আজকে সক্কাল সক্কাল বাসায় কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিলাম আমি।।
কত দিন হয়ে গেল আব্বু তুমি তো আমায় এখনও ফোন কিনে দিলা না।।আমার ফোন চায়।।
-এই মাসে ফোন কিনে দিতে পারবো না বাড়ির কাজ শেষ হলে দেখা যাবে।।(আব্বু)
-প্রতি মাসে তো একই কথা বলো।।(আমি)
-টাকা না থাকলে আমি কি করবো টাকা হলে দেখবো।।
-আমি জানি এই টাকা তোমার কখনই হবে না।।
-জানিস তো চিল্লাচ্ছিস কেনো??সর এখান থেকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে শুধু ফোন ফোন।।
এই কথা শোনার পর হুট করে বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম।।আসার পথে আম্মু পিছু
ডেকে নাস্তা করার কথা বলেছিলো কিন্তু আমি রেগে থাকায় কর্ণপাত করি নাই।।এমন
বাবা-মায়ের কথা শুনে কি হবে,যারা আমার কোন ইচ্ছা পুরন করে নাহ।।
মনে
মনে কি যেন ভাবছিলাম আর রাস্তা দিয়ে হাটছিলাম।।হটাত দেখি একজন বৃদ্ধ
রাস্তার এক কোনে দাঁড়িয়ে আছেন।।চোখে কালো ফ্রেমের মোটা চশমা,হাতে
লাঠি,কাঁধে ব্যাগ নিয়ে শীতের কন কনে ঠান্ডায় কাপছে আর কাশির শব্দ শোনা
যাচ্ছে।।মনে হয় অসুস্থ।।ভাবলাম এখানে হয়তো কারোর বাসায় বেরাতে এসে পথ ভুলে
গেছে।।আমি তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলাম।।বললাম_
আমিঃদাদু এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো,কোথাও যাবেন নাকি??
দাদুঃএই বয়সে মগো ঠিকানা একটাই দাদু ভাই।।(কাপুনি কন্ঠে)
আমি-দাদুর উত্তরে একটু অবাক হয়ে বললাম-বুঝতে পারলাম না দাদু।।
দাদুঃমুই যেইহানে যামু ওইহানে মোর মত তোমার আরও মেলা দাদুরা থাহে।।
আমিঃদাদু আপনি কি বৃদ্ধাশ্রমের কথা বলছেন??
দাদুঃহিম্ম এইতো বুইঝা ফেলাইছো।।লইয়া যাবা মোরে??মুই তো নেয়া আইছি এই শহর চিনি না।।
আমিঃকিন্তু কেনো??আপনার বাড়ি নাই দাদু,চলেন বাড়ি নিয়ে যায় আপনাকে।।
দাদুঃবাড়ি তো ছিলো,কিন্তু কুড়েঘর ছাইড়া বড় ঘরে আইসা ভুল কইরা ফেলাইছি।।এখন মোর কিছুই নাই।।তাই বৃদ্ধাশ্রম ঈ মোর বাড়ি হইবে অহন।।
আমিঃকেন বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন কেনো?এইখানে আপনার কেউ থাকে না দাদু?
দাদুঃসে মেলা কথা এহন কইতে পারুম না।।
আমিঃবলো না দাদু আমার গল্প শুনতে খুব ভালো লাগে ।।প্লিজ বলো না।।
আমার অনেক রিকুয়েস্ট এর পর দাদু রাজি হলো।।দুই জনেরই অনেক ক্ষুধা লেগেছিলো
তাই পাশের একটা হটেলে খেতে বসলাম।।খেতে খেতে দাদু শুরু করলেন তার পিছনে
ফিরে আসা অতীতের কাহিনী।।
মোরা ছোট্ট একটা গ্রামে থাকতাম।।লেহাপড়া
শিহি নাই।। চাষা মানুষ।। আমার পোলা আবির গ্রামের ইস্কুলের সবচেয়ে ভালা
ছাত্র ছিলো।।স্কুল থেইকা পাশ করার পড় ভালা কলেজে পড়ালেহা করার জন্য আবির
বাইনা ধরলে মুই ওরে শহরে পাঠায়।।খরচা বাড়তে থাকে।।তারপর কলেজের পরিক্কার
সময় টেহার লাইগা আবিরের মাইয়ের কথাই তার হাতের বালা দুইডা বেইচা পোলারে
টেহা পাঠাইলাম।।সেই সময় আবিরের মা কইছিলো পোলা আমার বড় হইলে খাটি সোনা দিয়া
দুইহান চকচকে বালা বানাইয়া নিমুনে।।এরপর কলেজ পাশ কইরা বেটা আমার গ্রামে
চইলা আহে।।আইসা কই বাবা আমি আবারও গোল্ডেন এ+ পাইছি।।এই লও মিষ্টি।।সেদিন
মোরা মেলা খুশি হইছিলাম।।তারপর সেই দিন রাইতের বেলা আবির আইসা কইলো_
আবিরঃআব্বাজান আমি ঢাকা যাইতে চাই।।ওখানে গিয়ে আমি ভারসিটিতে
পড়বো।।
আমিঃকিন্তু বাপজান এত মেলা টেহার বেপার কই পামু এত টেহা।।জমি জাইগা তো সব বন্ধক থুইয়া তরে এতদুর পড়ালাম, আর টেহা কই পামু!!
আবিরঃবাপজান এই বাড়ি ডা বন্ধক রাখো।।আমি বড় চাকরি পেলে তোমাগো ঢাকায় নিয়ে যাবো।।
এরপর আবিরের মার কথাই রাজি হইয়া শেষ সম্বল ভিটা বাড়িডারে বন্ধক থুইয়া
পোলারে টেহা পাঠায়লাম।।ঈদে মুই ছেড়া পাঞ্জাবি পড়লেও পোলারে আমি নতুন লাল
পাঞ্জাবি কেইনা দিছিলাম।।দুই তরকারি দিয়া মোরা কোনদিন ভাত খাই নাই।।মাঝে
মাঝে কয়েক বেলা উপস থাকতেও হতো।।এরপর আস্তে আস্তে পোলার পড়ালিকা শেষ হয়।।বড়
চাকরিও পাই।।এরপর হটাত কইরা আবিরের মার বড় অসুখ হয়।।পোলার কাছে টেহা
চাইলে, হ্যা কই নতুন চাকরি, টাকা পামু কই।।কই দিন যাক আমি টেহা
দিমুনে।।কিন্তু টেহা ছিলো না বলে বিনা চিকিৎসায় বউডা আমার মইরা গেলো।।পরে
জানতে পারলুম ঐ টাকা দিয়া মোর বেটা নাকি বড় বাড়ি লইয়াছে থাহার
জন্যি।।আবিরের মা মইরা যাওয়াই মুই গ্রামে একলা হইয়া যাওয়াতে পোলা মোরে তার
নতুন বাড়িতে লইয়া আনে।।যায়ে দেখলুম পোলার ভালো বাড়ি,দামি একখান গাড়ি
আছে।।আর যেইডা দেহে মোর চক্ষু দারা গেলো সিডা হলো পোলা দেহি বিয়াও কইরা
ফেলছে, ছোট্ট দাদু ভাই ও আছে।।কিছু মনে করলুম না।।আজাকাল কার পোলাপান তো
একাই বিয়া করে।।
আবির রে রাতে ঘরে ডাকলুম বাপজান তোর এত বাড়ি-গাড়ি তাইলে তোর মায়ের লাইগা টেহা পাঠাইছিলি না ক্যা?
আবির চুপ করে থেকে কইলো বাপজান তহন এইসব ছিলো না।।কিন্তু পরে জানতে
পারলুম বউ মার জেদাজেদিতে ঐ টেহা দিয়া নাকি এই বাড়ি লইয়াছে।।মুই রাগ করলুম
না, ভাবলুম পোলাপান তো ভুল করতেই পারে।।ওহন আর রাগ কইরা কি হবে।।
সবাই একলগে খাইলেও মোর খাওন ওরা আলাদা করে দিত।।
মুই একদিন কাজের পিচ্চি রে কইলাম।।
-মোর খাবার এইহানে লইয়াছো কেন?
পিচ্চিঃমেডামের বাবার বাড়ির মেহমান আইছে তো তাই মেডাম আপনারে এইখানে খাবার দিতে কইছে।।
মোর আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না।মুই অশিক্ষিত,ওদের মত ভালা কইরা কতা কইতে
পারি না।। তাই মোর বেটার বউ তার শশুর বাড়ির লোকজনের সাথে মোর পরিচয় কইরা
দিতে সরম পাই।।দাদু ভাইটা মোর কাছে আসতে চাইলে বউ মা লইয়া যাইতো।।তারপরও
জুজু বুরির গল্প শুনতে সে বারবার আসতো।।
তারপর একদিন শুনতে পায় বউমা কেন যেন আবিরের সাথে ঝগড়া করছে।।আমি কান পেতে শুনলাম।।
বউ মা-তোমার বাবার খক খক কাশিতে আমার ঘুম আসে না।।মেহমানের সামনে তোমার
মূর্খ বাবারে আমি আনতে পারি না।।তাছাড়া তোমার বাবার জন্য যে আলাদা ঘর লাগে
তার জন্যও তো অনেক টাকা লাগছে।।এত খরচ করলে আমাদের ভবিষ্যতের কি হবে বলো।।
আবিরঃতাহলে কি করবো আমি!!বাবাকে তো আর আমি ফেলে দিতে পারি না।।একবার তোমার কথায় মায়ের জন্য আমি টাকা পাঠাতে পারি নাই।।
বউ মাঃআরে আমি কি তোমার বাবারে ফেলে দিতে বলছি।ঐ বুড়োটাকে রেখে লাভ কি
শুধু খরচ।।বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দাও।।নইলে কিন্তু আমি বাবার বাসায় চলে যাবো।।
বউমার ওমন কতা শুনার পর মুই রুমে এসে কাপড় আর বাকি সবতা গুছিয়ে ব্যাগ ভরলুম।।ঐ সময় আবির আইসা কইলো_
-বাবা সব গুছিয়ে কোথাই যাচ্ছো??
আমিঃকোথাও না তর এই বড় বাড়িতে মোর ভালা লাগে নারে,পুকুর নাই,খোলা মাঠের
বাতাস নাই,গল্প করার লাইগা কেউ আহে না,দামি খাবার এসব ভালা লাগে না রে
বাপ।।
আবিরঃতাইলে তুমি কই যাবা এখন বাপজান??
আমিঃকোথাও না,এই
শহরে নাকি এক জায়গা আছে।।অইহানে নাকি মেলা বুড়োরা থাহে।।মুই অইহানে
যামু।।গপ্ল করার মত অনেকে আছে অইহানে।।মুই যাই, ভালো থাকিস।।মরে গেলে এক
মুঠো মাটি দিতে আছিস বাপ।।আসার পথে পিছু ফিরে দেখি জামা ধইরা দাদু ভাই
ডাকছে-
দাদু তুমি কোথাই যাচ্ছো,আমায় জুজু বুড়ির গল্প শোনাবে কে,
প্লিজ দাদু যেও না।। এই বলে মোরে জরা ধরে কাঁদতে লাগলো।।আমি কিছু না বলে
চলে আসলাম।।
গল্প শেষে আমি বললাম_ দাদু তুমি আল্লহর কাছে দোয়া কইরো
যেন তোমার ছেলে আর বউমা যেন কখনই সুখি না হতে পারে।। দাদু বললো না দাদু ভাই
ওরা তো ছোট ভুল করছে।।এইডা মোর কোপাল।।মুই ওদের কখনও অভিশাপ দিতে পারুম
না।।বরং দোয়া করবো মোর মত আবিরের জায়গায়ও যেন এমন না হয়।।
দাদুর কথা
শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।।চোখে পানি টলমল করতে লাগলো।।এমন সময় দাদু
বললো_দাদু ভাই কখনও বাবা-মা কে কষ্ট দিয়ো না।।দাদুকে গাড়িতে তুলে ভাড়া দিয়ে
দিলাম।।আসি ভালো থেকো।।এই বলে দাদু চলে গেলো।।
দাদুর পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।।সেলুট দাদু।।তুমি শ্রেষ্ঠ বাবা ।।তুমি সকল বাবাদের আদর্শ।।দোয়া করি আল্লাহ যেন তোমায় বেহেশত নসিব করে।।
দাদুর পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।।সেলুট দাদু।।তুমি শ্রেষ্ঠ বাবা ।।তুমি সকল বাবাদের আদর্শ।।দোয়া করি আল্লাহ যেন তোমায় বেহেশত নসিব করে।।
তারপর ভাবলাম আমিও আবিরের মত
হয়ে যাচ্ছি না তো।।আমি কাঁদতে কাঁদতে রাস্তার উপর হাটু গেরে বসে
পরলাম।।এরপর এক ঝলক আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে দিলাম দোড়।।দোড় দিয়ে বাসায়
এসে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।।ছড়ি আব্বু।।আমি আর কখনও তোমার সাথে
উচ্চস্বরে কথা বলবো না।।আমার ফোন লাগবে না,তুমি থাকলেই হবে।।আম্মু আমাদের
দেখে হেঁসে বললো পাগল ছেলে, খেতে আয় খাবার বেরেছি।।আব্বু আমার কপালে একটা
উষ্ণ ছোয়া দিয়ে বললো আম্মু ডাকছে খেতে যা।।
কোন মায়ের সন্তান যেন আবিরের মত না হয়।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন