১.
খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ছেলেটাকে মানায় খুব।ক্লাসের
কোনের টেবিলটাতে সব সময় বসে থাকে কেন ছেলেটা!
কারো সাথেই কথা বলতে চায় না।এমন কেন সে! মনকে
প্রশ্ন করে অর্পা।মন কোন উত্তর দেয় না।ছেলেটা প্রায়ই অর্পার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে।তবে কথা বলতে চায়না কেন সে! অর্পা তা ভেবে পায়না।প্রতিদিন
নিয়ম মাফিক করে ক্লাসের ফাকে ফাকে আড় চোখে
অর্পাও ছেলেটাকে দেখে আর বারবার মুগ্ধ হয়।বারবার
মুগ্ধ হতে অর্পার ভালোই লাগে। এই মুগ্ধতাই আস্তে
আস্তে ভালোবাসায় রূপান্তর হয়ে গেছে।মুখ ফুটে অর্পা
কিছু বলতে পারে না।বলবেই-বা কিভাবে! এখনো তো
ছেলেটার সাথে খুব একটা কথাই হয়নি।অর্পা অপেক্ষার ধ্রুমজাল বুনে।যেকোন একদিন কথা বলবেই।অর্পা অনেকবার
চেয়েছে কথা বলতে।কিন্তু ছেলেটা
প্রয়োজন ছাড়া যেন কথাই বলতে চায় না।এমন একটা
ছেলেকে অর্পা পছন্দ করেছে! অর্পার বান্ধবীরা এটা
নিয়ে অনেক ঠাট্টা করে।তবে সেদিকে অর্পার কোন
ভ্রুিক্ষুপ নেই।এমন একটা ছেলেকেই অর্পা তার জীবনে
চেয়েছিল।তার মত ছেলেরাই খুব গভীর আবেগ নিয়ে আপন করে
ভালোবাসতে যানে।আবেগ ছাড়া ভালোবাসা কল্পনার বাহিরে।
.
ছেলেটার নাম ইমরান।অর্পার সাথে একই ক্লাসে পড়ে।
ইমরানের সাথে অর্পার প্রথম দেখা হয় ছাদের কোনে।
পাশাপাশি বাসা দুজনের।দুই ছাদের নিচে দুজনের
আবাসস্থল।ভেজা চুলগুলো শুকানোর জন্য ছাদের উপর
উঠেছিল অর্পা।ছাদে উঠেই চোখ গেলো পাশের বাসার
ছাদের উপর।চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়ে ছাদের
রেলিং ধরে অন্যমনস্ক হয়ে দাড়িয়ে ছিল ইমরান।গায়ে
ছিল ধূসর সাদা পাঞ্জাবি।
.
অর্পা দুষ্টুমি করে ইমরানকে ডেকে উঠল,
"এই যে?......."
কোন প্রতি উত্তর নেই ইমরানের কাছ থেকে।আবারো
অর্পা ডাকল,
"এই যে শুনছেন?...."
"এই,আপনি কি কানে শুনতে পান না নাকি?"
অন্যমনষ্কতা ভেদ করে শেষের বাক্যটা ইমরানের কান
অব্দি পৌঁছিয়েছে।ফিরে তাকালো ইমরান।অচেনা
একটি মেয়ে।ঠোঁটের বেলকুনিতে হাসি এঁকেছে।
মেয়েটি কি ইমরানকেই ডেকেছিল?!! নাহ অপরিচিত
মেয়ে কেন ইমরানকে ডাকবে! ভেবেই তাৎক্ষনিক
মাথাটা ঘুড়িয়ে নিল ইমরান।অর্পা ভিমচিৎ খেয়ে
গেলো।আবারো ডাকল,
"এই শুনছেন? ফিরে দাড়ালেন কেন? এদিকে ঘুড়োন।
আপনাকেই ডেকেছি"
চশমাটা ঠিক করতে করতে ঘুড়ে দাড়ালো ইমরান।থমকে
থমকে মুখগহব্বর থেকে চুপসানো ধ্বনি বের হল।অর্পা
শুনতে পায়নি অস্পষ্ট কথাটুকু।অর্পা বলল,
"কি বললেন শুনতে পাইনি"
"না মানে কি জন্য ডেকেছিলেন?"
"কেন! আপনাকে ডাকা কারো নিষেধ আছে নাকি!!"
"তেমন কিছু নয়।আমি তো আপনাকে চিনিনা"
"কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।(একটু মজা করে মিথ্যা
বলল অর্পা)"
অর্পা ইমরানকে চিনে কথাটা শুনেও ইমরান একটুও
চমকালো না।ইমরানের কাছে পরিচিতির ব্যাপারটা
কমন মনে হয়।খানিকক্ষন চুপ থেকে ইমরান বলল,
"ভালো"
"ভালো মানে! আপনি আমাকে চিনেন না অথচ আমি
আপনাকে চিনি সেটা আপনার কাছে আশ্চর্য্যের মনে
হলো না!!"
"আশ্চর্য্যের কি আছে? আচ্ছা আমি যাই"
"আচ্ছা। ওহ আপনার নামটা কি?"
"ইমরান"
"আমি অর্পা"
ফিকে একটু হেসে সিঁড়ির দিকে ইমরান পা বাড়ালো।
ইমরানের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে অর্পা
তাকিয়ে রইল।মনে মনে ভাবছে ছেলেটা কতটা সরল
সোজা।তবে মোটা ফ্রেমের চশমায় ছেলেটাকে দারুন
মানায়।একফালি হেসে অর্পা তার নিজের রুমে চলে
গেলো।
.
(২)
ক্লাস শেষে বাড়িতে ফিরল অর্পা।অর্পা বরাবর প্রতিদিনের মতই অপেক্ষা করে কখন বিকেল হবে।বেশ কিছুদিন হলো ইমরান আর ছাদে আসে নি।তবে ক্লাসে যদিও প্রতি দিনই দুজনের দেখা হয় কিন্তু কথা হয়না বললেই চলে।অর্পা প্রতিনিয়ত ছাদে আসত।ছাদের কোনে একটি হুইল চেয়ার স্থাপন
করেছে সে।পরন্ত গৌধুলি বিকেলে ছাদের কোনে বসে
থাকে অর্পা।একদিন বিকেলে নীল আকাশের সাদা মেঘ
ধীরে ধীরে ঘন কালো হয়ে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।তীব্র
বাতাসের সাথে দলা বেঁধে নিকশ কালো মেঘেরা
ছুটাছুটি করছে।এই বুঝি ধুপ করে ছাপিয়ে বৃষ্টি নামবে।
নিকশ কালো মেঘলা আকাশ ইমরানের খুব পছন্দের।
জানালার পর্দার ফাক দিয়ে দলা বাঁধানো মেঘের
ছুটাছুটি দেখে রুম থেকে বেড়িয়ে ছাদে এসেছে ইমরান।
.
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।বৃষ্টির একেকটি ফোটা একেক
জনের মনে একেক রকম ভালো লাগার জন্ম দিলেও
কারো কারো মনে এক অদ্ভূত ভালোলাগার অনুভূতির
জন্ম দেয়।তাদের মধ্যে ইমরান একজন।
ছাদে এসে ইমরান মুর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।অর্পাও
বৃষ্টিতে ভিজে কাক ভেজা হয়ে গেছে।চুলগুলো লেপ্টে
আছে সারা মাথা জুড়ে।চুলের ঝরা বৃষ্টির জলগুলো গাল
দুটো বেয়ে থুতনি দিয়ে বুকের উপর ফোটায় ফোটায়
পড়ছে।
.
অপলক দৃষ্টিতে ইমরান তাকিয়ে রইল অর্পার দিকে।বৃষ্টি
ভেজা ললনাদের এতটা সুন্দর লাগে কাছ থেকে না
দেখলে সেটা বুঝার উপায় নেই।ইমরানের কাছে আজ
অর্পাকে মেঘকন্যা মনে হচ্ছে।ঠান্ডা হিমেল বাতাসে
শরীরে কাুপঁনি চলে এসেছে অর্পার।ছাদ থেকে নেমে
নিচে যাওয়ার ছলে ঘুরতেই দেখে ইমরানও ছাদের উপর
ভিজছে।চোখের দৃষ্টি রয়েছে অর্পার উপর।থমকে গেল
অর্পা।স্থির দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষন।প্রবল বেগে বৃষ্টির
বড় বড় ফোটা পরছে।টিপ টিপ পায়ে ইমরানের
কাছাকাছি যাচ্ছে অর্পা।ইমরানও ধীরে ধীরে অর্পার
দিকে ছাদের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এগুচ্ছে।রেলিং এর
সাথে আচমকা ধাক্কা লেগে চোখের পলক পরল।এতক্ষন
কি তাহলে ইমরানের চোখের পলক পরেনি!! মনে পরছে
না ইমরানের।অর্পাকে যত দেখে ততই কেন ভালো
লাগছে ইমরানের!! ব্যাখ্যাটা ইমরানের জানা নেই।
ভাবনায় শুধুই অর্পা।
.
ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন।হঠাৎ করেই
ধমকা বাতাসে শরীরটা কাঁপুনি দিয়ে উঠল দুজনের।
ইমরান বলল,
"বৃষ্টিতে ভিজছেন যে জ্বর আসবে না?"
"আপনিও তো ভিজছেন! আপনারও তো জ্বর আসতে পারে!"
সাবলীল উত্তর অর্পার।মেয়েটা গুছানো কথা বলে,ভাবছে ইমরান।ফুরফুরে বাতাস যেন অর্পার ভেজা চুলগুলো নিয়ে শূন্যে খেলা করতে চাচ্ছে।শরীরের কাঁপুনিতে চিকন গোলাপি ঠোঁট জোড়াও কাঁপছে অর্পার।
"বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করেন?" প্রশ্ন ছুড়ল অর্পা।
"হুম,অনেক বেশি পছন্দ।তবে মেঘলা আকাশ তার চাইতেও আরো বেশি পছন্দের"
ফিকে একটু হেসে অর্পা ছোট্ট করে বলল,
"আমারো খুব পছন্দ বৃষ্টিতে ভিজতে"
অতঃপর ঝুম বৃষ্টির ছায়ার নিচে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে
দুজনের খানিকক্ষন কথোপকথন হল।সেই কথার সুত্র ধরেই কিছুদিনের মধ্যেই দুজনের বন্ধুত্বের সূচনা হয়।
.
(৩)
যে ছেলেটা ক্লাসে কারো সাথেই কথা বলতে চাইত না সেই ছেলেটাই আজ ক্লাস মাতিয়ে রাখে।ইমরানের এতটা পরিবর্তের একমাত্র কারন অর্পা।বন্ধুত্বের অটুট বন্ধনে বাঁধা দুজনে।
দুজনার মনের ছোট্ট কৌঁঠিরে ভালোবাসা নামক এক অদৃশ্য অনুভূতির জন্ম নিয়েছে।কিন্তু হারিয়ে ফেলার অজানা এক ভয়ের হাত না বলা কথাগুলোকে চেপে ধরে রাখে।
ইমরান অনেকবার ভাবে আজ বলেই দিবে অপ্রকাশিত ভালোবাসার কথা।কিন্তু আবার খটকা লাগে যদি হাতটা অর্পার হাতের মুঠোয় মুষ্টিবদ্ধ না হয়! যদি অর্পা মুখের উপর না করে দেয়! পরক্ষনে আবারও ইমরান ভাবে ৩বছরের বন্ধুত্বের মধ্যে এক চিমটি ভালোবাসা হলেও তো অর্পার মনের কোনে জন্মিয়েছে।
অর্পার মনের ভাবনা ও চিন্তাধারা ইমরানের মতই।অপ্রকাশিত ভালোবাসার অনুতপ্ততা মনের ভেতরের জায়গাটুকু জুড়িয়ে নিচ্ছে।
.
ছাদের উপর দাড়িয়ে রয়েছে ইমরান।অর্পাকে ফোন করে ছাদে আসতে বলেছে।অনেক্ষন হলো অপেক্ষা করছে,তবুও অর্পার ছায়াও দেখা যাচ্ছে না।আজ ভালোবাসার কথা বলবেই ইমরান।যা হবার হোক।মনের কোনে অপ্রকাশিত ভালোবাসার স্ফরতা আর বইতে পারবে না সে।ঝিঁ ঝিঁ পোকার গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে চারদিকে।আকাশের চাঁদটা ঠোঁট বাকানো হাসিতে ঝুলে রয়েছে।
ইমরান আকাশের চাঁদটাকে কল্পনায় ঠোঁটের আকৃতিতে আঁকছে।মনে হচ্ছে সুদূর আকাশের তেপান্তর থেকে অর্পা হাসছে।হঠাৎ করেই নুপুরের ঝনঝন শব্দ এসে কানে মিছিল করছে।জ্যোৎস্নায় টুইটুম্বুর চারদিক।স্নিগ্ধ হাওয়ায় মাতাল করা এক গন্ধ ভেসে আসছে।বেলি ফুলের গন্ধ মনে হচ্ছে।কিন্তু আশেপাশে তো কোন বেলি ফুলের গাছ নেই! তাহলে কোথায় থেকে এই গন্ধ আসছে! বেশ খানিকক্ষন ভাবনার ঘোরের পর বেলি ফুলের গন্ধের অবসান ঘটল।জ্যোৎস্নাময়ী রাতে ধীরে ধীরে সামনের দিক থেকে অর্পা যেন জ্যোৎস্নার সাথে ভেসে আসছে।কড়া পারফিউম মেখেছে সে।তার উপস্থিতিতে বেলি ফুলের গন্ধে চারদিকটা মাতাল উন্মাদনাময় হয়ে উঠেছে।
.
(৪)
সামনা সামনি দাঁড়িয়ে দুজনে।মাত্র কয়েক কদমের ব্যবধান রয়েছে মাঝে।ব্যবধান বলতে দুই ছাদের উপর দুজন।মাঝে শুধু ছাদের শেষাংশের ফাঁকাটুকুই।রূপালি জ্যোৎস্নায় আজ অর্পাকে রূপালিকন্যা মনে হচ্ছে।একেক সময় অর্পাকে একেক রকম লাগে।অদ্ভূদ ধরনের সুন্দর লাগে তাকে।মেঘের জলে ভিজলে মনে হয় যেন মেঘকন্যা,রূপালি জ্যোৎস্না গায়ে মাখালে মনে হয় যেন রূপালিকন্যা।আর কিসে তাকে অন্য কোন রূপ এসে আকঁড়ে ধরে?!
"কি হয়েছে রে তোর! দিক ভুলা হয়ে তাকিয়ে আছিস কেন?"
ভাবনার ঘোর কাটল ইমরানের।এখন অপ্রকাশিত ভালোবাসার কথা বলতেই হবে।বুকের বাম পাশটা ধিকিধিকি স্বজোরে কাপঁছে।নিঃশ্বাসটা তাৎক্ষনিক ভারি হয়ে গেছে তার।খোলা আকাশের নিচে ছাদের উপর বাতাসের পথে দাঁড়িয়ে থেকেও ঘেমে যাচ্ছে ইমরান।অনুভূতিরা ঘিরে ধরেছে তাকে।ইমরান বুক ধুকধুকানি নিয়েই বলল
"তোকে একটা কথা বলার ছিল"
"বল"
"এমনি না।চোখ বন্ধ কর।চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে তোকে বলতে পারব না"
"মেয়ে নাকি তুই যে, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারবি না"
"বন্ধ কর না" কন্ঠে ভীষন আকুলতা।
"পারব না,চোখের দিকেই তাকিয়ে বল"
"আগে কথা দে,যেটাই বলি- না রাখতে পারলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবি না"
"আচ্ছা কথা দিলাম"
"উহু,এভাবে না।হাতটা এদিকে দে।"
"এত দূর থেকে ধরতে পারবি?"
"এদিকে হাতটা বাড়িয়ে দেখনা"
"এই নে,,,,,,,,,,,,,,,"
বলেই হাত দুটোই বাড়িয়ে দিল অর্পা।হাতের আঙ্গুলগুলো ধরে নিল ইমরান।মূহুর্তেই লজ্জায় মাথাটা নুইয়ে নিলো অর্পা।ইমরান বলল,
"এবার কথা দে।তবে হাত ছাড়বি না কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত"
"আচ্ছা ছাড়ব না।আর কথা দিলাম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করব না"
"নিচের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন! তুই না বললি চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে! চোখের দিকে তাকা"
পাপড়ি দুটো সরু করে ইমরানের চোখের দিকে তাকাল অর্পা।ইমরান বলতে চাচ্ছে কিন্তু কোন কথা যেন বের হচ্ছে না।মনে হচ্ছে স্বজোড়ে বলছে ইমরান তবুও সে যেন শুনছে না।এমন লাগছে কেন ইমরানের ভেবে পায় না।অস্বস্তি লাগছে নাকি অনুভূতিরা এসে গ্রাস করল!গলাটা হালকা ভাবে ঝাঁকিয়ে ইমরান বলল,
"কিভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয় জানিনা।আমি কোন কবি নই যে কাব্যিক ভাষায় ভালোবাসার ব্যাখ্যা করব।কেন জানি তোর পাশে থাকলে নিজেকে হারিয়ে ফেলি তোর মাঝে।তোর আলিঙ্গনের সর্বস্র উঠোন জুড়ে আনমনে খোঁজে বেড়াই নিজেকে।কোথাও পাইনা এই আমাকে।কোনখানে নিয়ে রেখেছিস তুই তা জানিনা।তোর আলতো স্পর্শে শরীরটা তুমুলভাবে নেচে উঠে।তোর একটু অভিমানে পাপড়ি কেঁপে কেঁপে চোখের এক কোনা দিয়ে জল ঝরে।আচ্ছা এটাকে কি ভালোবাসা বলে? যদি তাই হয়,তবে তোকে আমি ভালোবাসি।অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি।তোর হাতের আঙ্গুলগুলো যেভাবে আমার হাতের মুঠোয় মুষ্টিবদ্ধ আছে সেভাবে সারাটা প্রনয় তোকে ধরে রাখতে চাই।তোর হাত ধরে রাখার অধিকারটুকু কি আমায় তুই দিবি? তুই থেকে তুমি করে বলতে চাই তোকে।"
.
কথা শেষ করতেই রূপালি জ্যোৎস্নায় ইমরান দেখল অর্পার চোখে জল ছলছল করছে।চোখের নোনা জল বাঁধ ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে।আচমকা হু হু করে কেঁদেই দিল অর্পা।
"এই কথাটা বলতে এতদিন লাগল!! তুমি কি বুঝো না কতটা ভালোবাসি তোমাকে! চোখের দিকে তাকিয়েও কি বুঝতে পারো নি অজস্র ভালোবাসার অনুভূতির ভীড় সেখানে! খুব ভালোবাসি তোমায়"
কাঁদো কাঁদো ধরা কন্ঠে বলল অর্পা।
.
(৫)
ফ্লাইওভারের উপর নিয়ন বাতির লালচে আলোয় হাটছে ইমরান। বন্ধুত্বের পর ভালোবাসার সম্পর্কের ২বছর পেরিয়েছে।কখনো অর্পা তার সাথে এমন ব্যবহার করেনি।তবে আজ কেন এমনটা করল! অর্পার আব্বু দেশের বাহিরে থাকে।অর্পা আর তার আম্মু দেশে থাকত।আগামি মাসে দুজনেই তার আব্বুর কাছে যাবে বেড়াতে।প্রায় অনেকদিন ইমরানের সাথে দেখা হবে না এটা ভেবে রাগে হয়ত এমন ব্যবহার করেছিল।এটা ভেবে ইমরান সান্তনা দিল মনকে।
.
কিছুদিন ধরে অর্পা মাঝে মাঝে মাথা ঘুরে লুটিয়ে পরে যায়।এমনটা অর্পার আগে কখনো হত না।কি কারনে এমনটা হয় অর্পার আম্মু ভেবে পায় না।শহরের ভালো ডাক্তারের সাথে অর্পার আম্মু এটা নিয়ে কথা বলেছে।ডাক্তার বলেছে অর্পাকে নিয়ে যেতে কিছু চেকআপ করতে হবে।বিশেষ করে মাথাটা স্ক্যান করতে হবে।নির্দিষ্ট সময়ে চেকআপ শেষে রিপোর্টের দিন অর্পার আম্মুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরল।মস্তিষ্কের ভেতরে টিউমার বেঁধেছে।অপারেশনের মাধ্যমেও সেটা বের করা সম্ভব নয়।খুব শীঘ্রই অর্পা পৃথিবী পারি দিতে পারে।ডাক্তারের কাছ থেকে কথাগুলো শুনে অর্পার আম্মুর কাছে তা স্বপ্ন মনে হচ্ছে।চিমটি দিলে হয়ত স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাবে।নিজেই চিমটি কাটল।নাহ! কান ভুল শুনেনি।সবই সত্যি।হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সে।কিভাবে তা সম্ভব! বাড়িতে ধুমকালো মুখ নিয়ে ফিরে দেখে অর্পা বাসায় নেই।অর্পার আব্বুকে সব জানালো।অর্পার আব্বু বলেছে বিদেশে নিয়ে যেতে।ঐখানে যেভাবেই হোক অপারেশনের ব্যবস্থা করবেই।কিন্তু অর্পাকে কোন ভাবে জানানো যাবে না।এসব কিছুই অর্পা জানেনা।ইমরান তো জানেই না।অর্পা যানে কিছু দিনের জন্য সে তার আম্মুর সাথে আব্বুর কাছে বেড়াতে যাবে।
.
সূর্যাস্তের বিকেলে পুকুরের পানিতে যেন স্বর্নদানা চিকচিক করছে।প্রতিটি ছোট ছোট ঢেউয়ের সাথে স্বর্নদানা উপচে পড়তে চাইছে।অর্পা আসবে বলে দেশের বাহিরে গিয়েছে আজ আট মাস পেরিয়ে নয় মাসের পদার্পন হলো।কিন্তু অর্পা বলেছিল তিন মাস পরই চলে আসবে।প্রথম দুইমাস ফোনে যোগাযোগ হত।কিন্তু শেষের ছয়মাস আর কোন প্রকার যোগাযোগ হয়নি অর্পার সাথে।অর্পার ফোনের লাইনটাও গত ছয়মাস ধরে অফ পাচ্ছে।কি হলো হঠাৎ অর্পার! একটা মানুষ কিছু দিনের ব্যবধানে কি এতটা পরিবর্তন হতে পারে! মানুষটি আসলে পরিবর্তন হয়নি।অপারেশনের সময় অর্পা পৃথিবী পারি দিয়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে।কিন্তু তা ইমরানের কল্পনার বাহিরে।ইমরান এসবের কিছুই যানে না।জানবেই বা কিভাবে! কারো সাথেই তো ইমরানের যোগাযোগ নেই।
ইমরান ভাবছে,অর্পা তো ইমরানকে ছেড়ে যেতে চায়নি।এক প্রকার জোর করেই অর্পাকে দেশের বাহিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।যাওয়ার আগের দিন ইমরানকে জড়িয়ে ধরে ঠুঁকরে ঠুঁকরে কেঁদেছিল অনেকক্ষন ধরে।তবে কেন এভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল! কি কারনেই বা অর্পা আর ফিরল না।তবুও একরাশ কষ্টের কুন্ডুলি বুকে বেঁধে নির্বিক পথিকের মত অপেক্ষার ধ্রুমজাল বুনছে ইমরান।আশার অতীত অর্পা ফিরবেই।
`
`
`
কোনের টেবিলটাতে সব সময় বসে থাকে কেন ছেলেটা!
কারো সাথেই কথা বলতে চায় না।এমন কেন সে! মনকে
প্রশ্ন করে অর্পা।মন কোন উত্তর দেয় না।ছেলেটা প্রায়ই অর্পার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে।তবে কথা বলতে চায়না কেন সে! অর্পা তা ভেবে পায়না।প্রতিদিন
নিয়ম মাফিক করে ক্লাসের ফাকে ফাকে আড় চোখে
অর্পাও ছেলেটাকে দেখে আর বারবার মুগ্ধ হয়।বারবার
মুগ্ধ হতে অর্পার ভালোই লাগে। এই মুগ্ধতাই আস্তে
আস্তে ভালোবাসায় রূপান্তর হয়ে গেছে।মুখ ফুটে অর্পা
কিছু বলতে পারে না।বলবেই-বা কিভাবে! এখনো তো
ছেলেটার সাথে খুব একটা কথাই হয়নি।অর্পা অপেক্ষার ধ্রুমজাল বুনে।যেকোন একদিন কথা বলবেই।অর্পা অনেকবার
চেয়েছে কথা বলতে।কিন্তু ছেলেটা
প্রয়োজন ছাড়া যেন কথাই বলতে চায় না।এমন একটা
ছেলেকে অর্পা পছন্দ করেছে! অর্পার বান্ধবীরা এটা
নিয়ে অনেক ঠাট্টা করে।তবে সেদিকে অর্পার কোন
ভ্রুিক্ষুপ নেই।এমন একটা ছেলেকেই অর্পা তার জীবনে
চেয়েছিল।তার মত ছেলেরাই খুব গভীর আবেগ নিয়ে আপন করে
ভালোবাসতে যানে।আবেগ ছাড়া ভালোবাসা কল্পনার বাহিরে।
.
ছেলেটার নাম ইমরান।অর্পার সাথে একই ক্লাসে পড়ে।
ইমরানের সাথে অর্পার প্রথম দেখা হয় ছাদের কোনে।
পাশাপাশি বাসা দুজনের।দুই ছাদের নিচে দুজনের
আবাসস্থল।ভেজা চুলগুলো শুকানোর জন্য ছাদের উপর
উঠেছিল অর্পা।ছাদে উঠেই চোখ গেলো পাশের বাসার
ছাদের উপর।চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়ে ছাদের
রেলিং ধরে অন্যমনস্ক হয়ে দাড়িয়ে ছিল ইমরান।গায়ে
ছিল ধূসর সাদা পাঞ্জাবি।
.
অর্পা দুষ্টুমি করে ইমরানকে ডেকে উঠল,
"এই যে?......."
কোন প্রতি উত্তর নেই ইমরানের কাছ থেকে।আবারো
অর্পা ডাকল,
"এই যে শুনছেন?...."
"এই,আপনি কি কানে শুনতে পান না নাকি?"
অন্যমনষ্কতা ভেদ করে শেষের বাক্যটা ইমরানের কান
অব্দি পৌঁছিয়েছে।ফিরে তাকালো ইমরান।অচেনা
একটি মেয়ে।ঠোঁটের বেলকুনিতে হাসি এঁকেছে।
মেয়েটি কি ইমরানকেই ডেকেছিল?!! নাহ অপরিচিত
মেয়ে কেন ইমরানকে ডাকবে! ভেবেই তাৎক্ষনিক
মাথাটা ঘুড়িয়ে নিল ইমরান।অর্পা ভিমচিৎ খেয়ে
গেলো।আবারো ডাকল,
"এই শুনছেন? ফিরে দাড়ালেন কেন? এদিকে ঘুড়োন।
আপনাকেই ডেকেছি"
চশমাটা ঠিক করতে করতে ঘুড়ে দাড়ালো ইমরান।থমকে
থমকে মুখগহব্বর থেকে চুপসানো ধ্বনি বের হল।অর্পা
শুনতে পায়নি অস্পষ্ট কথাটুকু।অর্পা বলল,
"কি বললেন শুনতে পাইনি"
"না মানে কি জন্য ডেকেছিলেন?"
"কেন! আপনাকে ডাকা কারো নিষেধ আছে নাকি!!"
"তেমন কিছু নয়।আমি তো আপনাকে চিনিনা"
"কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।(একটু মজা করে মিথ্যা
বলল অর্পা)"
অর্পা ইমরানকে চিনে কথাটা শুনেও ইমরান একটুও
চমকালো না।ইমরানের কাছে পরিচিতির ব্যাপারটা
কমন মনে হয়।খানিকক্ষন চুপ থেকে ইমরান বলল,
"ভালো"
"ভালো মানে! আপনি আমাকে চিনেন না অথচ আমি
আপনাকে চিনি সেটা আপনার কাছে আশ্চর্য্যের মনে
হলো না!!"
"আশ্চর্য্যের কি আছে? আচ্ছা আমি যাই"
"আচ্ছা। ওহ আপনার নামটা কি?"
"ইমরান"
"আমি অর্পা"
ফিকে একটু হেসে সিঁড়ির দিকে ইমরান পা বাড়ালো।
ইমরানের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে অর্পা
তাকিয়ে রইল।মনে মনে ভাবছে ছেলেটা কতটা সরল
সোজা।তবে মোটা ফ্রেমের চশমায় ছেলেটাকে দারুন
মানায়।একফালি হেসে অর্পা তার নিজের রুমে চলে
গেলো।
.
(২)
ক্লাস শেষে বাড়িতে ফিরল অর্পা।অর্পা বরাবর প্রতিদিনের মতই অপেক্ষা করে কখন বিকেল হবে।বেশ কিছুদিন হলো ইমরান আর ছাদে আসে নি।তবে ক্লাসে যদিও প্রতি দিনই দুজনের দেখা হয় কিন্তু কথা হয়না বললেই চলে।অর্পা প্রতিনিয়ত ছাদে আসত।ছাদের কোনে একটি হুইল চেয়ার স্থাপন
করেছে সে।পরন্ত গৌধুলি বিকেলে ছাদের কোনে বসে
থাকে অর্পা।একদিন বিকেলে নীল আকাশের সাদা মেঘ
ধীরে ধীরে ঘন কালো হয়ে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।তীব্র
বাতাসের সাথে দলা বেঁধে নিকশ কালো মেঘেরা
ছুটাছুটি করছে।এই বুঝি ধুপ করে ছাপিয়ে বৃষ্টি নামবে।
নিকশ কালো মেঘলা আকাশ ইমরানের খুব পছন্দের।
জানালার পর্দার ফাক দিয়ে দলা বাঁধানো মেঘের
ছুটাছুটি দেখে রুম থেকে বেড়িয়ে ছাদে এসেছে ইমরান।
.
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।বৃষ্টির একেকটি ফোটা একেক
জনের মনে একেক রকম ভালো লাগার জন্ম দিলেও
কারো কারো মনে এক অদ্ভূত ভালোলাগার অনুভূতির
জন্ম দেয়।তাদের মধ্যে ইমরান একজন।
ছাদে এসে ইমরান মুর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।অর্পাও
বৃষ্টিতে ভিজে কাক ভেজা হয়ে গেছে।চুলগুলো লেপ্টে
আছে সারা মাথা জুড়ে।চুলের ঝরা বৃষ্টির জলগুলো গাল
দুটো বেয়ে থুতনি দিয়ে বুকের উপর ফোটায় ফোটায়
পড়ছে।
.
অপলক দৃষ্টিতে ইমরান তাকিয়ে রইল অর্পার দিকে।বৃষ্টি
ভেজা ললনাদের এতটা সুন্দর লাগে কাছ থেকে না
দেখলে সেটা বুঝার উপায় নেই।ইমরানের কাছে আজ
অর্পাকে মেঘকন্যা মনে হচ্ছে।ঠান্ডা হিমেল বাতাসে
শরীরে কাুপঁনি চলে এসেছে অর্পার।ছাদ থেকে নেমে
নিচে যাওয়ার ছলে ঘুরতেই দেখে ইমরানও ছাদের উপর
ভিজছে।চোখের দৃষ্টি রয়েছে অর্পার উপর।থমকে গেল
অর্পা।স্থির দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষন।প্রবল বেগে বৃষ্টির
বড় বড় ফোটা পরছে।টিপ টিপ পায়ে ইমরানের
কাছাকাছি যাচ্ছে অর্পা।ইমরানও ধীরে ধীরে অর্পার
দিকে ছাদের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এগুচ্ছে।রেলিং এর
সাথে আচমকা ধাক্কা লেগে চোখের পলক পরল।এতক্ষন
কি তাহলে ইমরানের চোখের পলক পরেনি!! মনে পরছে
না ইমরানের।অর্পাকে যত দেখে ততই কেন ভালো
লাগছে ইমরানের!! ব্যাখ্যাটা ইমরানের জানা নেই।
ভাবনায় শুধুই অর্পা।
.
ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন।হঠাৎ করেই
ধমকা বাতাসে শরীরটা কাঁপুনি দিয়ে উঠল দুজনের।
ইমরান বলল,
"বৃষ্টিতে ভিজছেন যে জ্বর আসবে না?"
"আপনিও তো ভিজছেন! আপনারও তো জ্বর আসতে পারে!"
সাবলীল উত্তর অর্পার।মেয়েটা গুছানো কথা বলে,ভাবছে ইমরান।ফুরফুরে বাতাস যেন অর্পার ভেজা চুলগুলো নিয়ে শূন্যে খেলা করতে চাচ্ছে।শরীরের কাঁপুনিতে চিকন গোলাপি ঠোঁট জোড়াও কাঁপছে অর্পার।
"বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করেন?" প্রশ্ন ছুড়ল অর্পা।
"হুম,অনেক বেশি পছন্দ।তবে মেঘলা আকাশ তার চাইতেও আরো বেশি পছন্দের"
ফিকে একটু হেসে অর্পা ছোট্ট করে বলল,
"আমারো খুব পছন্দ বৃষ্টিতে ভিজতে"
অতঃপর ঝুম বৃষ্টির ছায়ার নিচে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে
দুজনের খানিকক্ষন কথোপকথন হল।সেই কথার সুত্র ধরেই কিছুদিনের মধ্যেই দুজনের বন্ধুত্বের সূচনা হয়।
.
(৩)
যে ছেলেটা ক্লাসে কারো সাথেই কথা বলতে চাইত না সেই ছেলেটাই আজ ক্লাস মাতিয়ে রাখে।ইমরানের এতটা পরিবর্তের একমাত্র কারন অর্পা।বন্ধুত্বের অটুট বন্ধনে বাঁধা দুজনে।
দুজনার মনের ছোট্ট কৌঁঠিরে ভালোবাসা নামক এক অদৃশ্য অনুভূতির জন্ম নিয়েছে।কিন্তু হারিয়ে ফেলার অজানা এক ভয়ের হাত না বলা কথাগুলোকে চেপে ধরে রাখে।
ইমরান অনেকবার ভাবে আজ বলেই দিবে অপ্রকাশিত ভালোবাসার কথা।কিন্তু আবার খটকা লাগে যদি হাতটা অর্পার হাতের মুঠোয় মুষ্টিবদ্ধ না হয়! যদি অর্পা মুখের উপর না করে দেয়! পরক্ষনে আবারও ইমরান ভাবে ৩বছরের বন্ধুত্বের মধ্যে এক চিমটি ভালোবাসা হলেও তো অর্পার মনের কোনে জন্মিয়েছে।
অর্পার মনের ভাবনা ও চিন্তাধারা ইমরানের মতই।অপ্রকাশিত ভালোবাসার অনুতপ্ততা মনের ভেতরের জায়গাটুকু জুড়িয়ে নিচ্ছে।
.
ছাদের উপর দাড়িয়ে রয়েছে ইমরান।অর্পাকে ফোন করে ছাদে আসতে বলেছে।অনেক্ষন হলো অপেক্ষা করছে,তবুও অর্পার ছায়াও দেখা যাচ্ছে না।আজ ভালোবাসার কথা বলবেই ইমরান।যা হবার হোক।মনের কোনে অপ্রকাশিত ভালোবাসার স্ফরতা আর বইতে পারবে না সে।ঝিঁ ঝিঁ পোকার গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে চারদিকে।আকাশের চাঁদটা ঠোঁট বাকানো হাসিতে ঝুলে রয়েছে।
ইমরান আকাশের চাঁদটাকে কল্পনায় ঠোঁটের আকৃতিতে আঁকছে।মনে হচ্ছে সুদূর আকাশের তেপান্তর থেকে অর্পা হাসছে।হঠাৎ করেই নুপুরের ঝনঝন শব্দ এসে কানে মিছিল করছে।জ্যোৎস্নায় টুইটুম্বুর চারদিক।স্নিগ্ধ হাওয়ায় মাতাল করা এক গন্ধ ভেসে আসছে।বেলি ফুলের গন্ধ মনে হচ্ছে।কিন্তু আশেপাশে তো কোন বেলি ফুলের গাছ নেই! তাহলে কোথায় থেকে এই গন্ধ আসছে! বেশ খানিকক্ষন ভাবনার ঘোরের পর বেলি ফুলের গন্ধের অবসান ঘটল।জ্যোৎস্নাময়ী রাতে ধীরে ধীরে সামনের দিক থেকে অর্পা যেন জ্যোৎস্নার সাথে ভেসে আসছে।কড়া পারফিউম মেখেছে সে।তার উপস্থিতিতে বেলি ফুলের গন্ধে চারদিকটা মাতাল উন্মাদনাময় হয়ে উঠেছে।
.
(৪)
সামনা সামনি দাঁড়িয়ে দুজনে।মাত্র কয়েক কদমের ব্যবধান রয়েছে মাঝে।ব্যবধান বলতে দুই ছাদের উপর দুজন।মাঝে শুধু ছাদের শেষাংশের ফাঁকাটুকুই।রূপালি জ্যোৎস্নায় আজ অর্পাকে রূপালিকন্যা মনে হচ্ছে।একেক সময় অর্পাকে একেক রকম লাগে।অদ্ভূদ ধরনের সুন্দর লাগে তাকে।মেঘের জলে ভিজলে মনে হয় যেন মেঘকন্যা,রূপালি জ্যোৎস্না গায়ে মাখালে মনে হয় যেন রূপালিকন্যা।আর কিসে তাকে অন্য কোন রূপ এসে আকঁড়ে ধরে?!
"কি হয়েছে রে তোর! দিক ভুলা হয়ে তাকিয়ে আছিস কেন?"
ভাবনার ঘোর কাটল ইমরানের।এখন অপ্রকাশিত ভালোবাসার কথা বলতেই হবে।বুকের বাম পাশটা ধিকিধিকি স্বজোরে কাপঁছে।নিঃশ্বাসটা তাৎক্ষনিক ভারি হয়ে গেছে তার।খোলা আকাশের নিচে ছাদের উপর বাতাসের পথে দাঁড়িয়ে থেকেও ঘেমে যাচ্ছে ইমরান।অনুভূতিরা ঘিরে ধরেছে তাকে।ইমরান বুক ধুকধুকানি নিয়েই বলল
"তোকে একটা কথা বলার ছিল"
"বল"
"এমনি না।চোখ বন্ধ কর।চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে তোকে বলতে পারব না"
"মেয়ে নাকি তুই যে, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারবি না"
"বন্ধ কর না" কন্ঠে ভীষন আকুলতা।
"পারব না,চোখের দিকেই তাকিয়ে বল"
"আগে কথা দে,যেটাই বলি- না রাখতে পারলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবি না"
"আচ্ছা কথা দিলাম"
"উহু,এভাবে না।হাতটা এদিকে দে।"
"এত দূর থেকে ধরতে পারবি?"
"এদিকে হাতটা বাড়িয়ে দেখনা"
"এই নে,,,,,,,,,,,,,,,"
বলেই হাত দুটোই বাড়িয়ে দিল অর্পা।হাতের আঙ্গুলগুলো ধরে নিল ইমরান।মূহুর্তেই লজ্জায় মাথাটা নুইয়ে নিলো অর্পা।ইমরান বলল,
"এবার কথা দে।তবে হাত ছাড়বি না কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত"
"আচ্ছা ছাড়ব না।আর কথা দিলাম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করব না"
"নিচের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন! তুই না বললি চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে! চোখের দিকে তাকা"
পাপড়ি দুটো সরু করে ইমরানের চোখের দিকে তাকাল অর্পা।ইমরান বলতে চাচ্ছে কিন্তু কোন কথা যেন বের হচ্ছে না।মনে হচ্ছে স্বজোড়ে বলছে ইমরান তবুও সে যেন শুনছে না।এমন লাগছে কেন ইমরানের ভেবে পায় না।অস্বস্তি লাগছে নাকি অনুভূতিরা এসে গ্রাস করল!গলাটা হালকা ভাবে ঝাঁকিয়ে ইমরান বলল,
"কিভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয় জানিনা।আমি কোন কবি নই যে কাব্যিক ভাষায় ভালোবাসার ব্যাখ্যা করব।কেন জানি তোর পাশে থাকলে নিজেকে হারিয়ে ফেলি তোর মাঝে।তোর আলিঙ্গনের সর্বস্র উঠোন জুড়ে আনমনে খোঁজে বেড়াই নিজেকে।কোথাও পাইনা এই আমাকে।কোনখানে নিয়ে রেখেছিস তুই তা জানিনা।তোর আলতো স্পর্শে শরীরটা তুমুলভাবে নেচে উঠে।তোর একটু অভিমানে পাপড়ি কেঁপে কেঁপে চোখের এক কোনা দিয়ে জল ঝরে।আচ্ছা এটাকে কি ভালোবাসা বলে? যদি তাই হয়,তবে তোকে আমি ভালোবাসি।অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি।তোর হাতের আঙ্গুলগুলো যেভাবে আমার হাতের মুঠোয় মুষ্টিবদ্ধ আছে সেভাবে সারাটা প্রনয় তোকে ধরে রাখতে চাই।তোর হাত ধরে রাখার অধিকারটুকু কি আমায় তুই দিবি? তুই থেকে তুমি করে বলতে চাই তোকে।"
.
কথা শেষ করতেই রূপালি জ্যোৎস্নায় ইমরান দেখল অর্পার চোখে জল ছলছল করছে।চোখের নোনা জল বাঁধ ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে।আচমকা হু হু করে কেঁদেই দিল অর্পা।
"এই কথাটা বলতে এতদিন লাগল!! তুমি কি বুঝো না কতটা ভালোবাসি তোমাকে! চোখের দিকে তাকিয়েও কি বুঝতে পারো নি অজস্র ভালোবাসার অনুভূতির ভীড় সেখানে! খুব ভালোবাসি তোমায়"
কাঁদো কাঁদো ধরা কন্ঠে বলল অর্পা।
.
(৫)
ফ্লাইওভারের উপর নিয়ন বাতির লালচে আলোয় হাটছে ইমরান। বন্ধুত্বের পর ভালোবাসার সম্পর্কের ২বছর পেরিয়েছে।কখনো অর্পা তার সাথে এমন ব্যবহার করেনি।তবে আজ কেন এমনটা করল! অর্পার আব্বু দেশের বাহিরে থাকে।অর্পা আর তার আম্মু দেশে থাকত।আগামি মাসে দুজনেই তার আব্বুর কাছে যাবে বেড়াতে।প্রায় অনেকদিন ইমরানের সাথে দেখা হবে না এটা ভেবে রাগে হয়ত এমন ব্যবহার করেছিল।এটা ভেবে ইমরান সান্তনা দিল মনকে।
.
কিছুদিন ধরে অর্পা মাঝে মাঝে মাথা ঘুরে লুটিয়ে পরে যায়।এমনটা অর্পার আগে কখনো হত না।কি কারনে এমনটা হয় অর্পার আম্মু ভেবে পায় না।শহরের ভালো ডাক্তারের সাথে অর্পার আম্মু এটা নিয়ে কথা বলেছে।ডাক্তার বলেছে অর্পাকে নিয়ে যেতে কিছু চেকআপ করতে হবে।বিশেষ করে মাথাটা স্ক্যান করতে হবে।নির্দিষ্ট সময়ে চেকআপ শেষে রিপোর্টের দিন অর্পার আম্মুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরল।মস্তিষ্কের ভেতরে টিউমার বেঁধেছে।অপারেশনের মাধ্যমেও সেটা বের করা সম্ভব নয়।খুব শীঘ্রই অর্পা পৃথিবী পারি দিতে পারে।ডাক্তারের কাছ থেকে কথাগুলো শুনে অর্পার আম্মুর কাছে তা স্বপ্ন মনে হচ্ছে।চিমটি দিলে হয়ত স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাবে।নিজেই চিমটি কাটল।নাহ! কান ভুল শুনেনি।সবই সত্যি।হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সে।কিভাবে তা সম্ভব! বাড়িতে ধুমকালো মুখ নিয়ে ফিরে দেখে অর্পা বাসায় নেই।অর্পার আব্বুকে সব জানালো।অর্পার আব্বু বলেছে বিদেশে নিয়ে যেতে।ঐখানে যেভাবেই হোক অপারেশনের ব্যবস্থা করবেই।কিন্তু অর্পাকে কোন ভাবে জানানো যাবে না।এসব কিছুই অর্পা জানেনা।ইমরান তো জানেই না।অর্পা যানে কিছু দিনের জন্য সে তার আম্মুর সাথে আব্বুর কাছে বেড়াতে যাবে।
.
সূর্যাস্তের বিকেলে পুকুরের পানিতে যেন স্বর্নদানা চিকচিক করছে।প্রতিটি ছোট ছোট ঢেউয়ের সাথে স্বর্নদানা উপচে পড়তে চাইছে।অর্পা আসবে বলে দেশের বাহিরে গিয়েছে আজ আট মাস পেরিয়ে নয় মাসের পদার্পন হলো।কিন্তু অর্পা বলেছিল তিন মাস পরই চলে আসবে।প্রথম দুইমাস ফোনে যোগাযোগ হত।কিন্তু শেষের ছয়মাস আর কোন প্রকার যোগাযোগ হয়নি অর্পার সাথে।অর্পার ফোনের লাইনটাও গত ছয়মাস ধরে অফ পাচ্ছে।কি হলো হঠাৎ অর্পার! একটা মানুষ কিছু দিনের ব্যবধানে কি এতটা পরিবর্তন হতে পারে! মানুষটি আসলে পরিবর্তন হয়নি।অপারেশনের সময় অর্পা পৃথিবী পারি দিয়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে।কিন্তু তা ইমরানের কল্পনার বাহিরে।ইমরান এসবের কিছুই যানে না।জানবেই বা কিভাবে! কারো সাথেই তো ইমরানের যোগাযোগ নেই।
ইমরান ভাবছে,অর্পা তো ইমরানকে ছেড়ে যেতে চায়নি।এক প্রকার জোর করেই অর্পাকে দেশের বাহিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।যাওয়ার আগের দিন ইমরানকে জড়িয়ে ধরে ঠুঁকরে ঠুঁকরে কেঁদেছিল অনেকক্ষন ধরে।তবে কেন এভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল! কি কারনেই বা অর্পা আর ফিরল না।তবুও একরাশ কষ্টের কুন্ডুলি বুকে বেঁধে নির্বিক পথিকের মত অপেক্ষার ধ্রুমজাল বুনছে ইমরান।আশার অতীত অর্পা ফিরবেই।
`
`
`
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন