়। ওটা কাছ থেকে পেতে গেলে হিতের বিপরীত হয়ে যায়।
শিশির বিথীর কলেজ লাইফের বন্ধু। সেখান থেকেই বিথীকে তার ভাল লাগে। এতকিছুর পরও শিশির নিরবে ভালবেসে যাবে বিথীকে। ভালবাসার মানুষকে সবসময় কাছে পেতে হবে এমনতো কোন কথা নেই।
.
কয়েকদিন পর.....
--এই শুনো, চলো আমরা কোথা থেকে ঘুরে আসি! (হাবিব)
--ঘুরতে যাবা? কোথায়? (বিথী)
--হুহু..কক্সবাজার থেকে!
--কক্সবাজার!! এত দূরে? ছুটি দিবেনা আমাকে। আর এতদূরে যেতে পারব না। তাছাড়া তুমিইই কি ছুটি পাবে?
--আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিব। তুমি শুধু হ্যাঁ বলো! বাকি সবকিছু আমি দেখব।
--কিন্তু তাই বলে এখনি এতদূরে একা একা যাব?
--একা কোথায়, আমি তো তোমার সাথে যাচ্ছি।
--আচ্ছা, চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি। তারপর তো কোন সমস্যা নেই। যেখানে খুশি সেখানে চলে যাওয়া যাবে।
--আরে না, এখনি না। সময় হলে ঠিক করে নিব।
--তুমি আমাকে ভালবাস না?
--হুমমম বাসি তো।
--তাহলে বিয়ে করলে প্রবলেম কোথায়?
--আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি তারপর ঠিক বিয়ে করে নিব।
--না, আগে বিয়ে তারপর কক্সবাজার।
--তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?
--হুমম করি, প্রচন্ড বিশ্বাস করি। আর তাই তো তোমার কাছে ছুটে আসি।
--আমি কিছু বুঝিনা, সামনে সপ্তাহেই আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। তুমি ছুটি নিবে, এটাই ফাইনাল। আর কিছু জানিনা, বুঝিনা।
--আচ্ছা ঠিক আছে, আগে ছুটি তো নিতে দিবে! এখন যাই, রাত হয়ে গেছে। বাসায় মনে হয় টেনশন করছে!
--এখনি চলে যাবে? আরেকটু থাক না!!
--ছাড়োওওও আমাকে, যেতে হবে।
বিথী হাবিবের হাতটা সরিয়ে ওখান থেকে চলে আসলো।
--শুনোও, আমরা কিন্তু সামনে সপ্তাহেই যাচ্ছি। তুমি তৈরি থেকো!
.
এইমাত্র বিথী খাবার টেবিল থেকে ওর রুমে আসলো। আজ সারাদিন ওর পরিশ্রম হয়েছে। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে সে চাকরি করে। সেই সূত্রেই হাবিবের সাথে বিথীর পরিচয় হয় এবং হাবিব তাকে প্রেম নিবেদন করলে বিথীও তার প্রেমে হাবুডুবু খায়। কিন্তু শর্ত একটাই ছিল- বিথীকে বিয়ে করতে হবে। বেচারা হাবিব রাজি। অভাব-অনটনের মধ্যে সংসার চলার কারনে বিথীকে ঘরের বাহিরে কাজ করতে হচ্ছে। বিথী বগুড়ায় থাকে, সরকারী একটা কলেজ থেকে অনার্স পাস করে এখন মাস্টার্সে পড়ছে।
এই মূহুর্তে বিথী বিছানায় শুয়ে আছে। ও ঠিক ভাবছে, বিয়ের আগে হাবিবের সাথে কক্সবাজার যাওয়া উচিত হবে কিনা? আবার হাবিবকে সে প্রচন্ড বিশ্বাসও করে। তাছাড়া হাবিব বলেছে ওখান থেকে ফিরেই বিয়েটা করবে।
বিথী ঠিক বুঝে ওঠতে পারছেনা এখন তার কি করা ঠিক হবে? প্রচন্ড ভালোও বাসে হাবিবকে।
.
ঠিক এক সপ্তাহ পর......
বগুড়া বাসস্ট্যান্ড। ঠিক এই মূহুর্তে হাবিব ও বিথী বসে আছে একটি বাসে। এসি বাস, সামনে মনিটরে চলছে হিন্দি গান। হাবিবের পাশের সিটে বসে জানালার দিকে আনমনে হয়ে তাকিয়ে আছে বিথী। হাবিব আজ অনেকটাই খুশি, তার ইচ্ছেগুলো পূরণ হতে যাচ্ছে।
--কি ব্যাপার? তোমার মন খারাপ নাকি?? (হাবিব)
--কই নাতো, কিছু হয়নি তো! (বিথী)
--শুনোও, একদম টেনশন করবে না। আমি তোমার পাশে আছি তো।
--হুমম। (হাবিবের কাধে মাথা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিথী। হাবিবের প্রতি ওর অঢেল বিশ্বাস।)
.
৮ ঘন্টা পর,
এখন ওরা দু'জন কক্সবাজার। হোটেলে ওঠতে হবে, দু'জনেই প্রচন্ড টায়ার্ড। একটা হোটেলের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে তিনদিনের জন্য রুম বুক করে, স্বামী-স্ত্রী বলাতে বিথী খুব খুশি হয়েছে। এছাড়া ওদেরকে একসাথে হোটেলে থাকতে দেওয়া হবেনা।
তারপর হাবিব তার ইচ্ছেটা পূরণ করে। তিনদির ওরা ইচ্ছেমত ঘুরাঘুরি, সমুদ্রসৈকতে ঝাপাঝাপিসহ অনেক মজা করে। ওরা এখন স্বামী-স্ত্রী, এই তিনদিন এখানে ওরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে।
তিনদিন পর, ওরা তাদের অলিখিত হানিমুন শেষে বগুড়ায় ফিরে আসে। বিথী এখন খুবই উদ্বিগ্ন, বিয়েটা করতেই হবে হাবিবকে। যখনি হাবিবের সাথে দেখা হয় তখনি বিথীর প্রশ্ন একটাই - হাবিব, তুমি আমাকে কবে বিয়ে করছো??
হাবিব নানান অজুহাতে বিভোর। বিথী চিন্তিত হয়ে পড়লো, না হাবিব তো এমন করার কথা না। এখনো দৃঢ় বিশ্বাস হাবিবের প্রতি। কদিন যাবত হাবিব বিথীকে সময় কম দিচ্ছে, আগের মত হুট করে চলে আসে না। এই তো শুরু হয়ে গেলো প্রতারনার বহিঃপ্রকাশ।
.
এরপর বিথীকে কোনকিছু না জানিয়েই হাবিব চলে আসে ময়মনসিংহে, চাকরি করতে নয়। বিথীর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে হাবিবের প্রতি। হাবিবের সাথে দেখা করতেই হবে বিথীর। ইতিমধ্যে বাসার সবাই এখন জেনে গেছে কক্সবাজারে তিনদিন একসাথে হাবিবের সাথে রাত্রিযাপন করার বিষয়টা। পরিবারের সবাই বিথীকে নিয়ে চিন্তিত। হাবিবকে বিয়ে না করতে পারলে সবকিছু হারাবে বিথী।
বহু কষ্টে হাবিবের সাথে কন্ট্রাক্ট করে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে চলে আসে বিথী, একা একা। উদ্দেশ্য একটাই, হাবিবকে বুঝাতে হবে বিথীর এখন বিয়ে করা ছাড়া উপায় নেই। ময়মনসিংহে হাবিব তাকে রিসিভ করে, ঐদিন সারা বাকৃবি ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ায় তারা। রাত্রে হাবিবের বন্ধুর বাসায় আবার বিথীকে নিয়ে একসাথে রাত্রিযাপন করে। সকালে হাবিব উধাও, ফোন বন্ধ। সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। হতাশ আর পরাজয়ের গ্লানি এখন বিথীর মাথায়। বাধ্য হয়ে আইনের সহায়তা নেয় সে। কর্তৃপক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা সঠিক সমাধান না দিতে পেরে বিথীকেই হাবিবকে খোঁজার পরামর্শ দেয়। বেচারী এখন মহাবিপদে পড়েছে, না চিনে এ শহরকে না জানে এ শহরের লোকজন তাকে। বিকাল থেকে হাবিবের সন্ধান চালায় সে। শহরের অলি-গলি সব জায়গায় খোঁজতে থাকে হাবিবের বাসা। কিন্তু শুধুমাত্র একটা নাম দিয়ে কি শহরের কাউকে খোঁজে পাওয়া যায়। তবুও ব্যর্থ প্রচেষ্টা বিথীর।
.
রাত ১১ টা বাজে। প্রচন্ড ক্ষুধা, অক্লান্ত পরিশ্রম, মানসিক চাপ সব মিলিয়ে বিথী এখন হতাশায় ভোগছে। কেউ হাবিবের সন্ধান দিতে পারেনি। এদিকে রাতও অনেক হয়েছে, একটা আশ্রয় না পেলে যে কোন একটা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে তাকে। উদাসীনতা, হতাশা বিথীর মনকে ছেয়ে দিল। হাবিবকে বিশ্বাস করে ভুল করেছে বিথী, ভূল করেছে হাবিবকে ভালবেসে। যাকে এতবেশি বিশ্বাস আর ভালবাসতো সেই তাকে একা ফেলে চলে গেলো। বড়ই ভূল করেছে বিথী, এ ভূলের কোন ক্ষমা নেই। শিশিরের কথা অনেক মনে পড়ছে বিথীর। ছেলেটা খুব ভালো ছিল, তার মনে কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিল। সত্যিই সে বিথীকে প্রচন্ড ভালবাসত। অন্ততপক্ষে শিশির তাকে একা রেখে কোথাও যেত না এ বিশ্বাস ছিল। বিথী এখন এতটাই আনমনে আর হতাশাগ্রস্থ যে এত রাত হওয়া স্বত্বেও হাবিবের খোঁজ করতে অটল। কিন্তু এতে হতে পারে আরেক মহাবিপদ!! অবশেষে, মহল্লার স্থানীয় এক সহৃদয়বান ব্যক্তি বিথীকে রাত্রিযাপনের সুযোগ দেয়। উনাদের বাসায় রাতের আশ্রয় আর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাটা হল। চিন্তামগ্ন বিথীর রাতের ঘুমটাও ঠিকমত হয়নি।
.
সকালে স্থানীয় এক ব্যক্তির সহায়তায় অবশেষে প্রচন্ড ভালবাসার মানুষ হাবিবেরর বাসা খোঁজে পাওয়া গেলো। প্রাণবন্ত মনে ছুটে গেলো হাবিবের কাছে......
বাসার সামনে হাবিব দু'টো বাচ্চার সাখে খেলা করছে, হয়তবা বোনের ছেলেমেয়ে। ঠিক এই মূহুর্তে একটা বাচ্চা হাবিবকে আব্বু বলে ডেকে ওঠে। বিথী রীতিমত অবাক হয়। ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ হচ্ছে.......
"কি হল আসবে না তোমরা? খাবার রেডি, চলে এসো!"
একি কান্ড!! বিথীর মাথায় পুরো আকাশটা ভেঙে পড়লো। বিথীর আর বুঝার বাকি রইলো না। সে প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে হাবিবকে ডাকে.....
"প্রতারক হাবিব......"
হাবিব বিথীকে দেখে খানিকটা ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। মেয়ে মানুষের কন্ঠ শুনে আসমা দৌড়ে আসে।
বিথী কান্না বিজড়িত কন্ঠে হাবিবকে প্রশ্ন করে....
--তুমি আমার সাথে এমনটা কেন করলে?? আমার কি দোষ ছিল? আমি তো তোমাকে অনেক ভালবাসতাম আর বিশ্বাসও করতাম। তাহলে এমনটা কেন করলে আমার সাথে। (বিথী)
অপরাধী হাবিব নিশ্চুপ হয়ে বিথীর কথাগুলো শুনে যায়। এদিকে আসমা অবাক হয়ে হাবিবের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, কি হচ্ছে এসব? কান্না, এ যেন মরণ কান্না। চোখের পানিতে ভেসে গেল বিথীর জামা।
রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, হিংসা নিয়ে বিথী কয়েকটা থাপ্পর দেয় হাবিবকে। ইচ্ছেমত বকাবকি করে ওকে। কিন্তু তাতে কি সমস্যার সমাধান হবে?? মোটেও না। আশাহারা বিথী বাধ্য হয়ে বগুড়ায় চলে যায় সবকিছু ভুলে যেতে। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব??
কি জানি কি অপেক্ষা করছে বিথীর জন্যে। মানিসক যন্ত্রণায় বিথী এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
.
হয়ত এভাবেই জ্বলে-পুড়ে মরতে যাচ্ছে এদেশের আরেকটি মেয়ে। জেনে শুনে ভূল করতে যাচ্ছে সেই একই কাজ। তাদের থামাবার কেউ নেই, মিথ্যে ভালবাসায় অন্ধ তারা। সত্যিটা তাদের কাছে আজ অবহেলায় ভূগছে, মিথ্যেটাই বারবার হাত রাঙাচ্ছে তাদের মনে। বুঝেও না বুঝার ভান, সৌন্দর্য্য আর বিলাসিতায় মুগ্ধ তারা। সত্যিকারের ভালবাসাটা আছে তোমার পাশেই, খোঁজে দেখ সেটা বেলকনিতেই ডাকা পড়ে আছে। হয়তবা একটু রাঙিয়ে নিতে তোমার, কিন্তু পাবে তুমি খাঁটি মধুর হাড়ি। যে বুঝতে পারে সে হবে ভাগ্যবতী আর যে না পারে সে বিথীর মত জ্বলে পুড়ে মরবে।
শিশিরই ছিল তার ভালবাসার উত্তম সঙ্গী, যে কখনোই বিথীকে কষ্ট দিতে পারত না!!
.
--বিথী শুনোও, তোমার সাথে কিছু কথা আছে। (শিশির)
--হুমমমম, বলো। কিন্তু যা বলার দ্রুত বলবে। আমার কাজ আছে।(বিথী)
--বিথী, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। তুমি বিশ্বাস করো আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে প্রতিদিন দেখি। ভীষণ ভালবাসি, আর ভাবলাম যাকে ভালবাসি তাকে যদি ভালবাসার কথাটা না বলতে পারি সব বৃথা যাবে। তাই বলে দিলাম তোমাকে।
--আরো কিছু বলবে??
--হু না, আর কিছু নয়। এটাই বলার ছিল।
বিথী মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে, পেছন থেকে লাজুক চেহারার ছেলেটা ডাক দেয়....
--বিথী, কিছুতো বলে গেলে না।
শিশির বিথীকে একটু ভয়ও পায়, তাই কথাটা আস্তে করেই বলল।
--কি বলব তোমাকে। আমাকে বিয়ে করলে কি খাওয়াবা আমাকে?? কিছু খাওয়াতে পারবে? চাকরি করো তুমি? বেকার কোথাকার!!
বিথীর এমন জবাবে শিশিরের মনটা খনিকেই ভেঙে গেল। পাল্টা জবাবের কোন কথাই তার কাছে নেই। সত্যিই তো অনার্স পাস করে কোন চাকরিই তো পাচ্ছে না। আর চাকরি ছাড়া কোন মেয়ে ঝুটবে তার কপালে? শুধু শুধু ভালবাসার হয়রানি। শিশিরের মত ছেলেদের দূর থেকে ভালবেসে যাওয়াই শ্রেয়। ওটা কাছ থেকে পেতে গেলে হিতের বিপরীত হয়ে যায়।
শিশির বিথীর কলেজ লাইফের বন্ধু। সেখান থেকেই বিথীকে তার ভাল লাগে। এতকিছুর পরও শিশির নিরবে ভালবেসে যাবে বিথীকে। ভালবাসার মানুষকে সবসময় কাছে পেতে হবে এমনতো কোন কথা নেই।
.
কয়েকদিন পর.....
--এই শুনো, চলো আমরা কোথা থেকে ঘুরে আসি! (হাবিব)
--ঘুরতে যাবা? কোথায়? (বিথী)
--হুহু..কক্সবাজার থেকে!
--কক্সবাজার!! এত দূরে? ছুটি দিবেনা আমাকে। আর এতদূরে যেতে পারব না। তাছাড়া তুমিইই কি ছুটি পাবে?
--আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিব। তুমি শুধু হ্যাঁ বলো! বাকি সবকিছু আমি দেখব।
--কিন্তু তাই বলে এখনি এতদূরে একা একা যাব?
--একা কোথায়, আমি তো তোমার সাথে যাচ্ছি।
--আচ্ছা, চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি। তারপর তো কোন সমস্যা নেই। যেখানে খুশি সেখানে চলে যাওয়া যাবে।
--আরে না, এখনি না। সময় হলে ঠিক করে নিব।
--তুমি আমাকে ভালবাস না?
--হুমমম বাসি তো।
--তাহলে বিয়ে করলে প্রবলেম কোথায়?
--আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি তারপর ঠিক বিয়ে করে নিব।
--না, আগে বিয়ে তারপর কক্সবাজার।
--তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?
--হুমম করি, প্রচন্ড বিশ্বাস করি। আর তাই তো তোমার কাছে ছুটে আসি।
--আমি কিছু বুঝিনা, সামনে সপ্তাহেই আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। তুমি ছুটি নিবে, এটাই ফাইনাল। আর কিছু জানিনা, বুঝিনা।
--আচ্ছা ঠিক আছে, আগে ছুটি তো নিতে দিবে! এখন যাই, রাত হয়ে গেছে। বাসায় মনে হয় টেনশন করছে!
--এখনি চলে যাবে? আরেকটু থাক না!!
--ছাড়োওওও আমাকে, যেতে হবে।
বিথী হাবিবের হাতটা সরিয়ে ওখান থেকে চলে আসলো।
--শুনোও, আমরা কিন্তু সামনে সপ্তাহেই যাচ্ছি। তুমি তৈরি থেকো!
.
এইমাত্র বিথী খাবার টেবিল থেকে ওর রুমে আসলো। আজ সারাদিন ওর পরিশ্রম হয়েছে। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে সে চাকরি করে। সেই সূত্রেই হাবিবের সাথে বিথীর পরিচয় হয় এবং হাবিব তাকে প্রেম নিবেদন করলে বিথীও তার প্রেমে হাবুডুবু খায়। কিন্তু শর্ত একটাই ছিল- বিথীকে বিয়ে করতে হবে। বেচারা হাবিব রাজি। অভাব-অনটনের মধ্যে সংসার চলার কারনে বিথীকে ঘরের বাহিরে কাজ করতে হচ্ছে। বিথী বগুড়ায় থাকে, সরকারী একটা কলেজ থেকে অনার্স পাস করে এখন মাস্টার্সে পড়ছে।
এই মূহুর্তে বিথী বিছানায় শুয়ে আছে। ও ঠিক ভাবছে, বিয়ের আগে হাবিবের সাথে কক্সবাজার যাওয়া উচিত হবে কিনা? আবার হাবিবকে সে প্রচন্ড বিশ্বাসও করে। তাছাড়া হাবিব বলেছে ওখান থেকে ফিরেই বিয়েটা করবে।
বিথী ঠিক বুঝে ওঠতে পারছেনা এখন তার কি করা ঠিক হবে? প্রচন্ড ভালোও বাসে হাবিবকে।
.
ঠিক এক সপ্তাহ পর......
বগুড়া বাসস্ট্যান্ড। ঠিক এই মূহুর্তে হাবিব ও বিথী বসে আছে একটি বাসে। এসি বাস, সামনে মনিটরে চলছে হিন্দি গান। হাবিবের পাশের সিটে বসে জানালার দিকে আনমনে হয়ে তাকিয়ে আছে বিথী। হাবিব আজ অনেকটাই খুশি, তার ইচ্ছেগুলো পূরণ হতে যাচ্ছে।
--কি ব্যাপার? তোমার মন খারাপ নাকি?? (হাবিব)
--কই নাতো, কিছু হয়নি তো! (বিথী)
--শুনোও, একদম টেনশন করবে না। আমি তোমার পাশে আছি তো।
--হুমম। (হাবিবের কাধে মাথা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিথী। হাবিবের প্রতি ওর অঢেল বিশ্বাস।)
.
৮ ঘন্টা পর,
এখন ওরা দু'জন কক্সবাজার। হোটেলে ওঠতে হবে, দু'জনেই প্রচন্ড টায়ার্ড। একটা হোটেলের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে তিনদিনের জন্য রুম বুক করে, স্বামী-স্ত্রী বলাতে বিথী খুব খুশি হয়েছে। এছাড়া ওদেরকে একসাথে হোটেলে থাকতে দেওয়া হবেনা।
তারপর হাবিব তার ইচ্ছেটা পূরণ করে। তিনদির ওরা ইচ্ছেমত ঘুরাঘুরি, সমুদ্রসৈকতে ঝাপাঝাপিসহ অনেক মজা করে। ওরা এখন স্বামী-স্ত্রী, এই তিনদিন এখানে ওরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে।
তিনদিন পর, ওরা তাদের অলিখিত হানিমুন শেষে বগুড়ায় ফিরে আসে। বিথী এখন খুবই উদ্বিগ্ন, বিয়েটা করতেই হবে হাবিবকে। যখনি হাবিবের সাথে দেখা হয় তখনি বিথীর প্রশ্ন একটাই - হাবিব, তুমি আমাকে কবে বিয়ে করছো??
হাবিব নানান অজুহাতে বিভোর। বিথী চিন্তিত হয়ে পড়লো, না হাবিব তো এমন করার কথা না। এখনো দৃঢ় বিশ্বাস হাবিবের প্রতি। কদিন যাবত হাবিব বিথীকে সময় কম দিচ্ছে, আগের মত হুট করে চলে আসে না। এই তো শুরু হয়ে গেলো প্রতারনার বহিঃপ্রকাশ।
.
এরপর বিথীকে কোনকিছু না জানিয়েই হাবিব চলে আসে ময়মনসিংহে, চাকরি করতে নয়। বিথীর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে হাবিবের প্রতি। হাবিবের সাথে দেখা করতেই হবে বিথীর। ইতিমধ্যে বাসার সবাই এখন জেনে গেছে কক্সবাজারে তিনদিন একসাথে হাবিবের সাথে রাত্রিযাপন করার বিষয়টা। পরিবারের সবাই বিথীকে নিয়ে চিন্তিত। হাবিবকে বিয়ে না করতে পারলে সবকিছু হারাবে বিথী।
বহু কষ্টে হাবিবের সাথে কন্ট্রাক্ট করে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে চলে আসে বিথী, একা একা। উদ্দেশ্য একটাই, হাবিবকে বুঝাতে হবে বিথীর এখন বিয়ে করা ছাড়া উপায় নেই। ময়মনসিংহে হাবিব তাকে রিসিভ করে, ঐদিন সারা বাকৃবি ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ায় তারা। রাত্রে হাবিবের বন্ধুর বাসায় আবার বিথীকে নিয়ে একসাথে রাত্রিযাপন করে। সকালে হাবিব উধাও, ফোন বন্ধ। সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। হতাশ আর পরাজয়ের গ্লানি এখন বিথীর মাথায়। বাধ্য হয়ে আইনের সহায়তা নেয় সে। কর্তৃপক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা সঠিক সমাধান না দিতে পেরে বিথীকেই হাবিবকে খোঁজার পরামর্শ দেয়। বেচারী এখন মহাবিপদে পড়েছে, না চিনে এ শহরকে না জানে এ শহরের লোকজন তাকে। বিকাল থেকে হাবিবের সন্ধান চালায় সে। শহরের অলি-গলি সব জায়গায় খোঁজতে থাকে হাবিবের বাসা। কিন্তু শুধুমাত্র একটা নাম দিয়ে কি শহরের কাউকে খোঁজে পাওয়া যায়। তবুও ব্যর্থ প্রচেষ্টা বিথীর।
.
রাত ১১ টা বাজে। প্রচন্ড ক্ষুধা, অক্লান্ত পরিশ্রম, মানসিক চাপ সব মিলিয়ে বিথী এখন হতাশায় ভোগছে। কেউ হাবিবের সন্ধান দিতে পারেনি। এদিকে রাতও অনেক হয়েছে, একটা আশ্রয় না পেলে যে কোন একটা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে তাকে। উদাসীনতা, হতাশা বিথীর মনকে ছেয়ে দিল। হাবিবকে বিশ্বাস করে ভুল করেছে বিথী, ভূল করেছে হাবিবকে ভালবেসে। যাকে এতবেশি বিশ্বাস আর ভালবাসতো সেই তাকে একা ফেলে চলে গেলো। বড়ই ভূল করেছে বিথী, এ ভূলের কোন ক্ষমা নেই। শিশিরের কথা অনেক মনে পড়ছে বিথীর। ছেলেটা খুব ভালো ছিল, তার মনে কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিল। সত্যিই সে বিথীকে প্রচন্ড ভালবাসত। অন্ততপক্ষে শিশির তাকে একা রেখে কোথাও যেত না এ বিশ্বাস ছিল। বিথী এখন এতটাই আনমনে আর হতাশাগ্রস্থ যে এত রাত হওয়া স্বত্বেও হাবিবের খোঁজ করতে অটল। কিন্তু এতে হতে পারে আরেক মহাবিপদ!! অবশেষে, মহল্লার স্থানীয় এক সহৃদয়বান ব্যক্তি বিথীকে রাত্রিযাপনের সুযোগ দেয়। উনাদের বাসায় রাতের আশ্রয় আর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাটা হল। চিন্তামগ্ন বিথীর রাতের ঘুমটাও ঠিকমত হয়নি।
.
সকালে স্থানীয় এক ব্যক্তির সহায়তায় অবশেষে প্রচন্ড ভালবাসার মানুষ হাবিবেরর বাসা খোঁজে পাওয়া গেলো। প্রাণবন্ত মনে ছুটে গেলো হাবিবের কাছে......
বাসার সামনে হাবিব দু'টো বাচ্চার সাখে খেলা করছে, হয়তবা বোনের ছেলেমেয়ে। ঠিক এই মূহুর্তে একটা বাচ্চা হাবিবকে আব্বু বলে ডেকে ওঠে। বিথী রীতিমত অবাক হয়। ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ হচ্ছে.......
"কি হল আসবে না তোমরা? খাবার রেডি, চলে এসো!"
একি কান্ড!! বিথীর মাথায় পুরো আকাশটা ভেঙে পড়লো। বিথীর আর বুঝার বাকি রইলো না। সে প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে হাবিবকে ডাকে.....
"প্রতারক হাবিব......"
হাবিব বিথীকে দেখে খানিকটা ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। মেয়ে মানুষের কন্ঠ শুনে আসমা দৌড়ে আসে।
বিথী কান্না বিজড়িত কন্ঠে হাবিবকে প্রশ্ন করে....
--তুমি আমার সাথে এমনটা কেন করলে?? আমার কি দোষ ছিল? আমি তো তোমাকে অনেক ভালবাসতাম আর বিশ্বাসও করতাম। তাহলে এমনটা কেন করলে আমার সাথে। (বিথী)
অপরাধী হাবিব নিশ্চুপ হয়ে বিথীর কথাগুলো শুনে যায়। এদিকে আসমা অবাক হয়ে হাবিবের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, কি হচ্ছে এসব? কান্না, এ যেন মরণ কান্না। চোখের পানিতে ভেসে গেল বিথীর জামা।
রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, হিংসা নিয়ে বিথী কয়েকটা থাপ্পর দেয় হাবিবকে। ইচ্ছেমত বকাবকি করে ওকে। কিন্তু তাতে কি সমস্যার সমাধান হবে?? মোটেও না। আশাহারা বিথী বাধ্য হয়ে বগুড়ায় চলে যায় সবকিছু ভুলে যেতে। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব??
কি জানি কি অপেক্ষা করছে বিথীর জন্যে। মানিসক যন্ত্রণায় বিথী এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
.
হয়ত এভাবেই জ্বলে-পুড়ে মরতে যাচ্ছে এদেশের আরেকটি মেয়ে। জেনে শুনে ভূল করতে যাচ্ছে সেই একই কাজ। তাদের থামাবার কেউ নেই, মিথ্যে ভালবাসায় অন্ধ তারা। সত্যিটা তাদের কাছে আজ অবহেলায় ভূগছে, মিথ্যেটাই বারবার হাত রাঙাচ্ছে তাদের মনে। বুঝেও না বুঝার ভান, সৌন্দর্য্য আর বিলাসিতায় মুগ্ধ তারা। সত্যিকারের ভালবাসাটা আছে তোমার পাশেই, খোঁজে দেখ সেটা বেলকনিতেই ডাকা পড়ে আছে। হয়তবা একটু রাঙিয়ে নিতে তোমার, কিন্তু পাবে তুমি খাঁটি মধুর হাড়ি। যে বুঝতে পারে সে হবে ভাগ্যবতী আর যে না পারে সে বিথীর মত জ্বলে পুড়ে মরবে।
শিশিরই ছিল তার ভালবাসার উত্তম সঙ্গী, যে কখনোই বিথীকে কষ্ট দিতে পারত না!!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন