শনিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৬

যখন সময় থমকে দাঁড়ায়

কোথাও থেকে টুপটাপ পানি পড়ার শব্দ আসছে। ক্রমেই যেন বাড়ছে পানির শব্দটা, ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছে নিলয়। ইনসমনিয়াক কারো কাছে এক টুকরো ঘুমের চাইতে কাঙ্ক্ষিত আর কিছুই নেই। পানি পড়ার শব্দটা নিলয়ের ধরে আসা ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। পাতলা কাঁথাটা সরিয়ে বিছানা ছাড়ে নিলয়। শব্দটা বন্ধ করতেই হবে, যেভাবেই হোক। না হলে আজ রাতেও এক ফোটা ঘুম আসবে না তার। কালি গোলা আঁধার ঘরটাতে। গভীর রাতেও লোড শেডিং। ছোট কাঠের টেবিলের উপর তিন ব্যাটারির টর্চ লাইটটা থাকার কথা, আজ সেটাও নেই। আন্দাজে উঠে গিয়ে দরজাটা খুঁজতে লাগলো নিলয়। পাঁচটা বছর হয়ে গেছে এই ছোট্ট ঘরটাতে, দরজা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলো না তাই। খুট করে ছিটকিনি খুলে বাইরে বের সে। সামনের খোলা প্রান্তর ঝিকমিক করছে সোনালী জোছনায়। আজ কি পূর্ণিমা?
জোছনার একটা দুর্নিবার টান আছে। প্রবল ঘুমে কাতর মানুষও জোছনা রাতে কিছু সময় পরিচিত পরিবেশের হটাত বদলে যাওয়া রূপটা দেখতে তাকিয়ে থাকে। নিলয় বুঝে গেছে, তার আর ঘুমানো হলো না আজকে। জোছনার আলোতে ঘরের ভেতর থেকে একটা চেয়ার টেনে বাইরে এসে বসে সে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে জোছনার দিকে। মনের মাঝে একটাই গান তখন - "আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ..."। একেই মনে হয় চাঁদনী পসর রাত বলে। হুমায়ুন আহমেদের সেই বিখ্যাত লাইন গুলো - "চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়….."। এমন মায়াময় রাত্রিতেই তো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা যায়। জোছনার মায়ায় ভুলে যাওয়া যায় অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ।
আচ্ছা, এত সুন্দর একটা রাতে সে মৃত্যুর কথা ভাবছে কেন? হুমায়ুন আহমেদই বা কেন ভেবেছিলেন? এই সময়ে তো আনন্দময় কিছু ভাববার কথা। পূর্ণ চাঁদের আলোয় তো বিষণ্ণতা মাখানো থাকবার কথা নয়। একটা যুক্তি অবশ্য আছে। বানভাসি জোছনার সৌন্দর্যের মাঝে মানুষ জীবনের পূর্ণতা খুঁজে পায়। সে মনে করে তার জীবনের সব চাওয়া পূরণ হয়েছে। এখন আর চাইবার কিছুই নেই। চাহিদা বিহীন জীবন অবশ্যই অস্বস্তিকর হবার কথা, নিরানন্দ হবার কথা। সে জন্য মানুষ মরে যেতে চায়।
ট্রাউজারের পকেট থেকে সেল ফোনটা বের করে নিলয়। অনেক দিন অনেক বছর অযত্নে ফোন বুকের এক কোণায় পরে থাকা নীলার নাম্বারটা খুঁজে বের করে। গত পাঁচ বছরে এই নাম্বারে আর কল দেবার প্রয়োজন অনুভব করেনি সে। কি হবে কল দিয়ে? যে নিতান্ত অবহেলায় তাকে মাঝ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেছে, তাকে পিছু ডেকে বিরক্ত করবার কোন মানে নেই। অথচ কি জীবন্ত ছিল সেই দিন গুলো। রাত বিরাতে হুট করে সেল ফোনে মেসেজ “একটা কল দে তো”।
- ঘুম ভাঙ্গালি কেন? কি হয়েছে?
- স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছি, আমাকে শক্ত করে একটু জড়িয়ে ধরবি? ভয় পাওয়া কাঁপা কাঁপা গলা নীলার। সচকিত নিলয় তখন।
- আয়, আমার কাছে আয়, আমি আছি তো, তোর পাশেই আছি, তোর কাছে আছি, কোন ভয় নেই। স্বপ্ন দেখে কেউ ভয় পায় রে পাগলী। কি দেখেছিলি স্বপ্নে?
- রাসেদ ...
গলা আবারও কাঁপে নীলার।
- আরে, ও তোর কি করবে? তুই তো আমার বুকের মধ্যে আছিস। তোকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না এখন।
- হু, আমাকে শক্ত করে ধরে রাখ তুই, আমার ভয় কাটছে না।
শত মাইলের ব্যবধানে থেকেও সে সময় নীলাকে জড়িয়ে রাখতো নিলয়। এ কথা সে কথা বলে ওর ভয়টা কাটিয়ে দিতো। এক সময় কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পড়তো নীলা। নিলয় চুপ করে থাকতো তখন, ওর ভারী নিশ্বাসের শব্দটা শোনা পর্যন্ত অপেক্ষা করতো, এরপর লাইনটা কেটে দিতো।
রাসেদ, সেই ইতরটাকে হাতের কাছে পেলে এখনও গলা টিপে মারবে নিলয়। তের চোদ্দ বছরের নীলার সাথে ভালবাসার অভিনয় করে যে এক সময় আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল নীলাকে। অবশ্যই তার যে টুকু পাবার ছিল, সেটুকু নিয়েই। নীলা নিজেই বলতো –
- রাসেদ কখনই ভালবাসেনি আমাকে। আমি ছোট ছিলাম, আমি অবুঝ ছিলাম। বাসায় কেউ না থাকলেই ও আসতো। কিছুক্ষণ অহেতুক বকবক করে আমার শরীরটা নিয়ে খেলতো। আমার কষ্ট হতো, আমি বলতাম ওকে, কিন্তু ওকে কিছুতেই বাঁধা দিতে পারতাম না। আমার ঠোট কেটে যেত, গালে গলায় লাল লাল চাকা চাকা দাগ হয়ে থাকতো। অনেক কষ্টে আমি সেই দাগ লুকাতাম, ব্যথার জন্য পেইজ কিলার খেতাম। ও চলে গেলে প্রতিবার খুব কাঁদতাম, সারা রাত জেগে কাঁদতাম। আমি অনেক সময় ওর সাথে আনমনে আমার স্বপ্নের কথা, আমার ভালবাসার কথা, আমার পৃথিবীটার কথা বলে গেছি, এরপর কিছু জিজ্ঞেস করলে ও অবাক হয়ে তাকাতো, বলতো আমার কথা শুনছিল সে, আমার ভয়েজ শুনছিল সে, কিন্তু কোন কথাই তার মাথায় ঢুকছিল না। অবুঝ আমি ভাবতাম – কতই না ভালবাসে আমাকে, আমার গলার স্বরকে। আসলে সবই ছিল প্রতারণা। এরপর যখন ও চলে গেল, আমি ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারিনি। রাসেদের কথা ভাবলে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয়। ও আমার জন্য খুব ভয়ঙ্কর একটা কিছু। এই শহরে চলে আসবার পরেও সেই ভয়টা আমার কাটেনি। এখনও যদি ঢাকার লক্ষ মানুষের ভীরে আমি রাসেদের মুখটা একটিবার দেখি, আমি নিশ্চিত অজ্ঞান হয়ে যাব।
নিলয়ের হাতের মুঠি শক্ত হয়ে ওঠে। প্রচণ্ড জোরে চেপে ধরে সেল ফোনটা। ওর নীলার সাথে কেউ এমন বাজে আচরণ করতে পারে, ও ভাবতেই পারে না। কিন্তু কি করবার আছে এত দূর থেকে। ওদের রিলেশন হবার আগেই নীলা ওকে এই কথাগুলো জানিয়ে দিয়েছিল। তারপর খুব অবাক হয়ে দেখেছিল কি করে নিলয় ওকে ওর নিজের হাতে গড়া অবিশ্বাস আর ঘৃণার সেই শুঁয়োপোকার গুটিটা থেকে বের করে আনলো। ভালবাসার উষ্ণতায় কি করে আরেকবার ওকে প্রজাপতির মত উড়তে শেখালো। নিলয় তার সমস্ত হৃদয়টা দিয়েই ভালবেসেছিল নীলাকে।
তারপর একটা সময় নীলার সাথে যোগাযোগটা কমে এলো। ওর অভিযোগ বা অভিমানী কথায় শুধু হাসতো নীলা। বলতো সে খুব ব্যস্ত, সময় পায়নি টেক্সট করার। অথবা, ফোন ব্যাগে ছিল তাই কল ধরতে পারেনি। নিলয় ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি যে নীলা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে ওর কাছ থেকে। ওর ভালবাসার আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে অন্য কারও আকাশে। একদিন ওকে অবাক করে দিয়ে নীলা টেক্সট করে জানালো, ও কোন একটা ক্যাফেতে বসে আছে আরেকজনের সাথে। সেই ছেলেটা ওকে ক্লাস করতে দেয় নি, টেনে বের করে নিয়ে এসেছে। আজ সারাদিন ওদের বৃষ্টির মধ্যে রিক্সায় ঘোরার প্ল্যান। নিলয় এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিল, যেন বিশ্বাস করতে পারেনি টেক্সটের প্রতিটা অক্ষরকে। নীলার অনেক ছেলে বন্ধু, নিলয় জানতো। কিন্তু ও কখনও এই বিষয়ে প্রশ্ন তোলেনি, ওর প্রেমিকার ছেলে বন্ধু থাকতেই পারে, এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মত এতটা ছোট মনের মানুষ বলে নিজেকে ভাবতে পারেনি নিলয়। ওদের সাথে নীলা মাঝে মাঝে ঘুরতে যেত, খেতে যেত, গল্প করতো। নিলয়ের ভাল লাগতো যে মেয়েটা আনন্দ করছে, মজা করছে, ভাল আছে। কিন্তু নীলার আজকের কথাটা একদমই অন্য রকম। সন্দেহের দোলায় দোলে নিলয়ের মন।
এর কিছুদিন পর এক রাতে নীলার সাথে কথার শুরুতেই নীলা বলে –
- জানিস, কি যে ঝামেলা হয়ে গেছে। হুট করেই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহেই বিয়ে। আমার আব্বু অবশ্য রাজি ছিল না। এদিকে ও এসে ধরেছে ভাইয়ার বন্ধু রনী ভাইয়াকে। রনী ভাইয়া তো আমাদের ফ্যামিলি মেম্বারের মতই। উনি কি করে যেন আব্বাকে রাজী করিয়ে ফেললেন। আমাকে একটিবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেন নি।
নীলার গলায় এক ফোটা কষ্ট ছিল না। বরং একটা চাপা উত্তেজনা আর আনন্দ ছিল। নিলয় যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল ওর কথা গুলো শুনে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এই সেই ছেলে, যে ওকে ক্লাস করতে না দিয়ে টেনে আনে বাইরে, বৃষ্টির মধ্যে সারা দিন রিক্সা নিয়ে ঘোরে। আর নীলার সম্মতি ছাড়া এ বিয়ে হচ্ছে না। ও শুধু বলেছিল –
- নীলা, আমার কি হবে?
- দেখ, আসলে জন্ম মৃত্যু আর বিয়ে – এই তিনটা জিনিস মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কখন কার কি হয়ে যাবে কেউ জানে না। তুই অবশ্যই একটা লক্ষ্ণী টাইপের ফুটফুটে বউ খুঁজে পাবি। অবশ্যই ভার্জিন হবে সেই মেয়েটা। আমার মত এঁটো, সাত ঘাটের জল খাওয়া, কালো, অসুন্দর মেয়ে না।
- নীলা, আমি তো ফুটফুটে সুন্দর কোন মেয়েকে চাইনি। কোন ধরনের শর্ত ছাড়াই ভালবেসেছি তোকে। আমি তোর জায়গায় অন্য কোন মেয়েকে কল্পনাও করতে পারিনা।
- আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে সব। এক সময় কষ্ট পাবি না আর। তুই তো সব সময় চাইতি যেন আমি ভাল থাকি। এটাই মনে কর আমার ভাল থাকা। আমি তোকে মুক্তি দিয়ে গেলাম, তোর স্বপ্নটাও পূরণ করে গেলাম।
- আমার স্বপ্ন তো ছিলি কেবল মাত্র তুই ... গলা ধরে আসে নিলয়ের।
- স্বপ্ন তো স্বপ্নই রে বোকা। এটা তো সত্যি নয়। আর তোর স্বপ্নেই না হয় আমি তোর হয়ে থাকলাম। ... আশ্চর্য রকম শান্ত নীলার কণ্ঠস্বর।
- নীলা ... কেঁদে ফেলে নিলয়।
- দেখ, তুই যে কাঁদছিস, তোর কান্নার শব্দ আমার ভেতর কোন অনুভূতি সৃষ্টি করছে না। আমি ফোন রাখি।
ফোনটা কেটে দিয়েছিল নীলা। নিলয় আর ফোন করেনি ওকে। জানে কোন লাভ নেই। যে সুতোটা ছিঁড়ে গেছে, তাকে আর জোড়া লাগানো যাবে না। নীলাকে আর ফেরানো যাবে না। প্রচণ্ড কষ্টে পাগল হয়ে গিয়েছিল নিলয়। সারা দিন সারা রাত মন খারাপ করে থাকতো। মাঝে মাঝে শাওয়ার ছেড়ে শিশুর মত চিৎকার করে কাঁদতো। কাজের ফাকে একলা হয়ে গেলেও ওর চোখ চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই শ্রাবণের ধারা নামতো। ভালবাসায় এত কষ্ট নিলয় জানতো না নীলা ওভাবে চলে না গেলে। অনেক ভেবেও নিলয় তার ভালবাসায় কোন খুঁত ধরতে পারেনি। কি কারণে নীলে ওকে একা রেখে, ওর স্বপ্নটা ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেল, নিলয় আজও জানে না। ওদের মাঝে কখনও তেমন কোন ঝগড়া হয়নি, কখনও নিলয় এক ফোটা অবহেলা করেনি নীলাকে। কখনও নীলার জীবনটাকে বিধি নিষেধের জালে জড়াতে চায়নি। তবে কেন এভাবে অন্যের হয়ে গেল নীলা? কি কমতি ছিল ওর ভালবাসায়?
সময়ের সাথে সাথে মানুষ শোক সামলে ওঠে, কষ্ট ভুলে যায়। অনেক সময় লেগেছে নিলয়ের সামলে উঠতে। বেশ কয়েক মাস পর এক বিকেলে নিলয় ছোট্ট একটা টেক্সট করে নীলার নাম্বারে – “কেমন আছিস?”। জবাব পায় প্রায় সাথে সাথেই – “ভাল নেই। একটা কল দিবি? কথা বলতে ইচ্ছে করছে তোর সাথে”। অনেক কথা হয় সেদিন। বিয়ের পরেই সেই ছেলেটার বদলে যাওয়া, নীলার দিকে আগের মত নজর না দেয়া, মা বোনের কথা শুনে কোন কিছু যাচাই না করে নীলার সাথে খারাপ ব্যবহার করা – এই সব কারণে নীলা আপসেট ছিল খুব। সেদিন নীলয় ছিল খুব শান্ত। বার বার নীলাকে বোঝাচ্ছিল সব ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের প্রথম কিছু দিন এমন হতে পারে। ওদের পরিবারের মাঝে নীলা এখনও একজন নতুন মানুষ। এই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে ওদের সাথে সাথে নীলারও সময় লাগবে। কিন্তু সব ঠিক হয়ে যাবে এক সময়। অনেকক্ষণ কথা বলে নীলার মন ভাল করে দিয়ে নিজেও বেশ একটা আনন্দ পেয়েছিল নিলয়। যা হবার ছিল, তা হয়েছে, এখন নীলার ভাল থাকাই ওর প্রতি মুহূর্তের কামনা। কিন্তু একটা সময় নিলয় বুঝতে পারে, ওর আর নীলার কাছাকাছি থাকবার প্রয়োজন নেই। নীলার সাথে কথা বলে ওর যেমন কষ্ট হয়, নীলারও হয়তো তেমন কষ্ট হয়। ভাল তো সেও বেসেছিল। কিছুদিন পর নিলয় তার পুরনো নম্বরটা চেঞ্জ করে ফেলে, আগের চাকরীটা ছেড়ে নতুন একটা চাকরীতে জয়েন করে অনেক দূরে অন্য একটা জায়গায় চলে আসে, যেখানে নীলার কোন স্মৃতি ওর পিছু নেবে না। কিন্তু ওর চিন্তাধারা ভুল প্রমাণ করে নীলা ওর হৃদয়ের মাঝে থেকেই যায়, কোন ভাবেই ভুলতে পারেনা ওকে নিলয়। এই পাঁচ বছরে বহুবার নিলয় নীলাকে ফোন বা টেক্সট করতে গিয়েও করেনি, সামলে নিয়েছে নিজেকে। কিন্তু আজ, এই জোছনার মায়াবী আলো ভরা রাতে নিজেকে সামলাতে পারে না নিলয়। কাঁপা হাতে কল বাটন চাপে নিলয়। কয়েকটা রিং হবার পর ওপাশ থেকে নীলার কণ্ঠ শোনা যায় –
- হ্যালো ... হ্যালো ... হ্যালো
কোন কথা বলতে পারে না নিলয়। চুপচাপ শুনে যায় নীলার কণ্ঠ। ছোট্ট একটা বাচ্চার কেঁদে ওঠার শব্দ শোনা যায়, ভারী একটা কণ্ঠস্বর দূর থেকে বলে ওঠে – “কে এত রাতে ফোন দিয়েছে? তুমি এই সময় বারান্দায় বসে কি করছো? বাচ্চাটা কাঁদছে, থামাও ওকে, আমার সকালে অফিস আছে, ঘুমাতে পারছি না”। ফোন কেটে যায় এরপর।
বুকের মাঝে ধ্বক করে ওঠে নিলয়ের। নীলা জেগে ছিল, নীলা একাকী বসে ছিল বারান্দায়। ওর কি মন ভাল নেই? ও কি নিলয়ের কথা ভাবছিল? কেমন আছে নীলা? ভাল আছে তো? ভাল থাকলে এত রাতে একা বারান্দায় বসে থাকবার কথা নয়। ওকে কি একটা টেক্সট করবে নিলয়?
কিছুই করেনা নিলয়। বরং ফোন বুক থেকে নীলার নম্বরটা ডিলিট করে দেবার বাটন চেপে জোছনা দেখায় নিমগ্ন হয়।

*******তোমাকে ভুলব না কখন********

আমি আমাকে ঘৃনা করি কারন- তোমায়
অনেক ভালবাসি তা বুঝাতে পারিনি বলে।
আমি আমাকে ঘৃনা করি কারন- তোমায়
হারিয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারিনি
বলে।
আমি আমাকে ঘৃনা করি কারন-
তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম বলে।
আমি আমাকে ঘৃনা করি কারন- তোমায়
আজ ও ভুলতে পারিনি বলে।
আমি আমাকে ঘৃনা করি কারন - আমি
জানি আমি তোমাকে কোনদিন ভুলতে
পারব না বলে।
আমি আমাকে ঘৃনা করি কারন- তোমায়
পাবনা জেনে ও তোমার জন্য অপেহ্মা
করি।
আমি আমাকে ঘৃনা করি কারন- তোমায়
হারিয়ে বেঁচে আছি বলে।
আমি আমাকে ঘৃনা করি কারন- তুমি না
থাকলে, আমি কি ভাবে থাকবো সেইটা
ভাবিনি বলে।
আমি আমাকে ঘৃনা করি কারন- প্রতিটি
সময় তোমায় ভেবে কান্না করি বলে।
হ্যাঁ আমি আমাকে ঘৃনা করি কারন-
অতীতকে ভুলে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে
চলতে পারিনি বলে।
জানি পারব না কোনদিন ভুলতে তোমায়,
কারন এত কিছুর পর ও তোমায় ভালবাসি
প্রতিদিন।

সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০১৬

সুখ এবং কষ্টের গল্

সাথীকে প্রথম দেখেছিল এক রাস্তায়, সে তখন এক পথ শিশুকে খাবার খাইয়ে দিতেছিল।তাওহীদ তাকে মুগ্ধ নয়নে দেখতেছিল, সাথীর উপর থেকে কোনো ভাবেই তার চোখটা সরাতেই পারছিল না।
সাথী যে কখন তার সামনে এসেছে, সে বুঝতেই পারেনি।যখন সে বলল

- এই যে মিঃ চার চোখ ওয়ালা কানা (চার চোখ বলার কারণ সে চশমা ব্যবহার করে যে তাই) আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না! আমি যে কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।
তাওহীদ আবার অনেক রাগী ও অভিমানী ছেলে, কেউ তাকে একটু উল্টা-পাল্টা বললেই সাথে সাথেই তার সাথে রাগ বা অভিমান করে।কিন্তু সাথীর কথাতে সে রাগ বা অভিমান কোনো টাই করতে পারেনি।কেন পারেনি বুঝতে পারেনি।সাথীর কথাটা যেন তার আরও ভালই লেগেছে।
- এই যে মিঃ আবার কোথায় হারিয়ে গেলেন?
দেখে যে রাগে তার মুখটা লাল হয়ে আছে।
- কি বললেন হারিয়ে গেছি? যদি হারিয়েই যেতাম তাহলে আপনার সামনে কি করে থাকতাম!
- উফফ বেসতি কথা বলেন কেন?
- বেসতি কথা কই বললাম আমি তো কথার উত্তর দিলাম।
- আবার (রাগে)
- আচ্ছা (ভয় ভয় ভাব নিয়ে)
- ঠিক আছে, আচ্ছা আমার দিকে ঐ ভাবে তাকিয়ে ছিলেন কেন?
- ঐ ভাবে কিভাবে তাকিয়ে ছিলাম?
- বুঝেন না! (ভ্যাংচি মেরে) এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন কেন?
- কেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম বলতে পারব না, তবে মেয়েটাকে ভালো লেগেছিল তাই তাকিয়ে ছিলাম।
- কেন ঐ মেয়েটাকে ভালো লাগতে হবে! দুনিয়াতে কি আর মেয়ে নাই?
- আছে কিন্তু তার মত এত ঝগড়াটে মেয়ে নাই।
- কিহ! আমি ঝগড়াটে?
- হুম ঝগড়াটে।
- আপনি ঝগড়াটে
- আচ্ছা যান আমিই ঝগড়াটে।
- এই তো ভাল ছেলের মত কথা।
- ধন্যবাদ।
- আচ্ছা এতক্ষণ তো ঝগড়াই করলেন(দুষ্টু হাসি দিয়ে) নাম তো বললেন না।
- ঝগড়াটে ছেলেদের কোনো নাম হয় না(অভিমানী সুরে)
- ওলে বাবালে ঝগড়াটে ছেলেটা তো অভিমান ও করতে জানে। আচ্ছা যান আর ঝগড়াটে বলব না।এবার তো বলবেন
- আমি তাওহীদ, আপনি?
- আমি সাথী। আজ তাহলে চলি, আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখে তাহলে আবার দেখা হবে।
- আচ্ছা।

এই হল তাওহীদ আর সাথী। তাওহীদ পড়াশুনা শেষ করে এখন চাকুরি করে।আর সাথী অনার্সে পড়ে।তাওহীদের আপন বলতে এখন একমাত্র তার দাদী। তার বাবা-মা, বোন এক রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। আর সাথীর বাবা-মা ও এক ভাই আছে।সে অনেক ভালো মেয়ে, ভালো মেয়ের যত গুলো গুণ থাকার দরকার তার মাঝেও আছে।সে পর্দা মেনে চলে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, সকালে কুরআন তিলাওয়াত করে ও আরও অনেক কাজ করে।তাওহীদ হাসি-খুশিতে থাকত, সবাইকে হাসি-খুশির মাঝে রাখত। কিন্তু ঐ ঘটনার পর থেকে একদম চুপ হয়ে যায়।

তারপর আরও কয়েকটা দিন চলে যায়,তাদের আর দেখা হয়নি। একদিন তাওহীদ পার্কে বসে কাপলদের প্রেম খেলা দেখতে থাকে, আর বাদাম খেতে থাকে। এমন সময়
- এই যে মিষ্টার চার চোখ ওয়ালা(শুনে তাওহীদের মেজাজটা গরম হয়ে যায়)
পাশে ফিরতেই দেখে সাথী। সাথীকে দেখে তার রাগটা সাথে সাথেই মাটি হয়ে যায়।
- কি! কাপলদের প্রেম দেখে কি আপনার ও ইচ্ছা জাগে প্রেম করতে?
সে কি বলবে সে তো তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
- ও হ্যালো
- আমার মত ছেলেকে কি কেউ পছন্দ করবে বলেন!
- তাই না?
- হুম।
- আপনি জানেন আপনি কতটা কিউট?
- তাই না? আমি কি করে বলব বলেন? নিজেরটা কি কেউ বলতে পারে বলেন!
- হুম। তা অবশ্য ঠিক বলছেন। আমাকে এখন পাঁচশ টাকা দেন! পরে দিয়ে দিব।
- টাকা দিয়ে কি করবেন?
- হাওয়া খাব সাথে আপনাকে ও খাওয়াব(রাগে বলে)
- আচ্ছা নেন।
- এখন আমার সাথে আসেন।
- কোথায়?
- আকাশে
তাওহীদ আর কথা বাড়ায় নি। তারপর সাথী বইয়ের দোকানে যায়, বই কিনে তাওহীদের হাতে দেয়, সেই বই গুলো পরে পথ শিশুদেরকে দেয়। তাওহীদ নীরব দর্শকের মত সব দেখে যায়।

সাথী এরকম আরও অনেক ধরনের কাজ করত, যে গুলো তাওহীদের খুব ভাল লাগত।তার সাথে অনেক ঝাড়ি ও খেত, কিন্তু এই ঝাড়ি তার অনেক ভাল লাগত।
তারপর তারা ধীরে ধীরে আরও কাছে আসতে থাকে, সেই কাছে আসা থেকে ভাল লাগা, সেই ভাল লাগা থেকে ভালবাসা।

তারপর শুরু হয় তাদের এক নতুন পথ চলা, যে পথের শেষ নেই। ঝগড়া-ঝাটি, রাগ-অভিমান এসবের মধ্য দিয়ে তাদের দিন গুলি ভালই যাচ্ছিল। আবার তাদের দুই পরিবারকেও তাদের এই সম্পর্কের কথা বলেছিল। তারাও মেনে নেই, কারণ না করার তো কোনো কারণ নেই।
কিন্তু কথায় আছে না! সুখের দিন বেশিদিন যায় না, তাদের ও একই অবস্থা হয়।

একদিন তারা পার্ক থেকে আসতেছে, এমন সময় দেখে; এক শিশু রাস্তায় পরে আছে এবং তার দিকে দ্রুত গতিতে একটা গাড়ি ও আসতেছে। এটা আবার তাওহীদ লক্ষ করেনি।সাথী শিশুটাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনটা দেয়।
এ দৃশ্য দেখে তাওহীদ স্তব্ধ হয়ে যায়।পা ফেলে মাটিতে পরে যায়। সে কাঁদতে পারছে না, কিছু বলতেও পারছে না।শুধু চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে।
সাথীর কাছে গিয়ে সাথীকে ডাকে, কিন্তু সাথী মায়াভরা মুখটা নিয়ে ঘুমাতে থাকে, তার কথার উত্তর দেয়না।
তাওহীদ বলতে থাকে, এই সাথী কথা বল কথা বলবে না! আমার সাথে ঝগড়া করবে না! চার চোখ ওয়ালা বলবে না! এই সাথী কথা বল! কিন্তু সাথী আর কথা বলে না, কি করে কথা বলবে! সে যে সারা জীবনের মত ঘুমিয়ে পরেছে।

বি দ্রঃ আমাদের অনেকের জীবনে ভালবাসার মানুষ আসে, কারও থাকে আবার কারও চলে যায়।যাদের থাকে না যাওয়ার সময় তাদের কে কাঁদিয়ে যায়।

ভূতকন্যা

যে বাড়িতে এখন থাকছি, তার গেটের সাথেই পাশের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান। সন্ধ্যা থেকে রাতের মধ্যে যদি কখনও বিদ্যুৎ চলে যায় তাহলে প্রায়ই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেটের সিঁড়িতে বসি। গেইট থেকে পনেরো ফিট দূরেই পিচঢালা লকাল রাস্তা। নানান ধরনের মানুষ আর গাড়ি ঘোড়ার যাতায়াত দেখতে দেখতে বাতাস খেতে ভালই লাগে।
.
প্রায় দিনের মত আজকেও রাতে বিদ্যুৎ চলে যাওয়াতে গেটের বাইরে গিয়ে এক মনে ফোন চালাতে লাগলাম। বাতাস থম থমে, গরমও পড়েছে অনেক। হাতের ডানপাশে কবরস্থান।
.
হটাৎ করে মনে হলো রাস্তা দিয়ে খুব দ্রুত সাঁ করে কিছু একটা চলে গেলো। এ রাস্তায় অনেক দ্রুত মোটরসাইকেল ছাড়া অন্য কিছু চলার কথা নয়। কিন্তু....
কিন্তু মোটরসাইকেল এর ইঞ্জিনের কোনো শব্দ পেলাম না কেনো!
চোখের ভুল ভেবে আমার ফোনের দিকে মনোনিবেশ করলাম।
.
আসলে ফোনে বন্ধুদের সাথে চ্যাটিং করছিলাম ফেসবুকের মেসেঞ্জারে। এক বন্ধু বললো "আমু তোর জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করছি, দেখবি?"
.
আমি বললাম "দেরী না করে তাড়াতাড়ি দে.."
.
তাড়াতাড়িই দিলো ছবি, ওপেন করার সাথে সাথে দেখি....
.
এমন সময় ছোট্ট একটা অন্যরকম গলা খাঁকারির শব্দ আমার সামনে থেকে আসলো বলে মনে হলো। সামনে তাকালাম। হাত পা কাঁপতে লাগলো।
.
ফোনের ছবিটার সাথে আমার সামনে দাঁড়ানো জিনিসটা একদম কপি পেস্ট। একটা মেয়ে......
যার একটা চোখ তুলে নেওয়া যেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। আর পাশের চোখটা পুরোটাই সাদা যেখানে কালো অক্ষিগোলক বলতে কিছুই নেই। সাদা চোখের পাশের গালটা রক্ত মাখা হাতে ধরে আছে মেয়েটা।
.
নিজের হার্টবিট নিজেই শুনতে পাচ্ছিলাম। এমন সময় ফোনটা টুং করে উঠলো, বন্ধুর মেসেজ এসেছে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেসেজ দেখলাম, ওই একি ছবি সে আবার পাঠিয়েছে। ছবির দিক থেকে সামনের দিকে দেখতেই দেখি ভূত মেয়েটা নেই।
বন্ধুর দেওয়া ছবি দেখে রাতের অন্ধকারে হিপনোটাইস হয়ে গেছি এই ভেবে সিঁড়িতে বসলাম। বসার সাথে সাথেই বাম পাশ থেকে সেই একি গলা খাঁকারি। মুখ তুলে দেখতে গিয়ে তো আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। এমনটা কি বাস্তবে আসলেই সম্ভব! আমি কোনো ঘোরের মধ্যে আছিনাতো!
.
নিজেকে আগে অনেক সাহসী মনে করতাম, কিন্তু এই ভূতকন্যাকে দেখে তো আমার সাহস হুস হুস করে কমে যাচ্ছে। সবই বুঝি আমার দেখার ভুল মনের ভুল এই মনে করে শরীর টা একটু ঝাড়া দিলাম সাথে সাথেই আমার বাম কাঁধে কিসের যেনো ছোঁয়া পেলাম। ধীরে ধীরে চোখে বাঁকিয়ে দেখি ওই ডাইনীর রক্ত মাখা হাত।
.
আমার ঘেমে যাওয়া উষ্ণ শরীরে বুঝতে পারলাম তার শীতল হাতের ছোঁয়া। আমার মাথা ঘুরছে, যেকোনো সময় জ্ঞান হারাতে পারি। ভয়ের চোটে আপুকে ডাকতে চাইলাম কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলোনা, কেমন যেনো একটা ফ্যাস ফ্যাস শব্দ করে বসলাম।
.
ছোট আপুর আওয়াজ শুনতে পারলাম "আমু তুই কার সাথে বসে ছিলি? তোর পাশে বুঝি কাউকে দেখলাম।"
আপু কাছাকাছি আসতেই দেখি আমার পাশে আর ভয়ানক চেহেরার ডাইনীটা আর নেই।
.
আপুকে কিছু বলতে যাবো, যে, "আপু আমি খুব ভয় পেয়েছি এই এই এই এই কাহিনী।"
কিন্তু একি! ভূতকন্যা দেখি আপুর পিছনে দাঁড়িয়ে আমাকে ইশারা করছে, হাতজোর করছে, আমি যাতে আপুকে কিছু না বলি।
.
আমি কি করবো কি না করবো কিছুই বুঝতে পারলাম না। শুধু আঙুল দিয়ে আপুর পিছনে ইশারা করলাম। ব্যস এতটুকুই হাটু ভাজ হয়ে দড়াম করে মাটিতে পড়ে গেলাম।
.
.
.
বিদ্যুৎ আসলো। শরীরটা প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। খিদেও লেগেছে প্রচুর, কিন্তু কিছুই খেতে পারলাম না। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।
.
মাঝরাতে ঘুম ভাঙলো, দেখি বিদ্যুৎ নেই। বিছানায় ফোন হাতড়াতে লাগলাম, কিন্তু পাচ্ছিনা। এমন সময় আমার হাতটা খুব ঠান্ডা একটা জিনিস এ স্পর্শ করলো বুঝতে পারলাম।
.
সব কিছু বুঝতে আমার কিছুক্ষণ সময় লাগলো। বুকের উপর কেউ বুঝি উঠলো, নরম আর ঠান্ডা শরীর। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে... আ আ আ আপু আপু.... ডাকছি কিন্তু আওয়াজ হচ্ছেনা।
.
.
"আমু, এই আমু, আমু... কথা বল...।"
আপু আর দুলাভাই ডাকছে। চোখ মেলতে আর শরীরটা একটু আলগা করতেই বুঝতে পারলাম আমার শরীরের অবস্থা খুবই কাহিল। বেশ কয়েক জায়গায় খুব ব্যথা করছে। সবচেয়ে বেশি বুকে।
.
আপু আর দুলাভাইকে কিছু বলতে যাবো, তাতেই বিদ্যুৎ চলে গেলো। আমি চিৎকার করে বলতে লাগলাম "লাইট জ্বালাও লাইট জ্বালাও।"
.
.
মোমবাতি জ্বালালো আপু, দুলাভাই ফোনের লাইট অন করে টেবিলে রাখলো। এবং দুজনে বলতে লাগলো - "এভাবে চেঁচাচ্ছিলি ক্যান? কি হয়েছে?"
.
আমি চুপই রয়ে গেলাম, কেননা আপু আর দুলাভাই এর পিছনে ওই বিদঘুটে ভূতকন্যাটা আবারো ইশারা করছে কিছু না বলতে...।
কিন্তু আপনা আপনি আমার আঙুল তার দিকে ইশারা করলো...।
আর আমার পুরো শরীর ধীরে অবশ হয়ে যেতে লাগলো, চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসলো,ঝাপসা দেখতে লাগলাম সবকিছু...।
ভূতকন্যাকে দেখতে দেখতে চোখ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে এলো।
.
.

অদ্ভুত জীবন

বেশ ভালোই আছে এখন আবির। দেখে মনেই হয় না সেই কিছু দিন আগে হারিয়েছে তার জিবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুকে বুকে জড়িয়ে নিতে বাধ্য হতে হয়েছিল তার প্রাণপ্রিয় জননী মাকে।
অথচ আজ বেশ ফুরফুরে ভাবেই ঘুরতে দেখা যায় তাকে। লোকে বলে, অল্প শোকে কাতর, আর অধিক শোকে পাথর, ঠিক একই অবস্থা হয়েছে আবিরের।সেই দিন ছিল আবিরের এসএসসি রসায়ন পরিক্ষা।
রাত থেকে কেন যেন তার মায়ের শরীরটা বেশি খারাপ হয়ে পড়ে, চার ভাই বোন এর মধ্যে আবির ২ নম্বর। তার বড় একটা বোন আছে।পরিবারের উপাজনকরী শুধু তার বাবা, গ্রামের ছোট একটা চায়ের দোকান আছে তাদের। আবির পড়ালেখার সাথে সাথে তার বাবাকে সাহায্য করে মাঝেমধ্যে । আবিরের বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল।তার স্বামি ঢাকার কোন এক গামেন্টসে কাজ করতেন। সেই বার ওনাদের কর্ম স্থানে অপ্রত্যাসিত ভাবে আগ্নিকান্ডে দগ্ধ হতে হয় তাকে। পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল।কেউ তাকে চিনতে না পরলেও তার মা ঠিক চিনেছিল। আবিরের বোনের শাশুড়ি পাগল হয়ে গেছে কান্না করতে করতে। কারন তিন কন্যা পর পাওয়া একটা ছেলে, সেইও তাকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে।তারপর আবিরের বোনকে রেখে যায় তাদের বাড়িতে,যেহেতু এখনো তার কোন সন্তান হয় নি।তখন থেকে সেই আবিরদের বাড়িতে থাকে। যদিও তার বাবা তাকে দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চেষ্টা করছে।
এমনিতে টানপোড়া সংসার তাদের,।"ঠিক মতো খেতে পারাটাই যাদের জন্য দুষ্কর,দুরারোগ্য রোগে চিকিৎসা করাটা তাদের জন্য দুঃস্বপ্নই"। আর তাই একটু একটু করে ধুকে ধুকে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই সকালের দিকে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিল তার মা।আবির তখন তার মায়ের সামনেই,কিন্তু করতে পারেনি কিছুই।শুধু তাকিয়ে দেখেছে তার মায়ের শুকনো মুখটার দিকে।মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবাও যেন একটু বেশি ভেঙ্গে পড়েছে। তাই আবিরের আর এসএসসি পরিক্ষা দেওয়া হলো না। বাবার যা অবস্থা,আবিরকে ধরতে হয়েছিল সংসারের হাল। যখন তার খেলার বয়স তখন তাকে ব্যস্ত হতে হয়েছিল বাস্তব জীবনকে নিয়ে।মা হারানো কষ্ট টা বুকের এক পাশে রেখে প্রতিদিন তাকে করতে হয় ভালো থাকার অভিনয়। আর গভীর রাতে মায়ের কথা ভেবে ভেবে মুছতে হয় চোখের পানি।আর বুকের পাশদিয়ে এক পসলা দীর্ঘশ্বাস। দিনের আলোয় এই আবিরদের দেখলে, তাদের রাতের ঐ। চেহারা কল্পনা ও করা যায় না। কারন এরাই বাস্তবিক জীবন যুদ্ধের নিয়মিত যুদ্ধা। আবিরদের ভেতরের হাহাকার শব্দ টা তারা ছাড়া অন্য কেউ কে শুনতে দেয় না।